#পদ্মদিঘি_
১ম পরিচ্ছেদ
০১.
কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই শাদবিন শাহীর ১৬ বছরের কিশোরী সেহনাতের কৃত্রিম সাজ পানি দ্বারা ধৌত করে দিয়েছে। সেহনাতের নেত্রের কৃষ্ণ কাজল লেপ্টে আছে। পাত্রপক্ষ ওদিকে অপেক্ষায় মত্ত রমনীর। সেহনাত চোখ-মুখে ভীতির ছাপ তুলে পদতলের নিকট তাকিয়ে আছে। কপোল বেয়ে টপ টপ করে পানি পরছে। কিন্তু তার সামনের আগন্তুকটির সেদিকে খেয়াল নেই। সেহনাত ঠাওর করতে পারলো না, পরবর্তী পদক্ষেপে কী করবে? ইতিমধ্যে তার আম্মি শবনাম কক্ষের দ্বারে কড়াঘাত করে গেছে কিন্তু রমনী তার কোনো উত্তরই দেয়নি। হঠাৎ সেহনাতের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, সে চোখ তুলে যুবকটির দিকে তাকালো। রমনীর ক্রন্দন শাদবিন শাহীরকে কোমল করতে পারলো না। সে পর্বতের ন্যায় কঠোর হয়ে রইলো। তার নিঃশ্বাসের শব্দ কর্ণগোচর হতেই রমনী দূরে সরে আসার চেষ্টা করে কিন্তু শাদবিন শাহীর খপ করে তার হস্ত ধরে পূর্বের আসনে বসিয়ে দেয়। সেহনাত কিছুটা কেঁপে ওঠে আতঙ্কে! কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্ণগোচর হয় পুরুষালি বাজখাঁই কন্ঠস্বর। এতেও শাদবিন শাহীর কোনোরূপ অভিব্যক্তি দেখালো না। সেহনাত মিনুতির স্বরে বলে উঠে,
–“দোহাই লাগে, আমায় যেতে দিন। আমি চাই না আম্মিজান আমার জন্যে ওদের কাছে অপমানিত হোক, অবহেলার বস্তু হোক। দয়া করুন শাহীর বাবু!”
কাতরে ভরা বচন শাদবিন শাহীরের কর্ণগোচর হলেও সে তার সিদ্ধান্তে অটল। যুবক উল্টো রমনীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলে,
–“ভালো করোনি তুমি ভ্রমরাণী! তুমি আমায় রাগিয়েছো, এই জমিদার নবাব শাদবিন শাহীরকে বেদনা দিয়েছো। এর ফল কখনোই ভালো হয়নি আর না এখন হবে। যা হচ্ছে হতে দাও, আমি আমার শাহাজাদীকে কখনোই পরপুরুষের দর্শন করার বস্তু হতে দিবো না। তুমি আমার একান্তই ব্যক্তিগত সম্পদ। তুমি আমার বেগম, আমার ভ্রমরাণী, আমারই শাহাজাদী!”
রমনীর অশ্রুরা আজ বাঁধ মানছে না। আগাম ঘূর্ণিঝড় যে তার দিকেই ধেয়ে আসছে সেটা সে ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে! রমনী নিরুপায় হয়ে পদতলের নিকট দৃষ্টি স্থির করলো। শাদবিন শাহীর তার আসনেই বসে রইলো। যখন সে উপলব্ধি করলো পাত্রপক্ষ চলে গেছে তখনই সে উঠে দাঁড়ায় এবং রমনীর উদ্দেশ্যে বললো,
–“ভুল যা করেছো তার প্রায়শ্চিত্ত করো, এটাই তোমার শাস্তি। আমাকে না জানানোর ফল ভুগে নেও। আসছি, আল্লাহ হাফেজ!”
বলেই কক্ষের গোপন দ্বার দিয়ে সে বাহিরে বেরিয়ে গেলো। সেহনাত আজ শাদবিন শাহীর কে সালাম অবধি দেয়ার অবস্থায় নেই৷ ধৌত মুখশ্রীর জলটুকু ত্বক শুষে নিয়েছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই। আনমনেই সেহনাত দর্পণের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বড্ড এলোমেলো লাগছে তাকে। নেত্রের নিম্নে যেন অমাবস্যার কৃষ্ণ ছুঁয়েছে। না জানি তার এই ললাটে কোন বিপদ বয়ে আসছে?
——
~অতীত উল্লেখ~
মাসখানেক কেটে গেলো জমিদার নবাব শাহরিয়ার আমিনের মৃত্যুর। গ্রামের মানুষ দিন কয়েক শোকে জর্জরিত হলেও নিত্যকার জীবনে তারা ফিরে যায়। আজ মৃত্যুর চল্লিশ দিনের মিলাদে গ্রামের প্রায় প্রত্যেক পুরুষই জমিদার বাড়ির দিকে ছুটছে। তাদের মনের অভ্যন্তরের লোভটা হয়তো ভোজনের, আবার যারা প্রকৃত জমিদারকে ভালোবাসে তারা হয়তো প্রাণভরে দোয়া করবে সামান্য কিছুটা খাবারের বিনিময়ে। আবার কিছু মানুষ যাচ্ছেন নতুন জমিদারের সুখবরের আশায়।
গ্রাম বড় হওয়ায় সকলকে জমিদার বাড়িতে ভোজন না করালেও প্রতি গ্রামের মসজিদে মিলাদ এবং মিষ্টান্নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু হাতে গোণা কয়েকটা গ্রামই জমিদার বাড়ির নিকট যাচ্ছে। ফিরোজও তৈরি হচ্ছে, জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। বদ্ধ জানালা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে তরুণী সেহনাত দেখছে সকলের তড়িঘড়িতা। আয়েশা স্বামীর প্রয়োজনীয় টুপি হাতে তুলে দিয়ে বলে,
–“ওগো মোহিনীর বাপ! সবাই এমন ঘটা করে জমিদার বাড়িতে ছুটছে কেন?”
–“চল্লিশ দিনের মিলাদে বেগম আকলিমা গেরামের সকলরে দাওয়াত করসে। এই আয়োজন তিনদিনের বুঝলা আয়েশা? আইজ আমাগো নওপাড়া, শেখের জায়গা আর গন্ধপুর যাইবো। গতকাল চারগ্রাম গেছে।”
–“শুধু কী পুরুষরাই যাইবো?” এই প্রশ্নটা মনে আসলেও আয়েশা মুখে প্রকাশ করতে পারলো না। নিরবে স্বামীর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রয়। ফিরোজ তৈরি হয়ে পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে বলে,
–“আইজ নাকি জানা যাইবো আমাগো নয়া জমিদার কে হইবো। আসলেই তো জমিদার বিহীন আমাদের এই কাশিমপুর আর কতদিনই-বা চলব? যাইহোক এহন যাই, দেরী হইলে ঘাটে আবার নৌকা পামু না।”
ফিরোজ আয়েশা এবং তার একমাত্র মেয়ে মোহিনীকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘাটের উদ্দেশ্যে। যোহরের আযান দিতে আরও একঘন্টা বাকি। ফিরোজ সাহেব ভেবে রেখেছেন রহমতপুর গিয়েই যোহরের ওয়াক্ত ধরবেন এবং সেই বড় মসজিদেই সালাত আদায় করবেন।
ফিরোজ যেতেই আয়েশা শবনামকে ডেকে পাঠালেন। শিউলির হতে এই বার্তা পেতেই শবনাম তার মসলিন বুনন রেখে ধীর পায়ে চলে যায়। আয়েশা হাড়ির ভাত দেখছিলো তখন। কারো উপস্থিতি টের পেতেই বলে উঠলো,
–“প্রায় দ্বিপ্রহর হয়ে আসছে। গেরামে এহন পুরুষগো ছড়াছড়ি। তোমার ওই মাইয়ার খেয়াল রাইখো, ও যেন বাইর না হয়। তোমার ভাই গেছে জমিদার বাড়ি! তোমার এই মাইয়ার লেইগা আমার ঘরে কোনো অশান্তি হোক আমি চাই না!”
শবনাম নিরুত্তর। ভাবীর বচনগুলো কর্ণধারে নিয়ে প্রস্থান করলো। শবনাম সোজা কন্যার ঘরে এসে হাজির হয়। সেহনাত তখনো বদ্ধ জানালার ফাঁকে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। রমনী কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই পিছে ফিরে তাকায়।
–“আচ্ছা আম্মিজান, সকলে কোথায় যাচ্ছে? আর মামুজান-ই বা কোথায় ছুটলো..”
সেহনাত আরও কিছু বলার পূর্বেই লক্ষ্য করলো মায়ের মলিন মুখশ্রী। শবনাম মেয়ের মাথায় পিরিশিষ্ট ওড়নাটা দিয়ে দেয়। অতঃপর থমথমে গলায় বললো,
–“জমিদার বাড়িতে যাচ্ছে সবাই। নামাজের সময় হচ্ছে, হাম্মামখানায় গিয়ে দ্রুত গোসল সেরে নিবে। আর হ্যাঁ, আজ তিলোওয়াত আছে, বাহিরে বের হবে না!”
সেহনাত উত্তরে মাথা নাড়ালো। মায়ের মলিন মুখশ্রী দর্শন করে রমনীর বুঝতে বাকি রইলো না, আয়েশা অর্থাৎ তার মামীজান তার আম্মিজানকে কিছু বলেছে। সেহনাতের তার প্রতি আক্রোশ জম্মালেও সেটার বহিঃপ্রকাশ করলো না। মায়ের কথামতোন পরিহিত জামা এবং গামছা নিয়ে চলে যায় মেয়েদের জন্য খড়ের তৈরি ছোট হাম্মামখানায়। কয়েক কলসি জল রাখা আছে সেথায়।
অবশেষে নির্বাচিত হলো নতুন জমিদার৷ নতুন জমিদার হয়েছেন শাহরিয়ার আমিনের একমাত্র পুত্র শাদবিন শাহীর। কেটে গেলো দীর্ঘদিন। সময়ের ব্যবধানে শাদবিন শাহীর তার বিচক্ষণতা গ্রামের সাধারণ মানুষদের নিকট প্রমাণ করেছে। জমিদারিও সামলে নেয় নিখুঁতভাবে।
গ্রামের কিছু মানুষের শাদবিনের প্রতি অসন্তুষ্টি থাকলেও তার দক্ষতা সহিত জমিদারী সামলানো দেখে কারো কোনোরূপ দ্বিরুক্তি নেই। বরং সকলেই খুশি হয়েছে এমন জমিদার পেয়ে। শাদবিন শাহীর শীতল মস্তিষ্কের মানুষ হলেও তার মেজাজ ভয়ানক৷
শাদবিন গ্রাম পরিদর্শনের সময় অনেক কিশোরী-যুবতিই তাকে প্রাণভরে দেখে নেয়। শোনা যায় শাদবিন শাহীর শহরে শিক্ষাগ্রহণ করেছে।
কাশিমপুর সাধারণত মসলিনের জন্যে বিখ্যাত। মোঘল সম্রাটসহ নবাব-জমিদাররাও এই কাশিমপুরের মসলিনকে বেশি প্রাধান্য দেয়৷ কাশিমপুরের পূর্বাঞ্চল পুরোটাই মসলিন এবং তাদের স্রষ্টার রাজত্ব। নওপাড়া, গন্ধপুর, রূপনগরসহ আরও দুই গ্রামে মসলিন কারিগরদের বসবাস।
শীতলক্ষ্যার শাখা নদী বালু নদীর বিপরীতেই রহমতপুর। অদ্ভুত সব সৌন্দর্যে আবৃত এই পুরো কাশিমপুর। বালু নদীর স্বচ্ছ পানির ঘাটে দ্বিপ্রহরে কিশোর’রা ডুবিয়ে বেড়ায়। আবার মাছও ভালো পাওয়া যায়।
প্রথম সেহনাত শাদবিন শাহীর নামটি শুনেছিলো তার মামুজানের মুখে। এরপর প্রায় সময়ই জমিদারকে নিয়ে কথোপকথন শুনেছে তার সহপাঠীদের কাছে। তাদের সহপাঠীও বলা চলে না, সেহনাত তাদের সহপাঠী মনে করলেও তারা সেহনাতকে বরাবরই ঠাট্টার বস্তু মনে করে। এজন্য ইদানীং তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
আজও তাদের কানাঘুষা কর্ণগোচর হয়ে সেহনাতের। কথোপকথন জমিদারকে কেন্দ্র করেই।
ওদের এতো এতো প্রসংশার জন্যে মাঝেমধ্যে সেহনাতেরও ইচ্ছে করে, একপলক নতুন জমিদারকে দেখার। সেহনাত তার অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মেঠোপথ ধরে বালু নদীর দিকে চলে যায়। সেহনাতের অন্যতম অভ্যাসও একা একা ঘুরে বেড়ানো।
হঠাৎ অদূরে লক্ষ্য হয় এক যুবক ঘোড়ায় চড়ে এদিকেই আসছে। সেহনাত অনেকটা খুশি এবং অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তার মাথাতেই নেই সে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। শাদবিন অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে ঘোড়াটা থামালো। এখানে এসেছে এক মসলিন শাড়ির জন্যে। কাজ কতদূর এগোলো সেটাই পরিদর্শন করতে এসেছে সে। পথে এই কিশোরীকে বিরক্তি বই কিছু মনে হলো না তার।
–“আপনি কী শহর থেকে এসেছেন, শহুরে বাবু?”
শাদবিন স্তম্ভিত দৃষ্টিতে রমনীর দিকে তাকালো। তার এই দৃষ্টান্তে বিমূঢ়তা স্পষ্ট। হয়তো এই মুহূর্তে আশা করেনি কিশোরীর এমন বোকাসুলভ উক্তি। শাদবিন শাহীর ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায়। আজ সে স্বাধীন, সাথে নেই কোনো দেহরক্ষী।
শাদবিন শাহীর ঘোড়া থেকে নামতেই দেখতে পায় উজ্জ্বল শ্যামবতী এই কন্যাকে। মুহূর্তে তার চোখ আটকে যায় সেই নিষ্পাপ মুখশ্রীতে। অদ্ভুত সম্মোহনী নেত্রপল্লব রমনীর। সেহনাতেরও খেয়াল নেই যে তার মুখশ্রী হতে কিঞ্চিৎ কাপড় সরে গেছে।
শাদবিনকে সেহনাত আবারও একই বাক্য বললো। ধ্যান ভাঙ্গে যুবকের। অজানা কারণে তার পরিচয় লুকানোর ইচ্ছে জাগলো। শাদবিন গলা খাঁকারি দিয়ে মাথা নাড়ায়! রমনী হাসলো। এই হাসিতে যেন অদৃশ্য মোহ এঁটে দেয়া হয়েছে। রমনী আবারও অধরে হাসি লেপ্টে বলে ওঠে,
–“স্বাগতম, আমাদের মসলিন রাজ্যে।”
তখনই অদূর থেকে ছাতা হাতে ভৃত্য ছুটে আসলো শাদবিনের নিকট। মনিবের কাছে এসে ভৃত্য জাহিদ হাঁপিয়ে বলতে লাগলো,
–“ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন হুজুর। পথিমধ্যেই আসলে ইয়ে পেয়ে গেছিলো তাই একটু দেরী করে ফেলেছি। বেগম…”
শাদবিন হাত দিয়ে মনিবকে থামিয়ে দিলো৷ অতঃপর হুকুমের স্বরে বললো,
–“ঘাটে যাও, আমি আমার কাজ সেরে শীঘ্রই ফিরবো।”
ভৃত্য জাহিদ বিপরীতে কিছু বললো না৷ সালাম জানিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলো সে। যা ভুল করেছে তার জন্যে মনিব যে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেনি এটাই অনেক।
জাহিদ প্রস্থান করতেই সেহনাত তার পথে দৃষ্টি দিয়ে অবাকমিশ্রিত কন্ঠে বলে,
–“বাহ। বেশ মান্য করে তো আপনার। আচ্ছা, আপনি কী কোনো বিত্তশীল মানুষ?”
শাদবিন এক দৃষ্টিতেই রমনীর দিকে তাকিয়ে। রমনীর প্রশ্নে শাদবিন এবারও স্মিত হাসলো। তার চিত্তের খবর বোঝার কোনোরূপ জো নেই!
~চলবে, ইনশাল্লাহ!
@লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts ]
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। এ ধরণের উপন্যাস প্রথম লিখছি। জানি না প্রথম কেমন হয়েছে। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। আপনাদের রেসপন্সের উপর ভিত্তি করছে পরবর্তী পর্ব।