নীড়
রেশমী রফিক
১৪।।
শফিকুল চৌধুরী একজন সফল ব্যবসায়ী। দেশের প্রধান শিল্পপতিদের কাতারে তার নাম না থাকলেও ব্যবসায় ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ঢাকাইয়া পরিবারের ছেলে তিনি। তাও বংশের একমাত্র পুত্রসন্তান। তার বংশে কথিত চল আছে, ব্রিটিশ আমলে কোনো এক প্রজন্মের এক পুরুষ ছিলেন অত্যাচারী জমিদার। তার যন্ত্রণায় প্রজাদের জীবন অতিষ্ঠ ছিল। পাইক-পেয়াদারা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত কখন কাকে ধরে আনবে তুচ্ছ কোনো অপরাধে, আর জমিদারও বিনা বিচারে শাস্তি দিতে পৈশাচিক আনন্দ পেতেন। কিন্তু কথায় আছে, সব কর্মফলই একদিন শেষ হতে ধন্য। একদিন এক বাড়ন্ত কিশোরকে ধরে আনা হলো জমিদারের দরবারে। অপরাধ, খেলতে-খেলতে জমিদারের সীমানায় ঢুকে পড়েছে সে। শুধু তা-ই না, বাগানের ফুলগাছ থেকে কতগুলো ফুলও তুলেছে। মালিরা তাকে বাধা দিলে পাথর ছুটে একজনকে রক্তাক্ত করেছে। শুনে জমিদার খুব রেগে গেলেন। কত্ত বড় সাহস তার বাগানের ফুল ছিঁড়ে! আবার তারই কর্মচারীকে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়েছে! তিনি গর্দান নেবার নির্দেশ দিলেন। খবর পেয়ে ছেলেটির মা ছুটে এলো। জমিদারের পায়ে পড়ে খুব কাকুতি-মিনতি করল। তার ছেলেটা আসলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। কিছু না বুঝেই অন্যায় করে ফেলেছে। কিন্তু জমিদারের কথার নড়চড় কখনো হয়নি। তিনি একবার যা বলেন, তা আর কখনো পালটায় না। সেবারও তাই হলো। মায়ের কান্না-আহাজারি আর অনুনয়-অনুরোধ ছেলেটিকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারল না। সে ছিল মায়ের একমাত্র ছেলে। সাতটি কন্যাসন্তানের পর এই ছেলেকে আল্লাহ তার কোলে দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেবার অপরাধে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। পরিবার-পরিজনরা সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তবু সে ছেলেকে কোলছাড়া করেনি। যতই কষ্ট হোক, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেছে। নিজের দিকে খেয়াল না করে সবসময় ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। অথচ তারই চোখের সামনে তার ছেলের মাথা কেটে ফেলা হলো। সন্ধ্যা পেরোয় তখন, কিন্তু মা ছেলের রক্তাক্ত মাথা আগলে রেখে ওভাবেই বসে রইল বিরানভূমিতে।
জমিদার খবর পেয়ে নির্দেশ দিলেন মহিলাকে যেন রাজ্যছাড়া করা হয়। অতঃপর, ছেলের মাথা বুকের আঁচলের সাথে বেঁধে আর শরীর একটি বস্তায় ভরে মা রওনা হলো অন্য রাজ্যের উদ্দেশ্যে। সন্তানকে এই রাজ্যে কবর দিতেও অনীহা তার। কতটা পথ ওভাবে চলেছিল, জানা নেই। মৃত শরীরে পচন ধরতে শুরু করেছে। বিকট দুর্গন্ধে আশপাশে টেকা দায়। পথিমধ্যে এক ঋষিমুনির আশ্রম। ওর পাশ দিয়ে যাবার সময় গন্ধের উৎস আর কাহিনি শুনে তাকে থামানো হলো। এরপর নিয়ে যাওয়া হলো মুনির দরবারে। মুনি সবটা শুনে মহিলাকে বর দিলেন, ওই মুহূর্তে সে যা উচ্চারণ করবে মুখ দিয়ে, ওটাই সত্যি হয়ে যাবে। সন্তানহারা মা বললেন,
– আমার ছেলের হত্যাকারী নির্বংশ হোক। ওই বংশে এখন অবধি যত ছেলে বেঁচে আছে, সবাই মরে যাক।
মুনির বর কাজে দিল। রাজ্য থেকে বহুদূরে এক আশ্রমে বসে মহিলা কথাগুলো বললেও তা সত্যে পরিণত হলো। জমিদার তখন দরবারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তখনই হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা গেলেন। জমিদারের ভাইরা যে যেখানে ছিল, আচানক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল। এমনকি জমিদারের ছেলেরাও। কেবল ছোট ছেলে বেঁচে রইল। জমিদারের পঞ্চম স্ত্রীর সন্তান সে। বয়স মাত্র সাত বছর। মায়ের মতোই ধার্মিক আর শান্ত স্বভাবের। ওই সময়ে মায়ের সাথেই নামাজ আদায় করছিল সে। হয়তো আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যু তার ছায়া মাড়ায়নি। কিন্তু সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার জীবন নিয়ে টানাটানি চলল অনেকদিন। জমিদারের ধার্মিক স্ত্রী জায়নামাজে বসে রইলেন। আল্লাহর দরবারে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় ছেলে একদিন সুস্থ হলো ঠিকই, কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারল না।
সেই থেকে জমিদার বংশের উপর অভিশাপ স্থায়ী হয়ে গেল। ছেলে সন্তান জন্ম নেবার পর পরই মারা যায় কোনো না কোনো কারণে। শত চেষ্টা করেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। অবাক হলে সত্যি, প্রতিবারই কোনো না কোনো ধার্মিক মায়ের দোয়ায় একটি ছেলে বেঁচে যায়। সেই ছেলের বদৌলতে জমিদার বংশ এই পর্যন্ত টিকে আছে। শফিকুল চৌধুরী সেইসব ভাগ্যবান পুরুষদের মধ্যে একজন। তার ছেলে শারারও একই ভাগ্যে ফেরে বেঁচে যাওয়া সন্তান।
বর্তমান কালে পুরনো অভিশাপ কেউ বিশ্বাস করে না। শফিকুল চৌধুরীও করেন না। কিন্তু তার মা মরে যাবার আগে বিষয়টা ছেলেকে জানিয়ে গেছেন। এবং নির্দেশ দিয়েছেন যেন বংশ পরম্পরায় এই অভিশাপের খবর পৌঁছে দেয়া হয়। এরই জের ধরে বংশে যে পুত্রবধু আসে, তাকে অতি অবশ্যই ধার্মিক হতে হয়।
শারারের মা শুরুতে ধার্মিক ছিলেন না। তবে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ায় নামাজ-রোজার প্রতি মনোযোগী হওয়া তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছিল। প্রথম দুটি সন্তান মারা যাওয়ার পর যখন ডাক্তার বললেন, তিনি আর মা হতে পারবেন না। গর্ভধারণ জনিত কিছু জটিলতার কারণে তার জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তখন তিনি জাগতিক সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বাড়ির ভেতর মহিলাদের জন্য একটি নামাজঘর তৈরি করা হয়েছিল। সেখানেই রাতদিন পড়ে থাকতেন। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন তিনি। সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করতেন। এদিকে শফিকুল চৌধুরী নিজেও ধার্মিক মননের। তার মা তাকে গড়ে তুলতে সবার আগে ধর্ম শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনিও ব্যবসায় পরিচালনার ফাঁকে যখনই সময় মিলত, মসজিদে গিয়ে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত তুলতেন। এরই মধ্যে হঠাৎ কীভাবে যেন এক পরনারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেলেন। হয়তো তার ঈমান ঠিক ছিল না। শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে বিপথে চলতে শুরু করেছিলেন। হয়তো স্ত্রীর উদাসীনতা তাকে বাইরের জগতে ঠেলে দিয়েছিল। বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে মদে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখনই এক নারীর সাথে পরিচয়, তারপর প্রেম। ফলে দ্বিতীয় সংসার শুরু হলো অতি সঙ্গোপনে। সেই স্ত্রীর সন্তানই হচ্ছে শারার। ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে ওর মা। সেই মৃত্যু একজন স্বামী বা একজন সন্তানের কাছে কোনোভাবেই কাম্য না হলেও শফিকুল চৌধুরী এক প্রকার হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। কারণ, প্রতি ক্ষণে তার মনের মধ্যে খচমচ করত। প্রথম স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয় তাড়িয়ে বেড়াত। ক্ষণিকের মোহে পড়ে বিয়ে করলেও ক’দিন বাদে তার উপলব্ধি হয়েছিল, ব্যাপারটা খুব খারাপ হলো। প্রথম স্ত্রীর কানে এই খবর গেলে দুনিয়ার সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারপর তক্কে-তক্কে ছিলেন কতদিনে বিয়েটাকে গোপন রাখা যায়। ভাগ্য ভালো ছিল এখানেই, দুনিয়ার কোনো ব্যাপারেই প্রথম স্ত্রীর আগ্রহ থাকত না। সারাক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকতেন।
শারারকে এরপর নিজ বাড়িতে নিয়ে এসেছেন শফিকুল চৌধুরী। প্রথম স্ত্রীর কোলে তুলে দিয়েছেন তাকে। তবে ভুল করেও বলেননি, ছেলে তারই ঔরসজাত। শুধু বলেছেন, ছেলেটার বাবা-মা কেউ নেই। পালক ছেলে বিধায় প্রথম স্ত্রীর মনোযোগ একটু হলেও সংসারে ফিরল। অন্তত এই ছেলের মৃত্যু নিজ চোখ দেখতে হবে না তার। তাই সাগ্রহে ছেলেকে লালন-পালন করতে ব্যস্ত হলেন তিনি। শফিকুল চৌধুরীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। শারারের জন্মের সময় একদমই যে ঝামেলা হয়নি, তা নয়। যমে-মানুষে টানাটানি হয়েছিল। ডাক্তার স্পষ্ট বলেছিল, সন্তান অথবা মা যে কোনো বাঁচানো যাবে। শফিকুল চৌধুরী সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন।
তারপর শারারের উপর বহু ফাঁড়া এসেছে। কিন্তু তার পালক মায়ের কারণে সবটাতেই উৎরে গেছে সে। ছোটবেলা থেকেই সারাক্ষণ দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দেয়া হতো তাকে। কখনোবা পীর বাবার দরবারে নিয়ে যাওয়া হতো। বড় হবার পর অবশ্য ফাঁড়া কেটেছে অনেকখানি। এখন আর অত সমস্যা হয় না। কিন্তু ছেলের মতিগতি সন্দিহান। জন্ম-ফাঁড়া কেটে গেলেও তার মধ্যে বিপথে যাবার প্রবণতা বেশি। একমাত্র ছেলে হিসেবে তাকে যতই বৈষয়িক দিকে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করেন না কেন, শারারের আনন্দ কেবল টাকা উড়ানোয়। বন্ধুবান্ধবদের সাথে ফুর্তি করতে তার জুড়ি নেই। ছেলেরা তো বটেই, মেয়েরাও শামিল হয় সেই ফুর্তিতে। শফিকুল চৌধুরী সর্বক্ষণ ছেলের পেছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রাখতেন, যার প্রধাণ কাজ ছিল ছেলেকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনা। যেসব মেয়েরা শারারের আশপাশে ঘুরঘুর করে, তাদেরকে কোনো না কোনো উপায়ে হটিয়ে দেয়া। এতকাল ছেলে পড়াশুনা করেছে। তাই অতটা লাগাম টেনে ধরতে পারেননি। এখন নিজ অফিসে ঢুকিয়েছেন। তাই এখন আর গুপ্তচর লাগিয়ে রাখার দরকার মনে হয়নি। সপ্তাহে পাঁচদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শারার অফিসেই থাকে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বাসায় থাকার নির্দেশ জারি করা হয়েছে তার উপর। অর্থাৎ জুম্মা নামাজ পড়তে যেতে হবে বাবার সাথে। তারপর আবার বাসায় ফিরে দুপুরের খাওয়া হবে একসাথে। সপ্তাহের এই দুটো দিন বাবা-মা আর ছেলে মিলে একসাথে খাওয়া-দাওয়া করবে, এটাই নিয়ম। সেকারণে শারার খুব একটা সময় পায় না বন্ধুদের সাথে দেখা করার। তবে শুক্র-শনিবার বিকেলে সে বাইরে যায়। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বা কোনো অনুষ্ঠানে। তখন ফিরতে রাত করে। তবু তিনি অতটা গা করেন না। ছেলে বড় হয়েছে। নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছে। এখন গুপ্তচরগিরি না করলেও চলবে। অতি শাসনে ছেলের বিগড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অতটুকু ছাড় তিনি দিয়েছেন।
ইদানীংকালে এও লক্ষ করেছেন, শারার লাঞ্চের সময় কোনো না কোনো বাহানায় বাইরে যায়। এরপর আর অফিসে ফেরে না। এই ছাড়ের জন্যই অতটা পাত্তা দেননি। কিন্তু আজ ফোনের ওপাশে মেয়েলি কন্ঠের কথাগুলো শুনে তার মনে হলো, বড় ধরনের কোনো ঘাপলা আছে। তবে কি ছেলে আবার বিপথে চলতে শুরু করেছে? তাকে লুকিয়ে খারাপ ধরনের কোনো কাজে কি লিপ্ত হয়েছে? মেয়েলি কন্ঠের কারণে টেনশন আরও বেশি হচ্ছে। কে এই মেয়ে? শারারের সাথে তার কী সম্পর্ক?
শারার তখনই ফোনের লাইন কেটে দিয়েছে খট করে। এরপর আর কলব্যাক করেননি তিনি। তবে চুপচাপ বসেও নেই। মোবাইল কোম্পানীতে খোঁজ লাগিয়ে শারারের লোকেশন জেনে নিয়েছেন। বিশ্বরোডের কোনো এক জায়গায় দেখাচ্ছে লোকেশন। ঠিকানা যেটা জানা গেছে, ওটা একটা রেস্টুরেন্ট। নাম স্বর্ণপাতার থালা। শারার কি তবে কোনো মেয়ের সাথে লাঞ্চ করতে ওখানে গেছে? কোনো ঝামেলা হয়েছে নিশ্চয়ই। ওই মেয়েটাই হয়তো শারারকে ইচ্ছেকৃতভাবে ডেকে নিয়েছে যাতে আচ্ছামতো প্যাঁচ লাগানো যায়।
আপাতত ঠিকানা অনুসারে রওনা হয়েছেন ওদিকে। রেস্টুরেন্টে পৌঁছুবার পর বুঝা যাবে ঘটনা আসলে কী। কিন্তু টেনশন কমাতে পারছেন না একটুও। গাড়ি ছুটছে কিন্তু মনে হচ্ছে সময় থেমে আছে। কিংবা মরীচিকার উদ্দেশ্যে চলছেন তিনি। নাহ, এই ছেলেকে নিয়ে আর পারা গেল না। যতই শাসনে বা কড়া নজরে রাখেন, বংশের রক্ত আছে তার গায়ে। এই ছেলে তো সোজা পথে চলার নয়!
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়