— ” আমি তো তোর সাহস দেখে হতবাক । তুই কিনা আমাকে লাভ লেটার দিয়েছিস । হ্যাঁ রে তোর কতো বয়স ? বল কতো বয়স ? ”
স্পর্শের দাঁতে দাঁত চেপে বলা কথা শুনে আয়ু ভয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে গাট গুনতে লাগলো নিজের জন্ম সাল ।
— ” ষোলো বছ…র ”
— ” এইতো জানিস দেখছি । আমার বয়স
জানিস ? ”
–” হ্যাঁ…”
স্পর্শ রাগে হাতের দুই আঙ্গুলে কপাল ঘষতে ঘষতে বললো , “আমি তোর থেকে চার বছরের বড়ো আর তুই কিনা আমাকে লাভ লেটার দিয়েছিস । ”
রাগে হাতে থাকা দলা পাকানো কাগজটা স্পর্শ পুনরায় খুললো । কাল রাত থেকে অনেকবারই এটা ও পড়েছে । কেনো এতবার পড়লো ওই জানে।
” প্রিয় স্পর্শ দা ,
কখনো শত ডানার প্রজাপতির নাচ দেখেছো ? আমারও না ওদের মতো নাচ করতে ইচ্ছে করছে । কিছুতেই কোথাও মন বসছে না । চারিদিকে খালি তোমাকে দেখছি । তুমি জানো আমি একটা ভয়ঙ্কর কাজও করে ফেলেছি। আমি কিশোরী বয়সে প্রেমে পড়েছি । তুমি হয়তো ভাবছো এটা ঘটা করে তোমাকে কেনো বলছি ? এর কারণটা আমি তুমি নামক স্বপ্নসারথিকে ভালোবাসি । হ্যাঁ আমি না তোমাকে ভালোবাসি । এটা আবেগ না ভালোলাগা তা আমি জানি না । তবে এটুকু আমি জানি আমি তোমাকে ভালোবাসি ।
ইতি
আয়ু ।।”
আজ স্পর্শ আয়ুকে নিয়ে ঝিল দেখতে এসেছিল । মাঠের মাঝখানে ঝিলটা সকলেই প্রায় সময় দেখতে আসে । কয়েক বছর আগে বর্তমানে ঝিলের পুরো জায়গাটায় কয়লা পাওয়া গিয়েছিল । পরে জায়গাটায় বৃষ্টির জল পড়ে তা বর্তমানে ঝিলে রূপান্তরিত হয়েছে ।
আয়ুর দেওয়া চিঠিটা স্পর্শ কাল রাতে হাতে পেয়েছে । ওদের দুজনের বাড়ি সামনা সামনি । এমনকি দুজনের ঘর ও । সামনা সামনি বারান্দায় বেরোলেই একে অপরের দেখা পায় তারা ।এই সুযোগটাই আয়ু কাজে লাগিয়েছে ।কাল রাতে বারান্দায় কাগজটা ছুড়ে মেরে ছুটে ঘরে চলে গিয়েছিল সে ।
বর্তমানে প্রথমবার আয়ুর দেওয়া প্রেমপত্র টা হাতে পাবার পর স্পর্শ যেভাবে সেটা দুমড়ে মুছরে ফেলেছিল এবারও সেই কাজ করলো । কাল রাত থেকে ও রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে কিন্তু আর যেনো পারছেনা । ইচ্ছে করছে সামনের মেয়েটাকে ঝিলের জলে ছুড়ে ফেলতে । কিন্তু ও তো তা পারবেনা । ওর বোকা আয়ু তো সাঁতার জানে । দেখা যাবে জলে ফেলার পর পরই উঠে এসে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলবে , ” স্পর্শ দা তুমি খুব খারাপ আমাকে ভিজিয়ে দিলে । আমি কিন্তু খুব রেগে যাবো । ”
তার পর তো আছেই তিনদিন মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে । একদিকে ওর সাথে কথা বলবে না অপরদিকে সারাক্ষণ ওর সামনেই ঘুরঘুর করবে ।
–” পাগল মেয়ে তুই কাল যখন কাগজ টা আমার বারান্দায় ছুঁড়লি তখন দেখিসনি নীচে তোর আর আমার বাবা দাঁড়িয়ে কথা বলছিল । ভাগ্যিস তোর কাজটা তাদের চোখে পড়েনি । পড়লে তোর বাপের হাতে কয়েকখানা থাপ্পড় তুই ঠিকই খেতিস ।
–” উহু তোমাকে বলেছে । আমার বাবা কখনোই আমাকে মারে না । উল্টে তুমি আঙ্কেলের হাতে সাত দুকুনে চোদ্দটা থাপ্পড় খেতে । ”
আয়ুর ভেংচি কেটে বলা কথা শুনে স্পর্শ ওর বিনুনি টেনে ধরলো ।
— ” আহ্ লাগছে তো স্পর্শ দা । তুমি মারছো কেনো ? ”
–” বেশ করেছি । হ্যাঁ রে আয়ু তোর কী মনে হয় আমি আমার বাপকে ভয় পাই ? ”
–” এতে মনে হবার কী আছে তুমি তো সত্যিই আঙ্কেলকে ভয় পাও। ”
আয়ুর নিঃসংকোচ সম কথায় স্পর্শ ভ্রু কুঁচকে তাকালো । ও তো ভাবতেই পারছে না আয়ু কিনা ওর মুখে মুখে কথা বলছে !
–” তোর সাহস বেড়ে যাচ্ছে না । ”
–” অফফ স্পর্শ দা তুমিও না । আমি তোমাকে চিঠিতে লিখেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি । তার মানে আজ থেকে তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড । সুতরাং আজ থেকে আমি আর তোমাকে ভয় পাই না ।”
আয়ু বেশ সাহসের সাথে স্পর্শকে একবার দেখে ঝিলের জলে পা ভেজালো । এই দিকে ওর নীল রঙে রাঙা শাড়ির আঁচল টা হাওয়ার তালে এলোমেলো হয়ে চলেছে ।শাড়ির কুঁচির অংশটাও কিছুটা ভিজে গেছে কিন্তু সেই দিকে তার হুশ নেই । ও তাকিয়ে রয়েছে ঝিলের জলে স্পর্শের প্রতিবিম্বের দিকে । তাই হয়তো ও বুঝতে পারছে স্পর্শ ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । কিশোরী মনে কেমন যেনো একটা শীতল স্রোতের ভাটার টান অনুভব করলো সে । তবে কী এই শীতল স্রোতটাই ভালোবাসা ? যদি তাই হয় তবে ও ওই মানুষটাকে ভালোবাসে ভীষন ভীষণ ভালোবাসে ।
–” আয়ু আমি কি তবে ধরে নেবো তুই অবুঝ ? ”
স্পর্শের মুখে এই উদ্ঘট কথার কোনো মানে খুঁজে পেলো না আয়ু । তবুও নিজের মধ্যে তৎকিঞ্চিত কণা সাহসের সঞ্চার হলো । আয়ু তো অবুঝ না ও কিছুতেই অবুঝ হাতে পারে না ।
–” আমি মোটেও অবুঝ না স্পর্শ দা । ”
–” তুই যদি অবুঝ নাই হবি তাহলে কেবল নিজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ একা করেই আমি তোর বয়ফ্রেন্ড এটা তুই বলতিস না । ”
স্পর্শের কথায় আয়ুর কোমল মন আরও যেনো কোমল হলো । ও জল থেকে উঠে এসে স্পর্শের পাশে দাঁড়ালো ।
–” তুই অন্তত জানতে চাইতিস আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি কিনা ? কী রে বল?”
এর উত্তরে আয়ুর যেনো কিছু বলার নেই । ও ভুল করে ফেলেছে । অন্তত ওর একবার স্পর্শ দার সাথে এই বিষয়ে কথা বলা উচিত ছিল ।
–” আমি কাউকে ভালোবাসি আয়ু । সে আমার সব । আর আমি আমার নীলাম্বরী কে ছাড়া কাউকে ভাবতে পারি না আর না পারবো । আশা করি তুই বুঝেছিস । ”
–” নীলাম্বরী কে ?”
স্পর্শ জলে আয়ুর প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো । তাকে বেশ লাগছে । কিছুটা অন্যরকম । হয়তো শাড়ি পড়েছে তাই কিন্তু স্পর্শ সেই দিকে বেশিক্ষণ তাকালো না । চোখ সরিয়ে নিলো ।
–” আছে কেউ । শুধু তার নাম টা মনে রাখিস
‘ নীলাম্বরী ‘ । আমার ভালোবাসা । আমি তার প্রেমে আবেশিত , তার নীল বসনা রুপে মোহিত । আকাশের নীলিমায় সে মিশে যায় বারংবার । হাওয়ার দাপটে উড়তে থাকা তার নীল আঁচল খানা আমার মনকে দোলা দিয়ে যায় । তার চোখের গভীরে হারিয়ে যাই বারবার । তার শ্যামবর্ণা রূপে আমি মোহিত । কিন্তু জানিস সে না টিপ পরে না বোধহয় পছন্দ করে না । ”
আয়ু খুব কান্না পাচ্ছে । ভীষণ ভীষণ কান্না পাচ্ছে । কিন্তু চোখে এক ফোঁটা জল ও আসছে না । হৃদয়ের প্রতিটা অস্থি যেনো কম্পিত হচ্ছে । সেই সঙ্গে নিজেও কাঁপছে । হাতপা কেমন যেনো শীতল হয়ে আসছে। খুব করে মনে হচ্ছে কিছু একটা ওর নেই । আসল কথা হলো সে ওর না । কিন্তু ও কী দুর্বল ? না আয়ু দুর্বল না আর না অবুঝ । বেশ তো সামনের মানুষটা যখন ওকে ভালোবাসে না তবে এই সব কিছু এইখানেই শেষ করা উচিত ।
–” আয়ু তুই এখন খুব ছোটো । এই তো সবে ক্লাস 11 । এখনও তো নিজেই নিজেকে ঠিক মতো বুঝতে শিখলি না এর মধ্যে …. । ”
— ” আমি বুঝেছি , আচ্ছা বাদ দাও । তো তোমার নীলাম্বরীর সাথে আমার দেখা করাবে না ? ”
আয়ুর যেনো কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে । স্পর্শ তা বুঝেও না বোঝার ভান করলো ।
— ” আরে আমার নীলাম্বরীকে তোকে অবশ্যই দেখাবো । তবে আজ না সময় হলেই দেখাবো । ”
–” আচ্ছা । ”
তারপর খানিক নীরবতা । আয়ু জলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো । ওর হয়তো এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত কিন্তু ও কেনো জানি এক পাও এখান থেকে নাড়াতে পারছে না । স্পর্শ এগিয়ে এসে আয়ুর পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে ঠেলা মেরে বললো ,
–” এই পেঁচি ! ”
–” আমি মোটেও পেঁচি না ওকে । ”
–” উহু তুই পেঁচি । দেখ তোর নয়ন যুগলের কোণে কাজল তোর চোখের জলের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে । ”
আয়ু হকচকিয়ে গেল । সামনের মানুষটা বুঝলো কীকরে ? ও তো কাঁদছে না । হয়তো চোখের কোণে জলের আভা ভেসে উঠেছে আর কিছু না । হাজার চেষ্টা করেও তো তা কারোর জানার কথা নয় ।
–” যা পেঁচি আয়ু বাড়ি যা । বিকেল পড়ে এলো বলে । ‘
–” তুমি যাবে না ? ”
–” না তুই যা । ”
আয়ু বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো । ও এক তপ্ত নিশ্বাস ফেললো । আজ থেকে স্পর্শকে নিয়ে ওর ভাবনা এইখানেই শেষ । ওর অনুভূতি ওর মধ্যেই সঞ্চারিত থাকবে । যার বহিঃপ্রকাশ আয়ু আর কোনো দিনও করবে না ।
স্পর্শ এগিয়ে গেলো ওর বন্ধুদের দিকে । ওরা ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে । কিন্তু হঠাৎই কী মনে হতে পিছন ফিরে আয়ুর যাবার দিকে তাকালো ।
–” কী রে মেয়েটা কতো ভালোবেসে তোকে ভালোবাসার কথা জানালো আর তুই কিনা ওকে ফিরিয়ে দিলি । ”
–” আচ্ছা অরূপ তুই কী পাগল ? ওর কতো বয়স বলতো । আর এটা আবেগ ও তো হতে পারে ? ”
—- ” আমিতো তা বলছিনা সাদ । হতেও তো পারে আয়ু সত্যিই স্পর্শকে ভালোবাসে । ”
–” আমাদের স্পর্শ বাবু তো তার হৃদয়হরণী #নীলাম্বরীর_প্রেমে আবেশিত। তার চোখে কী আয়ু ফায়ু কাউকে ধরে । ”
সাদ কথাটা বলে স্পর্শকে হাত দিয়ে গুতো মারলো । স্পর্শ আবারও আয়ুর যাবার দিকে তাকালো । মেয়েটা বেশি দূর যায়নি । একা যেতে দেওয়াটা ঠিক হয়নি । আর তাছাড়া আজ ওকে ঠিক মতো রাগানো হয়নি । কথা গুলো ভেবে স্পর্শ বাঁকা হেসে সাদ আর অরূপের দিকে তাকালো ।
— ” ঠিক বলেছিস । এই স্পর্শ রায় তো #নীলাম্বরীর_প্রেমে আবেশিত । আয়ু সেন কে আমার মনে ধরবে না ।”
” কী করবি থাকবি না চলে যাবি ? ”
স্পর্শ ” আয়ু ” বলে ডেকে উঠলো । কিন্তু আয়ু শুনতে পাইনি ।
–” না রে অরূপ আমি আসছি ওকে বাই । ”
–” ওকে যা । সাদ চল আমার কটা পিক তুলে দে।”
( চলবে )
গল্পঃ : নীলাম্বরীর প্রেমে পর্ব : ১ ( সূচনা )
#Tuhina_pakira
{ বিঃ – কেমন হয়েছে জানাবেন । হ্যাপি রিডিং }