নীড় পর্ব-৬

0
1915

নীড়
রেশমী রফিক
৬।।
তুবা ফিক করে হেসে ফেলল। বলল,
– আচ্ছা, এমন তো হতে পারে আপনি যে মেয়েটাকে প্রপোজ করার জন্য এত হন্যে হয়ে আছেন, সে ম্যারিড। কিংবা অন্য কারও সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে?
শারার থমকে গেল। সত্যিই, তুবার কথায় যুক্তি আছে। এই ব্যাপারটা তার মাথায়ই আসেনি। একটু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
– আবার এমনও হতে পারে, সে অলরেডি অ্যানগেজড। মানে কারও সাথে রিলেশন চলছে।
– সেটাই। তখন কী করবেন?
শারার লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– প্রেম জিনিসটা খুবই সাধনার। এত সহজে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তার মর্যাদা থাকে না।
– বুঝলাম।
– এজন্য শুরুতেই হাল ছাড়া যাবে না। আমি মোটামুটি শিউর মেয়েটা ম্যারিড না। এরপরের পসিবিলিটিগুলো তেমন পাত্তা দেবার মতো না।
– কী বলেন?
– ইয়েস। প্রেম মানেই সাধনা।
– আমি ঠিক বুঝলাম না। যদি ওই মেয়ের কারও সাথে রিলেশন থাকে, তাহলে কি আপনি জোর করে প্রপোজ করবেন?
শারার এক চোখ টিপে বলল,
– বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ করানোর ব্যবস্থা করলে সবথেকে বেশি ভালো হয়।
তুবা হতভম্ব। শারার হেসে বলল,
– ওই মেয়ের কোনো বয়ফ্রেন্ডও নাই।
– এত নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?
– বেশ অনেকটা সময় ধরে তাকে খেয়াল করেছি। ম্যারিড হলে তার গেটআপ অন্যরকম থাকত। যেমন শাড়ির সাথে বেশি-বেশি গয়না পরা। চেহারায় ‘ম্যারিড’ সাইনটা ক্লিয়ার বুঝা যেত। আবার বয়ফ্রেন্ড থাকলেও দেখা যেত সে একটু পর পরই মোবাইল কানে দিয়ে কারও সাথে কথা বলছে আড়ালে দাঁড়িয়ে। কিংবা মোবাইলে টেক্সট চালাচালি করছে।
– ওই মেয়েটা ওরকম কিছুই করেনি?
– উহু, বিয়েবাড়ির হৈ-হুল্লোড়ে সে পুরোপুরি মজে ছিল।
– এতেই আপনি ধরে নিলেন সে সিঙ্গেল?
– গেস করলাম আর কী। বাকিটা জানার জন্য তো হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।
– কী করবেন তাহলে এখন? ওই মেয়েটাকে খুঁজে বের করবেন কীভাবে?
– উমম, তোমার আপুর বিয়ের কোনো অ্যালবাম আছে না তোমাদের বাসায়?
তুবা হতাশ কন্ঠে বলল,
– বিয়ের অ্যালবাম দিয়ে কী হবে?
পরক্ষণে চিৎকার করে বলল,
– ইয়েস, বিয়েবাড়ির ছবিগুলো থেকে মেয়েটাকে আইডেন্টিফাই করা যাবে।
– দেরিতে হলেও বুঝতে পারছ। দ্যাটস গুড।
– কিন্তু ছবি তো আপনার কাছেও আছে।
– উহু, আমার মোবাইলে খুব বেশি ছবি তোলা হয়নি। সাইফুলরা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারকে হায়ার করেছিল। তারাই সব ছবি তুলেছে। আর এমনিতেও যারা মোবাইলে তুলেছে, তাদের কাছ থেকে ছবি উদ্ধার করা পসিবল না।
– কেন?
– আমি কী করে জানব, ওই মেয়ের ছবি কার মোবাইলে আছে? এখন কি জনে জনে জিজ্ঞেস করে বেড়াব, এই যে কার মোবাইলে ওই মেয়ের ছবি আছে? আর আমি তো মেয়ের নাম-পরিচয় কিছুই জানি না।
– তা ঠিক। তবে সাইফুল ভাইয়ের কাছে অবশ্যই পাবেন। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের তোলা ছবিতে মেয়েটা অবশ্যই আছে।
– সাইফুলকে বলেছিলাম বিয়ের ছবিগুলো দেখাতে। ও বলল, এখনো নাকি ফটোগ্রাফার ছবি আর ভিডিও দেয়নি। সময় লাগবে একটু।
– ওহ, তাহলে আর কী করার। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
বলেই তুবা উঠে পড়ল। শারার আয়েশ করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে তখন। তুবা কাঁধে ব্যাগ ঝোলাতেই চট করে ওর হাত চেপে ধরল। বলল,
– কোথায় যাচ্ছ তুমি?
– কোথায় আবার? বাসায়!
– কেন?
– কেন মানে কী? আমার কি অন্য কোথাও যাবার কথা?
– না, কিন্তু আমাদের ডিসকাশন এখনো শেষ হয়নি।
– কে বলল শেষ হয়নি? প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার ছবি আর ভিডিও দেয়া পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতে হবে। ওগুলো পেলেই…
– উহু, তুমি বসো।
– পারব না, শারার ভাই। এমনিতেই লেট হয়ে গেছে। টাইমলি না ফিরলে আম্মা অনেক চিল্লাচিল্লি করবে।
– আমি তোমাকে ড্রপ করে দিব। প্লিজ, আরেকটু বসো।
তুবা আবার বসে পড়ল। হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
– বসলাম। এখন বলেন আপনার কথা।
– আমি বলছিলাম যে, তোমাদের মানে কনেপক্ষ থেকে কি ছবি তোলা হয়নি কোনো? মানে কোনো ফটোগ্রাফার…
– উমমম, ঠিক জানি না। ভাইয়ার ফ্রেন্ড তো দুইজন ডিএসএলআর ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল। ওরা কতদূর কী ছবি তুলেছে কে জানে। আর আমাদের দিক থেকে কোনো ফটোগ্রাফার হায়ার করা হয়নি। বড় দুলাভাই, ভাইয়া, ভাবি সবারই কমবেশি স্মার্টফোন আছে। ক্যামেরার রেজুলেশন ভালো। আর মেজপুর কয়েকটা ফ্রেন্ডও ছবি তুলেছে প্রোগ্রামের।
– তুমি কোনো ছবি তুলোনি?
– আমি কীভাবে তুলব? আমার তো মোবাইল নাই। ক্যামেরাও নাই।
শারার বড়-বড় চোখ করে তাকাতেই তুবা দাঁতে জিভ কেটে বলল,
– ইয়ে, ব্যাপারটা হইছে কী। আমার মোবাইলটার কথা আম্মা জানে না। শুধু ভাইয়া আর আব্বা জানে। বড়াপু, মেজপু কেউ জানে না। এইজন্য সবার সামনে মোবাইল বের করি না। বুঝতেই পারছেন ছবিও তোলা হয় নাই সেরকম।
– তার মানে তুমি কোনো ছবিই কালেক্ট করতে পারবা না?
– চেষ্টা করে দেখি। ভাইয়াকে বলব। বড়াপু আর মেজপুকেও বলব নে।
– হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে। আমি শিউর, ওই মেয়ের ছবি তোমাদের কারও তোলা মোবাইল বা ক্যামেরাতেই পাওয়া যাবে।
সেদিন কথাবার্তা অতটুকুই ছিল। তুবার দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে শারার ওকে ওয়্যারলেস মেইন রোডে নামিয়ে দিয়েছে। এরপর বাকিটা রিকশায় চড়ে গেছে। তবু মায়ের ঝাড়ি থেকে রক্ষা পায়নি। প্রায় আধঘন্টা ওকে বাসার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন শেফালি। একনাগাড়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। এমনকি রিকশাওয়ালাকেও জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথা থেকে এসেছে। ভাগ্যিস, সেদিন তুবা বুদ্ধি করে লিমার কথা বলেছিল। লিমা ওর স্কুলের বান্ধবী। ওদের বাসা ওয়্যারলেস মেইনরোডেই। আড়ং ভবনের উপরতলার অ্যাপার্টমেন্টগুলোর একটায় থাকে ওরা। ভালো মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে বলেছে, বাসায় ফেরার পথেই লিমার সাথে দেখা হয়েছে। রিকশা থামিয়ে কথা বলেছে খানিকক্ষণ। এরপর লিমা ওকে জোর করে নিয়ে গেছে তার বাসায়। সেজন্যই আসতে দেরি হয়েছে।
শেফালি মেয়ের কথা বিশ্বাস করেছেন কি না, তার মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই। তবে হাতেনাতে কোনো প্রমাণ না পেয়ে আর কথা বাড়াননি। এমনিতেও তুবাকে সন্দেহ করার মতো কিছু পাননি কখনো।
সেদিন অল্পের উপর দিয়ে ফাঁড়া কেটেছে। এজন্য আজ তুবা শারারকে আগেভাগে আসতে বলেছে। কলেজ ছুটি হবার কথা ছিল দুপুর একটায়। কিন্তু আজ দু’ঘন্টা বেশি থাকতে হয়েছে। হিসাববিজ্ঞান ম্যাম বহুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। অন্য এক ম্যাডাম উনার বদলি ক্লাস নিয়েছেন এতকাল। গতকাল উনি কলেজে এসেছেন। ওদের ক্লাস নিয়েছেন। সামনে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। অথচ সিলেবাসের অনেকটাই পড়ানো বাকি। একারণে ম্যাম গতকালই বলে রেখেছেন, কলেজ ছুটির পর যেন ক্লাসে থাকে মেয়েরা। তিনি এই সময়টায় ওদের বাড়তি ক্লাস নেবেন। আপাতত এক সপ্তাহ এভাবেই বাড়তি ক্লাস নিতে হবে। বেশ কিছু মেয়ে অবশ্য আপত্তি জানিয়েছে, তারা এই বাড়তি ক্লাস করবে না। কারণ তিনটায় তাদের কোচিং শুরু। এদিকে সুলতানা আর তুবাসহ বেশ কিছু মেয়েরা বলেছে, তারা কোচিং ক্লাসে দেরি করে উপস্থিত হবে। দরকার পড়লে এই এক সপ্তাহ কোচিংয়ে যাবে না। তবু হিসাব বিজ্ঞানের ক্লাস করা জরুরী। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের মূল বিষয় তো এটাই। তাও যেনতেন বিষয় নয়, এতে অঙ্ক আছে। অন্যগুলোয় কোনোরকমে থিউরি মুখস্ত করে লিখে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। হিসাব বিজ্ঞানে সেই সুযোগ নেই।
এই সুযোগটাই নিয়েছে তুবা। বাসায় কিছু জানায়নি আগ বাড়িয়ে। জানাবার দরকারও নেই। গত ক’দিন ধরে হিসাব বিজ্ঞানের ক্লাস শেষ করেই শারারের সাথে দেখা করতে দৌড়ায় সে। তবে আজই বোধহয় শেষ। আর দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। কারণ, শারারের কথামতো আজ সে মেজপুর বিয়ের অ্যালবাম নিয়ে এসেছে। গতকালই ভাইয়া সবগুলো ছবি ওয়াশ করে এনেছিল। মেজপুকে কেউ একজন বড়সড় অ্যালবাম উপহার দিয়েছে। সেটায় সবগুলো ছবি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই অ্যালবাম আজ তুবা নিয়ে এসেছে কলেজে। এটা থেকে শারারের পছন্দের মেয়েকে খুঁজে বের করা হবে। শারার মেয়েটাকে চিনতে পারলেই কাজ শেষ। তুবার পরিচিত অবশ্যই ওই মেয়ে। সে তখন শারারকে মেয়ের বৃত্তান্ত জানাবে, যতটা জানে আর কী। এর মধ্যেই শারারের কথার ধরন অনুসারে ছবিগুলোয় মিলিয়ে দেখেছে একটা মেয়েকে। মেয়েটা তুবারই চাচাত বোন। বড় চাচার একমাত্র মেয়ে। নাম তিতলি।
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here