পদ্মদিঘি পাঠ-১০

#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
১০.

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

[সেরা কমেন্টকারীদের নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করা হবে। গ্রুপের লিংক গল্পের শেষে দেয়া হলো।]
কাবিনের দিন আয়েশা যুবক পূর্বের চরণ ধরে বসে আছে। বিষয়টা অত্যন্ত লজ্জাজনক হলেও আয়েশা সন্তানের জন্য নিরুপায়! মোহিনীর পাগলামী এই এক সপ্তাহে ক্রমাগত বেড়েছেই। ফিরোজ সাহেব মোহিনীর গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে। আদরের কন্যার এই হাল কিছুতেই মানতে পারছেন না আয়েশা। স্বামীকে অনেক অনুরোধ করেছে যেন এই পাত্রের সঙ্গে মোহিনীর বিয়ের ব্যবস্থা করে। এদিকে শবনামও নাকোচ করেছে বারংবার। এ নিয়ে এক সপ্তাহ বেশ ঝামেলা হয়েছে। আয়েশা না পেরে যুবক পূর্বকেই পেয়েছে।

–“আরে আরে। চরণে হাত দিবেন না, দয়া করে!”

–“বাবা! আমার মাইয়াটা তোমার জন্যে নাওয়া-খাওয়া সব ছেড়ে দিছে। একটু রহম করো আমার মাইয়াটার উপর। বিশ্বাস করো, সেহনাতের চেয়েও সুন্দরী আমার মাইয়া। রূপে, গুণে সব দিয়ে ভালো। দয়া করো এই অসহায় মায়ের উপর!” ক্রন্দনরত অবস্থায় যুবককে অনুরোধ করলো আয়েশা। কিন্তু পূর্ব কিছু বলতে পারলো না। আজ এসেছে তার পিতার সঙ্গে। যাকে পছন্দ করে তাকে ব্যতীত কী করে অন্য কাউকে মেনে নিবে?

–“আম্মিজান, মোহিনী যখন এতো করে চাইছে তাহলে ওর সাথেই বিয়ে দিয়ে দাও!”

কিশোরীর সরল বুলিতে চোখ রাঙায় শবনাম।
–“এটা তোর প্রতি ঈর্ষা হতে করছে মোহিনী। ছোট বলে এতটাও ভালো সে নয়। তার অভ্যন্তরে বিশাল এক শয়তান বসবাস করছে। সাবধান! ওর কথায় ভুললে চলবে না।”

কিশোরী মায়ের কথার বিপরীতে কিছু বললো না। আগের ন্যায় নিরবে ঘটনা দেখতে লাগলো। ফিরোজ এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। স্ত্রীর এমন কর্মকান্ডের জন্যে বেশ লজ্জিত তিনি। আশেপাশের মানুষ আঙিনায় জড়োসড়ো হয়েছে অভ্যন্তরের খবর নেয়ার জন্যে। তার উৎসাহ যেন এসবে খুব বেশি। তাইতো কাজ-কর্ম ফেলে ছুটে এসেছে সমাপ্তির ফলাফল দেখতে৷ আয়েশার জন্যে সেদিন আর কাবিন হলো না। পূর্বও রাজি হলো না মোহিনীকে বিয়ে করতে। সে সদা অটল নিজ সিদ্ধান্তে। যুবকের পিতা বিরক্তির সুরে ফিরোজের উদ্দেশ্যে বললো,

–“আজ শুভ কাজ সারতে পারলাম না বেয়াইসাব। আগামী শুক্রবার অর্থাৎ দিন দুয়েক পর আবার আসবো। সেদিন আমি চাই না এরকম ঝামেলার সম্মুখীন হতে। আপনার স্ত্রীকে বুঝ দিন! আসি, আল্লাহ হাফেজ!”

বলেই তারা সেদিনের মতো বিদায় নেয়। আয়েশা পূর্বের ন্যায় মেঝেতে বসে রইলো। সকল অতিথি চলে যেতে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফিরোজ।

–“কন্যার অন্ধভক্ত হয়ে গেছো? বুঝ নাই তোমার? উঠতি বয়স মাইয়ার, আমি কী বলছি ওরে বিয়া দিবো না? বিয়ার জন্যে আমার ভাগনির হবু বরকে কেন টানতাসো, মা-মেয়ে মিল্লা? অন্যের ভালো কী সহ্য হয় না? তোমাদের জন্য আর কতো এই সমাজে নাক কাটা যাইবো?”

শেষোক্ত বাক্যটি ধমক দিয়ে বলে উঠলো ফিরোজ৷ আয়েশা সেভাবেই বসে রইলো। ফিরোজ নিজের ক্রোধ দমাতে না পেরে কক্ষ হতে বেরিয়ে গেলো। শবন পাশের আসনে ধপ করে বসে পরলো। শুভ কাজে এমন বাধা তার ভালো লাগছে না। মনের মধ্যে ভিষণ কুঁ ডাকছে। এ যেন কোনো বিপদের সংকেত। শবনাম নেত্রপল্লব বুজে ফেললো। অভ্যন্তরে রবকে ডাকলো। তার মেয়ের উপর যেন কোনো কালো ছায়া না পরে।

আয়েশা চোখ মুছে নিলো আঁচল দিয়ে। সে বুঝেছে কেউ তার এই দুঃসময়ে সঙ্গ দিবে না। তাই যা করার তাকেই করতে হবে। মেয়ের জন্যে তাকে ছুটতে হবে। বাড়ির বাহিরে পা ফেলতে হবে। আয়েশা ঘাড় ঘুরিয়ে কিশোরীর দিকে ক্রুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। কিশোরী নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। মামীর এই চোখের বিকট বজ্রপাত সে ভালোই বুঝেছে। তবে কিশোরী ক্লান্ত, এসব ধাক্কার মুখোমুখি হতে হতে। মন-মস্তিষ্ক জুড়ে থাকা পুরুষটিকে এখনো ঘৃণা করতে পারছে না সে। চিত্তে তীব্র রক্তক্ষরণ হয় যুবককে দর্শন করার জন্যে। কী অদ্ভুত এই অনুভূতি, যাকে ঘৃণা করা উচিত তার জন্যেই অম্বর সম অগাধ ভালোবাসা। তার বক্ষেই যেন খুঁজছে কিশোরী সুখ।

——————————————–

অনেকদিন পর নিজ কক্ষে এসে নিজস্ব ঘ্রাণ নিলো শাদবিন শাহীর! বদ্ধ কক্ষে তারই আতরের ঘ্রাণ বিদ্যমান। কেউ বলবে না এই কক্ষ গত দশদিনের জন্য বদ্ধ ছিলো। হয়তো জমিদার আসার পূর্বেই তার আলিশান কামরাকে দাসীরা পরিষ্কার-পরিছন্ন করে ফেলেছে। শাদবিন শয্যায় গা এলিয়ে দিলো। কক্ষে আসার পূর্বেই দাসীদের আদেশ দিয়েছে হাম্মামখানা প্রস্তুত করার জন্যে। আজ পদ্মদিঘির প্বার্শে স্নান সারতে আগ্রহী যুবক। তাই তাদের সবচেয়ে আকর্ষিত হাম্মামখানা তার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। সেই হাম্মামখানার সৌন্দর্য কম নয়। স্নান করতে করতে পদ্মদিঘির মনোরম দৃশ্য এবং খুশবু দুটোই মন-প্রাণ সতেজ করে তুলে। এ যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক। যুবকের ধ্যানে ফোড়ন কাটে দাসীর কন্ঠস্বর। চোখ মেলে উঠে বসে শাদবিন।

–“আসসালামু আলাইকুম, হুজুর। আপনার হাম্মামখানা প্রস্তুত।”

শাদবিন মাথা নাড়ায়। দাসী মাথা নিচু করে দু’কদম পিছিয়ে চলে যায়। শাদবিন গোসল করার মাঝেই শুনতে পেলো বাহিরে চেঁচামেচি হচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে নিরব হয়ে গেলো সব।

–“হুজুর! এক মহিলা বারংবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। কী করি বলুন তো?” প্রহরীর মুখশ্রীতে বিরক্তির ভাব। আহার সেরে সবে বসেছে শাদবিন। প্রহরীর অভিযোগ কর্ণগোচর হতেই জল পান করে ভৃত্য জাহিদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।

ভৃত্য জাহিদ বুঝলো মনিবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলো জাহিদ। অতঃপর শাদবিনের উদ্দেশ্যে বললো,

–“মহিলা আপনার প্রিয় মানুষটির মামীজান। আপনার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছুক।”

–“এখন তিনি কোথায় অবস্থান করছেন?”

–“জ্বী, পদ্মদিঘির বৈঠকঘরে।”

————————————-

–“আসসালামু আলাইকুম, হুজুর!”

যুবক উত্তর দেয় না। সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো আয়েশার পানে। আয়েশার মুখশ্রী কাপড়ে আবৃত। উত্তর না পেয়ে আয়েশা আবারও বলতে লাগলো,

–“আপনার সময় নষ্টের জন্যে মার্জনা করবেন হুজুর। আমি একপ্রকার বাধ্য হইয়াই আপনার স্বরণাপর্ণ হইসি।”

–“মূল কথায় আসুন।”

আয়েশা একে একে সবটা খুলে বললো জমিদারকে। সবটা শুনে শাদবিনের ক্রোধ এবং উগ্র ভাব বেড়ে গেলো। যুবকের আঁখিযুগল দ্বারা যেন অগ্নির গোলা উতলে পরছে। নিজের ক্রোধকে নিঃশব্দে সংবরণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যুবক। আয়েশা একসময় কেঁদেই দিলো,

–“আপনি কিছু একটা করেন হুজুর। নয়তো আমি আমার মাইয়ারে অকালে হারামু।”

আয়েশার আকুতি যুবকের কর্ণগোচর হলেও সে প্রতিউত্তর দিলো না। সে তখনো নিরবে হাঁসফাঁস করতে ব্যস্ত। অনেক কষ্টে এইটুকুই মুখে বললো,

–“নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি সব সামলে নিবো। এখন আসতে পারেন!”

বলেই নিজের উৎকন্ঠা চেপে উঠে দাঁড়ায় যুবক। আয়েশা শাদবিনকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করতে বেরিয়ে গেলো। এবার সকল বজ্রপাত গিয়ে পরলো ভৃত্য জাহিদের উপর। অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো যুবক, ভৃত্যের দিকে। শাদবিনের এই ধ্বংসাত্মক চাহনিতে জাহিদের গলা শুকিয়ে এলো। এবার হয়তো এখানেই মনিব তার গলা টিপে দিবে। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে ব্যস্ত হয়ে পরলো ভৃত্য জাহিদ। গলা টিপে না দিলেও শাদবিনের বাজখাই গলায় উপস্থিত সকলেই কেঁপে উঠলো,

–“আহাম্মক! এখানে এতকিছু ঘটে গেছে কেউ আমায় জানানোর প্রয়োজনবোধ করো নি? এতো দুঃসাহস তোমাদের আমার কথা অমান্য করেছো! আমি এ সব কিছুর কৈফিয়ত চাই। কী হলো? জবানে কী কোনো শব্দ নেই?”

ভৃত্য কাঁপা গলায় বললো,
–“আমি কী করে বলবো হুজুর? আমি যে আপনার সঙ্গেই শহরে ছিলাম!”

–“আর বাকিরা? তারা কী আমার অনুপস্থিতিতে মশা মারছিলো? সবকটা শাস্তি পাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হও! বোকার দল!”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো শাদবিন শাহীর। মেজাজ তার ভিষণ খারাপ। এতকিছু ঘটে গেলো, কিছুই টের পায় না সে? তার চেয়েও বড় কথা, তার এবং রাত্রির নামে গুজব ছড়ানো হয়েছে যার পুরোটাই ভিত্তিহীন। আচ্ছা, এই গুজবকে তার ভ্রমরাণী বিশ্বাস করে নেয়নি তো? শাদবিন কিছুক্ষণের জন্যে থমকে গেলো। পরমুহূর্তে সকল ঘটনা মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতেই মুখ ঘুচে এলো ক্রোধে। শাদবিন এক চিৎকার দিয়ে পাশের দেয়ালে সজোরে ঘুষি দেয়। কিছুতেই পারছে না নিজের ক্রোধকে সংবরণ করতে। এই ক্রোধের দহন নেভার নয়। ক্রোধ ব্যতীতও হৃদয়ে বড় আঘাত করে তার ভ্রমরাণী। রক্তাক্ত হস্ত মুঠিবদ্ধ করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,

–“সবকিছুর জন্যে কঠিন কিছু অপেক্ষা করছে তোমার জন্য ভ্রমরাণী। আমায় বারংবার ক্ষত-বিক্ষত করেছো তুমি! এবার চিনবে এই ধ্বংসাত্মক শাদবিনকে। অন্য পুরুষের সামনে নিজের মুখশ্রী দেখিয়েছো, আমায় অবজ্ঞা করেছো, এই শাদবিন শাহীরকে। আমি শাদবিন শাহীর, ধরনীর বুকে আমার একমাত্র ভালোবাসাকে নিজ হস্তে শাস্তি দেবো। অপেক্ষা করো, তোমার ধ্বংসাত্মক প্রহরের।”

———————————-

সারাদিন, জাগ্রত অবস্থায় পুরোটা সময় যার মুখে পান থাকে, সে হচ্ছে কুলসুম! বেগম আকলিমার একমাত্র পরামর্শদাত্রী। মহিলার ভালো বুদ্ধি কম কূটনীতিতে সে আকাশ ছোঁয়া। এজন্য বেগম আকলিমা খুব একটা ডাকেন না এই মহিলাকে। চাইলে তিনি তাকে বরখাস্তও করতে পারেন। কিন্তু সমস্যা এক জায়গায় বাঁধিয়ে রেখেছেন কুলসুম। বেগম আকলিমা যখনই ক্রোধের সঙ্গে বলে, তাকে এই চাকরি হতে বরখাস্ত করবে ঠিক তখনই মহিলা তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কারবারি দর্শন করায়। অতীতে বেগম আকলিমার এক লজ্জাজনক ঘটনা মহিলার জানা আছে। সেটা লোকজনদের মাঝে আসলে বেগম আকলিমা মুখ লুকানোর জায়গা পাবে না। সেই লজ্জাজনক ঘটনা তুললেই বেগম আকলিমা চুপ৷ তবে ভালো বুদ্ধি ছাড়াও কূটনৈতিক বুদ্ধিগুলো বেগম আকলিমার বড্ড মনে ধরে। তাইতো সে এবারও মন কাড়া বুদ্ধি পেলো কুলসুমের নিকট। কুলসুম পান চিবুতে চিবুতে বললো,

–“বুজ্জেন বেগম! জমিদাররে এখন কিছু কইবেন না। তারে আরও ব্যস্ত রাখেন, কাজে-কর্মে। কিছুদিনের মধ্যে আবারও শাহাজাদীরে আনবেন। তাহলেই তো এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। ওই ফকির কিশোরী কন্যা আর কী করবে?”

–“আমার দুশ্চিন্তা কিশোরীকে নিয়ে নয়। আমার দুশ্চিন্তা শাদবিনকে ঘিরে। বড্ড জেদী, এখনো বুঝতে শিখলো না ওই কন্যার মাঝে জমিদারনি হওয়ার যোগ্যতা নেই! গুপ্তচরের মুখে শুনেছি কন্যাটির রূপ নেই, কেমন ভোলাভালা। আমাদের জমিদার বংশে এমন কোনো কন্যার জায়গা নেই। এরা আমাদের দাসীর যোগ্য, জমিদারনির নয়!”

–“বাহিক্য সৌন্দর্য দ্বারা কী অভ্যন্তরের যোগ্যতা বিচার করা যায়, দাদীজান?”

চোখ কপালে তুলে দ্বারের দিকে তাকালো বেগম আকলিমা। কুলসুমও ভীতিতে মুখের পান চিবুতে ভুলে গেছে। দুজনের কন্ঠস্বরেই যেন ঢালাই করা, কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।

~চলবে।

___লাবিবা ওয়াহিদ___

গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here