#নীলকণ্ঠা
১৭।
সকাল থেকেই ফায়াজ পরীকে খোঁজার অভিযানে নেমেছে। বাড়ির প্রতিটি ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে হয়রান ফায়াজ। মনের মধ্যে অপ্রকাশিত শঙ্কা উকি দিচ্ছে। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ। হৃদস্পন্দন ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। মনের মাঝে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কোথায় গেলো পরী?
আজ ফায়াজের ঘুম ভেঙ্গেছে ভোরে। গ্রামে শীত শীত ভাব এসেছে। আবছা হিম জড়িয়ে রেখেছে গ্রামটাকে। গায়ে চেক শার্ট জড়িয়ে বাহিরে পা রাখতেই দেখা মেললো অদূরে ঘোলাটে, নিরানন্দ, ঝাপ্সা প্রকৃতির। ঘোলাটে আকাশের মাঝে ডিম্ব রঙা ঈষৎ কমলা বর্নের অরূণ। চারদিকে তার আভা ছড়িয়ে। প্রকৃতির মাঝে এক বিশেষ মায়া আছে যা তার সৌন্দর্যময় রূপে জীবকুলকে আকৃষ্ট করে, তার মায়ায় টেনে ধরে। আঁকড়ে ধরে নিজের সাথে। অদূরের হরিদ্বর্ণ বৃক্ষপল্লবের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। ফায়াজ বিমোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন।
দুদিকে হাত মেলে অলসতা ঝেড়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে পা বাড়ালো ফায়াজ। দুহাতে মাথার চুল গুলো পেছনে ঠেলে সে এগিয়ে চললো। বেশি দূর যেতে পাড়লো না তার আগেই দেখা হলো দুজন যুবকের সাথে। তাদের একজনের হাতে বিশাল কাতল মাছ। ফায়াজ তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। এই রাস্তা ধরে শুধু মাত্র মইনুর শেখের বাড়ি যাওয়া যায়। তাহলে এরা কি মইনুর শেখের বাড়ি যাচ্ছে? ফায়াজ তাদের পরিচয় মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু পাড়লো না। ভাবলো হয়ত এর আগে দেখা হয় নি। ফায়াজ তাদের জন্য রাস্তা ছেড়ে পাশে দাঁড়ালো। রাস্তা খালি পেয়েও যুবক দুজন গেল না। দুজনই ফায়াজের দিকে তাকিয়ে উপরের পাটি দাঁত বের করে হাসলো। তারা কি ফায়াজকে চেনে? ফায়াজ চিন্তায় পড়ে গেল।
যুবক দুজন এগিয়ে এলো ফায়াজের দিকে। একজন জিজ্ঞাস করল,
আপনি ফায়াজ সাহেব না?
ফায়াজ দ্বিধাগ্রস্ত মাথা নাড়িয়ে বলল,
জ্বি। কিন্তু আপনাদের তো চিনতে পাড়লাম না।
পেছনের যুবক ফায়াজের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি বজায় রেখেই বলল,
স্যার আমার নাম ফিরোজ আর ও তারেক। আপনি আমাদেরকে চিনবেন না। কিন্তু আমরা চিনি।
ফায়াজ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালো। বলল,
কিভাবে?
আব্দুল্লাহ ভাইয়ের সাথে মেলায় দেখছিলাম। ওই যে গ্রামের মেলা?
জ্বি।
তারেক হাতের কাতল মাছটা উঁচু করে ধরলো। বড় বড় আঁইশে আবৃত কাতল মাছের লেজটা থেমে থেমে নড়ে উঠছে। কানকোর সাথে ছোট্ট একটা দড়ি পেচানো আর সেটা তারেক তর্জনী আর মধ্যমা দু আঙ্গওলে ধরে রেখেছে। তারেক দাতঁ বের করে হাসলো। সুপুরুষ বদনখানিতে উপরের পাটি দাঁত বের করা হাসিটা বড্ড বেমানান। ফায়াজ তারেকের হাসিটা হজম করে নিল। তারেক তার মুক্তদানার মতো চকচকে দাঁত ফাকা করে বলল,
সাহেব, এইটা আব্দুল্লাহ ভাইয়ের পুকুরের মাছ। আপনার জন্য পাঠাইয়া দিছে।
ফায়াজ বেশ অবাক হলো। আব্দুল্লাহ তার পুকুরের বড় মাছ তার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে? অবাকের সাথে সে মনে মনে খুশিও হলো। অধরযুগলে কোমল হাসি বুলিয়ে ভদ্রতার খাতিরে বলল,
এসবের কি প্রয়োজন ছিল? অযথাই কষ্ট করলেন আপনারা।
তারেক বোকা হাসি টানলো ঠোঁটে। সুর টেনে বলল,
কি যে বলেন সাহেব, আপনার জন্য কষ্ট করতে পাড়াটা সৌভাগ্যের।
ফায়াজ চোখ নামিয়ে হাসলো। ফিরোজ বলল,
আব্দুল্লাহ ভাই কত কথা বলে আপনার। আপনি অনেক ভালো মানুষ। কত্ত বড় লেখক। কত্ত বড় মনের মানুষ আপনি। সবার সাথে কি সুন্দর কথা বলেন।
নিজের প্রশংসা শুনে খানিকটা লজ্জা পেল ফায়াজ। ঘাড়ের পেছনটা চুলকে বলল,
এসব কে বলেছেন? আব্দুল্লাহ?
তারেক ও ফিরোজ দুজনেই হ্যা বোধক মাথা নাড়লো।
_______
আতর আলীর সামনে বিশালাকার মাছ দেখে এগিয়ে এলো শ্রাবণ। বিস্মিত নয়নে চেয়ে বলল,
ওয়াও আঙ্কেল! মাছটা তো অনেক বড়।
আতর আলি বটিতে ধার দিচ্ছে। শ্রাবণের কথায় খানিকটা হেসে বলল,
হ সাহেব।
প্রাইজ কত নিলো?
আতর আলি প্রাইজ মানে বুঝলো না। প্রশ্ন তুললো,
কি সাহেব?
শ্রাবণ আতর আলির পরিস্থিতি বুঝতে পারলো। বোকা হেসে বলল,
হেহে। সরি সরি। দাম, মানে দাম কত নিয়েছে মাছটার?
আতর আলি বটিতে ধার দিতে দিতে বলল,
আমি কিনি নাই সাহেব। আমাগো বাড়ি আর এক সাহেব আছে না? ওনারে দিছে আব্দুল্লাহ।
শ্রাবণ ভ্রু কুচকালো। আর এক সাহেব বলতে কি ফায়াজকে বুঝিয়েছে? তাহলে এই আব্দুল্লাহ কে? শ্রাবণ সরু দৃষ্টিতে তাকালো। জিজ্ঞাস করলো,
ঠিক বুঝলাম না।
আতর আলি বটি রেখে বলল,
ওই যে ফায়াজ সাহেব আছেন না? ওনার জন্য আব্দুল্লাহ পাঠায়ছে। ওর পুকুরের মাছ।
মিস্টার ফায়াজের জন্য?
আতর আলি মাথা ঝাঁকালো।
শ্রাবণ ফের প্রশ্ন করল,
এই আব্দুল্লাহ কে?
আমাগো গ্রামের। জঙ্গলের ওই পাড়ে রাস্তায় ওর চায়ের দোকান।
শ্রাবণ মাথা নাড়লো তবে জবাবে কিছু বললো না। পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে। গ্রামের একজন চা দোকানদার মাছ পাঠিয়েছে ফায়াজের জন্য? বেপারটা বড্ড আশ্চর্যজনক। গ্রামের মানুষের সাথে এত কিসের সখ্যতা ফায়াজের?
_______
তারেক ও ফিরোজকে বিদায় জানিয়ে নিজের ঘরে গেল ফায়াজ। ঘরে যাওয়ার আগে পরীকে এক নজর দেখে গিয়েছে। আমেনা পরীর চুল বেধে দিচ্ছিল। ফায়াজ ঘরে যেয়ে ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে এলো। দেয়াল ঘড়িটায় সাকালের আটটা বেজে নয় মিনিট। পরীকে নাস্তা খাওয়াতে হবে। বাদামী টিশার্ট পড়ে চুলে হাত চালাতে চালাতে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো ফায়াজ। অবাক হলো যখন পরীর ঘর খালি পেল। ঘরে না আছে পরী আর না আছে আমেনা।
ফায়াজের কপালে দুই ভাজ পড়লা। দ্রুত পদে এগিয়ে গেল বসার ঘরে। সেখানেও কেউ নেই। খাবার ঘরে যেতেই দেখা মিললো আমেনার। তিনি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছেন। ফায়াজের শরীর থেকে থেকে কাঁপছে। কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞাস করলো,
প-পরী কোথায়?
টেবিলে রুটির প্লেট রেখে আমেনা মাথার আচল টেনে নিলো। বলল,
ওর ঘরেই, সাহেব।
ঘরে তো নেই।
আমি তো ঘরেই বসিয়ে রেখে এসেছিলাম।
ফায়াজ বিচলিত হলো। ঘরে রেখে এসেছিল তাহলে কোথায় গেল? পরী তো একা কোথাও যায় না। তাহলে? আমেনা আরো কিছু জিজ্ঞাস করবে তার আগেই ফায়াজ প্রায় দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল। বাড়ির সব ঘর খুঁজেও পরীকে পাওয়া গেল না। ফায়াজের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সব ঘর খুঁজে ফের এলো বসার ঘরে সেখানে রেনুকাকে দেখে ফায়াজ এগিয়ে এলো। হাপাতে হাপাতে জিজ্ঞাস করলো,
পরী কোথায়?
রেনুকা গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ফায়াজ উচ্চ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি কিছু জিজ্ঞাস করছি।
রেনুকা ফায়াজের থেকে চোখ সরালো। গম্ভীর কন্ঠে জানি না বলে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল কিন্তু ফায়াজ রেনুকার কনুই চেপে ধরলো। পুরুষালী কঠোর হাতের মুঠোয় নিজের কনুই আবিষ্কার করতেই যন্ত্রণায় আতকে উঠলো। ফায়াজের দিকে তাকাতেই ফায়াজের কঠোর দৃষ্টি নজরে এলো। হাতের বেদনায় কুঁকড়ে এলো চোখ মুখ। কন্ঠনালী থেকে কম্পিত শব্দ উচ্চারিত হলো,
ছা- ছাড়ুন।
ফায়াজ রেনুকার কনুই চেপে রেনুকার দিকে এগিয়ে গেল। তর্জনী আঙ্গুল তুলে চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাতঁ চেপে বলল,
তোর জন্য পরীর যদি কিছু হয়। তাহলে আজই তোর শেষ দিন।
বিস্ময়ে রেনুকা যন্ত্রণা ভুলে গেল। ফায়াজ তার সাথে তুই তুকারি করছে? ফায়াজের হঠাৎ কি হলো যার কারনে এমন পাগলামি করছে? ঘর্মাক্ত মুখটা লাল হয়ে আছে ফায়াজের। কপালেত পাশে রগ ভেসে উঠেছে। চোয়াল শক্ত করে চেপে রাখা। ফায়াজকে হিংস্র দেখাচ্ছে। নিমিষেই সব ধ্বংস ফেলবে যেন। ফায়াজ রেনুকার কনুই ঝাঁকিয়ে বলল,
মনে রাখিস আমার কথা। ছাড়বো না তোকে।
বলে হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল রেনুকাকে। কয়েক কদম পিছিয়ে পড়ে যেতে যেতে সোফা ধরে ফেললো। কোন মতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কনুইয়ে মালিশ করতে লাগলো। ফায়াজ সেখানে আর দাঁড়ালো না। ফায়াজ যখন উন্মাদ প্রায় তখন বাড়ির বাহির থেকে আমেনার কন্ঠ এলো।
সাহেব, পরী মায়ে এইখানে।
ফায়াজ দ্রুত দৌড়ে বাহিরে গেল। আমেনার কন্ঠ অনুসরণ করে পুকুর পাড়ে যেয়ে পৌঁছালো। দুহাটুতে হাত রেখে ঝুকে নিশ্বাস ছাড়লো। ঘর্মাক্ত শরীরে টিশার্ট মিশে আছে। ঘর্মাক্ত কপাল হাতের উল্টা পিঠে মুছে উঠে দাঁড়ালো। পরী পুকুর ঘাটে বসে আছে। বড় চুলের বেনুনী মেরুদণ্ড ছেয়ে কটিদেশে এসেছে। হালকা গোলাপি রঙা ফ্রক পরিহিত পরীর নিষ্পাপ আখিদ্বয়ের দৃষ্টি পুকুর জলে। পরীর ঠিক পাশে বসে আছে শ্রাবণ। পরীকে দেখে ফায়াজ যতটা সস্তি পেয়েছিল, পরীর পাশে শ্রাবণকে দেখে তার থেকে বেশি মেজাজ বিগড়ে গেল। নিজেকে শান্ত করে ফায়াজ কিছু কদম এগিয়ে পরীকে ডাকলো।
পরী।
ফায়াজের ডাক শুনতেই তৎক্ষণাৎ পরী পেছন ফিরে তাকালো। ঠোঁটে হাসি ফুটলো না তবুও মুখ দেখে মনে হচ্ছে ফায়াজের আগমনে সে খুশি হয়েছে। শ্রাবণের সঙ্গ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ফায়াজের পেটের কাছের টিশার্টের একাংশ মুঠো করে ধরলো। ফায়াজ মৃদু হাসলো। পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
এখানে কেন এসেছো পরী? আমি চিন্তা করছিলাম তো।
পরী কিছু বললো না শুধু চেয়ে রইলো। ফায়াজ পরীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
আমাকে না বলে কোথাও যাবে না আর। ঠিক আছে?
পরী পূর্বের ন্যায় নিরব। ফায়াজ আবার বলল,
এখন আমেনা খালার সাথে যাও। আমি আসছি। কেমন?
পরী মাথা নামিয়ে হাতের মুঠো থেকে ফায়াজের টিশার্ট ছেড়ে দিল। ফায়াজ আমেনাকে ইশারা করলে তিনি এসে পরীকে নিয়ে গেলেন। শ্রাবণের প্রতি অসীম ক্রোধ থাকা সত্ত্বেও ফায়াজ কিছুই বললো না। পেছন ফিরে চলে যেতে নিলেই শ্রাবণ ডাক দিল।
মিস্টার ফায়াজ, কিছু হয়েছে?
চলবে…
®উম্মে কুমকুম