#নীলকণ্ঠা
১৬।
পেটের উপর দু হাত তুলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে পরী। চোখ, মুখে ছিটেফোঁটা বিষণ্ণতার ছাপ। ডান পায়ে শুভ্র রঙা গজ পেচানো। দৃষ্টি মেঝেতে বসে ভাঙ্গা কাঁচ তোলারত আমেনার দিকে। আমেনা খুব সাবধানে ভাঙ্গা কাঁচের অংশ গুলো তুলছেন। তার কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। তার হতবুদ্ধি মনোভাবে তাকে ভীষণ বিচলিত দেখাচ্ছে। ক্ষানিকখন আগে ঘটে যাওয়া আকস্মিক অপ্রিয়কর ঘটনায় লজ্জিত সে।
বিছানার পাশে কঠোর মুখভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ। শ্রাবণকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় মাত্র। আমেনা ভাঙ্গা অংশ গুলো তুলে ভেজা কাপড়ে মেঝে মুছে উঠে দাঁড়ালো। ফায়াজ এগিয়ে যেয়ে বলল,
এগুলো রেখে আবার আসুন।
আমেনা মুখে কিছু বললেন না। কেবল মাথা নাড়ালেন। মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এলেন ঘরে। ফায়াজ শ্রাবণকে বলল,
বসার ঘরে আসুন শ্রাবণ।
শ্রাবণ নিজের সাফাই গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে বিনা অপরাধে কোন শাস্তি ভোগে প্রস্তুত নয়। বসার ঘরে যাওয়ার আগে এক পলক তাকালো পরীর দিকে। সে নত মুখে একহাতের আঙ্গুল দিয়ে অন্য হাতের আঙ্গুল খুঁটছে। এতে বেশ মনোযোগী সে। শ্রাবণ ভীষণ নিরবে এক তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
বসার ঘরে সোফার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ। কালো ট্রাউজারের পকেটে লোমশ হাতদুটি গুঁজে রাখা। গাম্ভীর্যতা চোখ থেকে ঠোঁট পর্যন্ত বিরাজমান। শ্রাবণ বসার ঘরে এসে দাঁড়াতেই ফায়াজ ভূমিকাবিহীন বলল,
সমস্যা কি আপনার?
ফায়াজের আকস্মিক প্রশ্নে থতমত খেল শ্রাবণ। প্রশ্নবোধক চাহুনিতে জিজ্ঞাস করল,
মানে?
ফায়াজ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
পরীর সাথে আপনার কি সমস্যা?
শ্রাবণ অসীম বিস্ময়ে বলল,
সমস্যা? তাও পরীর সাথে? পরীর সাথে কি সমস্যা থাকবে আমার? ও আমার মামাতো বোন।
ফায়াজ অসন্তোষে তাকালো। শ্রাবণ ফায়াজের মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করলো। দ্রুত সত্বর ফায়াজের দিকে কদম এগিয়ে বলল,
লুক, তুমি ভুল ভাবছো। আমি-আমি তোমাকে বলছি কি হয়েছে। আসলে আমি শুধু পরীর সাথে দেখা করতেই গিয়েছিলাম কিন্তু পরী আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে। জগ ফেলে দিয়েছে। এতে আমার কি দোষ তুমিই বলো।
আপনি যখন দেখেছেন পরী আপনাকে দেখে ভয় পাচ্ছে তাহলে আপনি সেখান থেকে চলে আসেন নি কেন?
শ্রাবণের বাক্য সম্পূর্ণ হতেই ফায়াজ গম্ভীর প্রশ্ন ছুড়লো।
আসলে আমি ওকে বুঝাতে চেয়েছিলাম আমি ওর ক্ষতি করবো না। আমি..শ্রাবণ নিজের সাফাই গাইতে যেয়ে হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
কিন্তু পরী তো সম্পূর্ণ সুস্থ্য না। তাহলে ওকে এভাবে খোলা মেলা রেখেছেন কেন?
কে বলেছে পরী সুস্থ্য না? ফায়াজের কন্ঠ উচ্চ এবং রাগান্বিত।
শ্রাবণের অবস্থা শোচনীয়। সে বুঝতে পাড়ছে না ফায়াজ কেন তার উপর এত রেগে আছে। ফায়াজ শ্রাবণকে বুঝতে পারছে না নাকি চাইছে না। শ্রাবণের সাথে ফায়াজের পরিচয়ের সূচনা থেকে গম্ভীর ভাবে কথা বলছে। কিন্তু ফায়াজ এমন করছে কেন? ফের ফায়াজের কন্ঠে শ্রাবণের ধ্যান ভাঙ্গলো।
আপনি পরীর থেকে দূরে থাকবেন।
ফায়াজের এহেম কথায় শ্রাবণকে অসন্তোষ, রুষ্ট দেখালো। শ্রাবণ কপালে তিনটি ভাজ ফেলে বলল,
কি বলতে চাচ্ছেন? আমি ওর থেকে দূরে থাকবো কেন? আমি ওর আত্মীয়, বরং আপনি পরিবারের বাহিরের।
শ্রাবণ কথা শেষ করা মাত্র তাকালো ফায়াজের দিকে। ফায়াজ কঠোর চোয়ালে পাকানো চোখে তাকিয়ে আছে। ফায়াজের মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। ফায়াজের এ রূপ দেকে ভড়কে গেল শ্রাবণ। তপ্ত পরিবেশকে হিম করার প্রয়াসে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো শ্রাবণ। বলল,
কুল ব্রো কুল। এভাবে রেগে যাচ্ছো কেন? আমি ওভাবে বলতে চাই নি। সরি ব্রো।
ফায়াজ চোখ নামালো। শ্রাবণ মুখ গোল করে একটা শ্বাস ফেললো।
_______
শ্রাবণ বিস্ময়ের আর এক দফা এগিয়ে গেল যখন দেখলো রাতের খাবারের জন্য পরী খাবার ঘরে এসেছে। মইনুর শেখের পাশের চেয়ারে শ্রাবণ বসে আছে। গভীর দৃষ্টি ফায়াজ আর পরীর দিকে। ফায়াজ নিজ দায়িত্বে যত্নপূর্বক খাইয়ে দিচ্ছে পরীকে। পরী এক লোকমা খাবার মুখে নিচ্ছে আর ফায়াজের শার্টের কোণা আঙ্গুলে পেঁচাচ্ছে আবার খুলছে। শ্রাবণ পুরো বিষয়গুলো ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করলো এবং সব শেষে তার মতামত হচ্ছে ফায়াজ বেশ ভালো ভাবেই পরীর সাথে মিশেছ। পরী যদি এ বাড়ির কারো সাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তাহলে সে হবে একমাত্র ফায়াজ।
_______
রাতের গভীরতা বাড়ছে। শুনশান, স্তব্ধীভূত বাড়িতে ঝিঝিপোকার ডাক ভীষণ শব্দ তুলছে। গ্রাম্যকোল জুড়ে আধারের ঘনঘটা। কারো কাটছে ঘুমে বা কারো কাটছে নির্ঘুমে। কারো জন্য আনন্দিত রাত আবার কারো জন্য বিষণ্ণবদন, কারো বা চলছে গোপন শলাপরামর্শ। যেমনটা চলছে এখন মইনুর শেখের ঘরে। মইনুর শেখ ধীর পায়ে হেটে বিছানায় যেয়ে বসলেন। অসলতা কাটিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
কেমন দেখলে?
মইনুর শেখের সামনে চেয়ারে বেশ আয়েশি ভঙ্গিমায় বসে আছে শ্রাবণ। চেয়ারের হাতলে কনুই চেপে হাতের উল্টো পিঠ থুতনিতে ঠেকানো। কিছুক্ষন কিছু একটা ভেবে সোজা হয়ে বসলো। দু হাত মালিশ করে একসাথে মুঠো করে বলল,
হ্যা দেখলাম। দেখলাম এবং বুঝলামও।
কেমন বুঝলে?
বুঝলাম জল গড়িয়েছে অনেক খানি, সাথে পরী আপনার হাতছাড়া হতে চললো বলে।
মইনুর শেখের সহজাত মুখশ্রী নিরংশু হয়ে যেতে নাম মাত্র সময় লাগলো। অন্ধকারাবৃত মুখশ্রী তুলে তিনি শ্রাবণের দিকে তাকালেন।
এখন কি করা যায়? মইনুর শেখের কন্ঠ অসহায়, অগতি শোনালো।
শ্রাবণ বড় একটা শ্বাস নিয়ে ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছাড়লো। থুঁতনি বৃদ্ধাঙ্গুলে চুলকে বলল,
পরী ফায়াজ আহমেদের সাথে খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। আপনি পরীকে বদ্ধ ঘরে রেখেছেন ফায়াজ আহমেদ তাকে মুক্ত করেছে। সমীকরণ অনুসারে পরীর অসজ্জিত মস্তিষ্ক বুঝে নিয়েছে ফায়াজ তার শুভাকাঙ্ক্ষী। এতে আপনার করণীয় একটাই সেটা হলো ফায়াজ আহমেদকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া এবং পরীর থেকে দূরে রাখা।
মইনুর শেখ গম্ভীর দৃষ্টিতে মেঝেতে তাকিয়ে আছেন। তিনটা পিঁপড়া মেঝেতে দৌড়াচ্ছে। কিছুক্ষন পর দুটো পিঁপড়া আলাদা হয়ে গেল। মইনুর শেখ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। শ্রাবণ মইনুর শেখের দৃষ্টি অনুসরণ করে মেঝেতে তাকালো। এরপর ফের তাকালো মইনুর শেখের দিকে। সূক্ষ্ম শব্দে ডাকলো, স্যার??
মইনুর শেখ মাথা তুললেন না। গভীর দৃষ্টি এখনও মেঝেতে দৌড়ানো পিঁপড়াগুলোর দিকে। শ্রাবণ ফের ডাকলো,
স্যার, শুনছেন।
মইনুর শেখ মাথা তুললেন। সরাসরি তাকালেন শ্রাবণের চোখের দিকে। ঠোঁটে চতুর হাসি টেনে বললেন,
শুনেছি, দেখেছি এবং বুঝেছি।
শ্রাবণ ভ্রু কুচকালো। জিজ্ঞাস করল,
মানে?
মইনুর শেখ শব্দ করে নিশ্বাস ফেললেন। বললেন,
পরীর সাথে ফায়াজ সহজ হয়েছে, বন্ধুত্ব করেছে, মিশেছে। ফায়াজ এগুলো পাড়লে শ্রাবণ পারবে না কেন?
কিছু বুঝতে পারছি না স্যার আপনার কথা।
ফায়াজ জানে তুমি আমার বোনের ছেলে। আমার আত্মীয়। পরীর আত্মীয়। পরীর মস্তিষ্কে ফায়াজ যে জায়গাটা করে নিয়েছে সে জায়গাটায় তুমি অস্তিত্ব ফলাবে। ফায়াজ পরীর মস্তিষ্ক থেকে দূরে সরে গেলে বাড়িও ছেড়ে দিবে।
কিন্তু এই কাজটা আমি কি করে করবো? আজ দেখলেন তো পরী আমাকে দেখে কেমন উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল।
সেটা সে ফায়াজকে দেখেও করেছিল। ইটের টুকরো ছুড়ে মেরেছিল। কিন্তু এখন দেখো।
তখন সে অসুস্থ্য ছিল। তবে আজ পরীকে যেমন দেখলাম সে এখন অনেকটাই সুস্থ্য।
পরীর মস্তিষ্ক অপরিণত। বাচ্চাদের সুলভ মন। তাকে ভোলানো বড় ব্যপার নয়। পরী তোমার হাতে মানে আমার হাতে। পরীকে কিছুতেই সুস্থ্য হতে দেয়া যাবে না। তোমার থেকে পরীকে ফের যেতে হবে অন্ধকারের বদ্ধ ঘরে।
ফায়াজ আহমেদ আজ আমাকে বলেছেন পরীর থেকে দূরে থাকতে।
তুমি কি বললে?
ইয়ে, মানে বলেছি দূরে থাকবো না।
তাহলে তো হয়েই গেল।
শ্রাবণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞাস করল,
ফায়াজ যদি কিছু করে?
সেটা পরের ব্যপার। তুমি আগে সক্ষতা বাড়াও। এতে সাপ ও মরবে আর লাঠিও ভাঙ্গবে।
স্যার, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
বলো।
ফায়াজ আহমেদ যদি বাড়ি ছাড়তে না চান তাহলে আপনি পুলিশ কমপ্লেইন করছেন না কেন?
কারন আমি পরীকে দুনিয়ার সামনে আনতে চাই না।
শ্রাবণ আগ্রহী কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
কিন্তু কেন?
এসব পরেও জানতে পারবে। আগে যা তোমাকে করতে বললাম সেটা করো।
শ্রাবণ মাথা নামালো। নত মুখেই জিজ্ঞাস করল,
পরীর সাথে সক্ষতা বাড়াতে আমাকে কি করতে হবে?
শ্রাবণের প্রশ্ন পাল্লা শেষ হতেই দমকা হওয়ায় জানালার কাঠের পাল্লা শব্দ করে খুলে গেল। শ্রাবণ ও মইনুর শেখ দুজনেই জানালায় তাকালো। মইনুর শেখ উঠে দাঁড়ালেন। কদম বাড়ালেন জানালার দিকে। বাহিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হিম শিতল বাতাস বইছে। রাত্রির কোন এক ক্ষনে হয়তো শুরু হবে বর্ষনের অঘোষিত তাণ্ডবলীলা। সেই তাণ্ডবলীলায় গা ভেজাবে পরিবেশ।
মইনুর শেখ শক্ত হাতে জানালার পাল্লা টেনে ধরনেই। জানালার কপাট লাগিয়ে পেছন ফিরে তাকালেন। বললেন,
এ বাড়িতে পরীর পছন্দের জায়গা পুকুরঘাট।
চলবে…
®উম্মে কুমকুম