নীড় পর্ব-২১

0
1152

নীড়
রেশমী রফিক
২১।।
শফিকুল চৌধুরীর ধারণাতেই আসেনি এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তিনি এসেছিলেন এমপির সাথে দেখা করতে। রেস্টুরেন্ট যারা ঘেরাও করেছে, তারা বেশিরভাগই অল্পবয়সী। ছেলে-ছোকরা। ওদের মধ্যে এমন কাউকে তিনি দেখেননি যারা দায়িত্ব নিয়ে কথা বলবে। এইসব ছেলেদের সাথে পুলিশ আলোচনায় যাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এদের শরীরের রক্ত গরম। অনুভূতিও কাজ করে আবেগের তাড়নায়। কোনোরকম যুক্তি বা বাস্তবতা মানতে তারা রাজি না। তাই ভেবেছিলেন এমপির সাথে কথা বললে এর থেকে পরিত্রাণের সম্ভাবনা আছে। তিনি দায়িত্ববান একজন মানুষ। তার পরিবার আছে। কোথাও না কোথাও তিনি একজন বাবাও বটে। হয়তো সেই স্থান থেকেই নিজেকে বিবেচনা করবেন। তাহলে আর এই ছেলেপেলেদের সাথে তাল মেলানোর কথা তার মাথায় আসবে না।
তাছাড়া এমপি বা তার দলের মুল শত্রুতা স্বর্ণর সাথে। শারারকে তারা চেনে না। ওর সাথে এদের কোনোরকম শত্রুতাও নেই। বেচারা এখানে এসে আঁতকা ফেঁসে গেছে স্বর্ণর ঝামেলায়। এই বয়সের ছেলেদের বুঝবুদ্ধি কম থাকে। জীবনে চলার পথে তারা যতই দায়িত্ববান হোক না কেন, এই সময়টায় তারা ভেবেচিন্তে সামনে পা বাড়ায় না। শারারও তাই। তুবাকে বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখে ওর হয়তো মনে ধরেছে। এরপর মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে এই রেস্টুরেন্টে। এই বয়সের অনেক ছেলেরাই কাউকে মনে ধরলে তার সাথে দেখা করে, রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। শফিকুল চৌধুরীর অনুমান, এমপি সাহেবের যদি কোনো ছেলে থাকে, সেও নিশ্চয়ই শারারের বয়সে এরকম অনেক বান্ধবীদের সাথেই ঘুরতে গেছে, রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া-দাওয়া করেছে। আবার হতে পারে, ছেলে বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘুরতে গিয়ে আঁতকা বিপদেও পড়েছে। এমপি কি তখন নিজের ছেলেকে উদ্ধার করতে তৎপর হননি? আর স্বর্ণ তো শারারের বন্ধুও না। এতক্ষণে স্বর্ণর সম্পর্কে সবটাই জানা হয়েছে তার। শারারের সাথে ওর সংযোগটাও জেনেছেন। শারারের ইউনিভার্সিটির এক বন্ধুর পরিচিত এই মেয়ে। কিছুদিন আগে ওই বন্ধুই আরও কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে এই রেস্টুরেন্টে এসেছিল খেতে। শারারও ছিল ওদের সাথে। হয়তো সেদিন খাবার মজা লেগেছিল ওদের। একজন তৃপ্ত খানেওয়ালা হিসেবে শারারের এখানে আজ আসাটা খুবই স্বাভাবিক।
এমপি মাসুদুল করিমের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা নেই শফিকুল চৌধুরীর। তবু একজন বয়স্ক কিংবা প্রায় সমবয়সী মানুষের সাথে মন খুলে সমস্যার বিস্তারিত আলোচনা করা যায়, যেটা অন্যদের সাথে সম্ভব না। কিন্তু এমপি দেখা করলেন না কিছুতেই। তার বদলে পাঠিয়েছেন নাইম নামের এই ছেলেকে। ছেলেটা বয়সে শারারের চাইতেও ছোট হবে হয়তো। হ্যাংলা-পাতলা শরীর দেখে সঠিক বয়স অনুমান করা যাচ্ছে না। কিন্তু মানতে হবে, শারারের চাইতেও বেশি ক্ষুরধার বুদ্ধি সে রাখে। কথাবার্তায় বেশ পরিপক্ক। অন্তত এখন অবধি কোনোরকম অযৌক্তিক কথা সে বলেনি। এছাড়াও আদব-কায়দা আছে ভালোই। ছেলেটা বসার ঘরে ঢুকেই তাকে ‘চাচা’ সম্বোধন করেছে, যেটা শুনে শফিকুল চৌধুরী চমকিত হয়েছেন। রাজনীতির মাঠে থাকা ছেলেপেলেদের কথাবার্তা সাধারণত ভদ্র হয় না। তারা গুছিয়েও কথা বলতে জানে না। কিন্তু এই ছেলেটা ব্যতিক্রম। তার কথাবার্তার ধরনই বলে দিচ্ছে, সে একজন হবু রাজনীতিবিদ। ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে কথা বলছে।
এই ছেলের সাথে আলোচনা বেশ ফলপ্রসু হচ্ছিল। শফিকুল চৌধুরী সহজভাবেই ওকে শারারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। ছেলেটার কথাবার্তায়ও বুঝা গেল, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। মাথা নেড়ে আফসোস করছিল শারারের জন্য। এমনকি এও বলেছে, চাচা আমি দেখতেছি কী করা যায়। আপনি টেনশন নিয়েন না। আপনার ব্যাপারটা আমি বুঝতেছি। আপনি মুরব্বী মানুষ। ছেলের জন্য এইখানে এসে কী হেনস্তাটাই না হচ্ছেন, ভেবে আমার খুবই লজ্জ্বা লাগছে। বিশ্বাস করেন চাচা, আপনাকে অসম্মান করার কোনো ইনটেনশন আমাদের ছিল না।
শফিকুল চৌধুরী এই ছেলের আন্তরিকতায় যারপরনাই মুগ্ধ। একবার ‘বাবা’ বলে সম্বোধনও করে ফেলেছেন। এও বলেছেন, তুমি আমার ছেলের বয়সী। হয়তো শারারের থেকেও ছোট হবা। কিন্তু তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে। তুমি অনেক ম্যাচিউর। আমার ছেলেটা সেই তুলনায় একদমই নাদান। ওকে নিয়ে আমি এই পর্যন্ত কম হেনস্তা হইনি। তাই তুমি আমার অসম্মান নিয়ে লজ্জিত হবা না একদম। তুমি শুধু আমাকে এই সিচুয়েশন থেকে বের হবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি তো তোমাকে সবটাই বললাম। শারার এমনিতে যাই হোক, ওরকম অকাজ করার মতো ছেলে না। তেমন কিছু হলে ওই মেয়েকে নিয়ে আমার বাসায়ই মউজ-মাস্তি করতে পারত। আমার বাসা তো বলতে গেলে খালিই থাকে। আমি সারাদিন ব্যবসায়ের কাজে বাইরে থাকি। ওর মা ধর্ম-কর্মে মন দিয়েছে। আর সংসার নিয়েও ব্যস্ত থাকে। ছেলের দিকে তাকানোর সময় কোথায়? আবার চাইলে কোনো ফ্রেন্ডের বাসায়ও যেতে পারত, যদি সেরকম ইনটেনশন থাকত। হোটেলে গেলেও অবাক হবার কিছু থাকত না। আমার অঢেল টাকা-পয়সা। সে যদি কোনো মেয়েকে নিয়ে টাইম পাসের জন্য হোটেলে যায়, তাতে কার কী আপত্তি থাকবে বলো? বাপ হয়ে তো আমি জানবও না। এই রেস্টুরেন্টে এসে তো এইসব কুকাজ করার দরকার নাই। কিন্তু সে একদমই ওরকম মেন্টালিটির না। স্বর্ণর রেস্টুরেন্টে খাবারের অনেক সুনাম। সে নিজে কিছুদিন আগে এসেছিল বন্ধুদের সাথে। হয়তো গার্লফ্রেন্ডকে বলেছে। এরপর মেয়েটা আবদার করেছে সেও আসবে খেতে। ব্যস, ঘটনা এই।
নাইম বিগলিত সুরে বলল,
– হ্যাঁ বুঝতে পারছি চাচা। আমি দেখতেছি কী করার যায়। আপনি রিল্যাক্স হয়ে বসেন।
এই কথা বলার পর নাইম বসার রুম থেকে বের হয়ে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচু গলায় কীসব কথা বলল, কার সাথে যেন। খানিকবাদে ফিরে এসে এই কথা বলছে! কল্পনাতীত হতভম্ব হলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলেন। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ না হলেও বয়স তো একদমই কম হয়নি তার। দুনিয়াদারিও এই অবধি কম দেখেননি। তাই দেরিতে হলেও মানুষ চিনতে পারেন। নাইমকে যতদূর যা ভেবেছিলেন, তা ভুল ছিল। এই ছেলে শুধু চতুরই না, এক নম্বরের বদমাইশ। নয়তো শারারকে ফাঁদ বানিয়ে স্বর্ণর ঝামেলায় ব্যবহার করার কথা ভাবত না। এই যে এখন যতটা নরম সুরে, নিরীহ ভালোমানুষের মতো চেহারা ঝুলিয়ে রেখে কথা বলছে, ব্যাপারটা সাদা চোখে অমন হলেও শফিকুল চৌধুরীর অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে বেশি সময় নিল না আসল কাহিনি। এই ছেলে নাটের গুরু হয়েও ভাব দেখাচ্ছে যেন তার হাতে কিছুই নেই। অথবা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এও বুঝে গেছেন, এমপি ইচ্ছেকৃতভাবেই নিজে সামনে না এসে এই ছেলেকে পাঠিয়েছেন। ওসির সাথে একমুহূর্ত দৃষ্টি বিনিময় করে তিনি নাইমের দিকে তাকালেন সরাসরি। স্পষ্ট সুরে বললেন,
– ঠিক আছে। তবে তাই হোক। কাজি ডেকে আনো তাহলে!
নাইম হকচকিয়ে গেল। এতক্ষণ সে খেল দেখিয়েছে শফিকুল চৌধুরীকে। পরিকল্পনা সুন্দরভাবে সাজিয়ে প্রায় বাস্তবায়নের দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে। ভেবেছিল, শফিকুল সাহেব তার ছলচাতুরি ধরতে পারবেন না। কিন্তু এখন তার পিলে চমকে গেছে। এক ঝটকায় তিনি ছেলের বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন, ভুল করেও ভাবেনি। আচ্ছা, এই ভদ্রলোকের মাথায় কি গোবর ভরা? জেনেশুনে এরকম অসম্মানিত পরিস্থিতিতে কী করে ছেলের বিয়ে দিতে সম্মত হচ্ছেন তিনি? কোনো ভদ্র পরিবারই তো রাজি হবে না। মেয়ের কথা অবশ্য আলাদা। খুব বেশি উচ্চপর্যায়ের পরিবার থেকে আসা না হলে এই মেয়ের বাবা-মা এমনকি চৌদ্দগুষ্টি শারারের বৃত্তান্ত না জেনেই চোখ বুজে রাজি হবেন বিয়েতে, শুধুমাত্র মানসম্মানের দিকে মুখ চেয়ে। কিন্তু বিষয়টা শফিকুল চৌধুরীর সাথে যায় না। উনার সাথে কথা বলতে আসার আগে যথেষ্ট ভালো করেই খোঁজখবর জেনে এসেছে সে। হয় তিনি ওর চালাকি ধরে ফেলেছেন, নয়তো আস্ত মাথামোটা। মাথা ভর্তি গোবর নিয়ে চলাফেরা করেন বলেই ছেলে বাপের রাস্তায় পথ চলে আচ্ছামতো ফেঁসেছে। নিশ্চিত হবার জন্য সে প্রশ্ন করল,
– আপনি রাজি? সত্যি বলছেন?
শফিকুল চৌধুরী চেহারায় যতটা সম্ভব বোকা ভাব ফুটিয়ে তুলে বললেন,
– হ্যাঁ, বাবা। আমি তো বললামই কাজি ডেকে আনো।
– চাচা, আপনি বুঝেশুনে বলছেন তো? আপনার একটা মাত্র ছেলে। তার বিয়ে নিশ্চয়ই যেনতেন ভাবে হবে না। আর মেয়ের সম্পর্কেও তো খোঁজ নিতে হবে। যেখানে-সেখানে ছেলের বিয়ে করানোটা বুদ্ধিমানের কাজ না।
শফিকুল চৌধুরী এবার মনে মনে কুৎসিত কিছু গালি দিলেন নাইমকে। আর মুখে বললেন,
– আমি তো বিয়ে দেবার জন্য অস্থির হইনি। তুমিই বললে, বিয়ে ছাড়া আর কোনো অপশন নেই।
– না মানে, চাচা আমি খুবই লজ্জিত। আমি অনেক চেষ্টা করলাম। কেউ মানতেছে না। শারারের পক্ষে কিছু শুনলেই ক্ষেপে যাচ্ছে। আসলে স্বর্ণর উপর এলাকাবাসীর অনেকদিন ধরেই ক্ষোভ জমে আছে। এই মেয়েটা বিশ্বাস করেন, এলাকার পরিবেশ একদম নষ্ট করে দিছে। তার উপর পাওয়ারফুল মানুষের মেয়ে। বুঝতেই পারতেছেন, এতদিন সবাই এই মেয়ের এতসব অপকর্ম সহ্য করছে, আজকে মনে করেন একদম ব্লাস্ট হয়ে গেছে।
শফিকুল চৌধুরী হতাশ ভঙ্গিতে বললেন,
– ওহ তাহলে আর কী করার। বিয়েটা দিতে হবে ওদের।
– চাচা, আমি বুঝতে পারছি আপনার ভেতর কী চলছে। আমি আসলে…
– না বাবা, ঠিক আছে। তুমি তোমার বেস্ট ট্রাই করেছ। এখন কপালের উপর তো কারও হাত নেই। আর দোষ আমার ছেলেকেই দিচ্ছি আমি। এত-এত রেস্টুরেন্ট বাদ দিয়ে ওর এখানেই কেন খেতে আসতে হলো। নিশ্চয়ই স্বর্ণ ওকে উল্টাপাল্টা কিছু বুঝ দিয়েছে। আর ওই মেয়েই বা কেমন? ক্লাস ব্যাঙ্ক করে… আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতিগতি বুঝা মুশকিল। আমরা বাবা-মায়েরা এদের জন্য যতই জানপ্রাণ ঢেলে দিই না কেন, এদের কোনো পরোয়া হয় না আসলে। নয়তো এই মেয়ে পড়াশুনা বাদ দিয়ে এই রেস্টুরেন্টে আসত না বয়ফ্রেন্ডের সাথে। আমার কথা হচ্ছে, হ্যাঁ তোমরা প্রেম করো। সমস্যা নেই। কিন্তু দেখাসাক্ষাৎ করার তো আরও সময় আছে। অফিস আর স্কুল-কলেজ বাদ দিয়ে কেন এই ভরদুপুরে রেস্টুরেন্টে আসা লাগবে?
– সেটাই, চাচা। এই মেয়েটাকে তো আমার একটুও ভালো মনে হচ্ছে না। ভাবেন একবার, ভদ্র ফ্যামিলির মেয়েরা কি এভাবে ক্লাস ব্যাঙ্ক করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরে বেড়াবে? ফ্যামিলি থেকে ভালো শিক্ষা পায় নাই আসলে। আর পেয়েছেও আপনার সোজাসরল ছেলেটাকে। জানে, অনেক টাকাপয়সা আছে। একমাত্র ছেলে, বলতে গেলে আপনার সমস্ত প্রপার্টি আর বিজনেস তো ওর হাতেই পড়বে দুইদিন পর। এমন ছেলেকে বাগাতে পারলে লাইফে আর কিছু লাগে? স্যরি চাচা, শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে আপনার। কিন্তু এটাই সত্যি। এইসব মেয়েরা টাকাওয়ালা ছেলে দেখলেই ঝুলে পড়ে।
– ওই মেয়ের কথা আর কী বলব। ফ্যামিলি ভালো শিক্ষা দেয়নি বলেই আজকে সে এখানে, এমন একটা সিচুয়েশনে পড়েছে। ভালো ঘরের মেয়েরা এইসব প্রেম-ট্রেম করে না। তারা ফ্যামিলির পছন্দে বিয়ে করে। আর ওই মেয়ের ফ্যামিলি ওরকমই। ওর বোনকে কদিন আগেই আমার ওয়াইফের ভাতিজা বিয়ে করেছে। প্রেমের বিয়ে। আমার ওয়াইফের বাবার বাড়িতে কেউ রাজি না ওই মেয়েকে বউ করে আনতে। না দেখতে ভালো, না ফ্যামিলি। স্ট্যাটাস বলে তো একটা কথা আছে। কিন্তু ভাতিজা কিছুই মানল না। তার জেদের কাছে হার মেনে আমার সুমন্ধি শেষমেশ বিয়ে করিয়েছে।
– এই দেখেন, আমার আন্দাজ কিন্তু মিলে গেল। এই মেয়ে আসলেই ভালো না।
– মেয়ে তো ভালো না-ই, আমার ছেলেরও অধঃপতন কম হয়নি। চিন্তা করো তুমি, আজ দুপুরে ইম্পরট্যান্ট মিটিং ছিল। ওর সেটা অ্যাটেন্ড করার কথা ছিল। সে অফিস বাদ দিয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছে। কেন? কী এমন জরুরী দরকার পড়ল যে ভরদুপুরেই অফিস আর ক্লাস বাদ দিয়ে দেখা করতে হবে!
– নিশ্চয়ই ওই মেয়েটা ফোর্স করেছে। আপনার ছেলেকে দেখে কিন্তু আমার কাছে এনাফ ডিসেন্ট মনে হয়েছে। আজকালকার মেয়েরা যেমন, বয়ফ্রেন্ডের মাথায় চড়ে সারা দুনিয়ার ভেজে খায়।
– হবে হয়তো।
– চাচা, আমি বলি কী, আপনি এত সহজেই রাজি হয়ে যাবেন না প্লিজ। ছেলের বিয়ে অবশ্যই দেবেন। তবে বুঝেশুনে। দশঘর দেখে, একটা খানদানি বংশ থেকে ভালো ক্যারেকটারের মেয়ে আনবেন। এই মেয়েকে বউ করে নিলে আপনার ফ্যামিলিতে ধ্বংস লাগবে। এইসব মেয়েরা ভালো হয় না। আপনার ছেলের লাইফটা হেল করে ছাড়বে।
– তাহলে কী করব? তুমিই একবার বলছ বিয়েটা হতে হবে। আবার তুমিই মানা করছ।
– না চাচা, আমি একবারও বিয়ের কথা বলিনি। ওটা তো এলাকাবাসীর দাবি। অসামাজিক কাজকর্ম হাতেনাতে ধরার পর তারা ওদের বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমি পারসোনালি ব্যাপারটা একদমই সাপোর্ট করছি না। আমার মনে হয় কী, আমি ওদের গিয়ে বরং বলি আপনি রাজি হচ্ছেন না। সোসাইটিতে আপনার একটা সম্মান আছে, পজিশন আছে। এই বিয়েটা সবকিছু ধুলিস্যাৎ করতে মোর দ্যান এনাফ।
শফিকুল চৌধুরীর মন বিষিয়ে যাচ্ছে এতসব প্যাঁচ দেখে। দিনদুনিয়া ইদানীং কালে এতই খারাপ হয়েছে, তার বড় নমুনা এই নাইম। এক রত্তি ছেলে সেদিন জন্ম নিয়েছে, নাক টিপলে দেখা যাবে এখনো দুধ বের হচ্ছে। অথচ সে এসেছে কি না তাকে টেক্কা দিতে। কত্ত বড় ধুরন্ধর হলে এরকম একটা জঘন্য খেলা সে খেলতে পারে! সে জানে না, কিছুক্ষণ আগেই শফিকুল চৌধুরীর মোবাইলে কল এসেছিল দেশের প্রধাণ খবরের কাগজের অফিস থেকে। মালিক নিজে কল করে তার কাছে বিষয়টা জানতে চেয়েছে। ঘটনাস্থলে একজন সাংবাদিক পাঠাতে বলা হয়েছে, তাও বলেছে। এছাড়াও, মিডিয়ার সাথে জড়িত যারা পরিচিত আছে, অনেকেই ফোন করছে, মেসেজ পাঠাচ্ছে। শফিকুল চৌধুরীর এই মুহূর্তে খুব ইচ্ছে করছে, কষে এক থাপ্পড় মেরে নাইমের কান বয়রা করে দিতে। অনেক কষ্টে মেজাজ সামলে নিলেন তিনি। বললেন,
– যা হয় হবে, তুমি কাজি ডাকো।
নাইম ঘাবড়ে যাচ্ছে। এই ভদ্রলোককে সে যতটা না সহজ ভেবেছিল, আদতে ইনি তার চেয়েও প্যাঁচালো। প্রথম সারির কিছু খবরের কাগজে কল করা হয়েছে। তারা সাংবাদিক পাঠাচ্ছে। দুটো টিভি চ্যানেলের সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসবে সবাই। তারপরই খেল জমার কথা ছিল। এই ভদ্রলোক তা আর হতে দেবে না মনে হয়। দপ করে জ্বলে উঠার ভঙ্গিতে সে বলল,
– চাচা, আপনি কিন্তু ভুল করছেন। আমি বলে রাখলাম…
শফিকুল চৌধুরী এই পর্যায়ে উঠে দাঁড়ালেন। নাইমের একদম সামনে গিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে তার চেয়ে জোর গলায় বললেন,
– আমার চিন্তা আমাকেই করতে দাও, নাইম। ছেলে আমার খুবই আদরের। ওর পছন্দ-অপছন্দের দিকে নজর রাখাটা আমার রেস্পন্সিবিলিটি। তাছাড়া মেয়েটাও আমার একদমই অপরিচিত না। আমার ভাতিজার শ্যালিকা সে। ওর ফ্যামিলির সাথে অলরেডি একদফা আত্মীয়তা হয়ে গেছে। নতুন করে নাহয় আরেকবার হলো। সবার আগে ভাবতে হবে, ওই মেয়ে যেমনই হোক, আমার ছেলে ওকে পছন্দ করেছে। তার পছন্দের উপর আর কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। ওসব সোসাইটির ব্যাপারটা তুমি নাহয় আমার উপর ছেড়ে দাও। তোমার দলের ছেলেরা বা তোমরা চাচ্ছ বিয়েটা হোক। আমি রাজি। এখানে বিষয়টা নিয়ে জল ঘোলা করার মতো আর কিছুই নেই। তুমি কী করতে চাচ্ছ জানি না। কিন্তু এটুকু মনে রেখো। আজ আমি এখান থেকে ছেলে আর ছেলের বউ নিয়েই ফিরব। আর হ্যাঁ, যদি চাও মিডিয়া কভারেজ হোক। গো অ্যাহেড। আফটার অল শফিকুল চৌধুরীর একমাত্র ছেলের বিয়ে, তারই পছন্দের মেয়ের সাথে। মিডিয়ার তো একটু হলেও কভার করা উচিত। বিষয়টা অন্যভাবে এগোলে নাহয় সেনাকুঞ্জে দাওয়াত পড়ত মিডিয়ার। স্বর্ণপাতার থালাই বা খারাপ কীসে? স্বর্ণ মেয়েটা এই রেস্টুরেন্টের পেছনে বহুদূর খেটেছে। আজ মিডিয়া কভার হলে ওর নিজেরও লাভ হবে। যারা এখনো ওকে চেনে না, বা ওর রেস্টুরেন্টের নাম শোনেনি, তারাও মিডিয়ার কল্যাণে জানবে। হেডলাইন কী দেয়া যায়, বলো তো? খবরটা হবে এমন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শফিকুল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে শারার চৌধুরী তারই প্রেমিকাসহ হাতেনাতে ধরা পড়ল স্বর্ণপাতার থালায়। প্রেমিকার আবদারে মজাদার সুস্বাদু খাবার খাওয়াতে এসেছিল প্রেমিকপ্রবর। স্থানীয় জনতা ক্ষেপে গিয়ে তার বাবাকে ডেকে এনেছে। অতঃপর তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিয়ের ঘোষণা দিলেন। হোয়্যাট অ্যা স্টোরি! কী হলো, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও মিডিয়াকে খবর দাও আর কাজি ডাকো। তারা স্পটে আসতে না আসতে আমি দেখি, ওদের বিয়ের শপিংটা চট করে সেরে ফেলা যায় নাকি। আমার ফ্যামিলিকেও জানাতে হবে। সবাই চলে আসুক এখানে। তুমি সময় পেলে সানাইপার্টি আনতে চেষ্টা করো। বিয়েতে সানাই না বাজলে কেমন যেন জমে না ঠিক। টুডে, অ্যান এক্সেপশনাল ম্যারেজ উইল টেক প্লেস হেয়ার। এরপর তো তোমাদের এই এলাকা আর স্বর্ণর রেস্টুরেন্ট বিখ্যাত হয়ে যাবে। হাহাহাহাহা!… (চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here