#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৭
মেলায়তন অনুষ্ঠানে কয়েকজন পুলিশ আনজুমাকে এরেস্ট করে। ছোট আশফি মায়ের আঁচল টেনে পুলিশদের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। অশ্রুজল নিয়ে ছোট আশফি মায়ের আঁচল ছেড়ে তার মায়ের বাহু ধরে দাঁড়ানো পুলিশের প্যান্ট আঁকড়ে ধরে। প্যান্টটা জোরে জোরে টেনে কান্নামাখা গলায় বলে,
‘ছাতো মাম্মাকে,পঁতা আঙ্কেল! ছাতো।’
আশফির ‘এয়ে এয়ে’ কান্নার সুর যেন মেলায়তনের পরিবেশ নিস্তদ্ধতায় ভরে দিয়েছে। পুলিশ বিরক্তের চোখে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আনজুমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘কিরে তোর বাচ্চা ! বাপ কই এর নাকি জারজ সন্তান পালিস। হাহাহা!’
তার সাথের কনস্টেবলগুলো তাদের অফিসারের কথা শুনে মিটমিটিয়ে হাসি দেয়। আনজুমা তিক্ষ্ণ চোখে চোয়াল শক্ত করে ফেলে। পুলিশ অফিসার হোক বা যে পেশার মানুষই হোক না কেন! তার সন্তানের নামে অপমানিত কথাবার্তা। মোটেও সহ্য করে না আনজুমা। অফিসারের জন্য মনে থাকা মর্যাদাকে পায়ের তলায় পিষে ঠাঠিয়ে চড় লাগায় সে। ‘ঠাসস’ করে জোরালো স্বরে থমকে যায় মেলায়তনের বিশেষ ব্যক্তিবর্গ।
মায়ের সামনে তার নিজের প্রণয়ের মাধ্যমে আসা সন্তানকে ‘জারজ’ বলায় যেন তার অগ্নিরুপ বেড়িয়ে এলো। রাশভারী কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলে,
‘শু’য়ো’রের অফিসারগিরি দেখাবি না। মুখে যা আসছে বলবি আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনবো ভাবছিস। কু’ত্তার মুখ সামলে রাখ। না হলে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব। আশফি আমার গর্ভের সন্তান। তার বাপের নখের যোগ্যও তুই হতে পারবি না। সে এখন নেই তো কি হয়ছে! সে ফিরবে ফিরে তোদের মত দুনীর্তি কর্মচারী অফিসারদের শায়েস্তা করবে। কু’ত্তা,বারো**দের লেজ কখনো সোজা হয় না। আরেকবার যদি আমার সন্তানকে নিয়ে কিছু বলিস তোর মুখ থেতলে দেব শু’য়ো’র কোথাকার!’
আনজুমার চড় দেওয়া ও অশ্লীল মিশ্রিত কথার কারণে অফিসারের মেজাজ বিগড়ে যায়। ঝাঁঝালো গলায় আনজুমার হিজাবের উপর থেকে চুল শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
‘চড় লাগিয়ে ভুল করেছিস। ভেবেছিলাম ইনভেস্টিগেইট করে ছেড়ে দেব। এখন ছাড় না জেলবন্দি করব তোকে। তাও এক অফিসারের গায়ে হাত তুলার দ্বায়ে। চল…!’
আশফি কেঁদে যাচ্ছে। তাকে কোলে নিয়ে চেপে ধরে বিউটিখালা। তারা আনজুমার সঙ্গে এসে ছিল শেষবার বেড়াতে। কেননা গতকালই মেয়েটি জানিয়ে ছিল তারা এ পরিচিত শহর ছাড়বে! ফলে বিউটিখালাকে অগ্রীম অনুরোধ করে ছেলের ইচ্ছে নিয়ে। আশফি চেয়ে ছিল আজকের সংগঠিত মেলায়তন অনুষ্ঠানে মজা করতে। ছেলের আবদার কোনো মা’ই ফেলতে পারে না। অতঃপর বেজায় খোশমনে ছেলে আর বিউটিখালার পরিবারের সঙ্গে অনুষ্ঠানে হাজির হয় আনজুমা। বিভিন্ন স্টল থেকে আশফি ভেবেচিন্তে পছন্দনীয় জিনিস কিনে নিল। খাওয়ার বায়না ধরা যেন তার ছেলের নিজস্ব অভ্যাস। খাওয়ার হলে খেয়েই নেবে। তবে স্টলের থেকে চকলেট,আইসক্রীম নিয়ে খেয়েছে। টিফিন বক্সে ছেলের জন্য সাদাভাতের সঙ্গে অমলেট বানিয়ে এনেছে আনজুমা। তবে ঝড়ের আলামত কেমনে এসে আনন্দ চুরমার করল বুঝে উঠতে পারল না কেউ! সৌহাদ্য তখন স্টেজে ছিল। অনুষ্ঠানের বিশেষ অথিতিদের মাঝে সভাপতিত্ব করতে। এরই মাঝে কয়েকজন পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত ব্যক্তি এসে অনুষ্ঠান থামিয়ে দিল। অফিসার মাইক নিয়ে অপরাধীর নাম ও বিবরণসহ তার খোঁজ লাগায়। আশ্চর্য হয়ে গেল সৌহাদ্যের পরিবার এবং আনজুমা। আনজুমা যেন অবাকের চরম শীর্ষে পৌঁছে গেল। গতকালের ঘটনার একদিন না পেরুতেই জেলবন্দির মত জুরুম সে করেছে বলে তার মনে পড়ছে না। বরং সে তো কোনো দোষ করেনি শুধু বিক্রি করেছে বিনিময়ে যোগ্য সুদ পায়নি। সৌহাদ্য ইতিমধ্যে পুলিশ অফিসারকে প্রশ্ন করে উঠে।
‘কি বলছেন মেয়েটার অপরাধ কি! আপনি কোনো ইনফরমেশন ছাড়া এক নিদোর্ষ নারীকে এরেস্ট করতে পারবেন না।’
অফিসার কুটকুটিয়ে হেসে বলে,
‘ওই খালিদা এ মশাইকে একটু লিগ্যাল ডিটেলস নোটটা দেখান যেটা সরকারের কাছ থেকে পাওয়া।’
খালিদা নামের মহিলা কনস্টেবল নোটটি সৌহাদ্যকে দেখায়। তার সঙ্গে আনজুমা নোটটি দেখে তার আত্মা বলে উঠে, ‘এমন জুরুম শাস্তি তার জন্য প্রাপ্য নয়। বরং প্রাপ্য ঐ শ্রেয়া জাফরের।’
সে বিধ্বস্ত চাহনী নিয়ে সৌহাদ্যকে বলে, ‘ভাইয়া বিশ্বাস করুন আমি নিদোর্ষ।’
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
তবে পুলিশের এক কথা মেয়েটি নাকি অসাধু ব্যবসা করে প্রচুর মাল বিক্রি করেছে। যার ফলে মানুষের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে।
অফিসার আনজুমাকে পেয়ে তার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগে।
সৌহাদ্য তবুও আনজুমাকে নিয়ে যাওয়া থেকে থামাতে চেষ্টা করে। এতে বাধ্য হয়ে অফিসার পিস্তল দেখিয়ে ধমকে বলে,
‘রাস্তা থেকে সরে যান’। ফলে বুকভরা কষ্ট নিয়ে সৌহাদ্য সরে পড়ে। নিজের মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকায়। আনজুমা সৌহাদ্যের দিকে না তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,
‘আপনি প্লিজ আশফির কাছে যান।’
সৌহাদ্য বাক্যহীন চলে যায় আশফির কাছে। মেলায়তনে উপস্থিত জনগণ বিদঘুট নজরে আনজুমাকে দেখে কানাঘুসো করছে। বয়স্ক এক বুড়ি লাঠিতে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ায় অফিসারের সামনে। তিনি রিনরিনে গলায় বলে,
‘মাইয়া নিদোর্ষ কইতাছে ছাইড়া এনা দিবি! ধইরা কই নিয়া যাস হে!’
‘দেখেন দাদি এটা আমাদের দায়িত্ব অপরাধীকে জেলে দেওয়া।’
‘নই তোদের হতা হনমু না।’
‘মাফ করবেন দাদি। আমরাও বাধ্য!’
অফিসার কথাটি বলে এক মহিলা কনস্টেবলকে ইশারা করে। এতে মহিলা কনস্টেবল বুড়িকে সরানোর চেষ্টা করে। তিনি অটুট তার মনের থেকে। বয়স্ক হলেও শক্তি নেই এমনটা নয়। মহিলা কনস্টেবল সরাতে না পেরে ক্ষোভে জোরসরো ধাক্কা দেয় বুড়িকে। এতে বুড়ি মেঝেতে পড়ে। আনজুমা সাহায্যের জন্য এগোতে নিলেই মহিলা কনস্টেবল চড় লাগায় তার গালে। ক্রোধের চোখে চেয়ে নোংরা গালি দিয়ে বলে,
‘অপরাধ করে সাধু সাজিস। জেলে বুঝাব তোকে। চুপচাপ চল নড়চড় করলে একদমে শঠ’নামী বের করে দেব।’
‘আপনি মেয়ে হয়ে অপর মেয়ের চোখের ভাষা বুঝছেন না। উনি না হয় পুরুষ মানুষ। আপনি তো বুঝার চেষ্টা করেন। আইম ইনোসেন্ট! প্লিজ লিভ মিইই!’
মহিলা কনস্টেবল কর্ণপাত করে না আনজুমার কথাগুলো। তিনি টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগে। আশফি বিউটিখালার কোলে মোচড়াতে থাকে নামার জন্য। তিনি ক্রন্দরচোখে শুধু চেয়ে আশফিকে চেপে রাখে। কিন্তু আশফি মাকে হারাতে চাই না। বিউটিখালার আঙুলে অনিচ্ছায় মৃদু কামড় দেয়। এতে তিনি মৃদু আর্তনাদ করে আশফিকে নামিয়ে দেয়। তিনি বুঝছে কেনো আশফি এমন করেছে ! বিধেয় রাগের পরিবর্তে ফিচেল হাসি ফুটে তার মুখে। আশফি দৌড়ে মাকে সামনে থেকে জড়ায় ধরে। কান্নার কারণে ছোট ছেলেটির গলা কচলে উঠছে বারংবার। আনজুমার বুক ফেটে যাচ্ছে। হাতে হাতকড়া থাকায় কোলে উঠিয়ে চুমু দেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় যেন সে কাতর!
আশফি হিঁচকি তুলতে থেকেও কষ্টমাখা গলায় বলে,
‘মাম্মা যেও না। যেও না মাম্মা।’
আনজুমাও কেঁদে বলে,
‘পাপা তুমি বিউটিখালার সঙ্গেই থেকো হে। তোমার মাম্মা জলদি আসবে কেমন।’
না তবুও যেন ছোট আশফি ছাড়ার পাত্র নয়। মহিলা কনস্টেবল অতিষ্ঠ হয়ে ছোট আশফির হাত ঝাড়া মে’রে ছু’ড়ে দেয়। আশফি বালিপূর্ণ মেঝের উপর পড়ে যায়। পড়ার কারণে তার হাতের কনুই ছিলে যায় মৃদু র’ক্ত ঝরে। কান্নার মাত্রা বেড়ে গেল তার। আনজুমা চেঁচিয়ে ‘আশফিইইই’ কে ডাকে। মহিলা কনস্টেবলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। তবে পারল না। তার হাতজোড়ায় থাকা হাতকড়ার কারণে। ছোট ছেলেটির চোখজোড়া মায়ের দিকে শায়িত। আনজুমা স্তদ্ধ, বিমূঢ় কলিজার অংশটা ব্যথার যন্ত্রণায় কাঁদছে। আর সে ব্যর্থ মায়ের মত চেয়ে গেল। মহিলা কনস্টেবল গাড়ির ভেতর পুরে নিল আনজুমাকে। কিন্তু সে মূর্তির মত তার ছেলের মায়াবী চেহারার দিকে চেয়ে রইল। গাড়ি চলতে আরম্ভ করে ফলে আশফির চেহারা অদৃশ্য হতে থাকে। চোখের নাগাল থেকে পরিপূর্ণ অদৃশ্য হতেই গগদবিদারী চিৎকার করে উঠে সে।
দুজন মহিলা কনস্টেবল ও একজন ছেলে কনস্টেবলসহ বয়স্ক অফিসারটি শয়তানি হাসি দেয়। অফিসার তার ফোন বের করে একটি বার্তা পাঠায় এক ব্যক্তির নাম্বারে।
‘কাজ হয়ে গেছে।’
ঠিক তার পনেরো মিনিট পর ঐ ব্যক্তির পক্ষ থেকে বার্তা এলো।
‘মেয়েটিকে আমার বাসায় নিয়ে আস। তারপর পেমেন্ট নিয়ে তোরা গা ঢাকা দেস।’
‘ওকে উই আর কামিং।’
ফোনটি পকেটে গুঁজে অফিসার মনের আনন্দে সিটে মাথা হেলিয়ে দেয়। আনজুমা তার আবাইয়ার পকেট থেকে চুরিচুপে ফোন বের করে। তাকে কেউ দেখছে না কেননা সে একদম পিছে একলা বসে আছে। কথা বলতে হলে সামনে ছোট আকৃতির জানালা বানানো আছে। সেখান দিয়ে কথা বলতে পারবে।
কিন্তু তার মনে নিকৃষ্ট অফিসারদের সঙ্গে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সে ফোনের বাটন প্রেস করে। স্ক্রিনে জ্বলমলে উঠল তার, আশফি ও সংযুক্ত ছবির একপাশ সুয়াইবের ছবি। ঠোঁট চেপে মনে মনে বলে,
‘আল্লাহ আমায় ধর্য্য দাও। নিশ্চয় তুমি ভালো কিছু কপালে রেখেছো। আমার ছেলের সহায় হোন। নিষ্পাপ ছেলেটি কিছু করেনি! তাকে রক্ষা করো, সামাল দাও। এক মায়ের কোলে তার ছেলেকে ফিরে আসার বাসনা পূরণ করে দাও আল্লাহ্। লা ইলাহা ইল্লাল্লা আন্তা সুবহান্নাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জালিমিন।’
চোখ বুজে ফোনটি বুকে চেপে রাখে। না জানে, ওদিকে আশফির কি অবস্থা! কেউ তার বাচ্চাটিকে পরম মমতায় আগলে নিয়েছে কি ! নাকি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ফেলে রেখেছে। অবশ্যই সে নিশ্চিত যে বিউটিখালার পরিবার আছে। তবুও মনের খুঁতখুঁতুনি রয়েই যায়।
৩১.
অঞ্জয় ঢোক গিলছে টিভির স্ক্রিনে ভেসে উঠা তার আনজুমা ম্যাডামের সঙ্গে হওয়া দৃশ্যপট। চোখ বাঁকা করে সে তার বসের দিকে তাকায়। আরভীক অনড় চাহনী নিয়ে দৃশ্যপট দেখছে। গুরুগম্ভীর চেহারা। ঠোঁটে হাসির কোনো চিহ্ন নেই। তথাপি একরাশ হিংস্র, বর্বরতা ফুটে আছে। চোখজোড়া ইতিমধ্যে রক্তিমবর্ণ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ক্ষণিকের মধ্যে চোখজোড়া হতে ফুটন্ত লাভার ন্যায় অশ্রু ঝরবে। অঞ্জয় খেয়াল করে দেখে। আরভীক তার হাতে থাকা বলপয়েন্টের টিপ কলমের মাথায় ‘টিপটুপ টিপটুপ’ করে টিপে শব্দ বের করছে। টিভির স্ক্রিনে দৃশ্যপট দেখে যেন তার হাতের স্প্রিড বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে এখনি এই কলম দিয়ে কিছু করে বসবে সে। অঞ্জয় অসহায় চোখে তাকিয়ে মনে মনে প্রে করছে। সায়াজ আশঙ্কার চোখে চেয়ে আছে। বিষয়টি মোটেও ঠিক হচ্ছে না। ফাহাদ কোথার থেকে যেন তড়িঘড়ি এসে হাঁপাতে লাগে। সায়াজের গা ঘেঁষে বসে তীব্রতর শ্বাস নেয়। দম ফেলে আরভীককে হাঁপানো কণ্ঠে শুধায়।
‘ডুড ডুড ওই পুলিশগুলো ফেইক ইয়ার! আনজুমা ভাবীকে এরেস্ট করে থানায় না, অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।’
আরভীক স্থীর,নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়ায় মগ্ন। অথচ ক্ষোভ তার হাতের বলপয়েন্টের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে। সেই ফাহাদকে বলে ছিল এ পুলিশের সম্পর্কে খোঁজ লাগাতে। ফলে ফাহাদ প্রতিটা থানার মধ্যে টিভির স্ক্রিনে দেখানো অফিসারের খোঁজ লাগায়। সব থানার অফিসার ফাহাদের দেখানো ছবিটি ভালোমত দেখে। অতঃপর তারা এক কথাই দাবি করে।
‘এ কোনো পুলিশ না। নকল পুলিশ সেজেছে।’
বলপয়েন্টের মাথায় ‘টিপটুপ’ করার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে আরভীক। যার কারণে তার নখের উপরিভাগ ফেটে র’ক্ত ঝরছে। ঘাবড়ে গেল তিনজনে। আরভীককে ধরতে নিলেই সে এক ভয়ানক কাজ করে ফেলে। তিনজনের কারো দিকে না তাকিয়ে। টেবিলের সামনে গিয়ে অফিসার আর খালিদা নামের মহিলাটির ছবির উপরে র’ক্তে’মাখা কলমটি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে কাগজটি ছিন্নভিন্ন করে দেয়। র’ক্তে কলমের সঙ্গে কাগজটিও মাখামাখি প্রায়।
নির্জীব গলায় তিনজনকে বলে,
‘শুন ফাহাদ তুই এখনি এদের ট্র্যক কর। অঞ্জয় তুই গিয়ে এখনি আমার ফোর্সদের আসার আদেশ দেই। সায়াজ যারা যারা এই রিপোর্টিং করে চ্যানেলে প্রচার করছে তাদেরকে ধর আর কাকে কোথায় নিয়ে হাজির হতে হবে তা তোরা নিশ্চয় জানিস!’
তিনজনে ‘ওকে লিডার’ উচ্চস্বরে বলে স্যালুট করে। আরভীক আসল অপরাধীদের দিকে তাকিয়ে চেহারায় বর্বরতা তৈরি করে বলে,
‘আমার প্রাণেশ্রয়ী নারীর উপর নিযার্তনের শাস্তি ভয়ানক। এ শাস্তি কেমন হবে ভাবতেও পারবি না তোরা। এমন শাস্তি দেব যে তোদের রুহ্ কেঁপে উঠবে। আমার কলিজার খু’নে’র উপর যে হাত,পা দিয়ে চড়,ধাক্কা দিয়েছিস না। সে হাত,পা যদি কেটে না দেয় তবে আমার নামও আরভীক ফাওয়াজ না। এতদিন দুনিয়া আমার রসিকতা দেখেছে। এবার দেখবে হিংস্র পশু জাগলে কেমন তান্ডব শুরু হয়। এর পরিণতি!’
আরভীক এর বলা প্রতিটা বাক্য যেন তিনজনের শ্রবণে গরম লাভা ভরে দিয়েছে। সত্যি হিংস্র পশুর রুপ কেমন সেটা আরভীক এর মুখশ্রী দেখলে যে কেউ আন্দাজ করে ফেলবে। তিনজনে ঢোক গিলে কাজে লেগে পড়ে।
আরভীক শান্ত মনে চোখ বুজে রাখে। আকস্মিক ফোনে কল আসায় ব্লুটুথ বাটন প্রেস করে। মেয়েলী কণ্ঠে জানান দিচ্ছে ‘ড্যাড’ শব্দটি। কল রিসিভ করে সালাম দেয়। আরাজ সাহেব টিভির দিকে বিস্ময় চোখে চেয়ে আরভীককে বলে,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। বাবা এইসব কি দেখছি! আনজুমা মাকে এমনে কেনো নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ! ও না তোর অফিসে চাকরী করে। তাহলে..।’
আরভীক বুঝল তার বাবা বিষয়টি নিয়ে উত্তেজিত হয়েছে। তিনি আনজুমাকে খুব বেশি পছন্দ করে, যেন সে তার দুচোখের মধ্যমণি। আশফিকে পেলে যেন তিনি নাতীর আদর যত দেবে তত কম। সেই মেয়ে ও বাচ্চার সঙ্গে হওয়া দৃশ্যপট দেখলে পরিচিত ব্যক্তিগণ উত্তেজিত, ক্ষুদ্ধ,কুপে ফেটে উঠবে স্বাভাবিক! চোখ বুজে দীর্ঘ শ্বাস টেনে আহ্লাদী কণ্ঠে শুধায়।
‘ড্যাড ইউ জাস্ট ডোন্ট ওয়ারি। আই উইল হ্যান্ডেল ইট!’
‘হে বাবা একটু দেখ মেয়েটা নিদোর্ষ আমি চোখ দেখেই বলতে পারি। আমার ছেলেও নিদোর্ষ ছিল কিন্তু শয়তানগুলো ওকে বাঁচতে দেয় নেই। ওই যে…..।’
আরাজ সাহেব আবেগে আপ্লুত হয়ে অতীতের পাতা ঘাঁটতে লেগে ছিল। পরক্ষণে থেমে যায়। আনজুমার সঙ্গে হওয়া দৃশ্যটির মধ্যে আজীবের সঙ্গে হওয়া চিত্র ভাসছে। ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখের কোণায় জমা হওয়া পানি মুছে নেয়। আরভীক ধরা সূচালো গলায় বলে,
‘ড্যাড তখন ভাইকে বাঁচাতে পারিনী। কিন্তু চিন্তে করো না আনজুমার সাথে অন্যায় হতে দেব না। আসল অন্যায়কারীদের প্রতিদান দিতেই হবে। বাই হুক অর বাই ক্রুক!’
আরাজ সাহেব নিবার্ক চোখে ‘হুম’ বলে ফোন রেখে দেয়। তিনি টিভির থেকে চোখ সরিয়ে পাশে থাকা দেওয়ালের দিকে তাকায়। সেখানে ছোট ফ্রেমে তিনজনের ছবি বাঁধানো। তিনি ও তার দুপাশে দুই মানিকরত্ন আজীব ও আরভীক। আরভীক এর চেহারার দিকে তাকিয়ে সার্থকপূর্ণ গর্বের শ্বাস নেয়। আপনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে,
‘তুই রক্ত, আমার রক্ত, দিনশেষে এর সত্যতা কেউ জানবে না। কেউই না। তোর কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ হলে সবই জানবি তুই। আমি নিজেই জানাব।’
আরাজ সাহেব কি ভেবে যেন তড়িঘড়ি ফোন নিয়ে লিয়াকত সাহেব কে কল দেয়। লিয়াকত সাহেব নিজের রুমে টিভিতে আজকে ঘটে ঘটনাটি দেখেও পাত্তা দিল না। কে মরছে, কে, কি করল তার কিছু যায়, আসে না! বিধেয় তিনি চ্যানেলের পরিবর্তে নোংরা,অশ্লীলতাপূর্ণ বই ও ছবি দেখে মনকে তাজা করার জন্য প্রস্তুত হয়। একটি বই সেল্ফ থেকে নিয়ে পড়তে নিলেই হঠাৎ কল আসায় বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে। বইটি বালিশের উপর রেখে ফোনের উপর জ্বলজ্বল করা নামটি দেখে চমকে যায়।
‘আরাজ’ কল দিচ্ছে তাকে ব্যাপারটি যেন হাস্যকর লাগল তার। দমফাটা হাসি আঁটকে কলটি রিসিভ করে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘কি অবস্থা বেয়াই সাহেব কি ভেবে এই মশাইকে কল দিলেন!’
‘দেখ লিয়াকত তোর সঙ্গে হাসিঠাট্টা করার কোনো রুচি নেই আমার। আমি শুধু এক কথা বলতে কল করেছি। তোর আনা মেয়ের সম্বন্ধ সম্পর্কে আমি পরে ভেবে জানাব। কালকে আসতে পারব না পার্টিতে। সো প্লিজ ম্যানেজ ইট। উই আর সরি।’
কথার ইতি টেনে তিনি লিয়াকত সাহেবের বিপরীত মন্তব্য শুনার পূর্বেই কল কেটে দেয়। অপরদিকে রাগে ফোঁসতে থাকে লিয়াকত সাহেব। ভেবে ছিল আহামরি কোনো সংবাদ শুনবে! কিন্তু তার কল্পনায় আগুন ধরিয়ে শান্তিভাবে কল কেটে দিল ঐ আরাজে। মন স্থীর রেখে ফোনটি নিয়ে জাফরের ফোনে কল দেয় সে।
এদিকে আরাজ সাহেব ফোন রেখে সোফায় বসে। কালকে অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারটি নিষেধ করে মনে শান্তি পেল তিনি। কেননা আজ আরভীক এর মতিগতি জানা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। এতে মেয়ে দেখার কথা উঠালে রেগেমেগে কিছু করে বসবে। অন্যথায় আনজুমার সঙ্গে আরভীক এর ঝগড়া সাপে-নেউলের মত হলেও খুনসুটিময় হয়। যা আরভীক কে দেখে তিনি বুঝেছে। যারা আনজুমা ও আশফির সঙ্গে অন্যায় করেছে।
না জানে কি হতে চলেছে সামনে!
চলবে….
(আজকে ব্যস্ত থাকায় বড় করে দিতে পারিনী। সবার কৌতূহল জাগবে জানি। তবে বলব কালকে ইন শা আল্লাহ্ ধামাকা পর্ব দেব।)