#নীরব_রোদনে
#আলো_রহমান—Alo Rahman
#পর্ব:৬
.
.
.
রাস্তার ধারের ছোট্ট একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আছে কঙ্কা। মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে রেখেছে সে। রাস্তায় বিতিকিচ্ছিরি শব্দে গাড়ি চলছে। কঙ্কা চোখ ঘুরিয়ে এদিকওদিক দেখছে। তার সামনের উঁচু বেঞ্চটায় সরু কাঁচের কাপে চা রাখা হয়েছে। চা থেকে ধোঁয়া উঠছে। সে চা খাচ্ছে না। গুড়গুড়ি পাকিয়ে উপরে উঠতে থাকা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কে জানে বাবা এখন কি করছে? সুস্থ আছে তো? কঙ্কার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে সে ফিরে যেতে চায়।
আবির কঙ্কার পাশেই বসে আছে। সে চায়ে ডুবিয়ে টোস্ট বিস্কুট খাচ্ছে। কঙ্কা নিজেকে সামলে নিয়ে আবিরের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো,
–আমরা কোথায় যাব এখন?
আবির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
–তোমার টাকাগুলো আমাকে দাও। আপাতত একটা হোটেলে উঠতে হবে।
–হোটেলে কেন? আমরা একটা বাড়ি ভাড়া নিতে পারি না?
–কঙ্কা, বাড়ি ভাড়া পাওয়া কি মুখের কথা? একদিনে কি বাড়ি পাওয়া যাবে? তাছাড়া বাসায় থাকতে তো কিছু জিনিসপত্র দরকার নাকি?
–তাহলে চলো, আমরা আমাদের সংসারের টুকটাক কিছু জিনিসপাতি কিনে নেই। তারপর একটা বাসা খুঁজে নেবো।
–কিন্তু কঙ্কা….
–কিন্তু টিন্তু নয়। আমি যা বলেছি তাই হবে।
আবির শান্ত গলায় বলল,
–আচ্ছা বেশ, চলো।
কঙ্কা জিজ্ঞেস করলো,
–আচ্ছা আবির? আমরা কি এখন থেকে এই রংপুরেই থাকবো?
–জানি না।
–আবির, সংসার চালাতে গেলে রোজগার প্রয়োজন। তুমি কোনো কাজ করবে না? চাকরি খুঁজবে না? বাবার টাকায় বউকে খাওয়াবে?
আবির বিরক্তি নিয়ে বলল,
–এজন্যই আমি সংসারে জড়াতে চাই নি। যতসব ঝামেলা!
কঙ্কা মুখ লুকিয়ে হাসলো। সে খুব ভালো করেই জানে যে আবিরের তাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য ছিল না। তবুও অবুঝের ভান করে প্রশ্ন করলো,
–সংসারে জড়াতে চাও নি মানে? তুমি তো রংপুরে এসেই আমাকে বিয়ে করবে বলেছিলে। বিয়েটা একটু আগে হয়ে গেছে। এতে অসুবিধা কোথায়?
আবির কথা বলল না। কঙ্কা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–চলো, যাই। চায়ের দাম কি তুমি দেবে? নাকি আমি?
আবির উঠে দাঁড়িয়ে দোকানীর হাতে টাকা গুঁজে দিলো। তারপর ইশারায় বলল, চলো। কঙ্কা তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে বাইরে এলো। আবিরের হাতেও একটা ব্যাগ। আশেপাশের লোকজন সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাদের দেখছে। কঙ্কার গায়ের বেনারসিই এই সন্দেহের কারণ। সে আর আবির ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। আবির চিন্তিত বোধ করছে। কি করবে সে এখন? কঙ্কাকে ফেলে চলে গেলেও তো সমস্যায় পরে যাবে সে। কারণ কঙ্কা চুপচাপ বসে থাকার মেয়ে নয়। কিন্তু কঙ্কাকে তো বাড়ি নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে মহা ঝামেলা পোহাতে হবে তাকে। কঙ্কা হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলো,
–আবির, আমাদের বিয়ের কথা তোমার মা বাবাকে জানিয়েছ?
আবির সংক্ষেপে উত্তর দিলো,
–না।
–জানাবে না? আমরা বাড়ি যাব না?
–ওসব পরে ভাবা যাবে।
–বিয়ে করে তোমার আফসোস হচ্ছে? প্রেমিকাদের হারিয়ে ফেলবে বলে?
আবির থমকে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে কঙ্কার দিকে তাকিয়ে রইলো। কঙ্কা শীতল গলায় বলল,
–তাকিয়ে আছ কেন এভাবে? আমি জানি তোমার একাধিক প্রেমিকা আছে। তুমি যে বাসায় থাকো, সেখানে তাদের যাতায়াতও আছে। তাদের মধ্যে প্রায় সবার সাথেই তোমার শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে। একবার নয়, একাধিকবার। যেকজন বাকি আছে তাদেরকেও তুমি খুব ঠান্ডা মাথায় ব্ল্যাকমেইল করে চলেছ। তাই না, আবির?
আবির রাগী গলায় বলল,
–কি আজেবাজে কথা বলছো, কঙ্কা?
কঙ্কা বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
–ঠিকই তো বলছি। আর এসব জেনেশুনেই তোমাকে বিয়ে করেছি আমি। ভুল কি বলেছি তুমিই বলো।
আবির কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর মুখে হাসি টেনে বলল,
–কঙ্কা, তুমি যে কিসব বলো! আমার আগে কিছু প্রেমিকা ছিল। তারা এখন আর নেই। এখন তুমি ছাড়া আর কারোর সাথে আমি সম্পর্ক রাখি নি।
–ঠিক আছে। তাহলে আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে চলো। তোমার ওই কুৎসিত ফ্ল্যাটে নয়। যেখানে তোমার মা বাবা আছেন সেখানে।
–বললাম তো, কঙ্কা। এখনই নয়। সময় দরকার। এখন চলো।
কঙ্কা একই ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,
–বিয়ের পরেও কি এতজনের সাথেই সম্পর্ক রাখার ইচ্ছা আছে? এভাবেই জীবন চালাবে? শোধরাতে ইচ্ছা করে না, আবির?
আবির অত্যন্ত বিরক্ত হলো। বিয়ে হতে না হতেই খবরদারি শুরু করেছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–কঙ্কা, এটা রাস্তা।
কঙ্কা চুপ করে গেল। নিজের ব্যাগটা টেনে নিয়ে চুপচাপ হাঁটতে থাকলো। আবির বলে উঠলো,
–তোমার ব্যাগটা আমাকে দাও। ভারী ব্যাগ তোমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না।
কঙ্কা মৃদু হেসে ব্যাগটা আবিরের হাতে দিলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই মানুষটা এখন তার স্বামী! আবিরের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কঙ্কা বিরবির করলো, “তুমি বদলে যাও, আবির। প্লিজ বদলে যাও।”
_______________________
বিকেল হয়ে এসেছে। নীলয় একজন ডাক্তার ডেকে এনেছিল কিছুক্ষণ আগে। কলিমউদ্দিন সাহেব ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন। মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিলেন। প্রথমদিকে মোটামুটি সুস্থই ছিলেন উনি। কিন্তু পাত্রপক্ষকে যখন ফোন করে কঙ্কার সাথে সম্বন্ধটা বাতিল করার কথা বলা হলো, বিপত্তি বাঁধলো তখনই। তারা এমন কিছু কথা শোনালেন যেগুলো মরার উপরে খাঁড়ার ঘা বলে বোধ হলো। কলিমউদ্দিন সাহেব আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তখনই উনার অসুস্থতা বাড়লো। ডাক্তার কলিমউদ্দিন সাহেবকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে গেছেন। উনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। আয়েশা বেগম স্বামীর শিয়রের পাশে বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন। উনার বুক ফেটে যাচ্ছে। কঙ্কাকে কি উনি কম ভালোবেসেছিলেন? মা মেয়ের সম্পর্কে কি ফাঁক থেকে গিয়েছে কোথাও? হয়তো তাই। তা নাহলে কঙ্কা কেন নিজের মনের কথাগুলো মাকে বলতো না? কঙ্কা কি ভয় পেতো? উনিই কি তবে মেয়ের সাথে ভয় পাওয়ার সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছিলেন? কথাগুলো ভাবতেই উনার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো পানি।
সুরমা অনেকক্ষণ যাবৎ আয়েশাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আয়েশা বেগম কিছুতেই খাচ্ছেন না। সুরমা ব্যথিত গলায় বলল,
–খালা, তুমি অসুস্থ হতে চাও। তুমি অসুস্থ হলে খালুজানকে দেখবে কে? আমার আর নীলয়ের কি হবে? আমার দিকে একবার তাকাও। আমাদের কথা ভেবে খেয়ে নাও।
আয়েশার যেন হুঁশ হলো। সত্যিই তো! এই মেয়েটাও তো উনারই মেয়ে। উনি জন্ম দেন নি ঠিকই, কিন্তু তবুও উনিই তো সুরমার মা। নীলয়ও তো উনারই ছেলে। ওদের জন্যও তো উনাকে সুস্থ থাকতে হবে। কিন্তু উনার আরেক মাতৃহৃদয় উনাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে। উনি খেতে পারছেন না। বারবার মনে হচ্ছে, মেয়েটার দিকে আরেকটু খেয়াল রাখা দরকার ছিল। মা হিসেবে উনি ব্যর্থ হলেন! মেয়েকে আগলে রাখতে পারলেন না। আয়েশা বেগম ডুকরে উঠে বললেন,
–আমার কঙ্কাটা কোথায় চলে গেল রে, সুরমা?
সুরমা হাত থেকে খাবারের থালা পাশের টেবিলে রাখলো। খালার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–কঙ্কা ফিরে আসবে তুমি দেখো। ওকে আমরা ঠিকই খুঁজে বের করবো।
আয়েশা আহাজারি করে বললেন,
–যে নিজে থেকে হারিয়ে যায়, তাকে কিভাবে খুঁজবি? কি করে খুঁজে পাবি তাকে? ও আমাদের কথা কেন ভাবলো না? কেন?
সুরমা কেঁদে ফেলেছে। আয়েশা কাঁদতে কাঁদতে সুরমার বুকে মাথা রাখলেন। সুরমা তার খালার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–খালা, তুমি শান্ত হও। খালুজানের কথা ভাবো একবার।
আয়েশা এবার ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। উনার চোখ আবার জলে ভরে এলো। এই মানুষটা যে মেয়েকে কতখানি ভালোবাসেন সেটা উনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। কি করে মানুষটাকে সামলানো যাবে আয়েশা বুঝতে পারছেন না।। না, ভেঙে পরলে হবে না। উনাকে নিজের স্বামীর জন্য হলেও শক্ত থাকতে হবে। আয়েশা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। উনি বুঝতে পারছেন যে উনাকে এখন পরিবারের ঢাল হতে হবে। উনি সুরমার বুক থেকে মাথা তুললেন। চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
–সুরমা, আমি খাব। দে, খাবার দে।
সুরমা খুশি হলো। খাবার এনে উনাকে খাইয়ে দিতে শুরু করলো। কিন্তু আয়েশা বেগম বেশি খেতে পারলেন না। দু’বার খাবার মুখে দিতেই উনার রুচি চলে গেল। খাবার যেন গলা দিয়ে নামছে না। উনি সুরমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–আমি আর খাব না, সুরমা। তুই খেয়ে নে যা। তুইও তো না খেয়ে আছিস।
সুরমা আহত চোখে তাকিয়ে বলল,
–খালা, তুমি তো কিছুই খেলে না। এক গ্লাস দুধ এনে দেই? খাবে?
আয়েশা মাথা নাড়লেন। উনি খাবেন। সুরমা রান্নাঘরে গেল। এক গ্লাস দুধ নিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলো। আয়েশা বেগমের সামনে বসতেই উনি হঠাৎ মনে পরার ভঙ্গিতে বললেন,
–নীলয় কোথায় রে?
–বাইরে গেছে। কঙ্কার খোঁজ করতে। তুমি খাও।
আয়েশা গ্লাসটা নিলেন। দুধ শেষ করে গ্লাস সুরমার হাতে দিলেন। সুরমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–তুমি খালুজানের পাশে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো। কিছু দরকার হলে আমাকে ডেকো।
খালাকে শুইয়ে দিয়ে সে বাইরে এলো। গ্লাসটা রান্নাঘরে রেখে বসার ঘরে গিয়ে বসলো সুরমা। তার মাথার ভেতরে দপদপ করছে। সে দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো। একে তো তার নিজের সংসারের চিন্তা, তার উপর তার পরিবারের এই অবস্থা। এই অবস্থায় যদি উনারা জানতে পারেন যে সুরমার ডিভোর্স হয়ে যাবে, তাহলে তো তার খালা খালুর কষ্টের শেষ থাকবে না। সে ডিভোর্স আটকানো নিয়ে ভাবতে চেয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে খালা আর খালুজানকে নিয়ে না ভাবলেই যে নয়! কঙ্কা কি করলো এটা? ও কার সাথে পালিয়েছে? কে ওর প্রেমিক? ও তো সব কথা সুরমাকে বলতো। নিজের প্রেমের কথা কেন বলে নি? নীলয় কি কিছু জানে? সুরমা আর ভাবতে পারলো না। মাথার যন্ত্রণা বেড়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। সুরমা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। শাদাব দাঁড়িয়ে আছে। সুরমা তাকে আজ আসতে বলেছিল। সে সুরমার কথা রেখেছে। শাদাবকে দেখে সুরমা কেঁদে ফেললো। শাদাব বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–কাঁদছো কেন? আর তোমার চোখমুখের এ অবস্থা কেন? কি হয়েছে?
সুরমা উত্তর দিতে পারলো না। তার কান্নাও থামলো না। শাদাব এবার সুরমার হাত ধরলো। আদুরে গলায় বলল,
–কি হয়েছে, সুর? আমাকে বলবে না?
শাদাবের “সুর” ডাকটা সুরমার বুকে দুঃখ, আনন্দ, খুশি, সমস্ত অনুভূতির মিশ্রণে এক অসহ্য ধাক্কা দিলো। বিয়ের পরে শাদাব তাকে এই নামেই ডাকতো। আজ বহুদিন পর শাদাব আবার সেই নামে তাকে ডেকেছে। একসাথে এত অনুভূতি সুরমা সহ্য করতে পারলো না। শাদাবের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে হুহু করে কেঁদে ফেললো। কোনোরকমে বলল,
–খালুজান অসুস্থ। কঙ্কা সব শেষ করে দিলো।
শাদাব বিশেষ কিছু বুঝতে পারলো না। শুধু একহাতে সুরমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কোমল গলায় বলল,
–কেঁদো না, সুরমা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো।
সুরমা কথা বলল না। শুধু আরও শক্ত করে শাদাবকে জড়িয়ে ধরলো।
.
#চলবে………