#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:৪
.
.
.
কঙ্কা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়েশা বেগম কপাল কুঁচকে ফেলেছেন। উনার মেয়ের কর্মকান্ড উনি কিছুই বুঝতে পারেন না। মেয়েটাও উনাকে নিজের কোনো কথাই বলে না। অজান্তেই মেয়েটার সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে উনার। কথাগুলো ভেবে উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সুরমা কঙ্কার দিকে এগিয়ে গেল। দু’হাতে কঙ্কাকে ধরে বলল,
–তুই তো দেখছি বউ সেজেছিস, কঙ্কা!
কঙ্কা হাসলো। শাড়ির আঁচলটা অভিনব উপায়ে ঘুরিয়ে বলল,
–আমাকে কেমন লাগছে, আপা?
সুরমা হাসিমুখে উত্তর দিলো,
–খুব সুন্দর লাগছে, কঙ্কা। খুব সুন্দর লাগছে তোকে।
আয়েশা বেগম মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন,
–আমার শাড়ি গয়নাগুলো কখন সরালি আলমারি থেকে?
কঙ্কা হেসে ফেলে বলল,
–চোর কি কখনো বলে সে কখন চুরি করেছে?
আয়েশা মৃদু হেসে বললেন,
–তোর শুধু মাথাভর্তি কথা! যাই প্রশ্ন করি না কেন, একটা বাঁকা উত্তর তৈরিই থাকে। তা কি মনে করে সেজেছিস এভাবে?
–এমনি সেজেছি, মা। আমাকে সুন্দর লাগছে না?
আয়েশা মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,
–হ্যাঁ, খুব সুন্দর লাগছে।
কঙ্কার চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল। সে তার মায়ের হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। মৃদু গলায় বলল,
–মা, তুমি আমার জন্য দোয়া করো।
কঙ্কার এমন কন্ঠস্বরে আয়েশা বেগম চমকে উঠলেন। একপলক তাকিয়ে থেকেই মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
–এভাবে কেন কথা বলছিস? আমি তো তোর জন্য সবসময় দোয়া করি, মা।
কঙ্কার কেন হঠাৎ এত কান্না পাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। কতদিন পর মা তাকে জড়িয়ে ধরলো! এর আগে শেষবার কবে সে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তার মনে পড়লো না। বেশ কিছুক্ষণ পর সে মাকে ছেড়ে দিলো। মুখে হাসি টেনে বলল,
–মা, যাও খাবার নিয়ে এসো। আমাকে আর আপাকে একসাথে খাইয়ে দাও। সেই ছোটবেলার মতো।
আয়েশা হাসলেন। চোখের কোণের পানিটুকু মুছে ফেলে বললেন,
–তোরা দুজনে বস। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
উনি চলে গেলেন। সুরমা এতক্ষণ মা মেয়েকে দেখছিল। এবার প্রশ্ন করলো,
–কি হয়েছে রে তোর?
কঙ্কা হাসলো। সুরমার হাত ধরে বিছানায় গিয়ে বসলো। বেশ কৌশলে কথা ঘুরিয়ে বলল,
–আমার কিছু হয় নি। তোর বরের কি হয়েছে বল তো? এত করে বললাম থাকতে। তবুও চলে গেল!
সুরমা ইতস্তত করে বলল,
–খুব জরুরি কাজ আছে তো। সেজন্য চলে গেল। নইলে থেকে যেতো।
কঙ্কা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
–দুলাভাই কেমন রে? তোকে খুব ভালোবাসে। তাই না, আপা?
সুরমা লাজুক হেসে উত্তর দিলো,
–তা তো বাসেই।
–আর তুই?
সুরমা মলিন হেসে বলল,
–আমিও ভালোবাসি। শুধু বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছি।
কঙ্কা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–এখন তো বুঝেছিস? নাকি এখনো তোর ওই অপদার্থ প্রেমিকের ভূত নামে নি ঘাড় থেকে?
সুরমা হেসে ফেলে বলল,
–নেমেছে।
কঙ্কা সুরমার হাত ধরলো। কোমল গলায় বলল,
–শোন আপা, দুলাভাই খুব ভালো মানুষ। তোকে ভালোবাসেন। স্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট সমাদর করেন। আর তোকে কিন্তু উনি জোর করে বিয়ে করেন নি। তুইও কিন্তু মত দিয়েছিলি। আর তোর ওই প্রেমিকের কথা ভাববি না। জানিস? ওর একটা নতুন প্রেমিকাও জুটে গেছে।
সুরমা ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কঙ্কা বলল,
–হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। আমি সেদিন দেখেছি ওদের। কথাও বলেছি।
সুরমা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
–কি কথা বলেছিস?
–জানতে চাইলাম, কতদিনের সম্পর্ক? বলল ছয় মাস। তোর সাথে ব্রেকআপ হওয়ার পর নাকি খুব ভেঙে পরেছিল ও। তখন নাকি মেয়েটা ওকে মনের জোর দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, কেয়ার করেছে। এত বেশি ভালোবাসা দিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত সে আর মেয়েটাকে ভালো না বেসে পারে নি। অথচ তুই বোকার মতো বলতি যে আর কাউকে নাকি কখনো ভালোবাসবি না তুই। কি অদ্ভুত যে তোর কথা! বিয়ের আগে তিন চারটা প্রেম হলে সেই তিন চারজন প্রেমিক প্রেমিকাকেই ভালোবাসা যায়। অথচ বিয়ে হয়ে গেলেই নাকি সব ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়! যতসব শয়তানি কথাবার্তা!
সুরমা হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বলল,
–শয়তানকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। আর ওই শয়তান ব্যাটাকে কোনো চান্সই দেবো না।
কঙ্কা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–তোর ফেলে দেওয়া শয়তান এখন আমার ঘাড়ে চেপেছে, আপা।
সুরমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
–মানে?
–কিছু না। আচ্ছা আপা, তোদের সংসার কেমন রে? একেবারে স্বপ্নের মতো লাল নীল সংসার?
সুরমার মন খারাপ হয়ে গেল। তার সংসারটা স্বপ্নের মতোই সুন্দর হতে পারতো। হয় নি কেবল তার ভুলে। সে কোনোমতে জবাব দিলো,
–হ্যাঁ।
কঙ্কা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। উদাস হয়ে প্রশ্ন করলো,
–প্রেমিককে বিয়ে করলে কি সবার লাল নীল সংসার হয়?
সুরমা মৃদু হেসে বলল,
–সেটা তো অনেক বড় তর্ক বিতর্কের ব্যাপার, কঙ্কা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী হওয়ার পর তাদের প্রেমসত্ত্বা হারিয়ে যায়। অধিকাংশ মানুষই দায়িত্ব আর ভালোবাসাকে সমন্বয় করতে পারে না। তবে শাদাবের মতো করে যদি কেউ ভালোবাসতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই স্বপ্নের সেই সংসার পাওয়া সম্ভব। শাদাবের মতো স্বামী পাওয়া ভীষণ ভাগ্যের ব্যাপার। ও অন্যরকম।
কথাগুলো বলার সময় সুরমার চোখেমুখে এক অবাধ্য লাজুক হাসির ছায়া খেলে গেল। কঙ্কা গালে হাত দিয়ে বলল,
–বা বাহ! বরের প্রেমে তো হাবুডুবু খাচ্ছিস দেখছি।
সুরমা মাথা নিচু করে ফেললো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,
–ও নিজেই এই জায়গাটা অর্জন করে নিয়েছে। ও সত্যিই ভীষণ ভালো।
কঙ্কা হুট করে বলে উঠলো,
–এক কাজ কর না, আপা। তোর বরটা আমাকে দিয়ে দে। আমি তোর চেয়েও ভালো বউ হবো।
সুরমা রাগী চোখে কঙ্কার দিকে তাকালো। হালকা করে বোনের গালে চড় বসিয়ে বলল,
–খবরদার! আমার একটা মাত্র বর।
কঙ্কা এবার হেসে উঠলো। সুরমাও হেসে ফেললো। ওদের হাসির মাঝেই আয়েশা বেগম খাবারের থালা হাতে ঘরে ঢুকলেন। পানির গ্লাস টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন,
–মাংসটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। গরম করতে গিয়ে একটু দেরি হলো। তোরা হাসছিলি কি নিয়ে?
কঙ্কা উত্তর দিলো,
–ওসব দুই বোনের ব্যাপার। তোমাকে বলা যাবে না, মা।
আয়েশা হাসলেন। মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিয়ে বললেন,
–আচ্ছা, বলতে হবে না। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।
আয়েশা দুই বোনকে খাইয়ে দিচ্ছেন। তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে উনার মেয়েরা। আজ বহুদিন পরে মনে মনে ভীষণ শান্তি পাচ্ছেন উনি। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে এ শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। মনে হচ্ছে, উনার মেয়েটা বোধহয় আরও দূরে সরে যাবে। এমন লাগছে কেন?
___________________________
ঘড়িতে রাত দশটা। কলিমউদ্দিন সাহেব বসার ঘরে বসে হিসাব লিখছেন। উনার হাতে একটা মোটা খাতা। কঙ্কা ধীরে ধীরে সেই ঘরে এসে ঢুকলো। সে এখনো নববধূ সাজেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কলিমউদ্দিন সাহেব একজন ব্যবসায়ী। এই শহরে উনার চারটা চাউল কল আছে। যদিও সব একদিনে হয় নি। বহুবছর সময় লেগেছে। কঙ্কার জন্মের আগ পর্যন্ত উনার একটাই রাইস মিল ছিল। কঙ্কার জন্মের পর হুট করেই ব্যবসায় উন্নতি হতে শুরু করলো। একারণে কঙ্কাকে উনি একটু বেশিই ভালোবাসেন। উনি সবসময় বলেন, কঙ্কা উনার জীবনে সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে। কঙ্কার ধারণা তার বাবা ব্যবসায় খুবই কাঁচা। অন্য কেউ হলে এতদিনে প্রায় দশটা রাইস মিল বানিয়ে ফেলতো। কিন্তু তার বাবা পারে নি। কর্মচারীদের অতিরিক্ত মাথায় তোলাই এর কারণ।
কঙ্কা ধীরে ধীরে তার বাবার কাছে এগিয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–বাবা, দেখো তো। আমাকে কেমন লাগছে?
কলিমউদ্দিন সাহেব মাথা তুলে তাকালেন। কন্যাকে একনজর দেখে হাতের খাতাটা বন্ধ করলেন। প্রশস্ত হেসে বললেন,
–আরেহ, আম্মাজান! তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে।
কঙ্কা হেসে বাবার পাশে বসলো। বলল,
–বাবা, তুমি আপার জন্য তিলের খাজা আনলে। আমার জন্য কিছু আনলে না?
–এনেছি তো, আম্মা। তোমার জন্যও তো তিলের খাজা এনেছি। খাও নাই?
কঙ্কা অভিমানী গলায় বলল,
–না, সব আপা খেয়ে ফেলেছে।
কলিমউদ্দিন সাহেব হেসে বললেন,
–আচ্ছা। আমি কাল আবার এনে দেবো।
কঙ্কার বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো। কাল যে সে আর এবাড়িতে থাকবে না সেটা সে কিভাবে বলবে তার বাবাকে? সে হুট করে বাবার পায়ের কাছে বসে পরলো। ডুকরে উঠে বলল,
–আমাকে মাফ করে দিয়ো, বাবা।
কলিমউদ্দিন সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে স্নেহের স্বরে বললেন,
–কি হয়েছে, মা আমার?
কঙ্কা চোখ মুছলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,
–কিছু না, বাবা। কদিন পরে আমার বিয়ে তো। তাই মন খারাপ লাগছে।
কলিমউদ্দিন সাহেব কোমল গলায় বললেন,
–পাত্রপক্ষ দেখতে আসলেই বিয়ে হয় না, আম্মাজান। আর কোনোদিন এভাবে কাঁদবা না। চোখ মুছে ফেলো।
কঙ্কা মাথা নাড়িয়ে বলল,
–আচ্ছা, কাঁদবো না। তুমি এবার ঘুমাতে যাও, বাবা। আমিও যাচ্ছি।
কঙ্কা উঠে দাঁড়ালো। বাবাকে ঘরে এগিয়ে দিয়ে সে নিজের ঘরে এসে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে প্রথমেই গায়ের গয়নাগুলো খুলে ফেললো সে। তার ফোন বাজছে অনবরত। ফোন করছে আবির। সে ইচ্ছা করেই ফোনটা ধরছে না। আবিরের অস্থিরতা বাড়ুক। সে মনোযোগ দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে। তাকে সত্যিই সুন্দর দেখাচ্ছে। বিশেষ করে তার কাজল আঁকা চোখ দুটো। কিন্তু সে জানে, আবির তার চোখের দিকে তাকাবে না। আবির তাকাবে তার শরীরের দিকে। ফোন আবার বাজছে। কঙ্কা এবার ফোন ধরলো। ওপাশ থেকে আবির ব্যস্ত গলায় বলল,
–কঙ্কা, তুমি কোথায়? দশটা পেরিয়ে গেছে। তুমি এখনো বের হও নি কেন? আমার বন্ধু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
কঙ্কা শীতল গলায় বলল,
–শুধু তোমার বন্ধু এলে হবে না, আবির। তোমাকেও আসতে হবে।
আবির থমকে গেল। একমুহূর্ত পরেই চেঁচিয়ে বলল,
–পাগল হয়েছ? আমি রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি, কঙ্কা। জলদি এসো।
–না, আবির। আগামী এক ঘন্টার মধ্যে তুমি আসবে। আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা সামনে যে চৌরাস্তার মোড় আছে, সেখানে অপেক্ষা করবে। আগে সেখানে আমাদের বিয়ে হবে। তারপর আমি বাড়ি এসে টাকাপয়সা আর গয়নাগাটি নিয়ে বেরোবো। তার আগে নয়।
আবির হতভম্ব হয়ে গেল। মুখে চলে আসা অকথ্য শব্দটাকে কোনোমতে চাপা দিয়ে ফেললো। গলায় আদুরে ভাব এনে বলল,
–এসব কি বলছো, জানপাখি? এমন তো কথা ছিল না। আমরা আগে রংপুরে যাব, তারপর তো বিয়ে করবো।
কঙ্কা শক্ত গলায় বলল,
–না, আগে বিয়ে হবে। তারপর যাব। তুমি এসো।
আবির এবার বিরক্তি দমন করতে পারলো না। রাগী গলায় বলে উঠলো,
–ফাজলামি পেয়েছ? অযথা সময় নষ্ট করো না, কঙ্কা।
–রাগ দেখিয়ো না। আমি যা বলেছি তাই করতে হবে। নইলে আমি যাব না।
আবির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গলায় আবার নরম ভাব এনে বলল,
–এতরাতে কিভাবে বিয়ে হবে, কঙ্কা? কাজী লাগবে তো।
কঙ্কা মৃদু হেসে বলল,
–আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। কাজী সাহেব সময়মতো চলে আসবেন।
.
#চলবে………..