নীড় পর্ব-৩২

0
3006

নীড়
রেশমী রফিক
৩২।।
তুবা আপনমনে কীসব ভাবছে। চোখমুখে তখনো মুগ্ধতা ঝরে পড়ছে। হঠাৎই শারার হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। ঘরের দরজা আটকে দিল। তুবা ওসব খেয়াল করল না। মুগ্ধতা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নিজের বাসায়, নিজের ঘর আর বিছানায় আজীবন ঘুমুবার চিন্তাও মাথায় ঘুরছে। শারার প্রথমে থমকে দাঁড়াল। আয়নার সামনে স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়ানো তুবা। চোখজোড়া স্থির। একবার দেখেই সে বুঝে গেল, ওটা ফাঁকা দৃষ্টি। ধীর পায়ে তুবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল সে। আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখা গেল। কিন্তু তুবা স্থির। শারারের উপস্থিতি তার নজরেই আসেনি। ওর দুই কাঁধে আলতো করে হাত রাখল শারার। তারপর দুই বাহু চেপে ধরল আলতো ভঙ্গিতে। চিবুকটা নামিয়ে আনল কাঁধের উপর। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
– কী ভাবছ, তুবামনি?
তুবার সংবিৎ ফিরল। তবু নড়ল না সে। কেবল আয়নার ভেতর দিয়ে শারারের দিকে তাকাল। বলল,
– আমি বাসায় যাব, শারার ভাই। আমার ভালো লাগছে না। আমি এখানে থাকব না। প্লিজ, আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসুন।
লম্বা দম নিল শারার। তুবাকে নিজের দিকে ঘোরাল। তারপর আজলা ভঙ্গিতে ওর মুখটা তুলে ধরল। খুব কাছে এসে আগের মতোই ফিসফিস করে বলল,
– তুমি আমাকে ভালোবাসো?
তুবা মাথা নাড়ল ডানে-বায়ে। মুখে বলল,
– না।
– কখনো ভালোবাসবে?
– না, না। এইসব ভালোবাসাবাসির মধ্যে আমি নাই। আম্মা জানতে পারলে আমাকে কেটে টুকরো-টুকরো করবে। আমাকে আগেই কড়া করে নিষেধ করে দিয়েছে। কোনো প্রেম-ট্রেম করা চলবে না।
– আচ্ছা। তাহলে বলো, আমাকে ভালো লাগে তোমার?
চোখ তুলে তাকাল তুবা। শারারের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মুখ নামিয়ে ফেলল। বলল,
– হ্যাঁ।
– কতটুকু?
– কতটুকু মানে কী?
– মানে কতটুকু ভালো লাগে আমাকে? অনেক বেশি নাকি একটুখানি।
– আমি জানি না। কিন্তু আপনি আমাকে এগুলো জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনি তো অন্য কাউকে পছন্দ করেন।
– কাকে?
– সেটা আমি কী করে জানব? আজকে অ্যালবাম ঘেঁটে ওই মেয়েটাকে চেনার কথা ছিল। কিন্তু অ্যালবাম তো নাই। হারিয়ে গেছে। ওই ব্যাগের মধ্যে ছিল…
তুবার ঠোঁটে আলতো করে আঙুল রাখল শারার। বলল,
– ওসব পুরনো কথা। ওগুলো এখন বলে লাভ নেই। কখন কাকে পছন্দ করেছি, কাকে খুঁজেছি, সবকিছু এখন অর্থহীন।
– কেন?
– কারণ আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন থেকে আমার শুধু তোমাকে ভালো লাগতে হবে। ভালোবাসতে হবে। তোমারও শুধু আমাকেই ভালো লাগতে হবে। ভালোবাসতে হবে।
– কিন্তু আপনার আব্বা-আম্মা তো বললেন অন্য কথা।
– তারা তাদের কথা বলবেই। কিন্তু সংসার তো তারা করবে না। করব আমরা। সো, ডিসিশন আমাদেরকেই নিতে হবে।
– ওহ।
– এখনই।
– কী?
– এখনই যা ডিসিশন নেয়ার, নিতে হবে। আমাদের হাতে সময় নেই।
– কেন? মানে কীসের সময়?
তুবার ঠোঁটে আবারও আঙুল রাখল শারার। বলল,
– আমাকে জাস্ট এটুকু বলো। আমাকে কতটা ভালো লাগে তোমার? অনেক নাকি অল্প একটু?
– অনেক। কিন্তু…
– ব্যস। আর কোনো কথা না। ডিসিশন নেয়া হয়ে গেছে।
– কীসের ডিসিশন?
– এই যে, তুমি আমাকে পছন্দ করো কি না। ভালোবাসো কি না।
– কিন্তু আমি বলি নাই, আপনাকে ভালোবাসি। আমার আম্মা…
তুবার মুখ চেপে ধরল শারার। বলল,
– চুপ। তুমি খুব বেশি কথা বলো, তুবা। আর একটা কথাও বলবে না। আমি যা বলব, সেটাই করবে। ঠিক আছে?
তুবা স্থির ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ-না কিছু বলল না। শারারও তাকিয়ে রইল। তুবার চোখগুলো দেখাচ্ছে পটলচেরা। যেন এখনই কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। হয়তো খুব কাছ থেকে দেখছে বলেই এতটা বড় মনে হচ্ছে। নইলে এই ক’দিন তো চোখে পড়েনি। আচমকা শারারের চোখ গেল তুবার ঠোঁটের দিকে। উপরের ঠোঁটের ঠিক ডানপাশের কোণায় খানিকটা ফুলে আছে। দুপুরে গাড়ির ভেতর থাকাকালীন সময়ে ওটাকে কালো তিল মনে হলেও এখন খুব কাছ থেকে দেখে মনে হচ্ছে লাল তিল। পুরোপুরি লালও না। কিছুটা খয়েরি আর কিছুটা লালের মিশেল। তিলের জন্য ঠোঁটের ওই কোণটা ফুলে আছে।
এই তিলটার জন্যই এত কিছু! কেবল তিলটাই খুব কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিল। এর জন্য কোথা থেকে কী হয়ে গেল, ভাবতেই পারছে না শারার। আজ দুপুরের ওই মুহূর্তটায় সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি, তিল দেখতে চাওয়ার অপরাধে এতটা জুলুম হয়ে যাবে ওর উপর। যেন লঘু পাপে গুরু দন্ড। যদিও এখন এটাকে আর জুলুম মনে হচ্ছে না। ঘুরেফিরে কেবল মনে হচ্ছে, এটাই হবার ছিল। গাড়িতে চড়ে যখন বাসায় ফিরছিল, তুবা ওর পাশে বসা কাচুমাচু ভঙ্গিতে। তখনকার অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম। জীবনে প্রথমবারের মতো বউ নিয়ে বাড়ি ফেরা! এখনো অনুভূতিটা রয়ে গেছে। আগের তুলনায় আরও বেশি ডালপালা মেলেছে। এখন মনে হচ্ছে, এতকাল এই ঘরটায় সে একা ছিল। নিজ জগতে একাকি ছিল। এখন থেকে আর একা হবার সুযোগ নেই। এতকাল যা কিছু ছিল একান্তই ওর নিজের, এখন সেখানে ভাগ বসিয়েছে তুবা। সবকিছুতে এখন ওর সমান অধিকার। শারারের কেন যেন ভালো লাগছে খুব। নিজ অধিকার সমান ভাগ হয়ে যাওয়ায়। যেন এতগুলো বছর একাই ভার বহন করেছে। এখন থেকে তুবা অর্ধেকটা ভার বহন করবে।
খুব আলতো করে তুবার ঠোঁটের উপর ওই তিলটায় ঠোঁট ছোঁয়াল। কয়েকটা মুহূর্ত ছুঁয়ে থাকল। তুবার কোনো নড়চড় নেই। বরফের মতো জমে আছে সে। শারার এবারে চুমু দিল ঠোঁটে। একবার নয়, কয়েকবার। ছোট-ছোট চুমু। তারপর তুবার চোখের দিকে তাকাল। তুবাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে, অবাক ভঙ্গিতে। শারার ফিসফিস করে বলল,
– ভালোবাসি।
তুবার ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি ফুটল। লাজুক ভঙ্গিতে সে বলল,
– আমিও।
– কী?
– ভালোবাসি।
– তোমার আম্মা জানলে মেরে ফেলবে না তোমাকে?
তুবার চোখমুখে আতঙ্ক ফিরল। শঙ্কার সুরে বলল,
– ওহ, ভালো কথা মনে করেছেন। আম্মা এই খবর শুনলে আমাকে খালি মেরেই ফেলবে না। কেটে টুকরো-টুকরো করবে। তারপর নদিতে ভাসিয়ে দেবে। আগেই বলে রেখেছে। না বাবা, থাক। আমার এতসব ভালোবাসাবাসিতে দরকার নেই। আমি বাসায় যাব।
শারার ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল,
– বাসায় গেলেই কি সাতখুন মাফ? তোমার আম্মা তো আজকের খবর জানবেনই।
– জানবে না।
– তুমি শিউর?
– হ্যাঁ, দিবাপুর পা ধরলেই সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। আম্মা কোনোদিনই জানতে পারবে না আজকের কাহিনি।
– তাই? আচ্ছা, যদি আমি নিজে তোমার আম্মাকে বলে দেই?
তুবার আতঙ্ক বাড়ল। কপালে চোখ তুলে প্রায় চেঁচিয়ে সে বলল,
– আপনি এত খারাপ কেন, শারার ভাই? আমি কয়েকদিন ধরে আপনার জন্য এত দৌড়াদৌড়ি করলাম। কাউকে না জানিয়ে চুপেচাপে আপনার সাথে দেখা করলাম। আপনার পছন্দের মেয়েকে খুঁজে বের করার জন্য অ্যালবাম চুরি করলাম। আর আজকের কাহিনি তো আপনার জন্যই হলো। আমি গেছিলাম কর্ণফুলী সিটিতে। আপনিই ওখান থেকে আমাকে বের করে আনলেন। বললেন, ওইখানে নাকি গরমে টেকা যাচ্ছে না। কিন্তু আংকেলের কাছে আমার নামটা ফাঁস করলেন। আমি নাকি আপনাকে বলছি রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াতে হবে! হ্যাঁহ! আপনি কী মনে করছেন আমাকে? আমি ছোঁচা? আমার মানসম্মান নাই যে সামনে যাকে পাব, তাকেই বলব আমাকে খাওয়াতে হবে? নাকি আমার বাসায় আমাকে খাইতে দেয় না? ছিঃ আপনি দুনিয়ার খারাপ। আপনাকে হেল্প করাই উচিত হয় নাই আমার।
শারার মিটমিট করে হাসছে। বলল,
– আর এই খারাপ মানুষটাকে তুমি ভালোবাস।
– কে বলল?
– কেন? তুমিই তো একটু আগে বলেছ।  নি?
– ওটা কিছু না। মুখ ফস্কে বের হয়ে গেছে।
– কিন্তু মুখ ফস্কে বের হোক। আর মন থেকে বের হোক। কথা তো সত্যি। তুমি ভালোবাস আমাকে।
– তা সত্যি। কিন্তু আম্মা…
– কোনো কিন্তু না। আমি যা বলব, তাই শুনবা। শাড়ি খুলো।
– অ্যা? কী বললেন?
– অ্যা মানে কী? কানে শুনতে পাও না? নাকি মাইক আনতে হবে এখন? শাড়ি খোল। তালব্য শ আকার শা, ড় হ্রস্ব ই-কার ড়ি। শা-ড়ি। খুলতে বলেছি। কুইক! হাতে একদম সময় নেই। (চলবে)
পাঠকদের উৎসাহের কারণে কথোপকথনের অংশটুকু আরও বাড়িয়েছি মনের মাধুরী মিশিয়ে। কেউ প্লিজ বিরক্ত হবেন না এই ভেবে, এরা এত কথা বলতে পারে কেমনে? আর হ্যাঁ, গল্প বাড়াতে পারব না। এন্ডিং আগেরটাই থাকবে। আর একটাই পর্ব আছে। যদি সময় পাই, তাহলে ভোর রাতে পোস্ট করে দেব ইনশাল্লাহ। নয়তো আগামীকাল দিনের বেলায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here