নীলকণ্ঠা পর্ব-১২

0
1630

#নীলকণ্ঠা

১২।
ওকে নিয়ে এই বাড়ির বাহিরে যাওয়ার অনুমতি আমি তোমাকে দিব না।

মইনুর শেখের গম্ভীর রসহীন তিক্ত কন্ঠে ফায়াজের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না। সে ঠিক আগের মতোই পরীর ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পরী ভীতিগ্রস্ত হয়ে ফায়াজের শরীরের সাথে সিটিয়ে রয়েছে। তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিচ্ছে এখানে সুখকর কিছু ঘটছে না। ফায়াজের মৌনতা মইনুর শেখের সহ্য হচ্ছে না। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,

কিছু বলছি তোমাকে।

ফায়াজ নির্বিকার হয়ে শিতল কন্ঠে বলল,

জ্বি শুনেছি তবে আপনি হয়ত ভুলে গিয়েছেন পরীর দায়িত্ব আপনি আমাকে দিয়েছিলেন।

ফায়াজের শিতল কন্ঠে বলা কথায় মইনুর শেখ খানিকটা থমকালেন। একটু নড়েচড়ে পূর্বের গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বললেন,

হ্যা দিয়েছি কিন্তু তাই বলে তুমি ওকে ভরা মেলায় নিয়ে যেতে পারো না।

কেন পারি না?

কারণ সে স্বাভাবিক নয় আর বেশি মানুষের মাঝে অভ্যস্তও নয়। আমি চাই না সেখানে যেয়ে সে কোন সমস্যার সম্মুখীন হোক।

দায়িত্ব যেহেতু আমার তাই আমার দায়িত্ব পুরোপুরি আমাকেই পালন করতে দিন।

ফায়াজের জেদি, একরোখা, একগুঁয়ে মনোভাবের সাথে নিত্তদিন নতুন ভাবে পরিচিত হচ্ছে মইনুর শেখ। রেনুকা ফায়াজের সাথে আপোষ করতে পাড়ে নি। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। এমন রগচটা স্বভাবের মানুষদের মইনুর শেখের অপছন্দ। তিনি আপাতত নিজের সিদ্ধান্তে আপসোস করছেন। ক্ষণেক্ষণে টের পাচ্ছেন ফায়াজকে সে চিনতে বড্ড বেশি ভুল করে ফেলেছেন। মইনুর শেখ গলা পরিষ্কার করলে। আশেপাশে তাকিয়ে ক্ষানিক বাদে বললেন,

ঠিক আছে তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করো তবে আমার দায়িত্বও আমি পালন করবো। রেনু যাবে তোমাদের সাথে। আশা করি এতে কোন সমস্যা হবে না।

ফায়াজ মইনুর শেখের কথা শুনে রেনুকার দিকে তাকিয়ে মইনুর শেখের দিকে তাকালো। স্বাভাবিক সুরে বলল,

না। সমস্যা নেই।

_______
বড় রাস্তায় উঠেই হাপিয়ে উঠেছে পরী। দীর্ঘদিনের অবসর কাটিয়ে আজ সামর্থ্যের বেশি হেটে ফেলেছে। কপালে চুলের গোড়া বেয়ে ঘর্ম বিন্দু লুটিয়ে পড়ছে কানের পাশ দিয়ে গলায়। ঘর্মাক্ত গলা, কাঁধ ভিজে চিপচিপে হয়ে আছে। শ্বাস ফুলে উঠেছে। মুখ হা করে শ্বাস নিচ্ছে। ফায়াজ পরীর হাত মুঠো থেকে ছাড়ে নি। রেনুকা পরীর থেকে তিন-চার হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ রাস্তার এপাশ ওপাশ তাকালো কিন্তু কোন গাড়ির বালাই নেই। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে গেল। অদূরে একটা ছোট্ট দোকান মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ পরীর হাত মুঠো করে সেদিকে পা বাড়ালো।

দোকানটা টিনের তৈরী। দোকানের সামনে মাঝারী আকারের দুটো কাঠের ব্যাঞ্চ পাতা। চা, বিস্কুট, চানাচুর, পান, চকলেট আর কিছু পানীয় পাওয়া যায়। ফায়াজ একটা পানির বোতল চাইলো। পরীকে ব্যাঞ্চে বসিয়ে পানি খাইয়ে দিল। পকেট থেকে টিস্যু বের করে পরীর ঘর্মাক্ত মুখ, গলা মুছে দিয়ে অবাদ্ধ চুলগুলোকে কানের পিঠে লুকিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দোকানি বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে ফায়াজ আর পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ পানির দাম মিটিয়ে নিল। দোকানি তার কৌতুহল দমাতে না পেড়ে জিজ্ঞাস করল,

আপনেরা কি শহর থেইকা আইছেন?

ফায়াজ দোকানির দিকে সন্দিহান হয়ে তাকালো। পরী আর রেনুকার দিকে ইশারা করে দোকানিকে জিজ্ঞাস করল,

আপনি ওদের চেনেন না?

ফায়াজের কথায় দোকানি কোমর তুলে ঝুকে দোকানের বাহিরে পরী আর রেনুকার দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি ফেলল। ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চেনার চেষ্টা করলো কিন্তু কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। দোকানি সোজা হয়ে বসলো। ফায়াজের দিকে তাকিয়ে না বোধক ঘাড় দুলিয়ে বলল,

চিনি না।

জনাব মইনুর শেখকে চেনেন? ফায়াজের কন্ঠ স্বাভাবিক।

দোকানি এবার দ্রুত মাথা নাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
হ চিনি।

ফায়াজ পরী আর রেনুকাকে দেখিয়ে বলল,
এরা তার বাড়ির লোক আর তার বাড়ির মেহমান।

দোকানি ফের ঝুকে পরী আর রেবুকার দিকে তাকালো। দোকানির এভারে বারবার ঝুকে তাদের দিকে তাকানো দেখে রেনুকার মেজাজ গরম হয়ে গেল। রুষ্ট মেজাজে বুকে হাত বেধে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ালো। অবশ্য দোকানির এহেম আচরনে পরীর কিছু যার আসছে না। সে কাঠের ব্যঞ্চে বসে আশেপাশে তাকাচ্ছে আর মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। দোকানি পরীকে উদ্দেশ্য করে ফায়াজের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞাস করলো,

এইডাই কি ওই পাগল মাইয়াডা?

ওকে পাগল মনে হচ্ছে কেন? ওকি পাগলের মতো কোন আচরন করছে?

ফায়াজের আকস্মিক কঠোরতর শিতল কন্ঠে দোকানি থমকালেন, ভড়কালেন, থতমত খেলেন। আমতাআমতা করতে লাগলেন। হুট করে কথাটা বলা ঠিক হয় নি। লজ্জায় মাথা নামিয়ে না বোধক মাথা নাড়লো।

তাহলে শুধু শুধু একটা মানুষকে পাগল বলে আক্ষায়িত করার কি বেশি প্রয়োজন?

দোকানি ঘাড়ের পেছন চুলকে লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলল,

না মানে, গ্রামের মাইনষে পাগল কর।

এরপর লোকের কথায় নয়। নিজের চোখে যেটা দেখেছেন সেটা বলছেন। ঠিক আছে?

দোকানি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো।

ফায়াজ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
আচ্ছা, এসব বাদ দিন বলুন তো এই রাস্তায় কি কোন গাড়ি পাওয়া যাবে?

দোকানি চোখ তুলে তাকালো। জিজ্ঞেস করল,

কই যাইবেন?

গ্রামে মেলা হচ্ছে সেখানে।

গাড়ি পাইবেন সামনে। বলে দোকান থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে বলল,

আপনেরা একটু খাড়ান আমি গাড়ি আনতাছি। বলে জুতা পড়ে প্রায় দৌড়ে গেল। ফায়াজ তাকে থামানোর আগেই সে বেশ দূরে চলে গেল। ফিরে এলো মিনিট ছয়েক পর। তিন চালাক পদচালিত ভ্যান নিয়ে। দুইটি চাকার উপর ছয়-সাতটা তক্তা বসানো আর তৃতীয় চাকাটা সামনে। দোকানি ভ্যান থেকে নেমে ফায়াজকে বলল,

এইডায় যান। এক্কেরে মেলায় যাইয়া থামবো।

ফায়াজ দোকানির দিকে কৃতজ্ঞতাপূর্ন হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানালো। পরীকে নিয়ে ভ্যানের পেছনে উঠে বসতেই রেনুকা এসে সামনে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে প্রতিবাদী কন্ঠে বলল,

ওকে নিয়ে এখানে বসেছেন কেন? যদি ও পড়ে যায়?

ফায়াজ পরীর কাঁধ জড়িয়ে ধরলো। বিপরীত প্রতিবাদী কন্ঠে বলল,
পরীর খেয়াল রাখার জন্য আমি আছি। আপনি নিজের খেয়াল রাখুন।

রেনুকা দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো। পাড়লে এখনই ফায়াজকে মেরে মাটিতে পুতে ফেলে। মইনুর শেখের কথায় সে এখানে এসেছে। পরীকে কিছুতেই ফায়াজের সাথে একা ছাড়া যাবে না। চোয়াল শক্ত করে ফুসফাস নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ভ্যানের সামনে যেয়ে বসলো।

_______
ভ্যান থামলো বিশালাকার ভাড়াট মেলার সামনে। মেলা জমজমাট হয়ে উঠেছে। ফায়াজ পরীকে নিয়ে ভ্যান থেকে নেমে সামনে গেল। ভাড়া মিটিয়ে মেলায় পা রাখলো। এমন গ্রাম্য মেলায় ফায়াজ অনেক গিয়েছে। মেলার ভেতরে অদূরে চাকরি ঘুড়ছে। বেলুন, পুতুল, খেলনা, খাবার সব এখানে আছে। বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে। মেলার ভেতর ঢুকতেই আব্দুল্লাহর সাথে দেখা। আব্দুল্লাহ প্রশস্ত হেসে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। তবে পরীকে দেখে হাসিটা মিলিয়ে গেল। ফায়াজের সাথে আব্দুল্লাহর চোখাচোখি হতেই আব্দুল্লাহ চোখ নামালো। ফের হেসে বলল,

সাহেব, আইছেন অনেক খুশি হইছি। আসেন।

ফায়াজ চারপাশে তাকিয়ে বলল,

খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে মেলাটা।

সাহেব, আপনের পছন্দ হইছে?

ফায়াজ হাসি টেনে বলল,
হ্যা।

আব্দুল্লাহ খুশিতে আকুপাকু হয়ে হাত ইশারা করে দুই তিনজনকে ডাক দিল। একজন রোগা পাতলা করে ছেলে। বয়স বড়জোর সতেরো থেকে আঠারো। নীল রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়া। আব্দুল্লাহ তাকে দেখিয়ে ফায়াজকে বলল,

সাহেব, আমার ছোড ভাই লতিফ। আইয়ে পড়ে।

ফায়াজ লতিফের দিকে তাকালো। হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বলল,
ভালো আছো?

লতিফ হেসে মাথা নাড়লো।
ফায়াজ জিজ্ঞাস বলল,
কোন গ্রুপে পড়ছো?

কমার্স।

ভালো করে পড়ালেখা করো। কেমন?

লতিফ মাথা নেড়ে বলল,
জ্বি।

আব্দুল্লাহ আরো দুজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। একজন মজনু আর একজন তারেক। এরা দুজন আব্দুল্লাহর বয়সী। ফায়াজ পরীকে নিয়ে মেলা ঘুড়ছে। রেনুকা পাশেই আছে। পেছন পেছন আসছে লতিফ আর তারেক। ফায়াজ টুকটার কথা বলছে তাদের সাথে। হঠাৎ ফায়াজের হাতে টান পড়লো। ফায়াজ ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। পরী দাঁড়িয়ে কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজও পরীর দৃষ্টি অনুসরন করে তাকালো। কাঠের গোলক। সেটায় কারুকার্যে রঙিন ফুল, পাতা, পাখি আঁকা। ফায়াজ পরীকে নিয়ে সেখানে গেল। পরী একদৃষ্টিতে গোলকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ পরীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞাস করল,

পরী এটা পছন্দ হয়েছে? নিবে?

পরী সাড়া দিল না। তার দৃষ্টি গোলকে অনড়। ফায়াজ একটা গোলক নিয়ে পরীর সামনে ধরলো। পরী ফায়াজের হাতের গোলকের দিক তাকালো। ফায়াজ গোলকটা পরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

নাও।

পরী ফায়াজের থেকে চোখ সরিয়ে গোলের দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ফায়াজের হাত থেকে গোলকটা তুলে নিল।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here