১.
‘হেই প্রিটিগার্ল চলেন আমার সঙ্গে একরাত দুজনে নেশায় মগ্ন থাকি। নেশা মিটিয়ে দিতে যত চাইবেন তার চেয়ে দ্বিগুণ দেবো। মনে করবেন না টাকার কমতি আছে।’
অচেনা যুবকের রাশভারী কণ্ঠ হতে বাক্যগুলো শুনে আনজুমার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠে। কাঁপুনির তালে তার হাতে ট্রের গ্লাসগুলোও সমান তালে কাঁপছে। চোখ তুলে যুবকের মুখ চেয়ে দেখল না। মাস্কের ভাঁজ নেড়ে মুখটা আবৃত রাখার প্রচেষ্টা করে সে। যুবকের গম্ভীর সূচাঁলো দৃষ্টি মেয়েটির আপাদমস্তক লক্ষ করছে। ঠোঁটের ভাঁজ দিয়ে ড্রিংকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে পান করে। আড়চোখে মেয়েটির কাঁপনধারা পরখ করছে। ব্যাপারটা দারুণ ঠেকছে তার দৃষ্টিকোণে। আনজুমা দৃষ্টিনত করে চলে যেতে নিলে পা থেমে যায় যুবকের কণ্ঠনালী হতে ব্যয়িত বাক্যে।
‘মিস কাম অন ডোন্ট ইগনোর মি। উই উইল বি এঞ্জয় ফুল নাইট।’
যুবকটি তার সন্নিকটে এসে হেঁটে ঘুরে পরখ করে। আনজুমার শরীর সংকোচ,জড়তায় কেঁপে চলছে ক্রমান্বয়ে। এমন পরিস্থিতিতে সে বারংবার পড়েছে। তবে কারো হাল বেহাল করার ক্ষমতা নেই তার। নিশ্চুপে কেটে পড়ে তখন। এতে হিতে বিপরীত হয়নি। অন্যথায় নতুন যুবকটি তাকে থামিয়ে দিচ্ছে। কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলে,
‘স্যার আপনার ড্রিংকের গ্লাসটি খালি হয়েছে। রাখুন আমি আরেক গ্লাস নিয়ে আসি।’
‘ওয়াও দ্যাটস সাউন্ডস গুড। কাম ইন মাই রুম বেইব।’
গ্লাসটি আনজুমার হাতে থাকা ট্রের উপর রেখে সন্তঃপণে নিজরুমের দিকে অগ্রসর হলো যুবক। মৃদু শরীর ঝাঁকিয়ে তৎক্ষণাৎ চিপা রুমের দিকে চলে যায় আনজুমা। চিপা রুমের ভেতর প্রবেশ করে। সেখানে ব্যাগের কাবার্ড রয়েছে সব ওয়েটারের। তার নিজের নাম চেক করে সেই কাবার্ড এর ড্রয়ার ওপেন করে। ব্যাগ থেকে সরল,রঙচটা থ্রিপিচ বের করে ওয়াশরুম চলে যায়। সাদামাটা থ্রিপিচটি পরে বেরিয়ে এলো। সমাবেশের চুক্ষগোচর হতে শরীর রক্ষার্থে বোরকা পরিদান করে । যেন ক্লাবে অবস্থানরত উ*ল*ঙ্গ মনের মানবেরা তাকে উ্যক্ত করতে না পারে। ফোন বের করে ক্লাবের ম্যানেজারকে মেসেজ দেয়।
‘স্যার আইম এক্সট্রেমলি সরি। আমার বাসায় ফিরতে হবে। খুব অসুস্থবোধ করছি আল্লাহ হাফেজ।’
মেসেজ সেন্ড করে ফোনটি সুইচ অফ করে ব্যাগে পুরে রেখে বেরিয়ে যায় আনজুমা। কোনো ধরনের অশ্লীল কথার সম্মুখীন হতে হবে না ইতিমধ্যে। তড়িঘড়ি রিক্সা ভাড়া করে বাসার দিকে রওনা হয়।
কাসুন্দি মিটনাইট ক্লাব💥
ক্লাবে যুবক তার বরাদ্দকৃত রুমে প্রবেশের ন্যায় দরজা খুলে। সকলে তৎপরে উৎফুল্লতায় জোরালো শব্দে ‘হ্যাপি বাথডে’ বলে উঠে। যুবক সরল মনে ভবন ভুলানো হাসি দেয়। তার রুমটি কোনো একসাইড রুম নয়। বরং এটি বাহির থেকে ছোট রুমের মত দেখালেও ভেতর থেকে একটি হলরুমের মত আলিশান বিস্তর আকৃতির। যুবক মিনি সাইজের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। টেবিলের উপর হরেক রকমের উপহার রাখা, তিন সাইজের চকলেট-ভ্যানিলা ফ্লেভারের কেক রাখা, মেয়েদের পক্ষ হতে লাভলেটার্স রাখা। ছুড়ি নিয়ে কেক কেটে এক টুকরো হাতে নিল। তার পাশে যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে তাকে খাওয়ে দেয়। ব্যক্তিটি উৎফুল্ল নজরে যুবকের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আল্লাহ উইল গিভ ইউ এ লং লাইফ মাই সান। লেডিস এন্ড জেন্টালম্যান মিট মাই রয়েল সান আরভীক ফাওয়াজ।’
‘থ্যাংকস ড্যাড।’
‘এঞ্জয় সান আই উইল গো নাউ।’
জনাব আরাজ ফাওয়াজ ছেলের জম্মদিন উপলক্ষে ক্লাবে হলরুমটি বুক করে ছিল। যেন ছেলে তার জম্মদিনের আনন্দ উজ্জ্বল, রসিকতায় কাটাতে পারে। ফলে ছেলেকে ভার্সিটি থেকে সোজা ক্লাবে চলে আসতে বলে। তিনি চায়নি আরভীক কোনো কমতি অনুভব করুক। বিধেয় জরুরি মিটিং থাকার সত্ত্বেও জম্মদিন পালনের উদ্যোগে তিনি প্রতিটা কাজ নিখুঁতভাবে করে হলরুম সাজিয়েছে। আরভীক থেকে বিদায় নিয়ে তিনি মিটিং এটেন্ট করতে চলে যায়। আরভীক তার বাবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসে। তখনি ঠাস ঠাস বার দুয়েক বারি দেয় কেউ তার পিঠে। সে ভ্রু কুঁচকে পিছে ঘুরে দেখে। তার বদ*মা*ইশ জানে জিগার দুটা রাগান্বিত নজরে তাকিয়ে আছে। তাদের রাগ দেখেও কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করে পাশ কাটিয়ে সুন্দরী এক রমণীকে ডাক দেয়।
‘হেই বেবিগার্ল লিসেন।’
ছেলে দুটা আরভীক এর ভাব দেখে ফোঁসে উঠে। আরভীক যেই না রমণীর সঙ্গে হাত মেলাতে যাবে। তখনি তার মুখের দিকে কেক ছুড়ে মারে দুজনে। আরভীক আড়চোখে তাকাতেই তৎক্ষণাৎ সরে পড়ে। ফলস্বরুপ কেক লেগে যায় সেই রমণীর মুখে। যাকে আরভীক ডেকে ছিল। রমণী রাগে ফুলে ফোঁসে পার্স নিয়ে দুএক ঘা দিতে আরম্ভ করে দুজন ছেলেকে। আরভীক কে দেখে ছেলে দুটা আহতপূর্ণ চোখে সহায়তার কণ্ঠে বলে,
‘তুই বড় মাপের কু*ত্তা।’
‘কি বললি তুই!’
আরভীক চোখ রাঙিয়ে তাকায়। ছেলে দুটা ভয়ে আমতা আমতা করে বলে,
‘আই মিন বড় মাপের গু*ন্ডা।’
চোরা হাসি দিয়ে আরভীক দুজনকে বাঁচিয়ে নেয়। রমণী পুনরায় মারতে নিলে গর্জে উঠে সে।
‘দু-এক মা*র*লে কিছু বললাম না। আমি ধরেছি দ্যাটস মিন ইটস এন্ড নাউ। কথার খেলাফে আঘাত দিলে তোমার সুন্দর চামড়াও আঘাত পাবে।’
রমণী ভয়ে পা গুটিয়ে সরে পড়ে। আরভীক তার শার্টের কলার টান করে ভাঁজ খুলে ফেলে। জেন্টালম্যান হয়ে চলার মত ইচ্ছে তার নেই। সে ভিন্নজাতের ব্যাড বয়। আরভীক তার জানে জিগারের দোস্তের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে,
‘তো হঠাৎ রেগে ফোঁসার কারণ জানতে পারি।’
‘ভাই তোর জম্মদিন বলে সাইবা বিচের মধ্যে রোমান্টিক মঞ্চ বানিয়ে বসে আছে। তোকে না পেয়ে এই মাসুম বাচ্চাদের উপর অ*ত্যা*চা*র করে যাচ্ছে।’
‘উফ এগেইন সাইবা। এ মেয়েরে গলা টি*পে মে*রে ফেল*তে মন চাই।’
‘কেন বে তোর পরাণের তৃষ্ণা, জানের কলিজা না সে!’
‘ফাহাদ বড্ড বলছিস।’
‘কিয়ের বড্ড বললাম হে! স্কুল লাইফ থেকে দেখে আসছি। সাইবারে কাছে পেলেই তোর যতসব ন্যাকামি। দূরে থাকলে ঢং মার্কা গা*লি শুনাস।’
‘আব্বে সায়াজ তুইও যোগ দিলি। পঁচানো হচ্ছে আমাকে।’
‘না না বড় মাপের গু*ন্ডা মাওয়ালি কে কেউ পঁচায়! তোকে তো পিঠিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলা উচিৎ।’
‘তোরা পেরেছিস আজ পর্যন্ত তুলতে!’
গাম্ভীর্যে ভরা নজরে আত্মবিশ্বাসময় কণ্ঠে আরভীক তার দুই বন্ধুর দিকে তাকায়। বেচারাদের মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। ন্যাকা সেজে কথা ঘুরানোর জন্যে বলে,
‘হয়ছে এত দূর কে জানাতে চাইবে। আমরা মজা করতেছি সিরিয়াসলি ইয়ার।’
আরভীক বাঁকা হেসে সায়াজ ও ফাহাদের গলা জড়িয়ে ধরে তাদের পিঠ বরাবর ধুমধাম মা*র*তে আরম্ভ করে। তিনজন লেগে পড়ে অট্টহাস্য রসিকতার মজ্জায়।
২.
‘আম্মু তুমি আবাল লেইট। আমি তোমাল সাথে কথা বলব না আড়ি হুহ্।’
ছেলের কথায় তিব্র অভিমান ভেসে উঠে। যা শুনে দুঃখি মায়ের মনে নেমে আসে একঝিলকি খুশির জোয়ার। পূর্ণ মেঘের আড়ালে আবৃত হয়ে সংসার গুছাতেই আনজুমার জীবন সংগ্রাম। ছেলে হয়েছেও বড্ড জেদি। তার জেদ ভাঙ্গানো আনজুমার বাঁ-হাতের ব্যাপার। হাতজোড়া কানে ধরে বাচ্চাদের মত মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘আশফি বাবাই আম্মুকে ক্ষমা করলে কেক দেব কিন্তু।’
কেকের কথা শুনে চার বছরের ছেলে আশফির মুখে পানি চলে এলো। সরু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে পুনরায় মুখ ফুলানোর ভান করে বলে,
‘কেক আনলেও রাগ ভাঙ্গতে পারবে না তুলি।’
‘আহ লক্ষী ছেলে কেক না খেলে দুষ্টু ছেলে হয়ে যাবে।’
কথার সমাপ্তি ঘটানোর পূর্বেই আশফি মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে গেল।
‘আম্মু আমালে দাও। আমি কেক খেয়ে ভদ্র ছেলে হবো।’
ছেলের সান্নিধ্য পেয়ে কলিজায় ঠান্ডা অনুভব করে আনজুমা। আবেগে ছেলেকে কোলে উঠিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যায়। সেখানে ট্রি টেবিলে সুন্দর করে কেক সাজিয়ে একটি উপহার রাখা আছে। আশফি উপহারটি প্রথমে খুলে। আনজুমার দিকে কান্নারত চোখে তাকিয়ে ‘থ্যাংকিউ আম্মু’ বলে গালে চুমু খায়। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ছুড়ি হাতে দিল। আশফি গিফ্টটা বুকে চেপে রেখে কেক কাটে। কেকের টুকরো মাকে খাওয়ে কোলে বসে পড়ে। আনজুমা কেক খাওয়ে দিতে থেকে জিজ্ঞেস করে।
‘পছন্দ হয়েছে নবাবের!’
‘আম্মু এটা আমাল ফেভারিট বিএমডাব্লিউ কারের আর্ট বুক।’
আশফি আর্টবুকটি বারংবার খুলে কালারগুলো মনের মধ্যে সাজাচ্ছে। ছেলের দক্ষতা আছে বটে। কালারের উপর জোঁক বেশি তার। সবচেয়ে প্রিয় জিনিস যদি কেউ তাকে দিতে চাই তাহলে বিএমডাব্লিউ কার এনে দিলে হবে। সে খোশমেজাজে চলে যাবে। আকস্মিক গালে চুমু পড়ায় হেসে দিল আনজুমা। ছেলেকে আদর করে মাথায় তেল লাগাতে গেলে ল্যান্ডফোনে কল এলো। কোল থেকে আশফিকে মেঝেতে রাখে। আশফি মেঝের উপরে বসে কালার নিয়ে আর্টবুক এ আঁকাবুকিঁ করতে আরম্ভ করে। হাতে নেওয়া স্বল্পখানিক তেলগুলো মাথায় লাগিয়ে নেয় আনজুমা। ল্যান্ডফোন অনবরত বেজে চলছে। রাত বাজে নয়টা। কেউ কখনো তাকে ল্যান্ডফোনে জরুরী ভিত্তি ছাড়া কল দেয়নি। ক্লাবের ম্যানেজার নয়তো! ভেবেই সময় বিলম্ব না করে ল্যান্ডফোনের হ্যান্ডেল কানে লাগিয়ে,
‘আসসালামুয়ালাইকুম কে বলছেন!’
অপরপাশ থেকে শাঁ শাঁ বাতাসের শব্দ ভেসে আসছে। আনজুমা নিষ্পন্ন চাহনী নিয়ে ল্যান্ডফোনের দিকে তাকায়। পুনরায় গলায় ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করে।
‘কে!’
‘প্রিটিগার্ল কথার অবাধ্য হয়ে মস্ত বড় ভুল করলেন।’
ব্যক্ত করা বাক্যটি যে কণ্ঠের মালিকের কাছ থেকে প্রকাশিত তাকে চিনতে ভুল করেনি আনজুমা। চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। ফোনের হ্যান্ডেল চেপে ধরে চাপা গলায় বলে,
‘মা মানে!’
‘প্রিটিগার্ল বলেছিলাম ড্রিংক নিয়ে আমার কাছে আসবেন। সেই আপনি নেশাবুদ পাগলকে ফেলে চলে গেলেন। এখন এই নেশাবুদ পাগল যদি আপনার বাসায় হানা দেয় তখন কি করবেন!’
যুবকের কথায় গলা শুকিয়ে কাঠ প্রায়। কথার বিপরীতে কি বলে ইতি টানবে বুঝছে না আনজুমা। আমতা আমতা করে বলে,
‘আ আমি অসুস্থ তাই।’
‘ওহ রিয়েলি ইউ আর সিক। দ্যাটস মিন ইউ নিড মি ব্যাডলি রাইট নাউ।’
‘চুপ করুন কথা বলতে দিয়েছি তার মানে এই নয় অ*সভ্য*তামি করে যাবেন। রাতবিরাতে কল করে মেয়েদের উ্যক্ত করলে থানায় আপনার নামে কেস দেব শা*লা ব*দখোঁড় লোক।’
দুঃসাহসিক কাজ করে শরীর হালকা অনুভব করছে আনজুমা। যুবকের রাশভারী কণ্ঠ শুনলেই কাপুঁনি ধরে তার। অসহ্য, অস্বস্তি দেয় যুবকের চোখের দৃষ্টিকোণ। ল্যান্ডফোনের সুইচ অফ করে দেয়। যেন কেউ কল করে বিরক্তি না করে। এ সময় সে শুধু তার ছেলের সঙ্গেই কাটায়।
কাসুন্দি মিটনাইট ক্লাব💥
ক্লাবে নাচ-গান-বাজনা চলছে ক্রমাগত। আরভীক ড্রিংকের গ্লাসে লেবু গুলে পান করছে। এতে তার নেশা ধরে না সহজে। লেবু বড্ড প্রিয় জিনিস বলা বটে। একবার খেলে টক যেমন প্রতিবার খেলে গালসহ টকময় হয়ে যায়। ড্রিংকের গ্লাসে লেবু দিতে দেখে সায়াজ ও ফাহাদ চেঁতে উঠে।
‘দোস্ত তোরটায় দিতেছিস ভালা কথা। আমাগোর গ্লাসে কেন দিতেছিস!’
‘কি মনে করস আমারে!
নেশা ছড়িয়ে ক্লাব রুমে ফস্টিনস্টি করবি আর আমি বুঝি ছেড়ে দেবো!’
ভোঁতা মুখখান ইঁদুরের মত করে। দৃষ্টিকোণে কটাক্ষপূর্ণ কথা বলতে নিলে। আরভীক বলে,
‘ওত ভালো বদদোয়া যেন মুখ থেকে বের না হয়। আমি বের করলে কেয়ামত হয়ে যাবে।’
মুখে যে কথা আনার ছিল নিমিশেষেই গিলে হজম করে ফেলে সায়াজ ও ফাহাদ। আরভীক গ্লাস পাঁচটি তাদের দিকে এগিয়ে দেয়। তিনটি তার নিজের বাকি দুটি সায়াজ ও ফাহাদের।
‘সেয়াস’ করে পান করায় মগ্ন হলো। আড়চোখে ক্লাবের কোণায় কোণায় চোখের বিচরণ দেয় আরভীক। তবে কোথাও সেই মাস্ক পরিহিতা রমণীর আগমন পেল না। ক্ষোভ জম্মে আছে তার। জম্মদিন উপলক্ষে চেয়ে ছিল মেয়েটির সাথে নটি*মেট টাইম স্পেন্ড করতে।
‘স্যার আপনার খোঁজা মেয়েকে পেতে একটু সময় লাগবে।’
এসিস্টেন্ট অঞ্জর এর কাঁপান্বিত চেহারার দিকে স্বাভাবিক চোখ নিয়ে তাকায় আরভীক। সায়াজ ও ফাহাদ কথাটি শুনে হ্যাবলার মত মুখ করে বলে,
‘কিরে আরভীক আমাদের দমিয়ে নিজে ফস্টিনস্টি করতেছিস!’
বন্ধু তাদের নিশ্চুপ,বিমূঢ়। অঞ্জয় ভীতি নজরে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে। আরভীক পায়ের উপর পা তুলে তর্জনী আঙুল দেখিয়ে বলে,
‘আই ওন্ট ডিসকাস মাই বিজনেস ওয়ার্ক ইন ক্লাব। ইউ মে গো এন্ড সি মি ইন দ্যা অফিস।’
ঢোক গিলে অনুনয়ভরা গলায় অঞ্জয় হাত পাতে নিলে ঠাস করে কাঠিন্যময় শব্দ হলো। আরভীক স্বইচ্ছায় মিনি সাইজের গ্লাস মেঝের উপর ছুড়ে মেরেছে। অঞ্জয়ের ভয়ে রুহ কেঁপে উঠে। তড়িঘড়ি লেজ গুটিয়ে পালায়। মরণের কাছে হাত চাইলে মরণ তো জীবন ভিক্ষা দিবে না। হিতে বিপরীত জঘন্যতম মরণ দিবে। সায়াজ ও ফাহাদ বুঝল নিশ্চয় সিরিয়াস কিছু। দুজনের মধ্যে একজনোও মনের কথা দমিয়ে ফেলার নয়। ফাহাদ ঐকান্তিক সুর টেনে বন্ধুর হাত ধরে বলে,
‘দোস্ত এনি প্রব্লেম।’
‘নো এন্ড ইঞ্জয় দ্যা পার্টি।’
দ্ব্যর্থহীন,সুস্পষ্ট,চিন্তাবিহীন জবাব দিয়ে আরভীক সহজাত প্রান্ত বজায় রাখে। দুজনের কেউ সন্তুষ্ট হলো না কথার বিপরীত প্রেক্ষিতে। তবুও বন্ধু তাদের সম্ভ্রম-ত্যাড়া জাতের ব্যক্তিত্বপূর্ণ। সহজে যেন কণ্ঠনালী ভেদ করে কথা বের হবার নয়। তাদের কল্পনার সিথি ইতি টেনে ফোন ভাইব্রেট হলো। সায়াজ রঙ্গ রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ফোনে একপলক দেখে মুখ সরিয়ে নিল। কি ভেবে যেন তৎক্ষণাৎ চোখ ডিম্বাকার করে ফোনের দিকে তাকায়। ফাহাদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘এই টনেডো কি সাইবানী!’
সায়াজ মুখ উপর-নিচ নাড়িয়ে হে জানায়। সাইবার নাম তার ফোনে টনেডো লিখে সেভ করেছে।
আরভীক তখনো অনুত্তেজিত,সুস্থির জেন্টালম্যানের মত ড্রিংক করছে। হাত দিয়ে ফোনটা চাপবে ভেবে সায়াজ হাত লাগাতে নিল। পূর্বেই নিরেট দন্ডের মত হাত চেপে ধরে আরভীক। ফাহাদ উৎকণ্ঠার গলায় শাসাঁলো।
‘দোস্ত ফোন না ধরলে কাল ভার্সিটির মধ্যে টনেডো বয়ে যাবো। ছাড় না দোস্ত।’
‘নেভার। সি ইজ আউটসাইডার। আই ডোন্ট লাইক আউটসাইডার এট অল।’
ক্লান্ত,অবসাদপূর্ণ নজরে ফোনের দিকে তাকিয়ে তারা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। পরপর বার তিনেক বেজে বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হতেই ফোন তিনটা সুইচ অফ করে দেয় আরভীক। ফাহাদ ‘এ্যাহ্’ করে উত্তেজিতের মত ‘ফোন সুইচ অফ কেন করছিস’ জিজ্ঞেসা করতে গিয়েও করল না। আরভীক এর চোখ রাঙানি দেখে ‘এ্যাহ্’ কে ‘হুম’ তে পরিণত করে চুপটি মেরে রইল। আরভীক বাঁকা হেসে উচ্চ আওয়াজে বলে, ‘লেটস ইঞ্জয় দ্যা নাইট।’
ইতিক্ষণে ফিরে পেল সায়াজ ও ফাহাদ মস্তি করার সময়। দৃষ্টিঅগোচরে ফোন বের করে অঞ্জয়কে মেসেজ করে পাঠায়।
‘আই নিড দ্যাট গার্ল ব্যাডলি। ফাইন্ড হার এনিওয়ার।’
ফোন রেখে ঠোঁটের কোণায় ডেভিলটাইপ স্মাইল আনে সে। চুলগুলো এলোথেলো নেড়ে আপনমনে বলে,
‘প্রিটিগার্ল ইউ নিড টু বি কাম। আমার অন্তর ধ্বংসের পথে তোমার চোখের বিষাদে। এই বিষাদ একরাত না হয় একদিনেই সমাপ্ত করব।’
তার মনোকল্পিত রেখা জানার সাধ্য এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। কখন কি ঘটাবে তার পূর্বকল্পনা সে নিজে করে রাখে। মনমেজাজ সঙ্গ না দিলেও পার্টির মজায় রঞ্জিত করতে মনযোগ দেয়। কেননা মনমেজাজ জুড়ে সেই অকল্পিত মাস্ক পরিহিতার নয়নজোড়ায় আঁটকে আছে।
সত্য মতে, কেউ যে বিষাদ হয়ে আসবে তা টের পেতে চলেছে।
৩.
রাত ঘনিয়ে ভোরবেলায় পাখির কলকাকলিতে নয়নজোড়া উম্মুক্ত হলো আনজুমার। বুকের মধ্যে আটঁসাটঁ বেঁধে ঘুমিয়ে আছে আশফি। বাচ্চাটির ঘুমের মধ্যে পাপহীন,নিষ্প্রাণ শিশুর আভাস ফুটে উঠেছে। এই বাচ্চার মধ্যেই সে বাঁচার পথ খুঁজে পায়। স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি পনেরো বছরে প্রণয়পূর্ণ মনে উজ্জ্বল ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দৃষ্টান্ত রুপ। দৃঢ় শ্বাস বেরিয়ে আসে আনজুমার অন্তর বেয়ে। তার বয়সই বা কত সবেই আঠারোর কৌঠায় পদাপর্ণ করবে।মধ্যবিত্তের পরিবারের সন্তান হলে জীবন গড়তে শিখতে হয়। পড়াশুনার ধারপ্রান্তে যাওয়ার সাধ্য নেই। ফলে খুটিনাটি কাজের দ্বারা তুষ্টিসাধন করছে।
দুঃখময় জীবন সংগ্রামে সে আর তার বাচ্চাটি বড় হচ্ছে। কেউ নেই যে হাত ছুঁয়ে সঙ্গতা দিবে, সকলের দৃষ্টিজোড়া শুধু বিছানার দিকে নেওয়া। ঘৃণ্য পরিবেশে খাপখেয়ে হলেও আশফিকে আগলে রেখেছে সে। শরীরকে সক্ষমতার জোড়ে হলেও রক্ষা করেছে। দৃষ্টিকটু,কুনজরের ধিক্কার হতে বাঁচা প্রায় অসম্ভব। তবুও পেরেছে রক্ষা করতে। স্বামীর ছোঁয়া,স্পর্শ শরীরের মধ্যে প্রতিক্ষণে বিরাজমান। আশফিকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখে পাশে থাকা ফ্রেমের দিকে তাকায়। গোলাকৃতি ফ্রেম যেখানে তিন জনার স্থিরচিত্ত অবস্থান। সে,স্বামী ও তাদের একমাসের শিশু আশফি।
স্বামীর দিকে ক্রন্দনময় দৃষ্টি বজায় রেখে বলে,
‘শান্তি পেলেন, কবরে নিশ্চিতে ঘুমিয়ে আছেন। দিয়ে গেলেন দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবন। যেখানে সুখের দেখা পাওয়া অনিশ্চিত।’
ঘুমের রেশ কাটিয়ে আশফিকে সন্তঃপর্ণে শুয়ে দিল। ফোনটা রাত হতে বন্ধ পড়ে রয়েছে। ফলস্বরুপ এখন চার্জ দিয়ে খুলে নেই। ফোন চালু হতেই একরাশ মেসেজ,ফোন কলের বর্ষণ হলো। নোটিফিকেশন ভরে যেতে লাগে। তবে তোয়াক্কা না করে নিজ কার্যসিদ্ধি সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হলো আনজুমা।
সোফার মধ্যে থেকে নোংরা হওয়া কভার খুলে বালতি ভর্তি করে ওয়াশরুমে রাখে। কিচেনে গিয়ে ওমলেট,পাউরুটি,চকলেট জেল,চায়ের ব্যবস্থা করে দুজনের জন্য। তম্মধ্যে ফোন হতে নিসৃত শব্দ বন্ধ হওয়ায় সুস্থিরভাবে ফোনটি হাতে নেই। বিশেষত্ব আননোন নাম্বার থেকে মিসড কল এসেছে। বুঝতে বাকি রইল না কে হতে পারে!
সাতসকালে ঐ বদ*খোড় লোকের কল’স দেখে সেই নাম্বারে একটি মেসেজ পাঠায়।
‘নিষ্ঠুর,জঘন্য মানুষের ধারপ্রান্তেও আমি যায় না। সো ইউ নিড টু লিভ ইউর ওন ওয়ে। ডোন্ট ইন্টারফেয়ার ইন মাই লাইফ।’
রাতে কটাক্ষপূর্ণ বাক্য বয়ান করে ভোরবেলায় মেজাজ দেখানোর মত বাক্য লিখে পাঠিয়ে দেয়। রাতে সেই অচেনা ব্যক্তির রসিকপূর্ণ কথা আনজুমার কান জ্বালাপাড়া করছে ক্ষণে ক্ষণে। চেয়েও পারছে না ভুলতে। তবে কেনো যেন কলের মধ্যে বলা কথায় অদৃষ্ট আগমনবার্তা ছিল। সেই ব্যক্তি কি কোনো পথ অবলম্বন করতে চলেছে! আনজুমা রাতের কথাটা তৎপর ভাবে এড়িয়ে গেল। এর প্রতি ঘ ও ঘাটল না।
চলবে…..!
#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০১
(নতুন গল্প, নতুন মোড় ভালো লাগলে জানাবেন। আর গল্পের মধ্যে কি হবে না হবে সব প্রকাশ পাবে আস্তেধীরে। ধর্য্য ধরে পড়বেন। ভালো লাগলে জানাবেন। নেক্সট পর্ব দেব।)