#নীলকণ্ঠা
৩০|
উঠানের ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে ফায়াজের ব্যাগ। কুঁচকানো শার্ট নিয়ে ব্যাগের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ। তার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার সাথে যা যা হচ্ছে সে আগে থেকেই এসব বিষয়ে অবগত। ক্ষানিক বাদে কুঁচকে যাওয়া শার্টের জায়গা দুহাতের তালুতে সমান করার ব্যর্থ চেষ্টা করতেই মইনুর শেখের উচ্চ কন্ঠ এলো। তিনি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। রেনুকা দাঁড়িয়ে আছে তার কিছুটা পেছনে। মইনুর শেখ গলা উঁচিয়ে ফায়াজকে শাসিয়ে বললেন,
এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বের হবে তুমি। তোমার এত বড় কলিজা আমার সামনে আমার মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলো। কলিজা টে*নে ছিঁ*ড়ে কুকুরকে খাওয়াবো।
ফায়াজ হাসলো যেন কৌতুক শুনলো। তার হাসির অর্থ হলো মইনুর শেখের কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা। ফায়াজের কৌতুক করা হাসি আগুনের ঘি ঢালার মতো মইনুর শেখের ক্রোধ আরো বাড়িয়ে দিল। তিনি চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছেন। শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ হচ্ছে। ফায়াজ নিচু হয়ে ব্যাগ তুলে নিল। ব্যাগের ধুলা ঝেড়ে ব্যাগ কাঁধেচাপলো। মইনুর শেখের দিকে তাকিয়ে এক বুক সাহস নিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
পরীকে আমি নিয়ে যাবোই।
মইনুর শেখ দাতঁ কিড়মিড় করে দরজা ছেড়ে বের হতে নিলেই রেনুকা বাধা দিল। নিচু স্বরে বলল,
আর ঝামেলা করার দরকার নেই যেতে দিন ওনাকে। বললেই তো আর নিয়ে যেতে পারবে না।
মইনুর শেখ আড়চোখে তাকিয়ে রেনুকার কথা শুনলেন। এরপর ফায়াজের দিকে তাকালেন। সে ঠোঁটে হাসি বুলিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে। ফায়াজ চোখের বাহিরে যেতেই মইনুর শেখ শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলেন। তার রাগ কিছুটা কমেছে। তবে সে চিন্তিত ফায়াজ তাকে সরাসরি বলেছে সে পরীকে নিয়ে যাবে। ফায়াজকে এভাবে হালকায় নিলে চলবে না। মইনুর শেখকে চিন্তিতভাবে পুরোঘরে পায়চারি করতে দেখে রেনুকা এগিয়ে গেল। ধীর স্বরে বলল,
চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মইনুর শেখ ঠোঁটে চেপে পায়চারি করেই চলছেন, কোন থামাথামি নেই। পায়চারি করতে করতে বললেন,
না না। ফায়াজ বসে থাকবে না। এতদিন যে থেমে থাকে নি আজও থেমে থাকবে না। আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতেই হবে।
মইনুর শেখ আরো কিছুক্ষন পায়চারি করে শব্দ করে আরাম চেয়ারে হেলে বসলেন। চোখ বন্ধ করে মাথা হেলিয়ে দিলেন। কিছু একটা করতেই হবে। মইনুর শেখ নিজেকে শান্ত করে রেনুকাকে জিজ্ঞাস করলেন,
পরী কোথায়?
ঘরেই। রেনুকা ক্ষীণ শব্দে জবাব দিল।
ওকে ওর পুরোনো ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দাও। অনেক হয়েছে। অনেক মুক্ত থেকেছে।
রেনুকা তীর্যক ঠোঁটে হাসলো। মাথা নেড়ে বলল,
জ্বি।
রেনুকা চলে যেতেই মইনুর শেখ চোখ খুললেন। কল করলেন কাউকে। ফোন কানে রেখে বললেন,
ফায়াজকে ম*রতে হবে। যে করেই হোক।
ফোনের ওপাশের জবাবের অপেক্ষা না করে ফোন রেখে দিলেন। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ফেললেন।
_______
ঝিমিয়ে পড়া অপরাহ্ন। কোমল রৌদ্র পড়েছে বাড়ির অর্ধেক জুড়ে। হাওয়ায় শিতলতা অনুপস্থিত। তপ্ত হাওয়া বইছে। রঙ্গ করে হালকা ভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে গাছের পাতা। ফের লুকাচ্ছে অজানায়। পরী জানালায় মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মন ভালো নেই তার। ফায়াজের কাছে থাকতে তার ভালো লাগে। ফায়াজ পুকুর ঘাটে নিয়ে যায়, কত জায়গায় ঘুড়তে নিয়ে যায়। খাইয়ে দেয়, চুলে বেনুনী করে দেয়, মাথায় হাত বুলায়। পরীর এখন ফায়াজের কথা মনে পরছে। যেতে ইচ্ছে করতে তার কাছে।
পরী জানালা থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পড়নে গতকালকের জামা। এলোমেলো চুল। পরী ঘরের দরজার দিকে তাকালো। ফায়াজ কোন ঘরে আছে পরী জানে না। ফায়াজের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল বসার ঘরে। রেনুকা তাকে ঘরে রেখে গিয়েছিল। পরী ধীর পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে গেল দরজার দিকে। হঠাৎ রেনুকাকে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। রেনুকা ভ্রু কুঁচকে পরীকে পর্যবেক্ষণ করছে। পরীকে হঠাৎ দেখে এখন আর মানসিক রোগী মনে হয় না। আগের মতো মাথা নাড়ায় না, নিজ মনে বিরবির করে না।
রেনুকা পরীর দিকে এগিয়ে এসে তীক্ষ্ম কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
কোথায় যাচ্ছিলি?
পরী জবাব দিল না। রেনুকার থেকে কিছুটা সরে দাড়ালো। রেনুকা ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। নিমজ্জিত কন্ঠে বলল,
ঢং ছুটাচ্ছি।
পরীর কাছে যেয়ে হুট করে পরীর বাহু চেপে ধরলো। অঙ্গচ্ছেদের মতো যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল পরী। পুরোনো বেদনাদায়ক যন্ত্রণা নতুন করে অনুভূত হচ্ছে। রেনুকার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছোটাছুটি করছে কিন্তু রেনুকার শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। রেনুকা পরীর বাহু আরো শক্ত করে থাবায় ধরে বলল,
এমন করলেই ছাড়া পাবি? অনেক মুক্ত থেকেছিস এবার নিজের ঘরে যাওয়ার সময় এসে গেছে চল।
পরীর বাহু চেপে এগিয়ে চলল রেনুকা। ব্যথায় কেঁদে দিল পরী। ঘর থেকে বেড়িয়ে কিছুটা যেতেই গলা উঁচিয়ে ফায়াজকে ডাকলো। হঠাৎ পরীর এভাবে ডাকে থমকে দাঁড়ালো রেনুকা। আশ্চর্য হয়ে তাকালো পরীর দিকে। কাঁদার ফলে পরীর নাক, মুখ লাল হয়ে আছে। এলোমেলো চুল গুলো গালের সাথে লেপ্টে আছে। রেনুকার বিশ্বাস হচ্ছে না পরী ফায়াজকে ডাকছে। পরী আবার গলা উঁচিয়ে ফায়াজকে ডাকলো। রেনুকা পরীর ডাক অগ্রাহ্য করে টেনে নিয়ে গেল বদ্ধ ঘরটায়। পরী নিজেকে ছাড়ানোর জন্য রেনুকার হাত খামছে ধরলো। উফ শব্দ করে রেনুকা পরীর বাহু ছেড়ে হাত ঝাড়তে লাগলো। হাতের পিঠে নখের দাগ বসে গেছে। রেনুকা আঁচড়ের উপর কয়েকবার হাত বুলিয়ে পরীর দিকে তাকালো। কটমট চোখে তাকিয়ে বলল,
সাহস বেশি হয়ে গেছে না? চল তুই। রেনুকা পরীর চুলের গোড়া চেপে ধরলো। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো পরী। রেনুকা চুলের মুঠি চেপে পরীকে বদ্ধ ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। আমেনা রান্নাঘরে ছিল।পরীর চিৎকার শুনে এক প্রকার ডৌড়ে এলো। রেনুকার কাছে অনুনয় করে বলল,
পরী মায়েরে এই ঘরে রাখছেন কেন? ছাইড়া দেন।
রেনুকা আমেনাকে একটা ধমক দিয়ে বলল,
চুপ। একদম চুপ। ওই লোককে দেখে নিজের অবস্থান ভুলে গেছিলে না? নিজেকে বাড়ির মালিক মনে হয়েছিল?
পরী ভেতর থেকে দরজায় বারি দিচ্ছে। আমেনার চোখে জল চলে এলো। রেনুকা আমেনার দিকে একপলক তাকিয়ে যাওয়ার আগে বলল,
যদি দরজা খুলেছো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।
আমেনা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ মুখে দরজার দিকে তাকালেন। তার যে এসব দেখা ছাড়া কিছুই করারা নেই।
_______
গোধুলি লগ্ন। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে বাড়ি ফেরার পালা। আধার নামছে ধীরে ধীরে। আমির আলি বাড়ি ফেরার পথে একজনের থেকে শুনলেন আব্দুল্লাহর বাড়িতে মানুষ ভীড় জমিয়েছে। আমির আলির আগ্রহ হলো তাই তিনিও দেখতে গেলেন ঘটনা আসলে কি ঘটছে। টিউবওয়েল থেকে পা ধুয়ে আমির আলি আব্দুল্লার ঘরের দিকে গেলেন। সত্যিকার অর্থেই সেখানে মানুষের ভীড় ছিল। ভীড় ঠেলে আমির আলি ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। একজন যুবককে ঘিরে জনসমাগম। যুবককে আমির আলি চেনে না। এর আগে দেখেনও নি। আব্দুল্লাহর বসার ঘরে একপাশে একটা বিছানা আর তার পাশে বড় পড়ার টেবিল। বিছানায় বসে আছেন কালাম মীর। তার পাশে বসেছে সেই যুবক। কালাম মীর যেহেতু এখানে উপস্থিত নিশ্চিত বিরাট কোন ঘটনা ঘটেছে। আমির আলি বাকিদের মতোই দাঁড়িয়ে রইলেন ঘটনা বুঝতে।
আব্দুল্লাহ বলল,
ওই মইনুর শেখ জীবনেও ভালো হইবো না। বদলোক একটা।
কালাম মীর ফায়াজের কাছে জানতে চাইলেন,
এখন কি করবে ভাবছো?
ফায়াজ দুহাটুতে দুই কনুই রেখে নিচু হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। কালাম মীরের কথা নিশ্বাস ফেলে বলল,
আমি পরীকে ওই বাড়ি থেকে বের করে আনতে চাই। মইনুর শেখ ওকে বাঁচতে দিবে না।
ফায়াজের কথার সুর ধরে আরেকজন জিজ্ঞাস করল,
কিন্তু কেমনে?
ফায়াজ মাথা তুলে তাকালো। কালাম মীর এবং বাকিদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
এই কাজ আমার একার পক্ষে সম্ভব না। আপনাদের সাহায্য লাগবে।
একজন বয়স্ক লোক বললেন,
মইনুর শেখরে আমরা সবাই চিনি। হেয় লোক ভালা না। মানুষরে মানুষ মনে করে না। হের লেইজ্ঞা আমাগো মনে যেই ক্ষোভ আছে হেইডা আমরা কোন দিন বাইর করতে পারি নাই কারন তোমার লাহান কেউ হের বিপক্ষে খাড়ায় নাই। এহন তুমি আইছো, তোমার লগে আমরা সবাই আছি।
আব্দুল্লার ছোট ভাই বলল,
চাচা, ঠিক বলছে। সাহেব, খালি বলেন কি করতে হবে।
_______
জাফর, পরীকে আগামীকাল সকালের মধ্যে ঢাকায় নেয়ার ব্যবস্থা করো।
জাফর আগ্রহী কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
হঠাৎ ঢাকায়?
ফায়াজ ছেলেটা এখনও গ্রামে। আমি তার কিছুই করতে পারছি না। পরীকে এখানে রাখাটা বিপদজনক। আমি চাই না এই যাত্রায় ফায়াজ জিতে যাক।
জাফর ক্ষানিকখন চিন্তা করে প্রশ্ন করল,
কিন্তু ভাইজান, পরীকে এখানে রাখবেন কোথায়?
সেটা আমি ভেবে রেখেছি। তোমার কাজ শুধু সব বন্দোবস্ত করা। বুঝতে পেরেছো?
ফোনের ওপাশ থেকেই জাফর মাথা নাড়ালো। সম্মতিসুরে বলল,
জ্বি ভাইজান।
মইনুর শেখ ফোন রেখে দিলেন। মনটা কিছুটা হালকা হয়েছে যেন কেন যেন বেশ উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছে। তার পরিকল্পনা মাফিক সব হয়ে গেলেই নিশ্চিত সে। চেয়ারে বসে বড় বড় শ্বাস ফেলে রেনুকাকে ডেকে বললেন,
পরী ব্যাগ গোছায়। আগামীকাল ঢাকা পাঠিয়ে দিব।
চলবে…
®উম্মে কুমকুম