#নীলকণ্ঠা
৩৪|
সোফিয়া, কুপিতে তেল ভরে আন। তোর আব্বা নামাজ শেষ কইরা এখই আসবো।
সোফিয়া তেলশূন্য কুপিটা বিছানার নিচ থেকে বের করে আনলো। জুলেখা বেগম বিছানায় শুয়ে তালপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। ভ্যাপসা গরমে চারপাশ কেমন তেতে আছে! ঘর্ম বিহীন গরম। সোফিয়াকে কুপি হাতে যেতে দেখে জুলেখা বেগম বাধ সাধলেন।
হারিকেন নিয়া যা। আন্ধারে তেল ভরবি কেমনে?
সোফিয়া হারিকেন আর কুপি নিয়ে বসার ঘরে গেল। সোফিয়া যেতেই ঘরটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। খাবার টেবিলের পাশে একটা প্লাস্টিকের বোতলে কেরোসিন তেল। সোফিয়া কেরোসিন তেল কুপিতে ভরে আগুল জ্বালালো। অন্ধকার ক্ষিণ হয়ে কোমল আলোয় ভরে উঠলো ঘর। হারিকেনের আলো কমিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সোফিয়া বাবার কন্ঠ পেল। হামিদ মিয়া এশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরেছেন। বাহির থেকে গলা উঁচিয়ে ডাক দিলেন।
সোফিয়ার মা, দরজা খোল।
সোফিয়া গিয়ে দরজা খুলে দিল। চারপাশ ভারী অন্ধকারের চাদরে মুড়ে আছে। ঝিঝিপোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। হামিদ মিয়ার হাতে ছোট আকারের ব্যাটারির টর্চ। হামিদ মিয়া টর্চ বন্ধ করে ঘরে ঢুকে মাথা থেকে টুপি খুললেন। জিজ্ঞাস করলেন,
তোর মা কই?
ঘরে। ছোট শব্দে জবাব দিল সোফিয়া।
হামিদ মিয়া হারিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। স্বামীকে দেখে জুলেখা বেগম শোয়া থেকে উঠে বসলেন। মাথায় আচল টেনে বললেন,
ভাত খাইবেন এখন? দিব?
হামিদ মিয়া দরজার পাশে মেঝেতে হারিকেন রেখে বিছানায় স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসলেন। হাতের টর্চ আর টুপি পাশে রেখে ধীরে সুস্থে খানিকটা শান্ত স্বরে বললেন,
একটু পরে দাও। তোমার লগে কথা আছে।
কি কথা?
হারিকেনের শিখায় জুলেখা বেগমের মুখের একপাশ চকচক করছে। সেই আলোতে হামিদ মিয়া স্ত্রীর চোখ মুখে কৌতুহল দেখলেন। মাথা নামিয়ে ঠোঁট টেনে হাসলেন তিনি। জুলেখা বেগম স্বামীর কাছ ঘেঁষে বসলেন। গলা খাদে নামিয়ে আগ্রহী কন্ঠে জানতে চাইলেন,
হাসেন কেন? কি হইছে বলেন আমারে।
হামিদ মিয়া হাসি মুখেই তাকালেন স্ত্রীর দিকে। সুপ্রসন্নস্বরে বললেন,
আমাগো মাইয়ার কপালডা খুইলা গেছে।
মানে?
সেইদিন রহমান ভাইয়ের লগে সোয়েব আইলো না?
জুলেখা বেগম সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন। হামিদ মিয়া বললেন,
আমাগো সোফিয়ারে দেইখা পছন্দ হইছে। বিয়ার প্রস্তাব পাঠাইছে।
আকস্মিক আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন জুলেখা বেগম। খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। বুকজুড়ে কোমল কম্পন ছেয়ে গেল। সে কি সঠিক শুনলো? এত বড় ঘর থেকে তার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে? তার মেয়ে কি সত্যিই চাঁদ কপাল নিয়ে জন্মেছে?
কি কন আপনে? সত্যি?
স্ত্রীর আনন্দ দেখে চওড়া হাসলেন হামিদ মিয়া। বললেন,
হ্যাঁ, সত্যি। নামাজ শেষ কইরা রহমান ভাই কইলো।
আমি তো বিশ্বাসই করতে পারতেছি না এত বড় ঘর থেইকা আমার মাইয়ার লেইজ্ঞা বিয়ার প্রস্তাব আইছে।
হামিদ মিয়া গর্বে বুক ফুলিয়ে বললেন,
আমার মাইয়া কোন অংশে কম নি? যেমন রূপে তেমন গুণে।
আপনে কি কইছেন? রাজি হইছেন?
সোয়েব কত ভালো পোলা রাজি না হইয়া উপায় আছে? তুমি কাইল সোফিয়ার লগে কথা কইও।
জুলেখা বেগম সত্বর দুহাত তুলে খানিক শব্দ করে বললেন,
আল্লাহ, আপনেরে লাখ লাখ শুকরিয়া।
_______
ভারী হাওয়ার মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে। হাওয়া বইছে ধুলিকণা নিয়ে। শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। দূরে কোথাও কঠিন শব্দে বজ্রপাত পড়লো। বৃষ্টির ফোটা পরতেই রান্নাঘর থেকে জুলেখা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন।
সোফিয়া, কাপড়গুলা ঘরে নে। বৃষ্টি পড়ে।
এক ফোটা, দু ফোটা এরপর ভারী বর্ষন নামলো সোফিয়াদের টিনের চৌচালে। আগুপিছু বৃষ্টির ফোঁটা গুলো টিনের চৌচালের সুমধুর ছন্দ তুলছে। টিনের চাল বেয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পরছে যেন প্রাকৃতিক ঝড়না! সোফিয়া কাপড়গুলো ঘরে রেখে সদর দরজায় এসে দাড়িয়েছে। তাদের শূন্য উঠানে রিনঝিন বৃষ্টি দেখছে। দরজায় দুহাত ঠেকিয়ে তার উপর মাথা রেখে হেলে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে সোফিয়া। ধুলোয় ঢেকে যাওয়া গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির স্পর্শে নিজেদের আপন রঙ ফিরে পেয়েছে। সোফিয়া পায়ের স্যান্ডেল খুলে বাহিরে নামলো। পা রাখলো কর্দমাক্ত ভেজা উঠানে। শৈত্য বিন্দু গুলো শরীর স্পর্শ করতেই শিরশির করে উঠলো মেরুদণ্ড। অবিচল দাঁড়িয়ে রইলো উঠানের মাঝে। অনুভব করতে লাগলো বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা। এর মাঝেই জুলেখা বেগমের আওয়াজ এলো।
এই ছ্যামড়ি অবেলায় বৃষ্টিতে ভিজতাছোস কেন? জ্বর আইবো। ঘরে যা।
বৃষ্টির কারণে তার কথা গুলো ক্ষীণ শোনালো। জুলেখা বেগমের কড়া কথা যেন সোফিয়ার কানেই ঢুকলো না। সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। জুলেখা বেগম ফের ডেকে উঠলেন।
বৃষ্টিতে ভিজিস না সোফিয়া। ঠান্ডা লাগবো। ঘরে গিলা কাপড় বদলা।
সোফিয়া শান্ত, নিরব। সে যেন নড়তেই ভুলে গেছে। জুলেখা বেগম অতিষ্ঠ হয়ে নিজ মনেই মেয়েকে অসভ্য, বেয়াদব উপাধি দিলেন। সোফিয়া বৃষ্টি সমাপন পর্যন্ত ভিজলো। বৃষ্টি শেষ হতেই শুরু হলো সোফিয়ার শরীর কম্পন। নাক, মুখ চেপে হাঁচি দিয়ে বসলো। আশপাশ চোখ বুলিয়ে মাকে খুঁজলো। এখন যদি জুলেখা বেগম সোফিয়াকে হাঁচি দিতে দেখেন তাহলে আর রক্ষা নেই।
_______
সোয়েব পোলাডারে কেমন লাগে তোর?
সোফিয়া খেজুরের গুড় দিয়ে শুকনা মুড়ি খাচ্ছিলো। জুলেখা বেগমের প্রশ্নে মুখের মুড়ি চিবিয়ে জানতে চাইলো,
কোন সোয়েব?
আরে খান বাড়ির। সেইদিন রহমান ভাইয়ের লগে আইলো যে পোলাডায়।
সোফিয়া মুখে মুড়ি নিয়ে গুড়ে কামড় বসালো। চিবাতে চিবাতে মাথা নাড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বললো। জুলেখা বেগম সোফিয়ার পাশে বিছানায় এসে বসলেন। সোফিয়ার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
কি কস? ভালো কইরা ক।
সোফিয়া মুড়ি চিবিয়ে গিলল। বলল,
ভালোই।
মেয়ের ছোট্ট শব্দে জুলেখা বেগমের সন্তুষ্টি হলো। তিনি বেজায় খুশি। মিটিমিটি হেসে কিছু একটা ভাবলেন। এরপর মেয়ের সান্নিধ্যে এসে নিচু স্বরে বললেন,
পোলাডারে আমারও ভাল্লাগে। কত সুন্দর চেহারা! এক্কেরে রাজপুত্রের লাগান। কত ভালো আচার ব্যবহার! আমার তো খুব পছন্দ। তোর আব্বারও পোলাডারে পছন্দ।
সোফিয়া অমনোযোগী হয়ে মায়ের কথা শুনছে। জুলেখা বেগম মেয়ের মনোভাব পর্যবেক্ষণ করে কোমলস্বরে বললেন,
আমি তো কুনসুম ভাবিই নাই। এই পোলা আমাগো বাড়ি প্রস্তাব পাঠাইবো।
সোফিয়া প্রথমে কথাটা খেয়াল করে নি। পরক্ষনে খেয়াল হতেই মুড়ি চিবানো ছেড়ে ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞাস করলো,
কি বললা? কিসের প্রস্তাব?
বিয়ার প্রস্তাব। তোর লেইজ্ঞা।
কথাটা বজ্রপাতের মতো শোনালো। বেখেয়ালিতে ঢোক গিলতে যেয়ে শুকনো মুড়ি গলায় আটকে কাশি উঠে গেল সোফিয়ার। খুক খুক কাশতে লাগলো বুক চেপে। জুলেখা বেগম অস্থির হয়ে উঠলেন। কিছুক্ষন সোফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দ্রুত পায়ে যেয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। সোফিয়াকে পানি পান করালন। সোফিয়ার কাশি থেমেছে। জুলেখা বেগম রাগান্বিত স্বরে বললেন,
কতখন কই মুড়িডি এমনে খাইস না। কথাই শুনস না আমার। বলে এক ঝাটকায় মুড়ির বাটি নিয়ে সরিয়ে রাখলেন। সোফিয়া কিছুটা শান্ত হয়েছে। কিন্তু তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সোয়েবের বিয়ের প্রস্তাবের কথা।
আব্বা কি বলছে?
মেয়েকে ঝাড়ি মারতে যেয়ে বিয়ের কথা মাথা থেকে বেড়িয়ে গেয়েছিল জুলেখা বেগমের।
কি?
সোফিয়া বলল,
বিয়ার প্রস্তাবে।
মনে পড়তেই জুলেখা বেগম ফের চওড়া হাসি দিলেন। চোখ মুখের রাগান্বিত ভাব উবে গেল তার। সুরেলা কন্ঠে বললেন,
কি আর কইবো? এত ভালো প্রস্তাব না কওন যায়?
কিন্তু মা। আমারে না জিজ্ঞাস কইরাই আব্বা হ কইরা দিল?
মেয়ের কথায় জুলেখা বেগমের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফুটে উঠল। সরু চোখে তাকালেন সোফিয়ার দিকে।
কেন তুই রাজি না?
না। দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিল সোফিয়া।
মেয়ের কথা শুনে জুলেখা বেগমের চোখ কপালে উঠলেন। বলে কি তার মেয়ে? এত ভালো ছেলের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কোন সাহসে? জুলেখা বেগম দাতঁ কিড়মিড় করে সোফিয়ার বাহু চেপে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে বসালেন। উচ্চ কন্ঠে বলল,
কি কইলি? তুই রাজি না? কেন? কেন রাজি না তুই? পোলা সুন্দর। পড়ালেহা জানে। ঢাকায় চাকরি করে। বংশ ভালো। আমাগো থেইকা কত উপরে!
বংশ ভালো হলেই হবে? ছেলে পছন্দ না আমার। সোফিয়া তেছড়া জবাব দিব।
তোরে জিগানডাই ভুল হইছে আমার। তোর পছন্দ লাগবো না। গ্রামের হগল মাইনষে যারে পছন্দ হয়ে হেরে তোর পছন্দ না।
সোফিয়া অসহায় কন্ঠে বলল,
মা আমি পড়তে চাই।
চুপ কর। ধমক দিলেন জুলেখা বেগম। এত পড়ালেহা কইরা কি হইবো? আমরা তো পড়ালেহা করি নাই। আমরা কি বাইচ্চা নাই? সংসার করতাছি না?
মা। সোফিয়া আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল তার আগেই জুলেখা বেগম বললেন,
তোর কোন কথা হুনা লাগবো না কমার। এই কথা যদি তোর আব্বায় হুনে আস্ত রাখবো না আর।
জুলেখা বেগম চলে গেলেন সোফিয়ার চোখ ভারী করে। এসিডে পুরে যাওয়া ঝলসানো যন্ত্রণায় ঢুকরে কান্না চলে এলো। চোখ ঝাপসা হয়ে নিমিষেই গলগল করে জল বেড়িয়ে এলো দুচোখ ভেদ করে। চোখের জল গুলো কোলের উপর জমা হতে লাগলো। সে যে মইনুরকে বিয়ে করতে চায়। মইনুর তার জন্য চাকরি নিতে গিয়েছে। সে যে মইনুরকে ছেড়ে অন্যকাউকে বিয়ে করবে না। কিছুতেই না।
চলবে…
®উম্মে কুমকুম
(আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের হয়ত মইনুর আর সোফিরার কাহিনী পড়তে ভালো লাগছে না। কিন্তু এটা জরুরী ছিল। কিছু বিষয় সংক্ষেপ করলে খাপছাড়া হতো। তবে আমি চেয়েছিলাম মইনুর আর সোফিরার কাহিনী দু পর্বে শেষ করতে। শেষ যেহেতু হয় নি। আগামী পর্বে শেষ হবে ইন শা আল্লাহ।)