#নীলকণ্ঠা
১৩।
হাওয়াই মিঠাই, যা মুখে দেয়ার সাথে সাথে উধাও হয়ে যায়। গলে যায়, মিশে যায় মুখগহ্বরে। মিষ্টি স্বাদযুক্ত হওয়ার কারণে অনেকের খুব প্রিয়। কিন্তু ফায়াজ কখনো কাউকে এত তৃপ্তিসহ এটা খেতে দেখে নি যেমনটা এখন দেখছে।
পরীর বাম হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা কাঠের কারুকার্য বিশিষ্ট গোলক। এত শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন অনেকেই সেটা নেয়ার জন্য চাতক পাখির মতো ওত পেতে চেয়ে আছে। আর ডান হাতে হাওয়াই মিঠাইয়ের লাঠি ধরে রাখা। পাটল রঙা ঠোঁটের ভাজে একই রঙের হাওয়াই মিঠাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। যেন তাদের আলাদা করা সর্বাধিক কঠিন কাজ। দীঘল কালো চুলগুলো মুক্তবাতাসে উড়ছে। সেই চুলের সুবাস হাওয়ায় ভেসে ফায়াজের নাকে বারি খাচ্ছে। পরীর আতিশয়্য দুরন্তপনা মিশ্রিত চোখ দুটো স্থির নেই। কোন এক ষোড়শী দস্যি কিশোরীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে বনে বাদাড়ে। এক আশ্চর্য বিকেলের পরিসমাপ্তি কালে দাঁড়িয়ে ফায়াজের হঠাৎ হাওয়াই মিঠাই খাওয়া যুবতীকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী উপাধিতে ভূষিত করতে ইচ্ছে করছে।
কিছু অবাদ্ধ অনুভূতি উকি মারতেই চোখ ফেরালো ফায়াজ। তবে সেটা স্বল্পকালের জন্য। ফায়াজের যুবক মন আজ বড্ড বেহায়া হলো। মস্তিষ্কের সঙ্গে অঘোষিত সংগ্রামে পরাজিত হয়ে ফায়াজ ফের তাকালো পরীর দিকে।
হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার দরূন পরীর ঠোঁটের চারপাশ আর হাত আঠালো হয়ে গেল। পরী প্রকাশ করতে পাড়ছে না তবে সে অসস্তিতে ভুগছে। ফায়াজ বিষয়টা খেয়াল করেছে। পরীর অব্যক্ত বর্ণ তার অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে। অর্ধেক পানি পূর্ণ বোতল থেকে পানি নিয়ে পরীর হাত আর মুখ ধুইয়ে টিস্যু দিয়ে মুছে দিল। পরীর ডান হাত পুনরায় জায়গা পেল ফায়াজের হাতের মুঠোয়।
মাগরিবের আজান দিচ্ছে। আমন্ত্রিত আধার নেমে আসতে শুরু করেছে মেলার বুকজুড়ে। মেলায় মানুষের ভীড় কমছে। আবহাওয়া শিতল হচ্ছে। আব্দুল্লাহ কোথা থেকে দ্রুত বেগে এসে বলল,
সাহেব আপনাদের জন্য বসার জায়গা করছি। গান বাজনা ঘন্টা খানেকের মইধ্যেই শুরু হইবো।
ফায়াজ অত্যন্ত বিনয়ী সুরে বলল,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে কিন্তু আমি থাকতে পারবো না।
আব্দুল্লাহ মনঃক্ষুণ্ণ হলো। মলিম মুখে জানতে চাইলো,
কেন সাহেব? গান বাজনায় থাকবেন না কেন?
পরী আর রেনুকার দিকে ইশারা করে ফায়াজ বলল,
আমি একা থাকলে অবশ্যই থেকে যেতাম কিন্তু সাথে ওরা আছে। আর রাস্তায় তেমন গাড়িও নেই। অন্ধকার হয়ে গেলে জঙ্গল পেরোনোটা কষ্টকর।
আব্দুল্লাহর মুখে ছেয়ে থাকা ঘন অন্ধকার কোথাও মিলিয়ে গেল। মলিন ঠোঁটে ফুটে উঠলো একগুচ্ছ স্বচ্ছ্ব হাসি। আব্দুল্লাহ পরম আনন্দিত সুরে বলল,
এই কথা? কোন সমস্যা নাই সাহেব। আমরা আপনেগোরে বাড়িত পৌছায় দিয়া আসমু। আপনে এইগুলা নিয়া কোন চিন্তা কইরেন না।
ফায়াজ দ্বিতীয় বারের মতো বাধা দিয়ে বলল, তবুও।
সাহেব কইলাম তো আমরা পৌঁছায় দিয়া আসমু। আপনেরা আসেন। সবার সামনে জায়গা রাখছি আপনেগো। আসেন।
আব্দুল্লাহ যেন আজ পণ করে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে। যে করেই হোক ফায়াজকে আজ গান বাজনা দেখাবেই। ফায়াজও আব্দুল্লাহর জেদ মেনে আব্দুল্লাহর পেছন পা বাড়ালো।
_______
মোটা কাপড়ে চারপাশ আবৃত। কাঠের বড় তক্তা দিয়ে মঞ্চ বানানো হয়েছে। তার উপর লাল কাপড় বিছিয়ে দেয়া। মঞ্চের অবশিষ্ট সাজসজ্জায় ব্যস্ত কিছু লোক। লাল রঙের বাতি গুলো ঝুলছে মঞ্চের ঠিক উপরে। মঞ্চের সামনে ঘাসের উপর লম্বা করে পাতা সাদা কাপড়। সেখানে সকলের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মঞ্চের ঠিক সামনে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা। ফায়াজ বুঝলো এগুলোতে তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফায়াজ পরীর হাত ধরে মঞ্চের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। রেনুকা ক্ষানিক দূরে ফোনে কথা বলছে। ফায়াজ চারপাশ দেখছে। তবে শুরু থেকে দলে দলে মানুষ আড়চোখে তাদের দেখে কানাঘুষা করেছে। ফায়াজ সবটাই লক্ষ করেছে।
শোন?
একজন বৃদ্ধকন্ঠ শুনে ফায়াজ পেছনে ফিরলো। তিন-চার জন একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। যিনি ফায়াজকে ডেকেছেন তিনি বাকিদের থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ, দুজনের বয়স মইনুর শেখের মতো। ফায়াজ ক্ষিন হেসে বলল,
জ্বি বলুন।
বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি বললেন,
তুমি বয়সে আমার থেকে ছোট তাই তুমি করে বললাম। তুমি মইনুর শেখের আত্মীয়?
জ্বি না। আমি তাদের বাড়ির মেহমান।
লোকটি সরু চোখে তাকালেন পরীর দিকে। পরী তখন মঞ্চের লাল কাপড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটি পরীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফায়াজের উপর ফেলল। গলার স্বর কিছুটা খাদে নামিয়ে বলল,
এই মেয়ে কি সুস্থ হয়ে গেছে? পাগলামি করে না এখন আর?
ফায়াজ বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল,
আমি আসার পর থেকে এখনও ওকে কোন পাগলামি করতে দেখি নি।
বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অর্ধবয়সী লোক বলল,
মনে হয় সুস্থ হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখায় কোন?
জ্বি না।
আর একজন বলে উঠলেন,
কথা বলতে পারে? কথা বলে?
না। তবে তাকে কেউ বিরক্ত না করলে সে আমাদের মতোই স্বাভাবিক থাকে।
বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি বেশ মনোযোগ দিয়ে ফায়াজের প্রতিটি কথা শুনেছে। প্রশ্ন উত্তর শেষে ফায়াজকে জিজ্ঞাস করলো,
তোমার নাম কি? কি করো?
আমার নাম ফায়াজ আহমেদ। পেশায় একজন লেখক।
হু ভালো। গান বাজনা দেখবা?
ফায়াজ মাথা নেড়ে বলল, জ্বি। আপনারা দেখবেন না?
ফায়াজের মনে হলো তিনি হাসলেন তবে সেটা ফায়াজের চোখে পরার আগেই মিলিয়ে গেল। বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি বিনা কারণেই শব্দ করে গলা পরিষ্কার করলেন। বললেন,
এসব দেখার বয়স কি আর আছে? এসব এখন তোমাদের দেখার বয়স।
ফায়াজ চুপ রইলো। তিনি আবার বললেন,
আমি কালাম মীর। কোন সমস্যা হলে আমাকে বলবে।
ফায়াজ হাসি টানলো।
জ্বি অবশ্যই। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।
মৃদু হাসলেন কালাম মীর।
চলবে…
®উম্মে কুমকুম
(আসসালামু আলাইকুম। ছোট করে দেয়ার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। বাসায় এসেছে একজন মহামান্য অতিথি। তার পেছনেই দিন রাত যাচ্ছে। হাতে অফুরান্ত সময় থাকার পড়েও লেখায় সময় দিতে পারছি না। তার সাথে লেগে থাকতেই ভালো লাগছে। )