নীড় পর্ব-৭

0
1742

নীড়
রেশমী রফিক
৭।।
তিতলি আপু তুবার চাইতে অনেক বড়। প্রায় মেজপুর বয়সী। দিবা হয়তো দুই-এক বছরের বড় হবে তিতলির। খুব রাশভারী গম্ভীর মেয়ে। সহসা কারও সাথে মিশতে পারে না, কথাও বলে না। তুবার ধারণা, এর জন্য দায়ী বড় চাচি অর্থাৎ তিতলির আম্মা। গুলশান আরা সবসময়ই মেয়েকে সামলে রাখেন। হুটহাট কারও সাথে মিশতে দেন না। যে সময়ে দিনা, দিনার বা দিবারা মেঝেয় গড়াগড়ি দিয়েছে, বা ধুলোবালির সাথে সখ্য গড়েছে, তখন তিনি তার পুতুলের মতো মেয়েকে সুন্দর করে সাজিয়ে বিছানায় ফোমের উপর বসিয়ে রাখতেন। চারপাশে থাকত অসংখ্য খেলনা। সবগুলোই দামি। হয় বিদেশ থেকে আনা, নয়তো চড়া দামে কেনা। দিনার-দিবাদের মতো সস্তা প্লাস্টিকের খেলনা কখনো তার হাতে উঠেনি। মেয়ে যখন একটু বড় হলো, তখন তাকে স্কুলে আনা-নেয়া করার জন্য গাড়ি কেনা হলো। মাসিক বেতনের ভিত্তিতে ড্রাইভার রাখা হলো। সে কী এলাহি কারবার! তিতলি স্কুলে যাবার কয়েক বছরের মধ্যেই চাচি তার বাবার বাড়ি থেকে নিজ অংশ বুঝে পেলেন। নিজ বলতে মিরপুরে চাচির বাবার বাড়ির অর্ধেক। বাকি অর্ধেক পেয়েছে চাচির বোন। অতঃপর বড় চাচা সপরিবারে চলে গেলেন সেখানে।
দিবার বিয়ে উপলক্ষ্যে বড় চাচারা এসেছিলেন। উপরতলায় একটা ফ্ল্যাট আগেই খালি করে রেখেছিলেন দিদারুল সাহেব। দিবার বিয়েতে যেসব আত্মীয়রা দূর-দূরান্ত থেকে আসবে, তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে ওখানে। বিয়ের ঝামেলা শেষ হবার পর দিনার আলাদা সংসার পাতবে ওখানে। আদৃতা প্রেগন্যান্ট, তার উপর বাসায় সেরকম কোনো ঘরও নেই। দিনারের থাকার মূল ব্যবস্থা বসার ঘরে। তবে বিয়ের পর আদৃতা যে কয়বার শ্বশুরবাড়ি এসেছে, ভাই-ভাবিকে নিজেদের রুম ছেড়ে দিয়ে দিবা-তুবা বসার ঘরে ঘাঁটি গেড়েছিল। আদতে বসার ঘর না হলে ওটাকে সেমি-বেডরুম বলা যায়। বসার ঘর কাম ডাইনিং বলতে যে জায়গাটা আছে তুবাদের বাসায়, ওটা আসলে বাসার বিশাল বড় অংশ। বসার ঘরটা ছোট পরিসরে সাজানো হয়েছে। ডাইনিংটাও বলতে গেলে ছোট। দিবার মায়ের বড় বাড়ি একদম পছন্দ না। পরিবার নিয়ে অল্প পরিসরে নিজ গন্ডির ভেতর থাকতে পছন্দ করেন তিনি। একারণে বসার ঘরের বারান্দা সংলগ্ন এক চিলতে জায়গা বলতে গেলে খালিই ছিল অনেক বছর। ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর দিনারকে ওখানে আলাদাভাবে পড়াশুনার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ওখানেই স্থায়ী হয়ে গেছে সে। আলমারি, খাট, কম্পিউটার টেবিল সবকিছু নিয়ে নিজের নিরিবিলি জগৎ তৈরি করেছে ডিভাইডারের ওপাশে। শেফালি এমনভাবে বাসা সাজিয়েছেন যেন বসার ঘরে কেউ এলে ডিভাইডারের ওপাশের প্রাইভেসিতে যেন বিঘ্ন না ঘটে। বসার ঘরটাকে সদর দরজার সাথে রেখে, মাঝখানে ডাইনিং টেবিল বসিয়েছেন। রান্নাঘরটাও ডাইনিংয়ের সাথেই। টেবিলের অন্যপাশে ডিভাইডার দিয়ে দিনারের শোবার ঘরটা পৃথক করা হয়েছে। তবু নতুন বউকে ওখানে থাকতে দেয়াটা বেমানান। এজন্য সে বাসায় এলে দিবা-তুবা ওখানে আস্তানা গাড়ে।
দিবার বিয়ের পর আদৃতা শ্বশুরবাড়িতে স্থায়ী হবে। ঘরোয়াভাবে অনুষ্ঠান করে ওকে তুলে আনা হবে। তখন ওরা উপরতলায় থাকবে। সেভাবেই ফার্নিচার কেনা হয়েছে অল্পসল্প। বাকিটা দিনার আর আদৃতা মিলেমিশে কিনবে। দিবার বিয়ের সময় সেখানে আত্মীয়দের থাকার ব্যবস্থা করা হলেও বড় চাচি শুরুতেই নাক সিটকালেন। তার তুলোর মতো নরম মেয়েকে নিয়ে এতসব মানুষজনের মধ্যে থাকা সম্ভব না। তিতলির প্রাইভেসি বলতে কিছুই থাকবে না তাহলে। এই বিয়েবাড়ির হট্টগোলেও সে বইখাতা নিয়ে এসেছে। সামনের মাসে তার সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। পাশেই দুই বাড়ি পর তিতলিদের নিজেদের বাড়ি। বাবার সম্পত্তি পেয়ে প্রাপ্ত জমির উপর ছয়তলা দালান করেছিলেন বড় চাচা। তিতলির জন্ম ওই বাড়িতেই। ওখানে একটা চিলেকোঠা আছে। চাচির খুব পছন্দের ছিল ছাদটা। শখের বশেই চিলেকোঠা বানানো হয়েছিল। আদতে চিলেকোঠা বলতে যা বুঝায়, তা নয়। বলা ভালো একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। তুবার চাচি খুব সৌখিন ঘরানার মানুষ। ছাদটা বলতে গেলে তার দখলেই থাকত। সেখানে চিলেকোঠার নামে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে ছিলেন। ওটা আসলে তার ছবি আঁকার ঘর। দিনের অনেকটা সময় ধরে তিনি ওই ঘরে বসে ছবি আঁকতেন। কখনোবা তিন-চারদিন একনাগাড়ে ছাদেই কাটিয়ে দিতেন। পরবর্তীতে এই বিল্ডিং পুরোটা ভাড়া দিয়ে অন্য বাসায় চলে গেলেও চিলেকোঠার ঘরটা তালাবদ্ধ থাকে। সংসারের কিছু জিনিসপত্র চাচি এখানে রেখে গেছেন। প্রায়ই আসেন। কিছুক্ষণ খুটখাট করে আবার ফিরে যান।
দিবার বিয়ে উপলক্ষ্যে তিতলিকে নিয়ে ওই চিলেকোঠার ঘরে ছিলেন তিনি। বড় চাচা অবশ্য বিয়েবাড়ি ছেড়ে একদণ্ড নড়েননি। দিবা এই বংশের বড় সন্তান না হলেও আদতে তার বিয়েটা এই বাড়ির প্রথম বিয়ে। বড় চাচার এক ছেলে আছে। পড়াশুনা করতে বিলেতে পাড়ি জমিয়েছিল। এরপর আর ফেরেনি। ওখানেই এক ইংরেজ মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। সিরিয়াল অনুসারে এরপর বিয়ে হবার কথা ছিল দিনার। সে তো পালিয়েই গেল। এরপর দিনারের পালা। দিনারের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে-হবে করেও হলো না। প্রথমে আকদ করা হয়েছিল ঘরোয়াভাবে। কথা ছিল, আদৃতার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হলে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা হবে। এর মধ্যেই সে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে এখনো তুলে আনা হয়নি। বাচ্চাটা সহিসালামতে জন্ম নিলে এরপর দুই পরিবার মিলে একটা ছোটখাট গেট টুগেদারের আয়োজন করবে। সেখানে দুই পরিবারের সদস্য আর আত্মীয়রা নিজেদের মধ্যে পরিচিত হবে। সাথে দিনার-আদৃতার প্রথম সন্তানকেও দেখা হবে। এক ঢিলে দুই পাখি। সঙ্গত কারণেই দিবার বিয়ে নিয়ে বংশের সবারই প্রত্যাশা ছিল কমবেশি। তাই দাওয়াত পাওয়ামাত্র কেউ দেরি করেনি। সপরিবারে চলে এসেছে।
শারার ভাইয়ের কথা অনুসারে, মেয়েটা তিতলি হবার সম্ভাবনা বেশি। কারণ বিয়েবাড়িতে একমাত্র সে-ই সবথেকে বেশি উচ্ছ্বসিত ছিল। সাধারণত মায়ের কড়াকড়ির কারণে দাদাবাড়ির কারও সাথে তার মেশা হয় না। চাচাত-ফুপাত ভাইবোনদের সাথে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু সেখানেও চাচির খবরদারি চলে। তার ফ্রেন্ডলিস্টে কে থাকবে আর কে থাকবে না, সেটা তিনিই ঠিক করে দেন। নানুবাড়ির দিকে যাকে খুশি অ্যাড করা যাবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কেবল দাদাবাড়ির দিকের কাউকে অ্যাড করলেই চাচির সমস্যা। তিনি কানের কাছে অনবরত ঘ্যানঘ্যান করেন। ঘ্যানঘ্যান বলতে দাদাবাড়ির প্রতিটা মানুষের বদনাম। তিতলির ভালো লাগে না এগুলো শুনতে। দাদাবাড়ির মানুষরা তার বাবার ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙ্গে খেয়েছে, মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। এগুলো বহু পুরনো গল্প। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার জোগাড়। হয়তো তার মায়ের কথাই ঠিক। দাদাবাড়ির মানুষরা ভালো না। কিন্তু তাই বলে সে কেন কাজিনদের সাথে মিশবে না? কেন চাচা-ফুপুদের সাথে যোগাযোগ রাখবে না। সে তো ওই বংশেরই একজন। মাকে এসব যুক্তি দেখানো অনর্থক। তাই ‘সমঝে চলো’ নীতিতে চলে সে। নাইবা থাকল দাদাবাড়ির কারও সাথে যোগাযোগ। তাদের সাথে কথা বলার জন্য সে মরেও যাচ্ছে না।
কিন্তু দিবার বিয়েতে এসে সে রীতিমতো ঈর্ষান্বিত। কাজিনরা সবাই এত বেশি হৈ-হুল্লোড় করছে। সবার চোখমুখে চাপা আনন্দ। বিয়েবাড়ির এই আনন্দ ঘনঘটায় সবাই যেন বয়স গুলে খেয়েছে। হোক ছোট কী বড়, সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে আনন্দ উৎসবে যোগ দিয়েছে। চাচি-ফুপুরাও কাজকর্মের ফাঁকে গল্পের আসর জমিয়েছেন। কাজিনদের কথা আর কী বলবে। সারাক্ষণ হুড়াহুড়ি আর দৌড়াদৌড়ি।
আজীবন নির্জন ফ্ল্যাটে বড় হওয়া তিতলি দাদাবাড়িতে পা দিয়ে রীতিমতো হতবিহ্বল। বইখাতা নিয়ে এসেছিল বটে, কিন্তু ধাতস্থ হবার আগেই কে যেন তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। নিজেকে সে আবিস্কার করল কোনো এক আড্ডার মধ্যমণি হিসেবে। সবাই তাকে ঘিরে আছে। প্রত্যেকের মুখে কলকাকলীর মেলা ছুটছে। চোখে চাপা উচ্ছ্বাস। যেন সে আসাতে তাদের আসর পরিপূর্ণ হয়েছে। কতজন তো ওকে জাপটেই ধরল। এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল, দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। আর কানের কাছে চিল-চিৎকার তো আছেই। এক ঝটকায় তিতলি ভুলে গেল, বাসা থেকে রওনা হবার আগে তার মা কী কী শিখিয়ে-পড়িয়ে এনেছে। পরবর্তীতে মায়ের সামনে পড়লেও চোখ রাঙ্গানি দেখার সুযোগ হয়নি। মা নিজেও কি কম জ্বালায় পড়েছে? চাচি-ফুপুরা তাকে একদণ্ড চোখের আড়াল করছে না। আড়ালে গিয়ে মেয়েকে শাসন করার সুযোগ পেলে তো!
(চলবে)
পরের পর্ব রাত নয়টায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here