নীড় পর্ব-১৮

0
1500

নীড়
রেশমী রফিক
১৮।।
শফিকুল চৌধুরী ফোনে কথা বলছেন কারও সাথে। খুব সম্ভব তার অধীনস্থ কোনো কর্মচারীকে নির্দেশ দিচ্ছেন কোনো ব্যাপারে। নিচু সুরে বলায় কিছু শুনতে পাচ্ছে না শারার। হতাশ ভঙ্গিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে সে। জীবনে অনেক বিপদ এসেছে ওর। অনেক বাধাবিপত্তি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবারই থমকে গেলেও কোনো না কোনো উপায়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথ তৈরি হয়ে গেছে বাবার কারসাজিতে। আজই প্রথম মনে হচ্ছে, এই বিপদ সহসা পিছু ছাড়বে না। কারণ এই মুহূর্তে বাবা ওর একটা কথাও বিশ্বাস করছে না। তিনি ধরেই নিয়েছেন, তুবা ওর গার্লফ্রেন্ড। এবং গাড়ির ভেতর অতি অবশ্যই কোনো অসামাজিক কাজকর্ম হচ্ছিল। নয়তো এতগুলো মানুষ হুট করে ক্ষেপে যাবার কথা নয়। স্বর্ণর উপর তাদের ক্ষোভ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে স্বর্ণর বন্ধু, কেবল এই ছুঁতোয় ওর উপর হামলা করবে, এটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
শারার অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছে। পুরো পরিস্থিতি যতটা খুলে বলা সম্ভব, তিল দেখার বিষয়টা ছাড়া আর কিছুই বাদ দেয়নি। কিন্তু তিনি অবুঝের মতো গোঁ ধরে আছেন। দু’বার ওকে ধিক্কার দিয়েছেন, তারই ছেলে হয়ে কীভাবে এমন জঘন্য কাজে সে লিপ্ত হতে পারল। স্বর্ণকেও শফিকুল চৌধুরীর বিশ্বাস হচ্ছে না। মেয়েটা হতে পারে ভালো পরিবারের। কিন্তু কতটা ভালো তার মধ্যে গচ্ছিত আছে, সেটাই ভাবার বিষয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই সবার আগে বখে যায়। আর তাদের বখে যাবার পেছনে বন্ধুবান্ধবদের ইন্ধন থাকে বেশি। নাইট ক্লাবে নাচানাচি থেকে শুরু করে কতটা অন্ধকার জগতে তাদের আনাগোনা চলে, সাদা চোখে দেখে বুঝার উপায় নেই। শারারও এতদিনে বিপথে চলে যেত, যদি না তিনি ওর বয়সন্ধিক্ষণ থেকেই শক্ত হাতে সামাল না দিতেন। একমাত্র ছেলে বলেই হয়তো অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। এই ছেলে তার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। সে বিপথে যাওয়া মানে সবকিছুর ধস।
স্বর্ণকে অবশ্য বখে যাওয়াদের দলে ফেলা যায় না। মেয়েটা এই বয়সেই ব্যবসায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, এটা নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক। তাও বাবার ব্যবসায় নয়, নিজ হাতে দাঁড় করিয়েছে এই রেস্টুরেন্ট। এখানকার সুনাম তার কানেও এসেছে। দু-একবার ভেবেছিলেন সপরিবারে অথবা শারারের মাকে নিয়ে খেতে আসবেন। সময়-সুযোগের অভাবে আসা হয়নি। তবে এও জানা ছিল না, মেয়েটা শারারের বান্ধবী। এরা স্কুল-কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে একসাথে পড়াশুনা করেনি। শারারের বন্ধুদের তিনি ভালো করেই চেনেন। ছেলে কখন কার সাথে মিশেছে, তার সব খবরই তিনি রাখতেন। অফিসে যোগদানের পর কী এক দুর্বল ক্ষণে মনে হয়েছিল, ছেলে যথেষ্ট বড় হয়েছে। নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছে। আর নজরদারি না করলেও চলবে। মনে হচ্ছে, ভুল করেছেন। আজেবাজে সব মেয়েদের সাথে ছেলের উঠাবসা চলে। স্বর্ণর তাও সামাজিক অবস্থান ভালো। তুবা কী করে শারারের সাথে ভিড়ল, এই প্রশ্ন তার মাথায় কুরেকুরে খাচ্ছে। সাইফুলের শ্বশুরবাড়ির কাউকে তার খুব একটা ভালো লাগেনি। সামাজিক অবস্থান অপেক্ষাকৃত নিচু। তবে দিবা মেয়েটা মোটামুটি ভালো। বিয়ের পর অল্প কদিনেই সবার মন জয় করে নিয়েছে। মেয়েটার মানসিকতা আর আচরণও ভালো। একটু গড়ে-পিটে নিলেই চলবে। তাই বলে তুবাও একইরকম হবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই বয়সেই কি না স্কুল ফাঁকি দেয়া শুরু করেছে। প্রায়ই শারারের সাথে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়। ভারি ধুরন্ধর!
এমপি মাসুদুল করিমের সাথে দেখা করতে হলে তার কার্যালয়ে যেতে হবে। তার আগে ওখানে কল করে পিএসের সাথে কথা বলতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে হবে। এমপি সাহেব ব্যস্ত মানুষ। তার সাথে চাইলেই দেখা করা যায় না। পিএসকে এই মুহূর্তে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। কার্যালয়ের ফোনটাও অনবরত বেজে যাচ্ছে। কেউ রিসিভ করছে না। শফিকুল চৌধুরী পরিচিত এক ব্যবসায়ীকে কল করেছিলেন যাতে কোনোরকম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই এমপির সাথে দেখা করা যায়। লোকটা আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেছে। এখনো কোনো কুলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এদিকে রেস্টুরেন্টেরই একজন কর্মচারী বলল এমপি নাকি আজ ঢাকার বাইরে গেছে। রেস্টুরেন্টে আসার পথে সকালবেলায় সে দেখেছে, এমপির গাড়ি কোথাও যাবে বলে রাস্তার একপাশ আটকে রাখা হয়েছে। শফিকুল চৌধুরী ওসিকে বললেন,
– এমপির সাথে কথা না বলে কিছু করা যায় না? আপনি এদেরকে লাঠিচার্জ করছেন না কেন?
ওসি অসহায় ভঙ্গিতে তাকালেন। শফিকুল চৌধুরী যতই বড় ব্যবসায়ী হন না কেন, রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচ সম্পর্কে একদমই অজ্ঞাত। নয়তো এই প্রশ্ন করতেন না। যেখানে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেছে, এলাকাবাসীর নামে আসলে এমপির লোকজনই ঝামেলা করছে, সেখানে এমপির সাথে কথা না বলাটাই বরং অস্বাভাবিক। আর এমপি যেখানে সরকারি দলের, কোন বুদ্ধিতে এদের উপর লাঠিচার্জ করবেন তিনি?
একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
– আপনি বিষয়টা এখনও ধরতে পারেননি। যতটা না দেখা যাচ্ছে, আসল কাহিনি আরও প্যাঁচালো। অনেক ডিপ।
– তো, এখন কী করার আছে আপনিই বলুন? আমার ছেলেকে নিশ্চয়ই এরা অনির্দিষ্টকালের জন্য এখানে আটকে রাখবে না। হি ইজ ইনজুরড। রক্ত পড়া বন্ধ হলেও ওর চোখ দেখেছেন আপনি? ওকে হাসপাতালে নেয়াটা জরুরী। আর ওই মেয়েটা, শি হ্যাজ টু গো ব্যাক হোম। ইজন্ট? মেয়েটা কি ছেঁড়া কাপড়ে বসে থাকবে?
– ছেঁড়া কাপড় তো কী হয়েছে? গায়ে ওড়না জড়ানো আছে। শি ইজ অ্যাবসোলুটলি ফাইন!
শফিকুল চৌধুরী হতাশ। ওসির সাথে কথাবার্তা চালাচালিটা এতক্ষণে কোনো কাজের বলে মনে হচ্ছে না। এর চেয়ে অন্য কিছু উপায় ভাবলে হতো। পুলিশ এতক্ষণ যাই করুক, এখন রেস্টুরেন্টের বাইরে অবস্থান নিয়েছে। ভেতরে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারের চাইতে এমপির লোকজন যাতে আঁতকা হামলা শুরু না করে, সেদিকে তাদের কড়া নজর। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিপক্ষ এভাবে রেস্টুরেন্ট ঘেরাও করে রাখবে কতক্ষণ?
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here