পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১৮

0
4098

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ আঠারো

দু’তলা বিশিষ্ট বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। গা হিম করা নিস্তব্ধতা এই বাড়িটাতে। মানুষ গুলো কেমন যান্ত্রিক ভাবে জীবনযাপন করছে। কারো সাথে কারো কথা নেই। আগে মোহনার চওড়া গলা শোনা যেতো আবাসিক এলাকাটার মোড় থেকে। সকাল বিকাল দর্শিনীর উপর চোটপাট করার জন্য হলেও তার কণ্ঠ উচ্চস্তরে পৌঁছাতো। কিন্তু আজকাল তো সেটাও নেই।

মায়া চা বানাচ্ছে রান্নাঘরে। নিস্তব্ধ বাড়িটায় খুটখাট শব্দটাই কেবল শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া কোনো জনমানসের চিহ্ন যেন নেই। ড্রয়িং রুমে টিভি চলছে। মোহনা বোধহয় টিভি দেখছে। টিভির শব্দটাও খানিক শোনা যাচ্ছে। মায়া খুব মনযোগ দিয়ে চা বানালো। অতঃপর চারটা কাপে চা ঢেলে ট্রেয়ের উপর নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে অগ্রসর হলো।

মোহনা খুব মনযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। মায়া মোহনার কাছে গিয়ে হাসিমুখে ট্রে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“শাশুড়ী, চা নেন।”

মোহনা টিভির দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলেন। মুখে কেমন যেন একটা কাঠিন্যতার আভা। শক্ত মুখে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থেকেই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
“আমি তো আজকাল ভয়ে থাকি,কখন তুমি আমার কী ক্ষতি করে দেও। এখন তো ভেবেছিলাম এই চায়ের কাপটা হাতে না দিয়ে বুঝি ঢেলে দিবে আমার শরীরে।”

মায়া হাসলো। মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“সবাইকে আপনার মতন কেনো ভাবতে যান, শাশুড়ি? সবাই কী আর মোহনা হয়?”

“হয়েছে,যাও যাও। ওদেরকেও চা দিয়ে আসো।”

মায়া মুচকি হেসে ট্রে টা নিয়ে ঘুরতে নিলেই ছোট্ট টেবিলটার কোণায় ধাক্কা খেয়ে উপুড় হয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। তার হাতের গরম চায়ের তিনটা কাপই মোহনার শরীলে পড়ে। চিৎকার করে উঠে মোহনা। তার শরীরে যেন কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। চিৎকারে ভারী হয়ে যায় নিস্তব্ধ বাড়িটা। বিপ্রতীপ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, মায়ার শ্বশুরও বিশ্রাম নিচ্ছিলো কিন্তু মোহনার চিৎকারে সেও জেগে উঠেছে। ছুটে বেরিয়ে এলো সে। মোহনা ততক্ষণে লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে। ঘটি হাতার ব্লাউজ পড়ার কারণে পুরো ফর্সা হাতটা লাল হয়ে গেছে সেটা দেখা যাচ্ছে। সাথে গলা আর গালও লাল হয়ে গেছে।

বিপ্রতীপ শীগ্রই ড্রয়িং রুমে এসে হতবাক। মায়া কোমড়ে হাত দিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার। মোহনা তারই পাশে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে। বিপ্রতীপ কাকে রেখে কাকে ধরবে সেটা যেন বুঝতেই পারছে না। অতঃপর নিজের বাবাকে বের হয়ে আসতে দেখে পথ খুঁজে পেলো। সে গেলো মায়াকে সাহায্য করতে আর তার বাবা মোহনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

বিপ্রতীপ মায়াকে টেনে উঠালো। ডান হাতে তার বাহু আঁকড়ে ধরে বিচলিত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে, মায়া? কীভাবে পড়লে? কোথায় লেগেছে বলো?”

মায়া বিপ্রতীপের টি-শার্ট টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। ভাব এমন যে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ততক্ষণে মোহনার চিৎকার যেন মিইয়ে গেলো। তার আদরের ছেলেটা তাকে না ধরে কিনা তার বউকে ধরেছে? বিচলিত হয়েছে? কই এত বছরে এমন দিন তো কখনো আসে নি! দর্শিনী থাকা কালীন যা-ই হতো নির্দ্বিধায় দোষ তাকে দিয়ে মোহনা শান্তিতে থাকতো কারণ বিপ্রতীপ ছিলো মাভক্ত। আর একমাসের ব্যবধানে সে ছেলে কিনা এমন ভাবে বদলে গেলো!

বিপ্রতীপ মায়াকে বসিয়ে রেখে মায়ের কাছে ছুটলো। আহ্লাদী স্বরে বললো,
“কী হয়েছে মা তোমার? চা পড়েছে? জ্বলে যাচ্ছে না? দাঁড়াও আমি বরফ নিয়ে আসছি।”

মোহনা কোনোরকমে চোখের জল লুকালো। তার যেন বিষ্ময়ই কাটছে না। তার ছেলের এমন বদল সে কিছুতেই মানতে পারছে না। এ ছেলের জন্যই সে কত কিছু করেছে এ জীবনে। কত পাপ! অথচ সবটা ভুলে বসেছে সেই ছেলে?

বিপ্রতীপ মাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বিচলিত কণ্ঠে শুধালো,
“কী হয়েছে বলবে তো মা? আচ্ছা তুমি বসো। আমি বরফ আনছি।”

“থাক বাবা,জ্বালা কমে গেছে। তুই বরং বউকে নিয়ে ঘরে যা।”

মোহনার বলা বাক্যে আক্রোশ ছিলো না, তীক্ষ্ণতা ছিলো না তবে ছিলো একরাশ নিস্তব্ধতা, বিষন্নতা। এতদিনের গড়া বিশ্বাসের প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার হাহাকার।

বিপ্রতীপের বাবাও নিজের স্ত্রীর কথাকে প্রশ্রয় দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, তুই বৌমাকে নিয়ে রুমে যা। আমি আছি তোর মায়ের সাথে।”

বিপ্রতীপ মাথা নাড়িয়ে মায়াকে ধরে উঠালো। মোহনা ভেবেছিলো তার অভিমানের ভাষা হয়তো বিপ্রতীপ বুঝবে কিন্তু না,বিপ্রতীপ বুঝে নি। সে দিব্যি বউকে নিয়ে ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো।

মায়া কোনোরকম হেঁটে যেতে যেতে পিছে ফিরে আবার মোহনার দিকে তাকালো। মায়ার দৃষ্টি মনে হলো যেন হাসছে। তার দৃষ্টি যেন ক্রুর হাসি হেসে বলছে,
“দেখলেন তো শাশুড়ি,সবাই মোহনা হয় না। মোহনা আর মায়ার মাঝে বিশাল তফাত। মোহনারা হাত পুড়াতে জানলে, মায়ারা পুরো শরীর পোড়ানের ক্ষমতা রাখে। শরীরের সাথে সাথে যে হৃদয়ও পুড়িয়েছি সেটা বোধগম্য হলো তো? এইতো আপনার মূর্ছা যাওয়া শুরু। এবার কেবল দেখুন কী হয়।”

মোহনা স্তব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তার তবে রাজত্ব হারানোর সময় হলো?

_

ঘর হারা মানুষ গুলোর ঠাঁই হয়েছে নিধিদের বাড়ি। পাশের গ্রামে নিধিদের বাড়ি বলে সেখানেই সবাই উঠলো। যেহেতু তাদের আর থাকার জায়গা নেই সেহেতু সেখানেই উঠতে হয়েছে। নিধির বাবা-মা আপ্রাণ চেষ্টা করছে কুটুমদের আত্মীয়তা সুন্দর ভাবে করতে। যতই হোক মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। সামান্য ভুল ত্রুটিও যেন না হয়।

বিকেল হতেই তৃণা,দর্শিনী,প্রতাপ,মৃত্যুঞ্জয়, দৃষ্টান্ত,নিধির বাবা,প্রদীপ সবাই রওনা হলো পুলিশ স্টেশন। এটার একটা বিহীত যে করতেই হবে। হরপ্রসাদ এত বড় অন্যায় করে তো পাড় পাবে না। অবশ্যই এর যথাযথ শাস্তি হবে।

প্রকৃতি সবে সন্ধ্যার সাজে সেজেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের জীপে করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে পুলিশ স্টেশন। সবার মাঝে নিরিবিলি ভাব। কারো মুখে রা নেই। অবশ্য কথা বলার অবস্থাতে কেউ নেইও। প্রতাপ সাহা কেমন পাথর রূপ ধারণ করেছে। নিধির বাবাও চুপচাপ। তার চুপচাপ থাকার কারণ হলো দৃষ্টান্ত। কেন জানি তার এ ছেলেটাকে পছন্দ না। পছন্দ না হওয়ার কারণটাও অবশ্য ফ্যালনা না। যে ছেলের বাবার জন্য তার বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িটা এমন দাউ দাউ করে জ্বললো সে ছেলের আদিখ্যেতা যেন তার সহ্য হচ্ছে না।

অবশেষে জীপ এসে থামলো থানার কাছে। সব গুলো মানুষ চুপচাপ নেমে গেলো। সবার মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে দারুণ ভাবে। কিছু একটা না করে তারা বাড়ি ফিরবে না প্রতিজ্ঞা করেছে বোধহয়।

থানার আশেপাশে বিরাট বিরাট বাল্ব জ্বলছে যা আলোকিত করছে চারপাশটা ভীষণ ভাবে। ধীরে ধীরে গুটি গুটি পায়ে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে থানার ভিতরে। হঠাৎ তৃণা অনুভব করলো তার হাতটা যেন কেউ শক্ত করে ধরলো। আরেকটা হাতের মুঠোয় বন্দি হলো তার ছোট্ট হাতটা। তৃণা অবাক হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো দৃষ্টান্ত। তৃৃণা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো,
“হাত ছাড়ো, লাট সাহেব। বাবা সাথে আছে। দেখে ফেললে সর্বনাশ। এমনেতেই সবার মন মানসিকতা খারাপ।”

তৃণার কথার পরিপ্রেক্ষিতে হাতের চাপ যেন বাড়লো বয় কমলো না। দৃষ্টান্তের দাঁত কিড়মিড় করে রুক্ষ স্বরে উত্তর এলো,
“তুমি আমাকে তোমার বাপ দেখাচ্ছো? চ’ড়িয়ে সোজা বানায় দিবো অ’স’ভ্য ডাক্তারনি। জানো কাল একটুর জন্য আমি ম’রি নি। কতটা ভয় পেয়েছি জানো? পাকামি না করলে কি তোমার পেটের ভাত হজম হয় না?”

“আমরা কী জানতাম এতকিছু হবে? আর তোমাকে তো কল দিয়েছিলাম কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ ছিলো। সবসময় নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে না দিলে পেটের ভাত কী তোমারও হজম হয় না?”

তৃণার শক্ত কণ্ঠে ভ্রু কুঁচকে তাকায় দৃষ্টান্ত। কোমড়ের পিছে তার বলিষ্ঠ হাতটা দিয়ে জোরে চিমটি কাটে। হাতের মাঝে থাকা হাতটা মুচড়ে দিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
“বেশি মুখে মুখে তর্ক শিখেছো না? দাঁড়াও, তোমার ব্যবস্থা আমি নিচ্ছি। ঝামেলাটা আগে মিটুক। বেশি কথা বেড়েছে না?”

তৃণা মুখ ভেংচি দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বাবার পাশে ছুটে গেলো। দৃষ্টান্ত ধরতে গিয়েও পারলো না। তার মন এখন শান্ত। কাল যা গিয়েছে তার উপর দিয়ে একমাত্র সে-ই জানে। মায়ের পর পৃথিবীতে একমাত্র এই নারীটার প্রতিই সে দুর্বল,আসক্ত। এ মানুষটাকে ছাড়া সে বোধহয় উ’ন্মা’দ হয়ে যাবে।

দর্শিনী থানায় পা রাখতে নিবে এমন সময় একজন মানুষকে দেখে সে থমকে যায়। থেমে যায় তার পা। এত গুলো দিন পর তার সামনে তার প্রিয় একজন মানুষ!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here