পথ_হারা_প্রজাপতি(অন্তিম পর্ব) #Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

0
496

#পথ_হারা_প্রজাপতি(অন্তিম পর্ব)
#Israt_Bintey_Ishaqu(লেখিকা)

রাযীন ভাইয়া?
সাফিরার অস্ফুট স্বরে রাযীন সারা দেয় না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাই আগে ওয়াশরুমের কাজ শেষ করে এসে আবারো ডাকলো। এবার কাজ হলো। রাযীনের ঘুম ভাঙ্গলো। চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,
–” এতো রাতে ডাকছো কেন? দিলা তো আমার সুন্দর ঘুমের তেরোটা বাজিয়ে।
সাফিরা মিনমিনে গলায় বলল,
–” ভাইয়া আপনি এখানে ঘুমিয়েছেন কেন? আপনার রুমে গিয়ে ঘুমান নাই কেন?

রাযীন ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
–” আমাদের বাড়ি, আমার ব‌উ, আমার যেখান মন চায় সেখানে ঘুমাবো। তোমাকে বলে নিতে হবে?

“আমার বউ” কথাটা যেন কান গরম করে দিল সাফিরার। এই সম্বোধন আগে কখনো করেনি রাযীন। প্রথম বার করায় সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। এ কেমন অনুভূতি? কাউকে বলে বুঝানোর মতো নয়। তারউপর তুমি সম্বোধন! একসাথে এতো গুলো স‌ইতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে সাফিরার।
রাযীনের পরবর্তী কথা,
–” বেয়াদব মেয়ে! স্বামীকে ভাই ডাকে কেউ? আর যেন না শুনি!
–” ভাইয়া বলেই তো সব সময় ডাকি।
–” আমি বলেছিলাম ডাকতে?
–” না।
–” তবে? আর ডাকবে না। যদি ভুল করেও ডাকো তাহলে শা*স্তি পেতে হবে! কথাটা যেন মনে থাকে।
মাথা কাত করে সাফিরা বলল,
–” আচ্ছা।
রাযীন আবারো ঠিকঠাক হয়ে শুয়ে পড়ল। আর বলল,
–” অনেক রাত হয়েছে শুয়ে যাও।
সাফিরা একটু দূরত্ব নিয়ে শুয়ে পড়লো।
.
.
সাফিরার আহত স্থানের সেলাই কাটা হয়েছে। এখন কাটা দাগটা স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মন খারাপ হয়ে যায় সাফিরার। তবুও ফোনের জন্য বেশি খারাপ লাগছে। একটু আধটু ফোন ইউজ না করলে সময় গুলো বড্ড বেশি বোরিং লাগে।

শুক্রবার ছুটির দিন মিনহাজ আর রাযীন ঘুরতে বেরিয়েছে। ঢাকা বসুন্ধরা সিটিতে এসেছে তারা। রাযীন বিশেষ করে এসেছেন ফোন কিনার জন্য আর মিনহাজ তার কিছু কেনাকাটা করার জন্য।
রেস্তোরাঁয় বসে বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে খেতে
মিনহাজ জিজ্ঞাসা করল,
–” কিরে কতদূর আগালি?
রাযীন মিনহাজ এর ইঙ্গিত বুঝতে না পেরে বলল,
–” কিসের?
–” ভাবির সাথে সবকিছু ঠিক করে নেওয়ার?
–” চেষ্টা করছি দেখা যাক কি হয়।
–” ইনশা আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে।
–” হুম ইনশা আল্লাহ।
.
রাযীন আগের মতো আর বকাঝকা করে না সাফিরাকে। তবে খুব কম কথা বলে। পড়াশোনা করতে ও জোর করে না। সময় মত পড়িয়ে দেয়, এরপর সাফিরার ইচ্ছা হলে পড়ে না হলে পড়ে না।

সাফিরা ঘুমানোর জন্য বিছানা ঝেড়ে নিল।
ঘুমানোর আগে বিছানা ঝাড়া সুন্নত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমানোর আগে বিছানা ঝাড়তে উৎসাহিত করেছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
যখন তোমাদের কেউ শয্যা গ্রহণ করবে, তখন সে যেন নিজ লুঙ্গীর একাংশ দ্বারা তার বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ, সে জানে না যে, তার অনুপস্থিতিতে কি কি জিনিস সেখানে এসেছে‌। [১]
.
সাফিরা বিছানা ছেড়ে মশারী টাঙানোর সময় রাযীন রুমে এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়! রাযীনের এহেন কান্ডে চমকে উঠে সাফিরা। মশারীর দুই কোনা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাছে এসে রাযীন বলল,
–” আর বাকি দুই কোনা কি লাগাবে না?
সাফিরা আবার দুই কোনা লাগিয়ে নেয়। এরমধ্যে রাযীন মশারীর ভিতরে ঢুকে মশারীর চারিদিক সুন্দর করে গুঁজে দিল। তারপর আরাম করে শুয়ে বলল,
–” এই লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে দেও।

রাত বারোটা বাজে। সবাই সবার রুমে ঘুমিয়ে আছে। তাই নিশ্চিন্তে রাযীন শুয়ে আছে। সাফিরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
–” দাঁড়িয়ে থেকে মশার কামড় খাবে নাকি ঘুমাতে আসবে?
সাফিরা ধীর পায়ে এগিয়ে আসে বিছানায়। বুক তার টিপটিপ করছে। রাযীনের কর্মকাণ্ড গুলো মেনে নিতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে। হঠাৎ এমন আচরণ কেন করছে রাযীন? বুঝতে পারছে না সাফিরা।

প্রায় এক মাস যাবত এমনি চলছে। এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে সাফিরা। আগের মতো আন‌ইজি ফিল হয় না। বরং অন্যর‌কম এক ভালোলাগা কাজ করে। সাফিরার যখন পড়া কমপ্লিট করতে লেইট হয় তখন বিছানা ঝেড়ে মশারী টাঙিয়ে অপেক্ষা করে রাযীন। তাছাড়া সাফিরার সাথে অনেক কথা বলে। সাফিরার মন খারাপ থাকলে কারণ জিজ্ঞাসা করে মন ভালো করার চেষ্টা করে।
তবে সবার সামনে আগের মতোই থাকে রাযীন! যেন সে সাফিরাকে পছন্দ করে না।
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও পরে সেটা বুঝতে পারে সাফিরা। তবে এই লুকোচুরি খেলার কারণ খুঁজে পায় না সাফিরা। সে তো তার বিয়ে করা বউ, তাবে এই লুকোচুরির আশ্রয় কেন নেয় রাযীন?

একদিন তামান্নার রুমে খাবার পানি শেষ হয়ে যায়। পানির জগ নিয়ে ডাইনিংয়ে আসে পানি নিতে। পানি নেওয়ার এক পর্যায়ে দেখতে পায় এদিক ওদিক তাকিয়ে রাযীন সাফিরার রুমে ডুকছে! যেন সে চু*রি করতে যাচ্ছে লুকিয়ে!
সবাই জানে রাযীন সাফিরাকে পড়ানোর জন্য তার রুমে যায়। পড়িয়ে আবার চলে আসে, থাকে না। কিন্তু এই মাঝ রাতে এভাবে যেতে দেখে তামান্নার মনে সন্দেহ জাগে। যদিও তারা স্বামী-স্ত্রী কিন্তু রাযীন তো আর মানে না।

এরকম কয়েকরাত দেখে তামান্না সিউর হলো রাযীন তাকে মেনে নিয়েছে ব‌উ হিসেবে। তাই আর ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলো না।
কিন্তু একদিন রাযীন রুমের বাল্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন বাল্ব লাগাতে লম্বা টুলের উপর দাঁড়িয়ে সাফিরা কে বলল, যে লাইনে বাল্ব লাগাবে ঐ লাইনের সুইচ অফ করে দিতে। কিন্তু ভুলবশত সাফিরা অন্য লাইনের সুইচ অফ করে দিয়ে চলে গেল। এদিকে রাযীন বাল্ব লাগাতে গিয়ে হঠাৎ বাল্ব জ্বলে ওঠায় হাত থেকে ফেলে দিল! নিচে পরে ভেঙে চুরমার বাল্ব! ভীষণ রা*গ হলো রাযীনের। আর তাই রা*গ মিটাতে সাফিরা কে ডেকে এনে ইচ্ছা মতো বকাঝকা করেছে।
যার কারণে সাফিরা নিজের রুমে এসে অনেক কান্নাকাটি করে। সে জানে তার ভুল হয়েছে তাই বলে এভাবে বকবে রাযীন?
তামান্না সবকিছু দেখে রাযীনের উপর প্রতি*শোধ নিতে সাফিরা কে বলল,
–” নিষ্ঠুর রাযীন ভাইয়া শুধু শুধু তোকে কতগুলো ঝাড়ি দিল। তোকে যদি ব‌উ হিসেবে মানতো তাহলে কি এভাবে ঝাড়ি দিতে পারতো? উহু পারতো না। তোর জন্য অনেক মায়া হচ্ছে রে। আজকে এতিম বলে ভাইয়া তোকে এরকম ব্যবহার করতে পারছে!

সাফিরা চোখের পানি মুছে বলল,
–” ব্যবহার করছে মানে?
–” দেখিস না? যখন যা ইচ্ছা তাই করছে তোর সাথে!

সাফিরাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল তামান্না। সাফিরা তামান্নার বলা কথা গুলো ভাবতে থাকে। প্রতিদিনের মত রাতের বেলা যখন রাযীন ঘুমাতে আসে। তখন সাফিরা বলল,
–” আমাকে এভাবে ব্যবহার করছেন কেন? আমি এতিম বলে? আমার কেউ নেই বলে যাচ্ছে তাই করে চলেছেন। আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয় না আপনার? এবাড়িতে আসার পর থেকে আপনার অত্যাচারে গুমরে মর*ছি আমি! প্লিজ দয়া করুন আমাকে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না আপনাকে!
–” কি করেছি আমি তোমার সাথে? তুমি যেন ভালো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারো তার জন্য দিনরাত তোমাকে পড়াশোনা করিয়েছি।
পড়াশোনা করার জন্য সাশন করেছি এগুলো আমার অত্যাচার?
খেতে না দিয়ে পরে আবার নিজেই নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছি এগুলো অত্যাচার?
স্বামীর অধিকার নিয়েও তোমাকে ব্যাড টাচ করিনি তাহলে কোনটা কে তুমি ব্যবহার সম্বোধন করছো বলো?
সাফিরা চুপ করে রইলো। রাযীন আর কথা না বাড়িয়ে হাতে থাকা শপিং ব্যাগ টা সাফিরাকে দিয়ে চলে যায় রুম থেকে। শপিং ব্যাগ টা খুলে দেখে নতুন মোবাইল ফোন! দেখে বেশ দামী মনে হচ্ছে। আবারো কান্না করে দেয় সাফিরা। তামান্নার ফাঁদে পা দিয়ে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে সাফিরা। এখন বুঝতে পেরে অনুসোচনায় দগ্ধ হচ্ছে।
সাথে সাথে দৌড়ে রাযীনের রুমে যায় কিন্তু রাযীন নিজের রুমে নেই। বাড়ির মেইন গেট ভিতর থেকে বন্ধ করা। তাই ছাদে গিয়ে দেখে একপাশে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাযীন।
সাফিরা দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে জাপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আর মাফ চেয়ে বলে,
–” আমাকে মাফ করে দিন। এরকম জগন্য বাক্য আমি আর কখনো মুখেও উচ্চারণ করবো না ইনশা আল্লাহ।

রাযীন সামনে ঘুরে বলল,
–” মাফ করে দিয়েছি।
এতো গুলো দিন স্ত্রীর হক আদায় না করার জন্য আমাকেও মাফ করে দাও?
–” মাফ করে দিয়েছি।
তারপর নিজের স্ত্রীকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাযীন। এ এক অদ্ভুত সুখের মুহূর্ত।
.
.
অতঃপর রাযীন সাফিরাকে মেনে নিয়েছে শুনে করিম সাহেব আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, এতিম শিশুদের খাওয়ানোর আয়োজন করেন।
রাযীনের কাজিনরা বাসর ঘর সাজিয়, তারপর সবকিছু নতুন করে শুরু হয় রাযীন আর সাফিরার জীবনে।

কয়েক মাস পর তামান্নার ও বিয়ে হয়ে যায়। শশুর বাড়ী গিয়ে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবাই সবার জীবনে ভালোবাসা খুঁজে নেয়।

রেফারেন্স:
[১] (সহীহ বুখারী, হাদীস (৬৩২০)

#সমাপ্ত

(আসসালামু আলাইকুম।
দুই দিন গল্প না দেওয়ার জন্য দুঃখিত।
রমজান মাস চলে আসায় গল্পটা বড় করলাম না। গল্পটা কেমন হয়েছে জানাবেন প্লিজ।
যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পটা লিখতে উৎসাহিত করেছেন আমাকে তাদেরকে জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here