নীড়
রেশমী রফিক
১১।।
চিৎকার-চেঁচামেচি করে চারদিক থেকে লোকজন জড়ো করেছে লোকটা। এতক্ষণে শারার টের পেল, আসলে পার্ক করে রাখা গাড়িগুলো খালি ছিল না। কমবেশি প্রতিটা গাড়িতেই ড্রাইভার ছিল, কেবল ওর পাশের গাড়িটা বাদে। লোকটার চিৎকারে তারা বের হয়ে এসেছে গাড়ি থেকে। রেস্টুরেন্টের পেছনের দরজা খোলা। সেখানে কিছু কর্মচারী যাওয়া-আসা করছিল। তারাও ছুটে এসেছে। শারারের গাড়িটাকে ঘিরে রীতিমতো জটলা তৈরি হয়েছে।
গাড়ির দরজায় লক ছিল। এখানে থামার পর লক খোলা হয়নি। তাই লোকজন টানাটানি করেও দরজার খুলতে পারল না। তাদের রোষ বাড়ল। চড়া সুরে বলতে লাগল,
– হারামজাদায় আকাম-কুকাম করনের আগে দরজা আটকায় লইছে। ওই কুত্তার ছাও, দরজা খুল শিগগির। নাইলে তর গাড়ি আজকা ভাইঙ্গাই ফালামু।
শারার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। বুঝতে পারছে পরিস্থিতি বেগতিক। কিন্তু কী করণীয় তার মাথায় ঢুকছে না। তুবার চিৎকার শুনে ধাতস্থ হলো সে। কানের পর্দা ফেটে যাবার আগমুহূর্তে ওকে বলতে শুনল,
– তাকিয়ে দেখছেন কী? গাড়ি স্টার্ট দিন।
গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে একটানে এখান থেকে বের হয়ে যাবার চিন্তা একবার যে মাথায় আসেনি শারারের, বিষয়টা তা নয়। সমস্যা হচ্ছে, এখান থেকে বের হতে হলে আগে গাড়িটা পেছাতে হবে। সেটা সম্ভব না। পেছনদিকে বহু মানুষজন জড়ো হয়েছে। ওদের গায়ে ধাক্কা লাগলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। আর যদি কেউ আহত হয় বা গাড়ির চাকার নিচে পড়ে মারা যায়, তাহলে তো কাহিনি পুরোটাই খালাস। হত্যা মামলা দায়ের হয়ে যাবে সরাসরি। এখান থেকে পালিয়ে গেলেও লাভ হবে না। গাড়ির নম্বর ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছে ওরা। আচ্ছা, এত লোক হুট করে জড়ো হলো কী করে? একটু আগেও তো জায়গাটা ফাঁকা আর সুনসান ছিল। এখন একেবারে লোকারণ্যে ভরপুর! কী আশ্চর্য।
– অই হাউয়ার পুত, তুই বাইরাস না কেন? গাড়ি খুল বাইঞ্চোদ।
জীবনেও এতসব গালি শোনেনি শারার। এই জঘন্য গালিগুলো কেবল ওকেই দিচ্ছে না এরা, ওর বাবামাকেও দিচ্ছে। কেন? বাবামাকে কেন এর মধ্যে টেনে আনছে?
– কী কইতাছি, তর কানে যায় না। অই মাগি, তুই চুপ মাইরা আছস কেন? গাড়ি খুলবি নাকি ক। নাইলে আজকা তর খবরই আছে। শইলে আগুন লাগছে না? নিভানির জায়গা পাইতাছস না। এইখানে আইসা গাড়ির ভিত্রে রঙ্গ শুরু করছস। মাগির ঘরের মাগি। অই, তর বাসার ফুন নাম্বার দে।
তুবা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। শারারের বংশ বা পরিবারের সামাজিক অবস্থান ওদের থেকে উপরে হলেও যথেষ্ট রক্ষণশীল ঘরানার মেয়ে সে। এত বিশ্রী কথা জীবনেও শোনেনি। কাতর সুরে বলল,
– প্লিজ শারার ভাই, কিছু একটা করেন। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হন।
– কিন্তু কীভাবে? পেছনে তো অনেক মানুষ।
– আপনি গাড়ি স্টার্ট করেন আগে।
শারারের মাথা ফাঁকা হয়ে আছে। আজকের মতো পরিস্থিতি কখনো পড়েনি বিধায় তুবার কথামতো গাড়ির ইগনিশন অন করল। পরমুহূর্তে শব্দ করে জেগে উঠল ইঞ্জিন। সেই শব্দ যেন আমজনতার বারুদে আগুন লাগিয়ে দিল। লোকজন মারমুখো হয়ে উঠল। শারার গাড়ি পেছনে নেবার চেষ্টা করছিল। তার আগেই সামনের গ্লাস ভেঙ্গে চুরচুর হলো। লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। শারার ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল। তুবা ভয়ে চিৎকার দিল আবার। ওর দিকের গ্লাসটাও ভাঙ্গা হয়ে গেছে। কতগুলো হাত ভেতরে এসে ওকে ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করছে। তুবার চিৎকারে কান ঝালাপালা। মানুষজনের যত না হৈ-হল্লা, তার চাইতে বেশি জোরে শোনা যাচ্ছে ওর কণ্ঠ। বুঝাই যাচ্ছে, প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। শারার ওকে জাপটে ধরল বুকের মধ্যে। আকুতির সুরে লোকগুলোকে বলল,
– প্লিজ ভাই আমাদের ছেড়ে দিন। আমরা চলে যাচ্ছি এখান থেকে।
– অই শুয়োরের বাচ্চা, যাইবি মানে কী? তোগোর এত সহজে যাইতে দিমু ভাবলি কেমনে? আজকা হেস্তনেস্ত একখান কইরাই ছাড়মু।
গালি ছাড়া লোকগুলোর মুখ থেকে কিছুই বের হচ্ছে না। তারা গাড়ির লক খুলতে না পারলেও ভাঙ্গা গ্লাসের ভেতর দিয়ে ওদেরকে হিড়হিড় করে টেনে বের করার চেষ্টা করছে। বেশিরভাগই তুবার দিকে হাত বাড়িয়েছে। ওর কোলের উপর কলেজের ব্যাগ ছিল। সেটা কোথায় উধাও হয়েছে আল্লাহ জানেন। চুল বেণি করা ছিল। সেই বেণি ধরে টানাটানি চলছে। এমনকি পরনের ক্রসবেল্টও টেনে নিয়েছে। তুবার কান্নার পারদ ধাই-ধাই উপরে উঠছে। শারার ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সম্ভবত সে বুঝতে পারছে এই লোকগুলোর মতলব। এরা ইচ্ছেকৃতভাবে তুবাকে স্পর্শ করছে। মুখে যত না প্রতিবাদি ভাষা, মনের মধ্যে কামনার আগুন তার চেয়ে অনেক বেশি। ওর নিজের উপরও হামলা শুরু হলো। তবে খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। এই গাড়ির একটা বৈশিষ্ট হচ্ছে, একবার লক করলে ম্যানুয়ালি খুলবে না। বাটন থাকলেও ইগনিশন অফ থাকলে কাজ করবে না। শারার গাড়ির ইনগিশন অন করেছিল বটে, কিন্তু সামনের গ্লাস ভাঙ্গার সাথে সাথেই আবার বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর এই লোকগুলোর মধ্যে কেউ একজন চাবি নিয়ে গেছে, যাতে গাড়ি স্টার্ট করতে না পারে। গাড়িটা কেনার পর থেকেই এরকম লক সিস্টেমের জন্য বিরক্ত ছিল শারার। প্রতিবারে গাড়ি লক করতে বা লক খুলতে ইগনিশন অন থাকতে হবে। আজই প্রথম সে এই সিস্টেমের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল। লক না থাকলে এতক্ষণে ওদের দুজনের হাল কী হতো, আল্লাহ মালুম। (চলবে)
পরের পর্ব রাত নয়টায়।