#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:৫
.
.
.
আবির বিপদে পরে গেল। তার পরিকল্পনা উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে। সে এরকমটা ভেবে রাখে নি। সে চায়ই নি কঙ্কাকে বিয়ে করতে। তার উদ্দেশ্যে ছিল কঙ্কাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়ি থেকে বের করা, এখান থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া আর নিজের কার্যসিদ্ধির পর কঙ্কার গয়নাগাটি আর টাকাপয়সা নিয়ে পালানো। মনে হচ্ছে তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাকে ফেঁসে যেতে হবে বিয়েতে। আবির নিজের হাত কামড়াতে লাগলো। তার ভুল হয়েছে। কঙ্কা তার আর দশটা প্রেমিকার মতো নয়। মেয়েটার বুদ্ধি কিছুটা বেশি। তবে আবিরের বুদ্ধিও কিছু কম নয়। সে ঠান্ডা মাথায় নিজের পরিকল্পনা নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা করলো। আবিরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কঙ্কা বলে উঠলো,
–কি হলো? চুপ করে গেলে কেন? আসছো কিনা?
আবির কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। বিয়ে তো কখনো না কখনো করতেই হবে। কঙ্কার মতো বুদ্ধিমতী বউ হলে মন্দ হয় না। বিয়ের পরে কোনো বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করলে সে ভালোভাবেই পারবে কঙ্কার ডানা ছাটতে। বরং তখন আরও সুবিধা হবে। স্বেচ্ছায় যদি মেয়েটা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিতে চায় তাহলে তার অসুবিধা কোথায়?
আবির হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। স্পষ্ট গলায় বলল,
–আসছি আমি। তুমি তৈরি থাকো।
কল কেটে গেল। কঙ্কা ফোন হাত থেকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আধো অন্ধকারে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো কেউ জেগে গিয়েছে কিনা। না, কেউ জেগে নেই। সবাই যে যার ঘরে। কঙ্কা খুব সাবধানে সিড়ির কাছে গেল। পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো। সিড়ির প্রতিটি ধাপে পা ফেলার পরেই আজ সে থমকে যাচ্ছিলো। হাতের আঙুলগুলো দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো পাশের সাদা দেয়াল আর সিড়ির বাদামী কাঠের রেলিং। কঙ্কার মনের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। ছাদ যত এগিয়ে এলো, তার হাহাকার তত বাড়লো। এই স্মৃতিমাখা বাড়ি, শৈশবমাখা আনন্দের পাতা আর কখনো কি জায়গা দেবে তাকে? এই শিকড়ের সাথে বন্ধন চিরকালের মতো চিরবিচ্ছিন্ন করে কতদিন সে বেঁচে থাকতে পারবে? দেয়ালের প্রতি ফোঁটা সাদা রঙ, সিড়ির প্রতিটি বালুকণা, রেলিঙের প্রত্যেক বাঁক তাকে যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। হাহাকার করে বলছে, “তুই আমাদের ছেড়ে যাস না, কঙ্কা।” কঙ্কা এই প্রকাণ্ড অনুভূতির সাথে বেশিক্ষণ লড়াই করতে পারলো না। স্মৃতিকাতর মনের সুগভীর দুঃখ গলে পরলো চোখের জল হয়ে।
ছাদে উঠে দরজা ধরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো কঙ্কা। আকাশে আধেক চাঁদ। চারপাশে মৃদু চাঁদনীর ঘোলাটে আলো। কিছুটা সময় একদৃষ্টিতে চন্দ্রমাকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে চোখের জল মুছলো কঙ্কা। নীলয়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো ঘরের আলো বন্ধ। সম্ভবত নীলয় ঘুমিয়ে পরেছে। কঙ্কা একবার ভাবলো নীলয়কে ডাকবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদল করলো। নীলয় যদি তাকে যেতে না দেয়! সে অনর্থকভাবে ছাদে পায়চারী করলো কিছুক্ষণ। তারপর নিচে নেমে গেল। কাজী সাহেবকে একবার ফোন করতে হবে। উনি শেষ পর্যন্ত আসবেন কিনা তা জানা দরকার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কাজী সাহেবকে আসতে রাজি করিয়েছে কঙ্কা। রাত বিরাতে বিয়ে পড়াতে আসতে উনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। শেষে তিনগুণ টাকা নেওয়ার শর্তে তিনি রাজি হয়েছেন। ঘরে ঢুকে কাজী সাহেবকে ফোন করলো কঙ্কা। উনি এসে পরেছেন। কঙ্কা এবার ঘড়ির দিকে তাকালো, সময় রাত ১১:০৫। সে এবার চুপিসারে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। গয়নাগাটি আর টাকাপয়সার ব্যাগ রেখে গেল সদর দরজার কাছে। যেন বিয়ে সেরে এসে চট করে সেটা নিয়ে পালাতে পারে।
_________________
একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল সুরমার। সে হুড়মুড় করে উঠে বসলো। ঢংঢং করে ঘড়ি জানান দিলো রাত দুটো বেজেছে। সুরমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কি অদ্ভুত এক স্বপ্ন সে দেখলো! সে স্বপ্নে দেখলো, এই বাড়ি ভীষণ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পরেছে বাড়ির চতুর্দিকে। যেন বিয়ে বাড়ি! কঙ্কা হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাড়িতে। হাসিমুখেই কঙ্কা একথালা মিষ্টি নিয়ে তার কাছে গেল। মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বলল,
–নে আপা, মিষ্টি খা। আজ আমার বিয়ে। খুব ভালো ছেলের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। এত খুশির দিন। অথচ তুই এখনো পর্যন্ত একটা মিষ্টিও খাস নি।
সুরমা কাঠকাঠ গলায় বলল,
–কঙ্কা, খালুজান মারা গেছেন। খালা কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে যাচ্ছেন। আর তুই মিষ্টি খাওয়াতে এসেছিস আমাকে?
কঙ্কা বলল,
–মানুষ তো মারা যাবেই। তাই বলে কি অন্য কারোর বিয়ে আটকে থাকবে? তুই মিষ্টি খা তো।
এই জায়গাতে এসে সুরমার ঘুম ভেঙে গেল। তার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে। এমন একটা ভয়ংকর স্বপ্ন কেন দেখলো সে? আর স্বপ্নে কঙ্কা এসব কি উল্টোপাল্টা কথা বলছিল? তার খালুজান ঠিক আছে তো? কঙ্কার বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো। সে দৌড়ে তার খালা আর খালুজানের ঘরের দিকে গেল। দরজায় বারকয়েক আঘাত করে ডাকলো,
–খালা! খালা।
দরজা খোলা হলো না। সুরমা আরও কয়েকবার দরজা ধাক্কালো। এবার আয়েশা দরজা খুললেন। সুরমা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আয়েশা চিন্তিত হয়ে কাছে এগিয়ে গেলেন। গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন,
–কি হয়েছে, মা? তোকে এরকম লাগছে কেন? ভয় পেয়েছিস?
সুরমা প্রচন্ড অস্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
–খালা, খালুজান ঠিক আছে?
আয়েশা একবার ঘরের ভেতরে তাকালেন। তারপর বললেন,
–হ্যাঁ, মা। ঠিক আছে। ঘুমিয়ে আছে। কেন, মা? কি হয়েছে? আমাকে বল।
সুরমা দরজার কাছে খানিকটা এগিয়ে গেল। দেখলো, তার খালুজান নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। এই মানুষটা! এই মানুষটা তার কাছে ফেরেশতা। তার নিজের জন্মদাতা বাবা যা করে নি, এই মানুষটা তার জন্য তাই করেছে। এই মানুষটা তার কাছে বাবার থেকেও বেশি। খালুজানের ঘুমন্ত শান্ত মুখটা দেখে সুরমার মন শান্ত হলো। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর আয়েশার দিকে ঘুরে অত্যন্ত নিচু গলায় বলল,
–দুঃস্বপ্ন দেখেছি, খালা। তাই ভয় পেয়েছিলাম।
আয়েশা হেসে বললেন,
–পাগলি! স্বপ্ন তো স্বপ্নই। এত ভয় পেতে হয়? যা, ঘুমিয়ে পর।
সুরমা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। তারপর ঘরে চলে এলো। বিছানায় কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো। চোখ বন্ধ করে শুতেই হঠাৎই শাদাবের কথা খুব মনে পরতে লাগলো। কি নিষ্ঠুর মানুষ! এত করে বলা সত্ত্বেও একা ফেলে চলে গেল? যাওয়ার পর থেকে একবার ফোন পর্যন্ত করলো না! এই উনার ভালোবাসা? এখন নিশ্চয়ই আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। সুরমা আবার উঠে বসলো। ফোন হাতে নিয়ে শাদাবকে ফোন করলো। মনে মনে বলল, “আপনার আরামের ঘুম আমি বের করছি।”
শাদাব ফোন ধরলো। ঘুম ঘুম গলায় বলল,
–রাত দুটো বাজে, সুরমা। তোমার চোখে ঘুম নেই বুঝি?
শাদাবের ঘুমাজড়ানো কন্ঠস্বর সুরমার বুকে আদুরে আঘাত করলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। সে মৃদু গলায় বলল,
–আপনি কি ঘুমিয়ে পরেছিলেন?
–এত রাতে না ঘুমিয়ে কি করবো? বউও তো নেই যে জেগে থাকবো।
সুরমা অভিমানী গলায় বলল,
_বউয়ের কাছে থাকতে আপনাকে কে মানা করেছিল? থাকতেই তো বলেছিলাম।
–উঁহু, আমার বউই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এখন হয়তো সে ভুলে গেছে সে কথা।
সুরমার আবার মন খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থাকলো সে। একটু সময় নিয়ে নিজেকে গোছালো। তারপর শান্ত গলায় বলল,
–শাদাব, আপনাকে একটা কথা বলার আছে।
–বলো।
–মানুষ কি নতুন করে ভালোবাসতে পারে না?
–আমি জানতাম পারে। কিন্তু তুমি বলেছ, পারে না।
–ভুল বলেছিলাম। আমি এখন বলছি, পারে।
–কদিন পরে যদি তোমার এটাকেও ভুল বলে মনে হয়?
–হবে না। কখনো মনে হবে না।
–সুরমা, ঘুমাও। আমি রাখছি।
সুরমা তাড়াহুড়ো করে বলল,
–শুনুন শুনুন, প্লিজ ফোন রাখবেন না।
শাদাব ফোন রাখলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–কি?
–আপনি কাল এখানে একবার আসবেন? প্লিজ না করবেন না।
–ঠিক আছে। আসবো। আর কিছু বলবে?
সুরমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। হুট করে বলে উঠলো,
–আপনি সিনেমা দেখেন?
আচমকা এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে শাদাবের ভ্রু কুঁচকে এলো। অস্ফুটে বলল,
–সিনেমা?
–হ্যাঁ, সিনেমা। আপনি বলিউড সিনেমা দেখেন? ঐশ্বরিয়া আর অজয়ের ওই সিনেমাটা দেখেছেন? কি যেন নাম ছিল! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। “হাম দিল দে চুকে সনম”। দেখেছেন?
শাদাব গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো,
–না, দেখি নি। আমি হিন্দি ছবি দেখি না।
–আচ্ছা, ঠিক আছে। বাংলা ছবি দেখেন? শাবনূর রিয়াজের ছবি? হৃদয়ের বন্ধন দেখেছেন?
–না, দেখি নি। আমি এসব দেখি না।
সুরমা হতাশ গলায় বলল,
–কি দেখেছেন তাহলে আপনি?
শাদাব এবার বলে উঠলো,
–বেলা বোস গানটা শুনেছি। তুমি জেনে অবাক হবে, আমি আমার জীবনে একজন বেলাকে দেখেওছি।
সুরমা থমকে গেল। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে যে শাদাব তাকে খোঁচা মেরে কথাটা বলেছে।সে এবার রাগী গলায় বলল,
–ওসব আজেবাজে জিনিসই তো দেখবেন শুধু। খারাপ লোক একটা!
শাদাব নিঃশব্দে হেসে ফেললো। নিঃশব্দে হেসেছে বলে সুরমা তা বুঝতে পারলো না। শাদাব বুঝতে দিলোও না। গলায় গাম্ভীর্য এনে বলল,
–রাত অনেক হয়েছে। ঘুমাও, সুরমা। আমাকেও ঘুমুতে হবে। কাল অফিস আছে। রাখছি।
সুরমা তাড়াহুড়ো করে বলল,
–আপনি কিন্তু কাল আসবেন।
কল কেটে গেছে। শেষ কথাটা শাদাব শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝতে পারলো না সুরমা।
___________________
আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙেছে নীলয়ের। নীলয় ছাদ থেকে নেমে নিচে এলো। বসার ঘরে কলিমউদ্দিন সাহেব বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। নীলয়কে দেখতে পেয়ে ডাকলেন। নীলয় ভেতরে গেল। কলিমউদ্দিন সাহেব বললেন,
–শুনলাম, গতকাল কোন এক প্রকাশকের অফিসে নাকি গিয়েছিলি।
নীলয় মাথা চুলকে বলল,
–জ্বি, চাচা।
–কোনো লাভ হলো?
নীলয় না সূচক মাথা নাড়লো। কলিমউদ্দিন সাহেব বললেন,
–নতুন লেখকদের বই ছাপতে টাকা লাগে। তুই চাইলে আমি তোকে সেটা দিতে পারি।
–না, চাচা। আমি টাকা দিয়ে বই ছাপতে চাই না।
–তাহলে তুই কি করতে চাস?
–ইয়ে, কিছু একটা হয়ে যাবে, চাচা। এখন তো পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হয়।
–পত্রিকায় কবিতা দেওয়ার বদলে কি তুই টাকা পাস?
নীলয় মাথা নিচু করে বলল,
–জ্বি না।
–এর মানে হলো, তোর প্রতিভা আর পরিশ্রম মূল্যহীন। তাই তো?
নীলয় উত্তর দিলো না। কলিমউদ্দিন সাহেব বললেন,
–কবি হতে চাস ভালো কথা। মানা করছি না। কিন্তু এসবের পাশাপাশি একটা চাকরির জন্য চেষ্টা কর, নীলয়। চাকরি পেতেই হবে এমন নয়। শুধু চেষ্টা করবি।
নীলয় মাথা নাড়িয়ে বলল,
–জ্বি আচ্ছা, চাচা।
–ঠিক আছে। যা এবার।
নীলয় বেরিয়ে এলো বসার ঘর থেকে। তার এক কাপ চা দরকার। বাসার কাজের মেয়েটা আসছে না আজ তিনদিন। মাঝে মাঝেই সে কাজ কামাই করে। মালিককে ভালো মানুষ পেয়েছে বলে যা ইচ্ছা তাই করতে অসুবিধা হয় না। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল নীলয়। কিন্তু গিয়েই তাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। রান্নাঘরের মেঝেতে বসে আছে সুরমা আর আয়েশা বেগম। আয়েশা বেগম সুরমাকে জড়িয়ে ধরে গুনগুন করে কাঁদছেন। সুরমা কাঠ হয়ে বসে আছে। তার মুখ মরার মতো সাদা। নীলয় দ্রুত এগিয়ে গেল। দুজনের সামনে বসে বলল,
–কি হয়েছে, চাচী? তুমি কাঁদছো কেন? আপা, চাচীর কি হয়েছে?
সুরমা উত্তর দিতে পারলো না। আয়েশা আর্তনাদ করে বলে উঠলেন,
–নীলয় রে! কঙ্কা আমার সর্বনাশ করে দিলো। মান সম্মান ডুবিয়ে দিলো। একবারও আমাদের কথা ভাবলো না।
নীলয় স্তব্ধ হয়ে গেল। কঙ্কা তার মানে সত্যিই পালিয়েছে! নীলয় ভাবতে পারে নি কঙ্কা সত্যি সত্যিই কাজটা করবে। এটা কি করলো মেয়েটা? নীলয়ের এখন কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করছে। সে কেন কঙ্কার কথাগুলোকে গুরুত্ব দিলো না? সে আরেকটু সচেতন হলে তো কঙ্কাকে আটকাতে পারতো। কি হবে এবার?
আয়েশা এবার চিৎকার করে কাঁদছেন। সুরমা উনাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সে খালাকে ধরে চাপা গলায় বলল,
–খালা, শান্ত হও। খালুজান শুনে ফেলবেন।
আয়েশা আরও চেঁচিয়ে বললেন,
–শুনুক। শুনতে তো হবেই। মেয়েকে অতি আদর দেওয়ার ফল দেখুক এবার।
আয়েশা হাহাকার করে কাঁদছেন। ভেতরের কান্নাকাটি আর গোলমালের শব্দে কলিমউদ্দিন সাহেব বসার ঘর থেকে উঠে ভেতরে এলেন। রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
–আয়েশা, কাঁদো কেন?
আয়েশা উঠে দাঁড়ালেন। আঁচলে বেঁধে রাখা একটা কাগজ বের করে স্বামীর হাতে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,
–দেখো তোমার মেয়ের কীর্তি। আদর দিয়ে তো মাথায় তুলে রেখেছিলে। তার কি দাম তোমার মেয়ে দিয়েছে দেখো তুমি।
কলিমউদ্দিন সাহেব কাগজটা মেললেন। এটা একটা চিঠি। মাত্র চারটা লাইনের চিঠি। সেখানে লেখা আছে,
“বাবা,
আমি আমার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাচ্ছি। তোমরা আমাকে খুঁজবে না। আমি সাথে করে মায়ের বিয়ের শাড়ি, মায়ের গয়না আর আলমারি থেকে বিশ হাজার টাকা নিয়েছি। আমাকে তোমরা ক্ষমা করো।
ইতি,
তোমার কঙ্কা মা।”
কলিমউদ্দিন সাহেব কাগজটা হাতে নিয়েই কিছুক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাৎ উনার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এলো। বুকে বিষম ব্যাথার ঢেউ খেলে গেল। উনি চোখ বন্ধ করে মেঝেতে বসে পরলেন। সবাই দৌড়ে উনার কাছে গেল। সুরমা কেঁদে ফেলে বলল,
–খালুজান, আপনি ঠিক আছেন?
নীলয় অস্থির হয়ে বলল,
–চাচা, অ্যাম্বুলেন্স ডাকবো?
কলিমউদ্দিন সাহেব পিটপিট করে চোখ খুললেন। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। আয়েশা বললেন,
–তুমি ঘরে চলো।
কলিমউদ্দিন সাহেব হাত নাড়িয়ে সবাইকে থামতে বললেন। নিচু আওয়াজে থেমে থেমে বললেন,
–না, আমি…আমি ঠিক আছি। তোমরা যাও। আমি একটু ছাদে যাব। তোমরা কেউ আমার সাথে আসবে না।
কলিমউদ্দিন সাহেব টলমল পায়ে চলে গেলেন। বাকি তিনজন মানুষ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আচমকা কান্নার আওয়াজ শুনে সবাই দৌড়ে সিড়ির দিকে গেল। আর সেখানে গিয়েই সবাইকে থমকে দাঁড়াতে হলো। কারণ কলিমউদ্দিন সাহেব ছাদে যান নি। সম্ভবত এতগুলো সিড়ি ভেঙে উপরে ওঠার মতো শক্তি উনি পান নি। উনি সিড়িতে বসেই কাঁদছেন। সিড়ির এক কোণায় বসে কঙ্কার চিঠি বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি। শিশুর মতো কান্না। যেন কোনো শিশু তার মাকে হারিয়ে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে উনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করছেন। বারবার বলছেন,
“মা গো! তুমি আমাকে ত্যাগ করলা, মা। আমাকে তুমি কিসের শাস্তি দিলা?”
উনার কান্না দেখে কেউই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। আয়েশা মুখে আঁচল দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। নীলয়ের চোখেও পানি এসে গেছে। জীবনে প্রথমবার এই মানুষটাকে সে কাঁদতে দেখলো। সুরমা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। দৌড়ে ঘরে ঢুকে হুহু করে কেঁদে উঠলো।
.
#চলবে…….