#নীলকণ্ঠা
২১।
প্রবল বাতাস আর ধুলিকণা এসে ধাক্কা খাচ্ছে গাড়ির জানালার স্বচ্ছ কাঁচে। গ্রামের সরু পিচঢালা পথ দিয়ে চলছে গাড়ি। পিচঢালা পথের বামে ঘন অরন্য আর ডানে সবুজ মাঠ। অদূরে কুয়াশা আবৃত্ত ঘন গ্রাম বসতি নজরে আসছে। বিয়ে বাড়ি থেকে তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি পাঠানো হয়েছে। নয়ত একমাত্র যানবাহন বাস। এতে খুবই কষ্ট হয়ে যায়।
গাড়িতে পরীর পাশের জানালার কাচঁ নামানো। পরী ফায়াজের বাহুতে পিঠ ঠেকিয়ে কাঁধে মাথা হেলিয়ে একমনে বাহিরে তাকিয়ে আছে। সবকিছুকে পেছনে ঠেলে গাড়ি সামনে এগিয়ে চলছে। আর মাত্র ঘন্টাখানেকের পথ। বাতাসের প্রবলবেগে গাছের পাতা নড়ছে, জমিতে ফলানো শশ্য ক্ষেতে তরঙ্গ তুলছে।
ঋতু বদলের সাথে সাথে বদলিয়েছে গ্রামের রুপ ও লাবণ্য। অনেকক্ষন পরী একই ভাবে কাঁধে মাথা চেপে রাখায় ফায়াজের কাঁধ ঝিমঝিম করছে। বেশ অনেক্ষন পরীকে একই ভাবে বসে থাকতে দেখে ফায়াজ ভ্রু ভাজ করে তাকালো। পরীর মুখটা জানালার দিকে। ফায়াজ অন্য হাত পরীর কাঁধে রেখে পরীকে হাল্কা সুরে ডাকলো। কিন্তু পরীর সারা শব্দ পেল না। ফায়াজ এবার নড়লো। দুহাতে পরীর কাঁধ জড়িয়ে নিজের দিকে ফিরাতেই পরীর মাথা হেলে পড়লো ফায়াজের প্রশস্ত বুকে। ফায়াজ চেয়ে রইলো ঘুমন্ত পরীর দিকে। বাতাসের কারনে পরীর পরিপাটি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে দলা পাকিয়ে রয়েছে। মুখের উপরের ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে খুব যত্নে কানের পিঠে গুজে দিল ফায়াজ।
পরীর কাঁধ জড়িয়ে হাল্কা ঝুকে পরীর পাশের জানালার কাচঁ তুলে দিলো। সোজা হয়ে পরীর মাথা নিজের বক্ষে চেপে বসে রইলো।
_______
বড় প্রাচীর ঘেরা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো। গ্রামটা বেশ উন্নত। আসার সময় ফায়াজের অনেক পাকা বাড়ি চোখে পড়েছে। বাড়ির সামনে বড় গেইট বাধানো। ড্রাইভার পেছন ফিরে বলল,
স্যার, আইসা পরছি।
ফায়াজ বাড়িটা দেখছিল। ড্রাইভারের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্য হাসলো। পরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে গভীর ঘুমে। ফায়াজের গলার কাছের শার্ট পরীর মুঠোয় বন্দি। ফায়াজ পরীর কাঁধে হাত বুলিয়ে মৃদুভাবে ডাকলো। পরী শুনলো না। ফায়াজ ফের ডাকলো পরীকে। পরী এবার নড়ে উঠলো। ফায়াজ হালকা স্বরে বলল,
পরী, উঠে পরো। দেখো চলে এসেছি আমরা। পরী?
ফায়াজের ডাকে পরী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ফায়াজ হাসি দিয়ে পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
দেখো, এসে পড়েছি আমরা।
পরী ফায়াজের বুক থেকে মাথা তুলে চোখ কচলাতে কচলাতে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে হাত মেলে আড়মোড়া ভেঙ্গে দাঁড়ালো। ফায়াজ পরীর ওড়না ঠিক করতে করতে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করলো।
পরী ফায়াজের দিকে তাকিয়ে আবার বাহিরে আঙ্গল তুলে দেখালো। ফায়াজ পরীর ইশারা বুঝতে পেরে কানে ফোন রেখেই মাথা দুলিয়ে বলল,
এইতো নামবো একটু পর।
পরী আবার বাহিরের দিকে তাকালো। দু হাত গাড়ির কাচেঁ চেপে বাহিরে তাকিয়ে রইলো। ফায়াজ কানে ফোন রেখে বলল,
হ্যা, জয়। চলে এসেছি আমরা। বাহিরে আছি।
বলেই কল কেটে ফোনে সময় দেখলো। বেলা একটা বেজে ছয় মিনিট। ফোন পকেটে রাখতেই গাড়ির জানালার কাচেঁ খটখট আওয়াজ হলো। ফায়াজ তাকাতেই পরিচত মুখ দেখে প্রশস্ত হাসি টানলো। গাড়ি থেকে নেমে জড়িয়ে ধরলো। জয় ফায়াজের কাঁধে চাপড় মেরে বলল,
শেষমেশ পৌঁছাতে পারলি ব্যাটা।
ফায়াজ হেসে দিল। বলল, হ্যা।
জয় গাড়ির জানালায় উকি দিয়ে বলল,
ইয়ে, পরী কোথায়?
ফায়াজ সরে এসে গাড়ির দরজা খুললো। পরী ডাহুক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। ফায়াজ হালকা হেসে পরীকে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দাড় করালো। পরী চারপাশে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। জয় ফায়াজের দিকে তাকালো। এরপর ক্ষীণ শব্দে গলা পরিষ্কার করে পরীর দিকে ঝুকে দাঁড়ালো। সুরেলা কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
কেমন আছো পরী?
জয়কে এভাবে দেখেঝুকে তাকতে দেখে পরী ফায়াজের পেছনে যেয়ে দাঁড়ালো। জয় ক্ষানিকটা ইতস্তত বোধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ফায়াজের দিকে তাকাতে ফায়াজ বলল,
ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। প্রথমবার এমন ভায় পায়।
জয় এবার কিছুটা স্বাভাবিক হলো। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
আচ্ছা, চল ভেতরে। এরপর ড্রাইভারকে বলল,
জামাল ভাই, ব্যাগ গুলা বাড়িতে দিয়ে যান।
_______
বাড়িতে বিয়ের আমেজ। সারা বাড়িয়ে মানুষজনে ভরপুর। হৈ হৈ ড়ৈ ড়ৈ ব্যাপার। জয়ের আজ গায়ে হলুদ আগামীকাল বিয়ে। ফায়াজ জয়ের পেছন পেছন পরীর হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। উঠানে কিছু ছেলে মেয়ে ছুটাছুটি করে খেলছে। সবার পড়নে হলুদ রঙা জামা। জয় উঠানে দাঁড়ালো। জয়ের সাথে ফায়াজ আর পরীও দাঁড়ালো। জয় একজন বৃদ্ধাকে বলল,
মা, দেখ। ও ফায়াজ আর ও পরী।
বৃদ্ধা ফায়াজ আর পরীকে দেখে অমায়িক হাসলেন। সাদা কাপড়ে রূপালি সুতার কাজ। মাথায় আচল টানা, চোখে বড় ফ্রেমের চশমা। ফায়াজ এগিয়ে যেয়ে সালাম দিল। জয়ের মা সালামের উত্তর দিয়ে হাসি বজায় রেখে বললেন,
ভালো আছো? তোমাদের কথা জয় বলেছে।
ফায়াজ হাস্যজ্জল মুখে উত্তর দিল।
জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
আসতে অসুবিধা হয় নাই তো।
না না। কোন অসুবিধা হয় নি।
জয়ের মা মাথা নাড়িয়ে আড়চোখে পরীর দিকে তাকালেন। সভায় পরীর মন নেই। তার সামনে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেদিকেও তার মন নেই। সে ঘাড় বাকিয়ে অদূরে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ জয়ের মায়ের গতিবিধি লক্ষ করলো। ফায়াজের মনে হচ্ছে জয়ের মা পরীর সাথে কথা বলতে আগ্রহী। জয়ের মায়ের থেকে চোখ সরিয়ে ফায়াজ পরীর দিকে তাকালো। হালকা স্বরে ডেকে হাত ধরে সামনে টানলো। পরী দু কদম এগিয়ে দাঁড়ালো। ফায়াজ জয়ের মায়ের দিকে ইশারা করে পরীকে বলল,
পরী, দেখো ইনি তোমার আন্টি হয়।
পরী আন্টি মানে বুঝলো না। অবুঝ চোখে তাকালো জয়ের মায়ের দিকে। জয়ের মা লম্বা হেসে জিজ্ঞাস করলেন,
ভালো আছো মা?
পরী এখনও তাকিয়ে আছে। জয়ের মা কিছুক্ষন তাকিয়ে বিভ্রান্ত হলো। উকশুক করতে লাগলেন। পরী এখনও উত্তর দেয় নি। জয় গলা খেঁকারি দিয়ে বলল,
ইয়ে মা, ওরা জার্নি করে এসেছে। ফ্রেস হয়ে একটু রেস্ট নেক।
জয়ের মা ছেলের দিকে তাকালেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,
হ্যা হ্যা। ফায়াজ তোমরা যাও গোসল করে নাও।
জয় বলল, হ্যা চল। তোদের ঘর দেখিয়ে দেই।
ফায়াজ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে জয়ের সাথে পা বাড়াতেই সেখানে উপস্থিত হলেন জয়ের মামি নাসিমা বেগম। বাড়িতে নতুন দুখানা মুখ দেখে এগিয়ে এলেন। জয়কে জিজ্ঞাস করলেন,
কারা রে, জয়?
মামি, ও ফায়াজ আমার বন্ধু আর ও পরী।
নাসিমা বেগম মাথা বাকিয়ে পানের পিক ফেলে বাকি রস শব্দ করে টেনে দাতঁ বের করে হাসলেন। পানের রসে লাল হয়ে যাওয়া দাঁতগুলো বের হয়ে রইলো।ফায়াজ সৌজন্য হেসে সালাম দিল। নাসিমা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
ঢাকা থেইকা আসছো?
না, আদুরীগাঁও থেকে।
নাসিমা বেগম ভ্রু কুঁচকালেন। মনে করার চেষ্টার আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। এরপর পান চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞাস করলেন, এইটা কই?
এইতো মামি দুই এক গ্রাম পরে। জয় বলে উঠলো।
নাসিমা বেগম পানের রস গিলে বলল, ওহ। এরপর তাকালেন পরীর দিকে। পরী নাসিমা বেগমের ফেলা পানের লাল পিকের দিকে তাকিয়ে আছে। নাসিমা বেগম পরীর দিকে ইশারা করে ফায়াজকে জিজ্ঞাস করলেন,
ও তোমার বউ?
নাসিমা বেগমের আকস্মিক প্রশ্নে চমকে উঠলো ফায়াজ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উত্তর দেয়ার মতো কিছু খুঁজে পেল না। তবে নাসিমা বেগম এখনও ফায়াজের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। ফায়াজ কিছুক্ষন ইতস্ততভাবে এদিক সেদিক তাকিয়ে উত্তর দেয়ার জন্য মুখ খুলতেই উঠানে ছুটাছুটি করা বাচ্চাদের মধ্যে একজনের ধাক্কায় পরী মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল। ফায়াজের হাতের মুঠো থেকে পরীর হাত ছুটে গেল। নিদারুণ পীড়ায় আঁৎকে উঠলো পরী। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল নিঃশব্দে। একটা অঘটনীয় ঘটনা ঘটে গেছে বুঝেই বাচ্চারা দৌড়ে চোখের বাহিরে চলে গেল। নাসিমা বেগম সেদিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
ওই, চোখে হুলি পরছে তোগো? চোক্ষে দেখোস না? মাইনষের গায়ের উপড়ে পড়ছ।
ফায়াজ ব্যস্ত হয়ে পরীকে মাটি থেকে তুললো। পরী ঠোঁট উল্টে কেঁদেই চলছে। ফায়াজ পরীর হাতে পায়ের মাটি ঝেড়ে বলল,
ব্যথা পেয়েছো পরী? কোথায় পেয়েছো? পরী?
পরী নিঃশব্দে কাঁদতে ব্যস্ত। জয় লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
সরি রে। ও মনে হয় হাতে ব্যথা পেয়েছে। ওকে ঘরে নিয়ে চল। আয়।
ফায়াজ পরীর কাঁধ জড়িয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। জয়ের মা ও নাসিমা বেগম সেখানে দাঁড়িয়েই তাকিয়ে রইলেন। তিনজন চোখের বাহিরে গেলে নাসিমা বেগম ঘাড় বাকিয়ে পানের পিক ফেললেন। জয়ের মায়ের কাছঘেঁষে দাঁড়িয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
মাইয়াটা কেমন জানি। না?
জয়ের মা চুপ করে তাকিয়ে রইলেন শুধু।
_______
জয়ের কথা সত্যি হলো। পরী ডান হাতে ব্যথা পেয়েছে। হাত ছিলে লাল লাল হয়ে আছে। পরীর কান্না থেমে গেছে। সে চুপ করে বসে ফায়াজকে দেখছে। ফায়াজ পরীর হাতে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে হালকা করে ফু দিয়ে চলছে। ফায়াজ এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে পরীর দিকে তাকালো। পরীর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওর মনটা ভিশনভাবে খারাপ। বাড়িতে এসেই এমন অপ্রিয়কর ঘটনা ঘটে গেল। ফায়াজ বেশ গোপনে একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো পরীর সামনে থেকে। তুলা আর এন্টিসেপ্টিক বিছানার পাশের টেবিলে রাখতেই দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। ফায়াজ এন্টিসেপ্টিক রেখে পেছন ফিরে তাকালো। উঁচু স্বরে জিজ্ঞাস করলো, কে?
দরজার বাহির থেকে মেয়েলী কন্ঠ ভেসে এলো।
ভাইয়া আমি যুতি। জয় ভাইয়ার ছোট বোন।
দরজা খোলা। আসো।
ফায়াজ পরীকে গোসল করিয়ে দেয়ার জন্য কাউকে ডাকতে বলেছিল। জয় তাই তার ছোট বোন যুথিকে পাঠিয়েছে। যুথি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ঘরে চোখ বুলিয়ে পরীকে বিষণ্ণবদন বিছানায় বসে থাকতে দেখলো। বিছানার পাশের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ। যুথি এগিয়ে যেয়ে বলল,
জয় ভাইয়া আসতে বলল।
হ্যা। তোমার সাহায্য লাগবে একটু।
যুথি সৌজন্য হেসে বলল,
জ্বি বলুন।
চলবে…
®উম্মে কুমকুম