#নীলকণ্ঠা
১৫।
সুঠাম দেহী এক যুবক। পড়নে নীল টিশার্টের উপর কালো জ্যাকেট আর জিন্স। চোখে রোদ চশমা। পেশিবহুল হাতে বাদামি রঙা চামড়ার ঘড়ি। কাঁধেচাপা কালো ব্যাগ। ফায়াজ যুবককে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালো। যুবক তার চোখের রোদ চশমাটা খুলে ঠোঁটে ছটাক ভোর হাসি টানলো। ফায়াজের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল,
হেই, আমি শ্রাবণ। তুমি?
ফায়াজ তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো শ্রাবণের দিকে। স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
কে আপনি?
নেফিউ।
ফায়াজ ভ্রু কুচকালো। মানে?
শ্রাবণ ঠোঁট গোল করে আশেপাশে চোখ ঘুড়িয়ে তর্জনী দিয়ে দাড়ি চুলকে বলল,
বোনের ছেলে। মইনুর শেখ আমার বড় মামা।
শ্রাবণের সাক্ষাৎকারে ফায়াজ বেশ একটা খুশি হলো না। খুশি না হওয়ার প্রথম কারণ সে মইনুর শেখের আত্মীয় এবং দ্বিতীয় কারণ হয়তো শ্রাবণ দেখতে ফায়াজের চেয়ে সুদর্শন। মানব জাতির ক্ষেত্রে বিষয়টি স্বাভাবিক যে তারা নিজের চেয়ে অধিক সুদর্শন, বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এবং অধিক গুণাবলীসম্পন্ন কাউকে পছন্দ করে না। ফায়াজ ছোট শ্বাস ফেলে বলল,
আমি ফায়াজ।
শ্রাবণ এবার আর হাত বাড়ালো না। কাঁধে পড়ে থাকা ব্যাগের একপ্রান্ত হাল্কা উঁচিয়ে ফের কাঁধেচাপা দিয়ে বলল,
নাইচ টু মিট ইউ।
ফায়াজ সামান্য হাসলো মাত্র। শ্রাবণ দরজা দেখিয়ে বলল, মে আই?
ফায়াজ দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো।
_______
পুরোটা সময় ফায়াজের বিরক্ত লাগছে। শ্রাবণকে তার অসহ্য লাগছে। নিজের কাজে মনোযোগী হতে পারছে না ফায়াজ। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে কিছু কদম পেরুতেই শ্রাবণের দেখা মেললো। তবে অন্য ভাবে। পরীর আগের বদ্ধ ঘরের দরজায় উকি মারছে সে। ফায়াজ ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত চাপলো। নিঃশব্দে আরো কিছু কদম এগিয়ে গম্ভীর রাশভারী কন্ঠে বলল,
এখানে কি করছেন মিস্টার শ্রাবণ?
হঠাৎ কোন গম্ভীর কন্ঠে চমকে উঠলো শ্রাবণ। পেছনে ফিরে ফায়াজকে দেখে বিভ্রান্তিতে পরে গেল। চোরের মতো এদিক সেদিক তাকিয়ে ফায়াজের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
আরে ফায়াজ। তুমি এখানে?
এতে ফায়াজের মনোভাবের পরিবর্তন হলো না। সে নিজের গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি ফেলে রাখলো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ কিছুটা উকশুক করলো তবে কিছু বললো না। ফায়াজ বলল,
প্রশ্নটা আগে আমি করেছি। আপনি কি করছেন এখানে?
শ্রাবণ আমতা আমতা করে মাথার পেছনে চুলকে বলল,
ইয়ে মানে এমনি কিছু করছিলাম না।
ফায়াজকে দেখে মনে হলো তার কাছে শ্রাবণের কথাটা পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস অযোগ্য। ফায়াজ তার দৃষ্টি সরিয়ে পেছন ফিরে পা বাড়াতেই শ্রাবণ পিছ ডেকে জিজ্ঞাস করল,
ইয়ে, পরী কোথায়?
ফায়াজ ফিরে তাকালো। শ্রাবণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল,
পরী নিজের ঘরে।
শ্রাবণ সত্বর বলল, দেখলাম না তো।
তবে শ্রাবণের কথা ফায়াজের কানে গেল না। ততক্ষণে সে শ্রাবণের দৃষ্টির বাহিরে চলে গিয়েছে। শ্রাবণ চেয়ে আছে ফায়াজের যাওয়ার দিকে। ভাবছে লোকটা এমন গম্ভীর নিরস কেন? শ্রাবণ সেখান থেকে সরে যেতে নিলেই রেনুকার সঙ্গে দেখা। শ্রাবণকে দেখে রেনুকা বিস্তর হাসলো। শ্রাবণ এগিয়ে যেয়ে মিনমিনে বলল,
তোমার নাম যেন কি? ভুলে গেছি। রেবু, রেবুক
শ্রাবণকে থামিয়ে রেনুকা বলল,
আমার নাম রেনুকা। তবে আপনি রেনু বলে ডাকতে পারেন।
ওহ সরি সরি রেনুকা। খুব সুন্দর নাম। বাই দ্য ওয়ে, তোমাকে যে তুমি সম্বোধন করছি এতে তুমি রাগ করছো না তো?
রেনুকা হেসে দিল।
না রাগ করি নি। বরং আপনি সম্বোধন করলে অখুশি হতাম।
শ্রাবণ বুকে হাত চেপে বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
বাঁচালে।
রেনুকা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। শ্রাবণ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
ওহ একটা কথা জিজ্ঞাস করব?
জ্বি বলুন।
শ্রাবণ আঙ্গুল নাড়িয়ে বলল,
নো নো আপনি নয়। যেহেতু আমি তুমি করে বলছি তাই তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।
রেনুকা চোখ নামিয়ে হেসে মাথা নাড়ালো। ফায়াজ বলল,
আসার পর থেকে পরীকে দেখলাম না যে। ও কোথায়?
পরীর কথা শুনে রেনুকার হাসি নিভে গেল। মুখশ্রী হয়ে গেল অন্ধকারাবৃত।
_______
আমি পরীকে ওর মায়ের ছবি দেখিয়েছি।
বলিস কি? পরী কি চিনতে পেরেছে? ফোনের ওপাশ থেকে রাফসানের কৌতুহলী কন্ঠ।
সম্ভাবত হ্যা। আজ আবার দেখাবো।
ছবি দেখে ওর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
অদ্ভুত। কান্না করছিল, পাগলামি করছিল, নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলার মতো টেনে ধরেছিল। শান্ত করতে একটু কষ্ট হয়েছে।
ফোনের ওপাশ থেকে রাফসানের নিশ্বাসের শব্দ এলো। রাফসান বলল,
ওষুধ গুলো চালাচ্ছিস?
হ্যা।
সেগুলো চলতে থাক আর ওর আচরনে কোন পরিবর্তন?
অনেক পরিবর্তন এবং কথা হলো সেগুলো সেগুলো পজিটিভ।
বাহ! খুব ভালো। তাহলে তো বলা যাচ্ছে তোর কাজ প্রশংসনীয়।
ফায়াজ নিরবে হাসলো। বলল,
আমি দ্রুত আমার কাজটা সম্পন্ন করতে চাই।
কোন কাজ?
ফায়াজ কিছুটা চুপ থেকে বলল,
পরীকে সুস্থ্য জীবনে ফিরিয়ে নেয়া।
ওহ হ্যা। আচ্ছা তুই চেষ্টা করে যা। লাগলে আমাকে বলবি।
ফায়াজ মাথা নামিয়ে কপাল চুলকে বলল, হ্যা।
ধরণীতে আধার নেমেছে অনেক্ষন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বিশাল অম্বরে তাকালো ফায়াজ। সেখানে মস্ত বড় শশী দৃশ্যমান। নিগূঢ় দৃষ্টি ফেলতেই মনে হলো এ তো শশী না, যেন আনকোরা কারো হাতের পুড়ে যাওয়া এক রুটি। তবে শশী একা নয়। তাকে ঘিড়ে রয়েছে লক্ষাধিক নক্ষত্র। বসেছে খোশগল্পের আসর। ফায়াজ একহাত ভাজ করে তার উপর অন্য হাতের কনুই রেখে তর্জনী থুতনিতে আর বৃদ্ধাঙ্গুল গালে চেপে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ মাথা নামালো বাড়ির ভেতরের থেকে কোন কিছুর ভাঙ্গার আওয়াজে। ফায়াজ অতন্দ্র বাড়ির দিকে তাকালো। এরপর সেকেন্ড ব্যায় না করে ডৌড় লাগালো বাড়ির দিকে।
থামলো পরীর ঘরের দরজার সামনে। ফায়াজের ধারনা ঠিক হলো। পরীর ঘরেই ভাঙ্গচুর হয়েছে। মেঝেতে কাচের গ্লাসের ভাঙ্গা টুকরো গুলো বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। ফায়াজ মেঝে থেকে মাথা তুলে তাকালো। পরী ঘরের দুই দেয়ালের কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপছে আর তার ঠিক চার হাত দূরে শ্রাবণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মূহুর্ত্বে তার ঠিক কি করা উচিত সে বুঝতে পারছে না। ফায়াজকে দেখে সে আরো বিভ্রান্ত হলো। কয়েকটা ফাকা ঢোক গিললো। ফায়াজকে বুঝানোর চেষ্টা করে মুখ খুলতেই পরী তড়িঘড়ি করে ফায়াজের দিকে এগিয়ে এলো।
পরী সাবধান, কাঁচ। ফায়াজ আতঙ্কিত কন্ঠ।
তবে এতে কোন কাজ হলো না। এর আগেই পরীর খালি পা পরলো ভাঙ্গা কাঁচের উপর। কোণা বিধে গেল মোলায়েম পায়ের পাতায়। অসহ্য যন্ত্রণায় কেপে উঠলো আপাদমস্তক, কুঁকড়ে উঠলো কন্ঠনালী। পরী কেঁদে দিল শব্দ করে।
চলবে…
®উম্মে কুমকুম
(রিচেক হয় নি এবং ছোট হয়ে যাওয়ার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।)