#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৫(গুপ্তকথন ফাঁস)
জাফরের কুকর্মের নীতি খবরে ছড়ানোর পরদিন হতে আজ পনেরো দিন কেটে গেল।কিন্তু অবহেলিত হলো আরভীক! বেচারা আশফির সঙ্গ পেলেও, বউয়ের সোহাগী আদর পাচ্ছে না! ধূলিসাৎ করে বেড়িয়েছে মেয়েটা। ক্ষমা চেয়ে ঘুষ হিসেবে আইসক্রীম, ফুসকা, কাচ্চি বিরিয়ানী অথাৎ মেয়ের প্রিয় খাবারের লোভ টোভ দেখিয়ে হলেও সোহাগ আদায় করতে চেয়ে ছিল কিঞ্চিৎ প্রণয়ের মুহুর্ত হিসেবে। তবে তার পরিকল্পনায় জল ঢালতে ওস্তাদ তার বউ ! এমন গম্ভীর,শঠ’নামী মেয়ের মত মুখ করে রাখে, যেন সে তাকে অত্যাচার,নিপীরিত করে চলে প্রতিক্ষণে!
আরে ভাই এটা কোনো ইনসাফ হলো!
আশফি তার বাবাইয়ের অসহায় মুখখানি দেখে। বাবাইয়ের খোঁচা দাড়ি ধরে টান দেয়। ব্যথায় ‘আউচ’ শব্দ বের করে উঠে আরভীক। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায়। খিলখিলে হেসে কানের কাছে এগিয়ে এলো তার বাবাইয়ের। আদু কণ্ঠে বলে,
‘মাম্মা আততে আততে হাতে তুতি জানো না!’
ভ্রু কুঁচকে আশফির দিকে অবাক সহিত পলক ফেলে সে। ছেলে তার বাবাইয়ের দুঃখ বুঝতে পেরে মায়ের গোপনে হাসার কথ্য বয়ান করেছে। সেও এবার জালে বন্দি করবে! কতদিন হলো কাউকে সে জালে ফেলেনি! আজ থেকি জাল বুনতে আরম্ভ করবে এবং শিকারী হবে বউ অথাৎ মিসেস আনজুমা ফাওয়াজ! বাঁকা হেসে আশফিকে চোখ টিপ দেয়। সে হেসে পরক্ষণে লাজুক হেসে তার বাবাইয়ের কান মলে দেয়। ছেলের আজগুবি কাজে মাঝমধ্যে হতভম্ব হয়ে যায়। কান মলে দেওয়ার কারণ বুঝে না সে ! কান মলে দেওয়ার পরও তার বাবাইয়িকে চুপ থাকতে দেখে মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘হিসু কতব! তোমার উপ্রে কতি।’
আরভীক বেক্কলের মত হা করে তাকায়। তার ছেলে কিনা হিসুর জন্য কান মলে দিল। আর সে কিনা ভাবল তার মাম্মার সাথে দুষ্টুমি করছে ভেবে কান মলেছে! ফিক করে ছেলের কথায় হেসে দেয়। আশফি তার বাবাইয়িকে তাড়া দেয়। আরভীক স্বেচ্ছায় ছেলেকে হিসু করিয়ে পরিষ্কার করে দেবে। তার বেশ ভালোই লাগে ছেলের সেবা,স্নেহ করতে।
আনজুমা রান্নাঘরে ঘিন্নির ন্যায় শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে খিচুড়ি রাঁধছে। ইতিমধ্যে তার শ্বশুরআব্বুর মন গলেছে আনজুমার উপর থেকে। তবুও বহিঃপ্রকাশ করে না বিষয়টি। পূর্বের ন্যায় প্রাণবন্ত হেসে কথা বলে না তিনি। যা ভীষণ কষ্ট দেয় আনজুমাকে।
টিভির রুমে এসে ধপ করে বসে পড়ে আরাজ সাহেব। গলা ফাটিয়ে সার্ভেন্টকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘কবে থেকে এককাপ কফি চেয়েছি। কেউ কি দেবে আমায়!’
আনজুমা মুচকি হাসল। সে নিজ হাতে কফির পাউডার নিয়ে চায়ের কেটলিতে পানি ঢেলে চুলায় বসায়। গরম সদ্য তৈরিকৃত কফির মগ নিজ হাতে এগিয়ে দেয় আরাজ সাহেবের সামনে। তিনি গম্ভীর রগচটা নয়নে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মুখ ফুলানো কণ্ঠে শুধায়।
‘সার্ভেন্টকে দিতে বলেছি। তার মানে এই নয় এ কফি আমি খাবো না। কোনো টাকার জিনিস নষ্ট করা ভালো না।’
কফির মগ নিয়ে নিবিঘ্নে চুমুক দিয়ে অশান্ত মাথা ব্যথাকে শান্ত করতে লাগে আরাজ সাহেব। আনজুমা কষ্ট পেলেও প্রকাশ করেনি। মুচকি হেসে নিশ্চুপে রওনা দেয় রান্নাঘরে। আরভীক আড়াল থেকে তার বাবার ভাবভঙ্গি দেখে এগিয়ে এলো। পাশ ঘেঁষে ঘাপ্টি মেরে বসে। ছেলের মতিগতি মন্দ ঠেকছে তার নিকট! বিধেয় নিবিড়ে মগে চুমুক দিয়ে যায়। গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আরভীক। আরাজ সাহেব স্বাভাবিক কণ্ঠে শুধায়।
‘বউয়ের হয়ে সাফাই গাইতে এলে বলব, ইউ আর কাম ইন রং টাইম।’
‘ড্যাড তুমি জানো যা করছো! এতে আনজুমার খারাপ লাগবে। সে মন খুলে প্রাণহীন না হেসে কতদিন ধরে মূর্তির মত দায়িত্ব আদায় করে চলেছে। অথচ মুখ ফুটে টু শব্দ অব্দি বের করেনি। কেননা সে আমাদেরকে মন থেকে ভালোবাসে। আজকাল তুমি যে বিহেভ করছো মনে হচ্ছে টিপিক্যাল শ্বশুরের ন্যায় বিহেভর! তার আপন বাবা-মা মধ্যবিত্ত বলে সেই চৌদ্দ বছর বয়সে আমার হাতে সপে কেটে পড়ে ছিল। অথচ আমাদের বিবাহিত জীবন পেরানোর পরও তারা আসেনি মেয়ের একবার খবর নিতে! বরং অন্যের উপর সপেছে এই বেশি হলো তাদের ভাষ্যমতে। এই যে আমার আর তার বিয়ের সময় খুঁজে এনেছি কারণ কি জানো! তুমি আর আনজুমা এর পেছনের ঘটনা জানো না।’
আশ্চর্যান্বিত নয়নে আরাজ সাহেব ছেলের দিকে তাকায়। অদ্ভুত চাহনী দেখে মৃদু হেসে আরভীক মুখ খুলতে নিলে আশফির কণ্ঠ শুনে থেমে যায়। আশফি প্যান্টের চেইন বাঁধতে পারছে না! ফলে ঠোঁট ফুলিয়ে ‘বাবাইয়ি, মাম্মা,দাদু’ বলে চেঁচিয়ে উঠছে। রুম থেকে বেরিয়ে তার ছোট দেহের নু’নু দেখিয়ে দৌড়ে হাঁটছে। ইতিমধ্যে আশফির এরুপ দৌড়ানো দেখে দমফাটা হাসি পেল সকলের।
আশফি দৌড়ে আকস্মিক কারো সঙ্গে ধাক্কায় মেঝেতে পড়ে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ‘বাবাইয়ি,মাম্মা,দাদু’ ডাক দেয়। তারা এসে আশফিকে মেঝেতে পড়া দেখে ঘাবড়ে যায়। আরভীক তৎপর হয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে তার বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
‘চ্যাম্প কোথায় ব্যথা লাগছে বলো!’
আশফি কান্না থামিয়ে দেয়। সে তো বাহানা করছিল কোলে উঠার। প্যান্টের চেইন বেঁধে দেওয়ার জন্য ইশারা করে। তার ইশারা করার দৃশ্যটি যে সে দেখবে সেই ফিট খেয়ে ক্রাশ নামক বাঁশ খেয়ে যাবে। ভ্রু নাচিয়ে চোখ নামিয়ে প্যান্টের দিকে ইশারা করছে। আরভীক হেসে প্যান্টের চেইন লাগিয়ে দেয়। ততক্ষণে পিচ্চি খুকির কণ্ঠ পেয়ে আরভীক অবচেতন নয়নে সামনে তাকায়। আশফিও কি ভেবে যেন সামনে তাকায়। তার ধারণামতে সে ধাক্কা খেয়েছে কোনো এক নরম শরীরের সঙ্গে!
‘এই পতাঁ ছেলে ছিছি দেখিয়ে দৌড়ো শরম করে না তোমার হে!’
পিচ্চি খুকির বাক্যধারা শুনে হাসি পেল আনজুমার। খুকি দেখতে দু-তিন বছরের মেয়ে হবে সে,স্বাস্থ্য মোটামুটি গুলুমুলু ধরনের, ধপধাপ পা ফেলে হাঁটে, বেবি গার্লস ফ্রকটি খুকি মেয়ের শরীরে মানিয়েছে! আরভীক তার বউকে খুকির দিকে গাঢ় নজরে চেয়ে থাকতে দেখে কদম ফেলে কান বরাবর এসে ফিসফিসানো কণ্ঠে শুধায়।
‘ওয়ান চান্স প্রিটিগার্ল, নেক্সট ইয়ার উই অলসো হেভ এ লাভলী গার্ল লাইক হার! ডোন্ট সি হার ডিপলী। কোজ আই কান্ট কন্ট্রোল মাই সেল্ফ।’
কথাগুলো বলে চোখ টিপুনি দিয়ে সরে এলো। খুকি মেয়েটি দেখে শাঁসানো কণ্ঠে বয়ান করে।
‘এইত আঙ্কেল তুতি আন্টিকে চোখ মাতছো!’
খুকি মেয়ের কথা শুনে কাশি পেল আরভীক বেচারার। আনজুমা ইজ্জত বাঁচাতে রান্নার নাম করে কেটে পড়ে। আরভীক হাসার চেষ্টা করে খুকি মেয়ের দিকে ঝুকঁতে নিলে থামিয়ে দেয় আশফি। ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নেড়ে ঝুকঁতে বারণ করে। খুকি হাত দেখিয়ে ভাব নিয়ে বলে,
‘আঙ্কেল তুতি নিচু হও না। যদি কোমর ভেঙ্গে যায়।’
আরভীক পড়ল মহা বিপদে! ভেবেছিল খুকি সাদাসিধে হবে কিন্তু এ কি বুড়ি কথা সব একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে। তার মত ইয়াং ছেলেকে কিনা কোমর ভাঙ্গনের কথা বলে বুড়া আখ্যায়িত করছে। ইয়াং থেকে আর লাভ কি! কাঁদো কাঁদো মুখখানি নিয়ে সে তার ড্যাডের দিকে তাকায়। তিনি মিটমিটিয়ে হাসছে।
ড্যাড এগিয়ে এসে খুকি মেয়েকে জিজ্ঞেস করে।
‘তুমি কোথার থেকে এসেছো দিদিভাই!’
‘আতি পাপ্পা মায়ের সাথে আতছি।’
‘ওহ তারা কো….।’
আরাজ সাহেবের বাক্য ব্যয় করতে হলো না। ‘সরি সরি গাইজ’ কথাটি বলে ভেতরে প্রবেশ করে ঊনত্রিশ বয়সের এক সুদর্শন পুরুষ। নিজের মেয়েকে তার বয়োজ্যষ্ঠ বাবার ন্যায় ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখে চওড়া হাসি দেয়।
‘আসসালামুয়ালাইকুম কাকা কেমন আছেন!’
আরাজ সাহেব ও আরভীক ভদ্রপুরুষকে দেখে বিস্মিত হলেও পরক্ষণে খুশিতে আপ্লুত হলো। দুজনে সালামের জবাব দেয়। আরাজ সাহেব ছেলের কাঁধে হাত রেখে আহ্লাদী গলায় শুধায়।
‘কতদিন পর তোকে দেখছি বাপ! এই তাহলে বউমা!’
পুরুষের পাশে বোরকা পরিহিত হিজাবী এক নারীও মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। সে এসে সালাম করে। বিনিময়ে তারাও সালামের জবাব দেয়। আনজুমা রান্নাঘর থেকে দেখে আবাইয়া পরিদান করে নেয়। পুরুষগণের মাঝে একলা নারী ইতস্ততঃ বোধ করবেই। বিধেয় সে হিজাব পরে সরল হাসি দিয়ে সালাম দেয় ভদ্র পুরুষের সঙ্গে আগত নারীকে। তিনিও হেসে সালামের মাধ্যমে কুশল আদায় করে। আরভীককে দেখে পুরুষটি তার মুখের মধ্যে হাত রেখে পরখ করে দেখে। চওড়া হাসি দিয়ে বলে,
‘আলহামদুলিল্লাহ্ আমার এক্সপেরিমেন্ট সফল। আরভীক ভাই মুখে কি কোনো ব্যথা অনুভব হয়!’
সে নাবোধক মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করে। তিনি আনজুমাকে দেখে পরম হাসির বিনিময়ে আহ্লাদময় কণ্ঠে বলে,
‘ভাবী আমি হলাম আরভীক এর কাকাতো ভাই আদাফাত । বয়সে বড়, বাচ্চাকাচ্চা সংসার নিয়ে সুদূর প্রদেশে ব্যস্ত থাকি। ইতঃপূর্বে তোমার কথা জেনেছি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন। সুদূর ইংল্যান্ড পেরিয়ে তোমার দর্শনে এসেছি। অবশ্যই আমার ওয়াইফ নাইফা তোমার কথা জানতে পেরে উত্তেজিত ছিল এজ মিট করার জন্যে। আমিও উৎসাহী ছিলাম সাথে আরভীকের চিকিৎসার সুফলতা কতখানি হলো সেটা দেখারও সুবর্ণ সুযোগ হলো।’
আনজুমা অতীব আগ্রহদীপ্ত নয়নে কথাগুলো শুনে মুচকি হাসি উপহার দেয়। নাইফা এগিয়ে এসে তার মেয়ের হাত ধরে একত্রিত হয়ে দাঁড়ায়। আদাফাত মেয়েকে কেন্দ্র করে বলে,
‘এই হলো আমাদের চোখের মণি আহিফা জামান। তো আহিফা তোমার চাচুর,দাদুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছো!’
আহিফা ছোট মাথা নেড়ে হ্যা জানায়।আদাফাত সরু দৃষ্টিতে চেয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে।
‘দুষ্টুমি করেছো!’
হিহি করে দাঁত খেলিয়ে হেসে দেয় আহিফা। সে আদু কণ্ঠে তার পাপ্পাকে ধরে বলে,
‘জানো এ ছেলে ছিছি দেখিয়ে দৌড়ে !’
‘কুহ কুহ’ করে কেশে দেয় আরভীক। আশফি রাগান্বিত দৃষ্টিতে পুচকি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এ পতাঁ মেয়ে আতি নুনু দেখালে তুমার কি হে! তোমাকে তো দেখাছি না হু।’
বোকা মেয়ে আহিফা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে বলে,
‘কেনো আমাতে দেখালে কি হবে!’
‘তুতি দেখবে ঠিট আতে বড় হলে তুমাকে দেখাব!’
আহিফাও দাঁত পাঁকিয়ে হেসে ‘আত্তা’ বলে দেয়। শুনে যেন আদাফাত ও আরভীক এর চোখ কপালে উঠে। দুজন বেক্কলের মত তাদের সন্তানকে দমিয়ে আনে। আদাফাত বউ-মেয়েকে নিয়ে গেস্টরুমে অগ্রসর হলো। যেহেতু বহুবছর পূর্বেই ফাওয়াজ বাড়িতে ছিল সেহেতু রুমের দিক নিদের্শনা পূর্ব অবগত।
আরভীক চোখ গোলাকৃতি করে আশফির মুখ মৃদু চেপে হেহে করে হেসে তৎক্ষণাৎ কেটে পড়ে। আরাজ সাহেব কানে কিছু শুনেনি তেমন ভাব নিয়ে নিজের রুমে যায়। আনজুমা গেস্ট এসেছে বলে রান্নার কড়া আয়োজনে সেফকে লাগিয়ে দেয়। নতুন মেহমান আপয়্যনে ত্রুটি চাইবে না নিশ্চয়!
সেফ’স রাজি তাদের দায়িত্বে। মশলা বাটা, মুরগি কসা, মাছ ধুয়ে, সবজি বেছে কেটেকুটে রেখে দেয়। যার কারণে একঘণ্টা ব্যয় হয়েই যায় তার। সেফ’সের কাজ দেখিয়ে সে প্রস্থান করে। রুমে আসতেই কেউ তাকে হেঁচকা টেনে দেওয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে ওষ্ঠদ্বয় একত্রিত করে দেয়। আকস্মিক কার্যে ভীতিগ্রস্থে কেঁপে উঠে সে। পরক্ষণে স্বামীর আদুরীয় ছোঁয়া পেয়ে শান্ত হয়ে যায়। রান্নার সময় থেকে আরভীক এর ওষ্ঠদ্বয় অধৈর্য্য হয়ে ছিল মিলনের আক্ষেপে। কিন্তু মিসেস ফাওয়াজ হতচ্ছাড়ার মত ‘ধুর ধুর’ করে দূরত্ব টানছে। না, সে তো দূরত্ব আসতে দেবে না! এত বছর দূরে ছিল আজ সময় সুযোগ সুদে এসেছে উসুল করার!
আনজুমা কি ভেবে যেন জোরসরো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বিস্ময়ের সঙ্গে হৃদয়ে খারাপ লাগা কাজ করে আরভীক এর। আনজুমা ফোঁস করে রক্তিম শ্বাস নিয়ে শাসাঁয়।
‘আপনি এত বে’হা’য়া যে একটা মেয়ের ফিলিং নিয়ে খেলতেও কয়েকমিনিট ভাবলেন না। চার বছর জানেন চারবছর কি হারে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছি! কত কটুতিক্ত কথার সম্মুখীন হয়েছি, এককোলে আশফি কে মানুষ করার জন্য বাজে সমাজের মাঝে সংগ্রামে লিপ্ত হলাম, নিজেই দেখেছেন ক্লাবে কি পরিমাণ হ্যারেসের শিকার হতে হয়েছে আমাকে! আরে আপনি নিজেও আমাকে একরাতের কথা বলে কাছে এসে ছিলেন মনে পড়ে কথাটা! আপনি যে সুয়াইব তা যদি বলতেন বিশ্বাস করেন একরাত কি বহু রাতও আপনার সঙ্গে কাটিয়ে দিতে মঞ্জুর আমি। কিন্তু আপনি ছু’ড়ি’ঘাত করেছেন আমার হৃদয়ে। আশফির সঙ্গে আমাকে পেয়ে ভেবে নিলেন আমি সব জেনে মাফ করেছি ! একদম না ভুল ভাবছেন। অঞ্জয় আমাকে আজ্ঞা করেছে, আপনিই সে নরপশু যে কিনা আমাকে ইচ্ছেকৃত বখাটে মেয়েদের কবলে ফেলেছিলেন! ইশ আমিও বোকা হয়ে আপনার কথায় গলে যেতাম। যত বার জীবন বাঁচিয়েছেন ততবার আমি কৃতজ্ঞ হয়ে আপনার সঙ্গে সুন্দর জীবন পাড়ি দিতে চেয়েছি। অথচ আপনি আমার প্রথম স্বামী সুয়াইব! কেন কি এমন হয়ে ছিল যার কারণে আপনার চেহারা বদল হলো! বলেছেন একটুও! বলেননি সবর্দা অতীতকে লুকিয়ে আমার মনে অভিমানের পাহাড় জমিয়েছেন। এখন তো আপনার প্রতি ভালোবাসাটাও কমে গেছে। আপনার নিম্ন মানসিকতার কথা জেনে। না জানি কপালে আর কি লিখা আছে এই সংসার নিয়ে!’
রাগে ফোঁপিয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা আঁটকে দেয় আনজুমা। অন্যত্রে আরভীক ভাবমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কান ও হৃদয় তিক্ত কথাগুলো নিতে চাইছে না। কষ্ট হচ্ছে তার! মাথা ঝিম ধরেছে। যেন এখনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। আশফি নিশ্চুপে তার বাবাইয়ি ও মাম্মার ঝগড়া দেখে শান্ত রইল। সে তার বাবাইয়ির হাটু জড়ে ধরে। আরভীক চোখের পানি মুছে হেসে কোলে উঠিয়ে নেয় তাকে। নিশব্দে রুম হতে প্রস্থান করে। আনজুমা ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খাবার পরিবেশন করে দেয়। কিন্তু টেবিলে আজ আরভীক টু শব্দ অব্দি করেনি। অথচ অন্যদিন হলে আনজুমাকে ঘেঁটে লাজহীন হতো। মুখ বাঁকিয়ে আনজুমা খুশি হলো। কেননা আজ সে লজ্জায় পড়ছে না বড় বাঁচা গেল যেন তার পক্ষে!
রাতে ঘুমানোর সময়ও রুমে এলো না আরভীক। আশফিকে মেইডের কোলে দিয়ে পাঠিয়েছে। ব্যাপারটায় খানিক কষ্ট পেল আনজুমা। তবে আমলে নেইনি। কারণ নিশিরাত্রিতে আরভীক এর দুষ্টুমি বহুগুণে বেড়ে যায়। তাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবে,পুরু মুখে পরপর চুমু খাবে, শাড়ির আঁচল সরিয়ে বুকের মধ্যে জোরকৃত মাথা রেখে তাকে আগলে নেবে,উদরে হাত চালিয়ে চিমটি কাটবে ইত্যাদি আরভীক এর বদঅভ্যাস বলা যায়।
রাত পেড়িয়ে যায় আনজুমা এপাশ ওপাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। আশফি বহু পূর্বেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বজ্জাত ঘুম হানা দিচ্ছে না আনজুমার চোখে! ঘুম আসবেও বা কেমনে একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আরভীক এর বুকে ঘুমানো! এই এক রাত্রি কঠিনচিত্ত হলো আনজুমার কাছে। চোখ বুজে থাকা অবস্থায় দুপুরের দৃশ্য নিয়ে ভেবে আনমনে আওড়ায়।
‘বেশি বলে ফেলেছি মনে হচ্ছে! উনি কি অভিমান করেছেন। যাই করুক আমার কি হু!’
ফাউল কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। অথচ অন্য এক রুমে আরভীক চোখের পানিতে নির্ঘুম রাত্রি পাড় করে দেয়। সকালে নাস্তার টেবিলে আরভীক কে না দেখে মন খারাপ হলো তার! ভেবে নিল ‘সরি’ বলবে। ফলে সে যে রুমে আরভীক গতরাতে থেকেছে সে রুমে গেল। দেখল ঘুমন্ত মুখটি! ইশ! কি মায়াবী চেহারা হুবুহু সুয়াইবের প্রতিচ্ছবি। আড়মোড়া হয়ে বসে ডাক দেয়। জবাব এলো না। পুনরায় ডাকতে নিলে আরাজ সাহেব এসে ধমকে উঠে। আনজুমা ভয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তিনি এসে আনজুমার হাতের কনুই চেপে নিজের রুমে অগ্রসর হয়। আদাফাত ও নাইফা চুপটি করে দেখে গেল। নাইফা আশফিকে বসিয়ে খাওয়ে দেয়। যেহেতু কথা চলছে শ্বশুর ও তার ছেলের বউয়ের মাঝে। আরাজ সাহেব কান্নামাখা গলায় অনুরোধ করে।
‘মা আমার ছেলেটার দোষ নেই সে কিছুই করিনি। কেনো তুমি গতদিনে ওত কথা শুনালে! জানো সে গতরাতে কি করেছে! দু দুটি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিচ্ছিল। ভাগ্যবশত আমি দেখে নেওয়ায় খাইতে পারিনী। পুরু রুম জুড়ে পাগলামী করছিল। আদাফাত ডক্টর হওয়ায় তার কাছে ইঞ্জেকশন ছিল। সে ইঞ্জেকড করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। মা আমার শুনো আরভীক তোমার সাথে কোনোরুপ অন্যায় করেনি! তাকে মেরে নদীতে ফেলেছিল ঐ জাফর ও লিয়াকত! রাজিবকে দেখে ছিলে নিশ্চয়। তাকে তুমি চিনো না কারণ খুব ছোটবেলায় পরিচয় তোমাদের! তুমি বড় হতেই সে হারিয়ে যায়। তবে রাজিব তোমাকে সবসময় চোখে রেখেছে ভাই হিসেবে। তাই যখন তোমার বিয়ে সুয়াইবের সঙ্গে হলো তখন সে সুয়াইব সম্পর্কে বিস্তারিত খবর নেয়। রাজিব পরবর্তীতে এসি জাফরের কুকর্ম সম্পর্কে জানায় সুয়াইবকে সত্য কথা জানিয়ে দেয়। এতে সুয়াইব আইডিয়া দেয় যে রাজিব যেন তার হয়ে কাজ করে। অন্যথায় তার কাজ হবে পুলিশের পক্ষে থেকে এজেন্ট রুপে। ফলে তোমাদের কিডনাপ হওয়া সবটা রাজিবই বলেছে আরভীককে। সে তোমারই সুয়াইব। জানি তার চেহারায় অন্য কারো আদল। এই চেহারা অন্য কারো নয় আমার বড় ভাই ইয়াসিরের। যার বউ-বাচ্চা এক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। তখন আমি বউ ও ছোট আজীবকে নিয়ে অন্য জেলায় ছিলাম। ভাইয়ের মৃত্যুতে বেশ ব্যথিত হয়। তার সন্তানকেও দেখা সুযোগ পায়নি। যেদিন আরভীককে নদীতে ভেসে যেতে দেখি সেদিনই তাকে হসপিটালাইজড করি। সেবাযত্ন পেলেও ক্ষতি হয়ে ছিল বহু। ডাক্তার নতুন ফেইস চাইল। আমি কার ফেইস এনে দিব স্বল্প সময়ের মাঝে। তখন মাথায় এলো কৈশোরকালীন বয়সে আমার ভাইয়ের মুখখানি। তার ছবি দেখে ডক্টর প্রথমে নাকচ করে দেয়। পরবর্তীতে মেনে নেয়। হে এখন আরভীক এর ফেসে চেঞ্জিং এসেছে! সে পূর্বের চেয়ে বেশি সুদর্শন শ্যামবর্ণ হয়েছে। ফেসের দূবির্ষহ সময় কাটার পরও ভালো খবর পায়নি। বরং খারাপ খবর পেলাম যে সে কোমায় চলে গেছে। মাসখানেক পরই সে কোমা থেকে ফিরে রুমের চারপাশ জুড়ে কি যেন খোঁজছিল! ডক্টর চেকআপ করে জানায় সে তার স্মৃতি হারিয়েছে। তথাপি গ্যারান্টি দিয়ে ছিল স্মৃতি ফিরতেও পারে! সেই আশায় নিজের কাছে রেখে বড় করি তাকে। আজীবের ছোট ভাই হয়ে যায় সে। আজীবও ভীষণ আদর করতো তাকে। স্বল্প পরিচয় যেন আমাদের কে সুগভীর সুখের সন্ধান দিয়ে ছিল। পরক্ষণে এক সুনামি আমার আজীবকে কবরে ঠেলে দেয়, সেই সুনামির মিথ্যে অপবাদকে আরভীক প্রকাশ্যে আনায় ইনসাফ পায় আমার আজীব। আর রইল তোমার সঙ্গে ঘটা নিষ্ঠুর কার্যটি। সেটি নিয়ে আমি অবশ্যই ব্যথিত মন থেকে। তাও নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে তুমি যে আরভীককে দূরে ঠেলে দিলে, ভেবেছো কখনো সে ঐ নিষ্ঠুতার পরিপ্রেক্ষিতে আটঁকে রইল না। তার কাছে তোমার সঙ্গ যেন স্বর্গীয় সুখের মনে হতো! ফলে ধীরস্থিরে তোমার জন্য তার সাইকোনেস ফিলিং দেখলাম। বুঝেছি ছেলে আমার তোমার উপর মায়া জম্মে ফেলেছে! আমিও মনপ্রাণে রাজি ছিলাম। অথচ তার স্মৃতি না ফিরলে আমি ভেবেই রেখে ছিলাম জাফরের মেয়ে ঐ শ্রেয়ার সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দেব। ওহ তুমি তো জানো না, শ্রেয়া নামের মেয়েটা হলো ঐদিন তোমার সঙ্গে যে বেয়াদবী করে কথা বলিস না এমন কথা বলেছে। ঐ মেয়েই হলো শ্রেয়া। অতঃপর ছেলে আমার কথার অমান্যে তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। খুশিও হলাম সেই সঙ্গে কষ্টও পেলাম আরভীকের প্রতি তোমার ব্যবহারে। মা একবার সুযোগ দিয়ে দেখতে ছেলে আমার তার অব্যক্ত কথাগুলো বলে আগলে রাখতো। সেই তুমি কিনা দূরে সরিয়ে দিলে…। আমি জানিনা মা আরভীক জাগলে কি রুপ আচরণ করে! পারলে আগলে রেখো নিজের সুয়াইবকে। একবার হারিয়েছো আশা করি দ্বিতীয় বার হারাবে না।’
নিজের মনে চেপে রাখা তিক্ত কথার সঙ্গে গুপ্তকথন পেশ করে দেয় আরাজ সাহেব। মন শান্ত হলেও তিনি ভাবল সঠিক জায়গায় নিশানা ছুঁড়েছে ! মেয়েটা বড় হলেও একটু আধটু অবুঝ রয়েই গেল এবং বদরাগী ! তবুও জীবনসঙ্গি হিসেবে সে মন্দ নয়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নাস্তা করতে যায়। আনজুমা নিজের রুমে এসে অজড় ধারায় অশ্রুসিক্তে মগ্ন হলো! সে ভুল করে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে তার সুয়াইবকে। চেহারার পরিবর্তন হলেও মানুষটা তো তারই! অথচ সেই মানুষটিকে নরপশু বলতেও তার হৃদয় কাঁপেনি। কান্নার জোয়ার রুমের মধ্যেই আবদ্ধ। সে কোন মুখে দাঁড়াবে আরভীক এর সামনে জানে না! তবে তাকে মানিয়ে ছাড়বে। অভিমান করেছে ভাঙ্গানোর চেষ্টা করবে সে। যদি শত অবহেলা সহেও মানুষটি তোমায় ভালোবাসে তবে সেই মানুষটি নরপশু নয় বরং হৃদপুরুষ!
আকস্মিক হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে এসে হাজির হলো নাইফা। দীর্ঘ জোরালো দম ফেলে আনজুমাকে বলে,
‘ভাবী তাড়াতাড়ি আসেন আরভীক ভাই চলে যাচ্ছে।’
ধুক করে উঠে আনজুমার হৃদয়। নিবিঘ্নে দাঁড়িয়ে যায়, হৃদয় তার দহনক্রিয়ায় পরিণত হলো। তৎক্ষণাৎ আবাইয়া পরে বেরিয়ে আসে। গেইটের সামনে এসে দেখে মরমরা হয়ে আরভীক হাতে লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয়,শরীর কাঁপছে আনজুমার। মানুষটাকে থামাতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু মুখ ফুটিয়ে বলার মত শক্তি পাচ্ছে না। অন্যত্রে আরভীক আড়চোখে আনজুমাকে খেয়াল করলেও পাত্তা দেয়নি। চোখের ও ভাবভঙ্গির মাঝে উপেক্ষা ও অবহেলার কষ্ট কেমন তা বুঝিয়ে দিতে থাকে আরভীক।
চলবে.