#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
১১+১২.
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
[সেরা কমেন্টকারীদের নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করা হবে। গ্রুপের লিংক গল্পের শেষে দেয়া হলো!]
দ্বিতীয়বারের মতো পূর্ব এলো তার কাবিনের দিন। সেদিন পূর্বের সঙ্গে তার মাতাও এসেছেন। গতদিনের ঘটনা শ্রবণ হতেই ভদ্রমহিলা বেশ চটে গেছিলেন। তাই আজ যেন কোনোরূপ সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয় সেজন্য নিজে উপস্থিত হলেন। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈঠকঘরে প্রবেশ করতেই তাদের চোখ কপালে উঠে গেলো। স্বয়ং জমিদার নবাব শাদবিন শাহীর বসে আছে। চোখ-মুখে গাম্ভীর্য এঁটে আছে। জমিদারের দর্শন পেতেই পূর্বসহ তার পিতা-মাতা সৌজন্যমূলক হেসে সালাম জানালো। শাদবিন মুখে সালামের উত্তর না নিলেও গম্ভীরমুখে মাথা ঝাকালো।
ফিরোজ বা শবনাম কেউ-ই বুঝে উঠতে পারছেন না জমিদারের আসার কারণ। শবনাম যুবককে দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না ইনি-ই তার কন্যার ভালোবাসা। শবনাম এক মনে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। অতিথিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাদবিন বিনয়ের স্বরে বললো,
–“কী হলো, দাঁড়িয়ে কেন আপনারা? বসুন!”
যুবক নিজের বিপরীতে বসার আহবান জানালেন। অতিথিগণ সেই আহবানে নিরবে বসলেন। কাজী এবং ইমাম বসে আছে শাদবিনের বাম পাশের দুটি আসনে। ফিরোজ অধৈর্য হয়ে বললেন,
–“ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন হুজুর, তবে এই গরিবের ঘরে আপনার আগমনের সঠিক কারণ জানতে চাচ্ছি! আমাদের দ্বারা কী আপনি কোনো ভাবে ব্যথিত জনাব?” মোলায়েম স্বরে বললো ফিরোজ। শুদ্ধ ভাষা তার খুব একটা আয়ত্ত্বে নেই। তাই কিছুটা আটকে আটকে আসছিলো তার কথা৷ বোনের নিকট হতে টুকটাক শিখেছে আর কী, খুব একটা পাকাপোক্ত নয়!
–“হয়েছি দেখেই তো উপস্থিত হয়েছি ফিরোজ সাহেব! তাই তো আসলাম, নিজের জন্য ন্যায়বিচার পেতে। তার আগে আপনাদের বিবাহকার্য শুরু করুন, আমি দেখি!”
কাজী অনুমতি পেতেই বলতে শুরু করলেন। কিন্তু পূর্বের নামের পর সেহনাতের নাম উচ্চারণ করতেই শাদবিন বাঁধা প্রদান করে। এতে উপস্থিত সকলেই চমকে ওঠে, ভৃত্য জাহিদ ব্যতীত।
–“সেহনাত নয় কাজী সাহেব। মোহিনী লিখুন!”
সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় পূর্ব। আক্রোশ যেন উপচে পরছে তার। শাদবিন শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পূর্বের নিকট। পূর্বের পিতা আমতা আমতা করে বললো,
–“ইয়ে মানে, জমিদার সাহেব। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। বিয়েটা তো সেহ…”
–“আমি যা বলেছি ঠিক বলেছি। যথার্থ প্রমাণ ব্যতীত আমি কিছু বলি না, ভুল হওয়া তো দূরে থাক। বিয়ে মোহিনীর সঙ্গেই আপনার পুত্রের হবে। এক বিবাহের জন্যে তো আমি এক মেয়ের জীবন ধ্বংস করতে পারি না?”
–“ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন জনাব! একটা কথা না বললেই নয়, ওই কন্যার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাই আপনি আমায় বাধ্য করার কোনো অধিকার রাখেন না!”
পূর্ব আরও কিছু বলার পূর্বেই পিতা তাকে ধরে বসিয়ে দিলো এবং মিনমিন করে বললো,
–“আল্লাহ্’র দোহাই লাগে, চুপ কর বাপ!”
–“বাহ, আপনার ছেলের প্রসংশা করতে হয়, জমিদার নবাব শাদবিন শাহীরের চোখে চোখ রেখে তেজী বুলি ফুটাচ্ছে। সত্যি-ই প্রসংশার যোগ্য! তা লুৎফর সাহেব, আপনার পুত্রকে জানাননি আমার ক্রোধ সম্পর্কে?”
লুৎফর দমে গেলো। ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম বিদ্যমান। জমিদার বাড়ির-ই কর্মচারী এই লুৎফর। বেগম আকলিমা, জমিদার শাহরিয়ার দয়ায় আজ সে বিত্তশালী মানুষ হিসেবে দাপট দেখাতে পারেন। তার স্ত্রী তো কখনই দমে গেছেন। তার বড্ড ভীতিবোধ এই জমিদার বংশের প্রতি, সেখানে স্বয়ং জমিদার উপস্থিত।
শাদবিন সকলের দিকে নজর বুলিয়ে দাপটের সঙ্গে পায়ের উপর পা তুলে হেলান দিয়ে বসলো। অতঃপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো শবনামের দিকে। শাদবিন শাহীর অধর বাঁকিয়ে তার উদ্দেশ্যে বললো,
–“ঘুম থেকে জাগ্রত করেননি আপনার কন্যাকে?”
শবনাম থতমত খেয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শাদবিনের পানে। হতবিহ্বল হয়ে দ্রুত কক্ষের দিকে যেতে অগ্রসর হয়। শাদবিন এবার পা নামিয়ে বলে,
–“দেখুন, আমি সোজা হিসেবি মানুষ। আপনার ছেলে বাধ্য মোহিনীকে বিয়ে করতে আর সেহনাতের কথা যেন জবানে উচ্চারণও না করে। সে ইতিমধ্যে উপরওয়ালার তরফ থেকে আমার জন্য ধ্রুব। আংটিবদল হয়েছে আমার সঙ্গে, কিশোরীর। তাই তার আশা ছেড়ে দেয়া উত্তম বৈ কিছু নয়।”
শাদবিনের উক্তিতে উপস্থিত সকলে যেন আকাশ থেকে পরলো। পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো আয়েশা এবং মোহিনী উভয়ই সমানতালে স্তব্ধ। মোহিনী হতবিহ্বল হয়ে বলে,
–“এজন্যই জমিদারের সেহনাতের জন্যে এতো দরদ উতলায় আম্মা। বিষয়খানা ধরতে পারসো?”
আয়েশা নিরুত্তর, কিংকর্তব্যবিমুঢ়! পূর্ব উঠে দাঁড়ায় আবারও। অতঃপর জমিদারের নিকট প্রশ্ন ছুঁড়লো, “প্রমাণ কী?”
শাদবিন হাসলো। তখনই উপস্থিত হলো কিশোরী সেহনাত এবং শবনাম। শাদবিন নির্বিকার হয়ে প্রেয়সীর পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কিশোরী তখনো ঘুমে ঢুলুঢুলু। সারারাত ঘুম হয়নি তার বিয়ের চিন্তায়। কিশোরী চোখ কচলাচ্ছে নিজের মতো। এখনো খেয়াল হয়নি তার প্রেমিক পুরুষকে। যখন চোখ খুলে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখলো তখনই তার সর্বাঙ্গ শিরশির করে উঠলো। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রয় সেই প্রাণ পুরুষটির নিকট। শাদবিন বেশিক্ষণ তাকালো না, সরিয়ে ফেললো নিজ দৃষ্টি। কিন্তু কিশোরী তখনো অপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো। কতো সুদর্শন লাগছে তার শাহীর বাবুকে। দিনদিন যেন সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তার প্রেমিক পুরুষের। কিশোরী মস্তিষ্কশূণ্য হয়ে তাকিয়ে রইলো। আশেপাশে কারো উপস্থিতি অথবা কারো কথার ঝংকার শ্রবণ হচ্ছে না। তার শ্রবণ, দৃষ্টি দুটোই যে শাহীর বাবু কেড়ে নিয়েছে, নিবিড়ভাবে।
শাদবিন অধর জোড়া বাঁকিয়ে বললো,
–“প্রমাণ? দাঁড়াও শ্রবণে নয়, স্ব-চক্ষে দেখাচ্ছি!”
বলেই শবনামের পাশ থেকে কিশোরীকে টেনে নিজের সামনে নিয়ে এলো। শবনাম আটকাতে চাইলে পেছন থেকে ভৃত্য জাহিদ এসে পথ আটকে দেয়। এত মানুষের সামনে শবনাম চেঁচালো না। নিজেকে সংগত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালালো। শাদবিন নিজের পাঞ্জাবির পকেট হতে এক ছোট কাপড়ের বাক্স বের করে সেটা থেকে আংটি হাতে নিলো। সেটা নিয়ে বিনা সময় ব্যয়ে দ্রুত কিশোরীর বা হাতের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিলো। এতে কিশোরী হতবিহ্বল, বিমূঢ় হয়ে গেলো। চমকালোও দারুণভাবে। তার বিমূঢ়তা এতোই প্রগাঢ় যে শাদবিনকে কোনো কাজে বাঁধা দিতে পারেনি। মস্তিষ্ক তার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। শাদবিন স্ব-যত্নে রমনীর হাত ছেড়ে দিয়ে সেহনাতকে ভেতরে চলে যেতে বলে। ভৃত্য জাহিদ শবনামের পথ হতে সরে দাঁড়ায়। শবনাম দ্রুত এই কোলাহল হতে মেয়েকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়।
চলার পথে এত বড় ঘটনা মানতে না পেরে কিশোরী মায়ের বুকে ঢলে পরে। শবনাম হন্তদন্ত হলেও নিরব থাকলো। এমন ঘটনার জন্যে সে নিজেও যে প্রস্তুত ছিলো এমনটা নয়। শবনামের আঁখিযুগল অশ্রুসিক্ত। যেই আতঙ্ক হতে কন্যাকে দূরে রাখতে চেয়েছিলো সেই আতঙ্ক তার মেয়ের জীবনে ইতিমধ্যে জড়িয়ে গিয়েছে। এখন চাইলেও শবনাম জবানে কিছু বলতে পারবে না। যতোই হোক, শাদবিন একজন জমিদার আর শবনাম সেই জমিদারের প্রজা। চেয়েও পারবে না কন্ঠ বড় করে প্রতিবাদ জানাতে। শবনাম রয়েসয়ে মেয়েকে নিয়ে কক্ষের অভ্যন্তরে চলে গেলো।
ভেঙ্গে গেলো সেহনাত এবং পূর্বের বিয়ে। পূর্ব শাদবিনের নিকট মাফ চাইলো নিজের ব্যবহারের জন্যে৷ শাদবিন উপরে উপরে ক্ষমা করে দিলেও অন্তঃপুরে যুবকের জন্যে কঠিন সাজা এঁকে নিলো। যুবক ক্ষমা চেয়ে অনুরোধের স্বরে শুধায়,
–“বিয়ে ভাঙ্গার পর দ্বিতীয় বার কাউকে বিয়ের জন্য আমায় বলবেন না, জনাব। আমার সিদ্ধান্তে নিজস্ব স্বাধীনতা চাইছি!”
শাদবিন ভাবলো কিছু মুহুর্ত। অতঃপর অধর প্রসারিত করে বলে,
–“বেশ! তোমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অবশ্যই আছে।”
পূর্ব আর কথা বাড়ায় না। জমিদারকে সালাম জানিয়ে বৈঠকঘর ত্যাগ করলো। সকলেই চলে যায়। যাওয়ার পূর্বে লুৎফর সাহেব বেশ অনেকবার ক্ষমা চাইলেন পুত্রের হয়ে। সে জ্ঞাত, জমিদার মুখে ক্ষমা করেছে বললেও মনে পুষেছে নিরন্তর রাগ। শাদবিন শাহীর নেত্রে রক্তিম ভাব এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“এতো সাহসও ভালো নয়, লুৎফর সাহেব। ভাগ্যিস আপনাকে শ্রদ্ধা করি, নয়তো আপনার পুত্র আমার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে কথা বলার মূল্য বুঝতো। সময় থাকতে শুধান নিজের পুত্রকে। আর হ্যাঁ, তাকে যেন কোনোদিন আমার ত্রিসীমানায় না দেখি! আসতে পারেন!”
লুৎফর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। অতঃপর আরেকবার মার্জনা চেয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। শাদবিনের মুখমন্ডলে তখনো গাম্ভীর্য ভাব। আয়েশা স্তব্ধ হয়ে পাশে তাকাতেই চমকে উঠলো। মোহিনী কোথায়? মোহিনীকে খুঁজতে মোহিনীর কক্ষ অতিক্রম করার সময়েই ভেতর থেকে গুনগুন শব্দ শুনতে পান আয়েশা। থমকে দাঁড়ান তিনি। কৌতুহলবশত ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলো মোহিনী গুনগুনিয়ে গান করছে আর শুয়ে শুয়ে চরণ নাচাচ্ছে। কারো উপস্থিতি টের পেতেই মোহিনী দ্বারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মাকে দেখে স্মিত হাসে মোহিনী।
–“আমি তোরে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াই আর তুই এইহানে গান গাস?”
–“কী করবো কও তো মা? আমি যতবার সেহনাতকে চরণ ধরে নিচে নামাতে চাই ততোই ও উপরে উঠে যায়! চিন্তা করতে পারতাসো? জমিদারের সাথে ওর আংটি বদল হইসে?”
–“তাই বইলা তুইও তো তোর জিনিসরে হারাইলি!”
–“ওহ আম্মা! পূর্ব যেইহানেই যাক না ক্যান, আমার আঁচলেই ধরা দিবো ওয়। ছোট শিকারী হইয়া তো বাঘের শিকার করতে পারি না, তাই হরিণ অর্থাৎ পূর্বরেই শিকার করলাম!”
আয়েশা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলেন। এবার তার ধারণা সঠিক, তার এই মেয়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত। নাহ এর সাথে আলাপ করে মানসিক রোগীতে পরিণত হওয়ার সখ নেই।
—————————–
পিটপিট করে তাকাতেই নিজ শয্যায় আবিষ্কার করলো কিশোরী। চট করে উঠে বসলো সে। জানালা ভেদ করে বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো কিশোরী। রোদের তেজ বেড়েছে, তার মানে বেলা গড়িয়ে দ্বিপ্রহর হয়েছে। পরমুহূর্তে মাথায় এলো সকালের ঘটনা। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে সে বাম হাত আঁখিযুগলের সামনে ধরে। নাহ মিথ্যে নয়, সত্যি-ই তার শাহীর বাবু এসেছিলো এবং তাকে এই মূল্যবান রত্নের আংটিও পরিয়ে দিয়েছেন। কিশোরীর বক্ষে প্রশান্তির হাওয়া দোলা দিলো। স্বপ্নের সাগরে ভাসমান কিশোরী, অফুরন্ত সুখ তার হৃদ বাগানে প্রজাপতি হয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে।
উঠে দাঁড়ায় কিশোরী। ইতিমধ্যে যোহরের আযান দিচ্ছে। প্রফুল্ল মনে মাথায় কাপড় দিয়ে প্রয়োজনীয় জামা এবং গামছা নিয়ে চলে গেলো হাম্মামখানায়। এই সুখ তাকে ভুলিয়ে দিলো অতীতের সকল দুঃখ এবং শাহীর বাবুর বিরহ। যোহরের ওয়াক্ত শেষ করে কতবার যে নিজ হস্তের আংটিটির দিকে নজর বুলিয়েছে হিসেব করা দুষ্কর। শবনাম আজ নিশ্চুপ হয়ে মসলিন বুনছে। তার মুখে হাসি নেই, ভর করেছে দাম্ভীকতা। কিশোরীও ভয়ে মায়ের ধার ধারেনি। দূর হতে যা যা প্রয়োজন তা জিজ্ঞেস করেছে এবং প্রশ্ন করেছে, শুধু এটুকুই। ফিরোজ গিয়েছে চাষের জমিতে। প্রতিদিন ভোর ভোর গেলেও আজ দেরী হয়। হয়তো অপরাহ্নেই ফিরবে।
কিশোরী বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিলো, তাই মস্তকে ভালো ভাবে কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে পরলো। কিশোরী ভেবেছিলো বাহিরে গেলে তাকে নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু তার ভাবনা বিফলে যায়, কেউ-ই তাকে আহামরি প্রশ্ন করে না। প্রতিদিনের মতোই সকলের ব্যবহার স্বাভাবিক। এর মানে কী এই আংটিবদল গোপনে সম্পন্ন হয়েছে?
শাদবিন সকলকে বিদায় দেয়ার পূর্বেই অবগত করে দেয় যেন এসব বাহিরের মানুষদের কানে না পৌঁছায়! কেউ ভুল করে বললেও তার জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করবে। এই ভুল শাদবিনের জন্যে বড় ধরণের অপরাধ, যার কোনো ক্ষমা তার নিকট নেই। সেই কারণেই মূলত বাহিরের কেউ এ বিষয়ে অবগত হয়। তবে কিশোরীর ভালোই লাগছে, স্বাধীনভাবে চলতে, মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলতে। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে যেন এক বক্ষ প্রশান্তিও নিজের মধ্যে গ্রহণ করে নিচ্ছে কিশোরী। এই সুন্দর স্বর্ণালি অপরাহ্নে শাহীর বাবুকে পাশে পেলে মন্দ হতো না। কিশোরী হাঁটতে হাঁটতে শাদবিনের দালান বাড়ির অতি নিকটে চলে আসলো। এদিকটা একটু বেশি-ই সুন্দর।
হঠাৎ কোথা থেকে এক ধারালো তীর দ্রুত গতিতে কিশোরীর পেছন থেকে আসতে লাগলো। কিশোরীর গায়ে লাগার পূর্বেই কেউ হেঁচকা টানে কিশোরীকে সরিয়ে দেয় এবং কিশোরী প্রাণে বেঁচে যায়। কিশোরী ভড়কালো, বিষ্ময়ে মুখ ঘুচালো। আগন্তুক অভ্যস্ত হাতে তীরটি অবলীলায় ধরে ফেললো। কিশোরী তটস্থ হয়ে মাথা উঁচু করে আগন্তুকটির দিকে তাকালো। শাদবিন শাহীর দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে। শাদবিনের ললাটে কয়েকটি সূক্ষ্ম ভাঁজ দৃশ্যমান। আঁখিযুগল অত্যন্ত রক্তিম। নিঃশ্বাসের শব্দ শ্রবণে আসছে অবলীলায়। কিশোরীকে ছেড়ে শাদবিন তীরের দিকে সূক্ষ্ম নজর বুলালো। পরিচিত গন্ধ পেলো এই তীর হতে। তীরকে পরীক্ষা করে বুঝলো এই তীর ভয়ানক। এখনো তীরের চোখাটা চিকচিক করছে।
ভৃত্য জাহিদ ছুটে আসলো। সে আসতেই কন্ঠে ঝংকার তুললো শাদবিন। সেই ঝংকারে কিশোরী এবং জাহিদ উভয়ই কেঁপে উঠলো,
–“আমারই পরিবারের একজন আমার শত্রু। এই তীর আমাদের অস্ত্রশালার জাহিদ! আর বাহিরের কেউ আমাদের অস্ত্রশালার অস্ত্র তখনই পাবে যখন আমাদের পরিবারের কেউ তাকে সাহায্য করবে। বুঝলে জাহিদ, আমায় মমতা দিয়ে আবার আমার পিঠেই ছুঁরি বসাচ্ছে সেই চিরচেনা মানুষ। ”
শেষোক্ত বাক্যটি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে শাদবিন শাহীর। অতঃপর আবারও বলে ওঠে,
–“প্রহরীরা, দ্রুত জঙ্গলের ভেতরে ছুটে যাও! আমার বিশ্বাস ওই পিশাচটা এখনো জঙ্গল অতিক্রম করতে পারেনি! দ্রুত!”
প্রহরীরা সম্মতি জানিয়ে সেদিকে ছুটলো। তীরটা অদূর জঙ্গল হতেই ছুঁড়া হয়েছে। জাহিদ তীরটা নিয়ে কোথাও চলে গেলো। কিশোরী তখনো অবুঝ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো শাদবিনের পানে। ঘটনা এখনো সে বুঝে উঠতে পারেনি। যুবক এবার কিশোরীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এই ক্রোধমিশ্রিত চাহনিতে কিশোরীর আত্মা কেঁপে ওঠে। আগে কখনো এরূপ দৃষ্টির মুখোমুখি রমনী হয়নি। কেঁপে কেঁপে কিশোরী কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই শাদবিন তার অতি নিকটে চলে গেলো। ভড়কালো কিশোরী। আতঙ্কে ছুটে সরে আসতে নিতেই শক্ত করে ডান হস্তের কব্জি ধরে আটকায় যুবক। অতঃপর অত্যন্ত কঠিন কন্ঠে বলে ওঠে,
–“তোমার করা অন্যায়ের কঠিনতম শাস্তি তুমি পাবে শাহাজাদী! তৈরি হও নিজের ধ্বংসাত্মক সময়ের। খুব সখ না, অন্যকারো সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার? সেই সখ দ্রুত বর্জন করো, এই সখ তোমার জন্য পাপ। ভেবো না তোমার দেয়া ক্ষতের দাগ অতি দ্রুত মিটবে!”
বলেই ছিটকে দূরে সরিয়ে দেয় যুবক। কিশোরী পরতে পরতে নিজেকে সামলে নেয়। বিমূর্ঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় এই প্রেমিক পুরুষের নিকট। তড়তড় করে স্মরণে এলো শাদবিন এবং শাহাজাদী রাত্রীর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি। নেতিয়ে পরে কিশোরী। কিশোরী চেয়েও কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো না, শাদবিনের বিরুদ্ধে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে যুবকের দিকে তাকিয়ে রয়।
————————–
শাদবিনের অনুপস্থিতিতে একপ্রকার হুট করেই জমিদার মহলে আগমন ঘটে শাহাজাদী রাত্রীর। শাহাজাদী মহলে নজর বুলিয়ে আপনমনে বলে উঠলো,
–“আপনার মোহে সিক্ত আমি শাদবিন সাহেব। তাই পারিনি বেশিদিন এই বিরহ সহ্য করতে। এবার কী পূর্ণাঙ্গ আপনি টাকে পাবো? ইতি ঘটবে কী, আমাদের এই দূরত্বের?”
এখন শাহাজাদী নিজ কক্ষে বিশ্রাম করছে। হয়তো অপেক্ষাও। তার এই অপেক্ষা শাদবিন শাহীরের, তার সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষা।
শাদবিন রাত্রীতে অন্দরমহলে আসলো এবং সোজা গিয়ে উপস্থিত হয় বেগম আকলিমার কক্ষে। বেগম আকলিমা তখন খাস দাসী নীতুকে দিয়ে পা টেপাচ্ছিলেন! শাদবিনের উপস্থিতি টের পেতেই চোখ মেলে তাকায় আকলিমা। প্রিয় পৈত্রকে ভয়ংকর রাগাম্বিত দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হন আকলিমা। দৃঢ় স্বরে বলে ওঠলো,
–“কী হলো আমার শের! এতোটা রাগাম্বিত? কোনো সমস্যা?”
–“সেটা তো আপনি ভালো বলতে পারবেন আমার শ্রাদ্ধেয় দাদীজান!”
পৈত্রের তেঁজী বুলিতে বিমূঢ় হলো বেগম আকলিমা। চোখে-মুখে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিমা এনে বললেন,
–“মানে?”
–“আপনি আমার ভ্রমরাণীকে কতল করতে লোক পাঠিয়েছেন? এমন নিকৃষ্ট কাজ আপনার নিকট হতে আশা করিনি দাদীজান!”
বেগম আকলিমা যেন আকাশ থেকে পরলো। খাস দাসী নীতুরও বিষ্ময়ে চোখজোড়া কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বেগম আকলিমা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে ওঠলো,
–“নাউজুবিল্লাহ, আমার শের! এসব কী বলছো তুমি? আমি কেন ওই কন্যাকে কতল করতে লোক পাঠাবো? এতোটাও নিকৃষ্ট নই আমি!”
–“আপনি-ই তো আমাদের আলাদা করতে এতো বড়ো ফন্দি আঁটলেন। এখন কতল করতে আপনার হাত কাঁপবে কেন? স্বার্থপর মানুষ’রা স্বার্থের জন্যে সব করতে পারে। আপনিও তাদের ব্যতিক্রম নন!”
–“থামবে তুমি শাদবিন! বললাম তো এসবের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই! স্বীকার করছি আমি তোমাদের আলাদা করতে চেয়েছিলাম, হয়তো ভবিষ্যৎ এও করবো। তাই বলে এতো বড়ো জুলুমকারী নই আমি৷ তোমার দাদীজানকে তুমি এখনো পুরোদমে চিনলে না পৈত্র?”
শেষোক্ত বাক্যটি রাশভারি কন্ঠে বললেন বেগম আকলিমা। শাদবিন দমে গেলো এবং নিবিড়ভাবে বেগম আকলিমাকে পর্যবেক্ষণ করলো। তার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধরা দেয় না কোনো অযুহাত, অভিনয়।
এর মানে কী দাদীজান সত্যি বলছেন? তার নিজেরও যে বিশ্বাস হয় না তার দাদীজান এমন কাজ করবেন। বেগম আকলিমা আর যাই হোক, অন্যের রক্তে নিজ হস্ত রঞ্জিত করেন না। হোক ছলে বা কৌশলে। তাহলে কে এতোটা নির্দয়, নিষ্ঠুর হলো? দাদীজান ব্যতীত কেউ-ই যে কিশোরীর সম্পর্কে অবগত নয়। শাদবিন দোটানায় পরে গেলো। কার দিকে ছুঁড়বে সন্দেহের তীর?
তখনই সেই প্রহরীরা আসলো। শাদবিনকে সালাম দিয়ে নিজ ভান্ডারে থাকা তথ্য ফাঁস করলো।
–“অপরাধীকে আমরা ধরার পূর্বেই হাত ফসকে পালিয়ে যায়। প্রায় অনেকক্ষণ ধরে সন্ধান করার পরেও অপরাধীকে আমরা পাকড়াও করতে পারিনি, হুঁজুর।”
শাদবিনের ধাঁধা আরও জটিল হয়ে যায়। ললাটে আঙুল ঘষে ভাবনায় মত্ত হয় যুবক। বেগম আকলিমা প্রহরীদের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললো। প্রহরীরাও নিঃশব্দে কক্ষ ত্যাগ করলো। শাদবিনও কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে গেলো। মিনমিন করে বললো,
–“তোমায় এই উম্মুক্ত ধরণীতে রাখা সম্ভব নয় ভ্রমরাণী! খুব শীঘ্রই আমার মহলে আমারই বক্ষে তোমায় নিয়ে আসবো। এই বক্ষের তুমিকে তখন কেউ ছুঁতে পারবে না, কতল তো দূরে থাক! আমি ব্যতীত কেউ তোমায় সুরক্ষা দিতে পারবে না কারণ, শাদবিন শাহীর এখন কাউকে বিশ্বাস করে না।”
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
লেখনীতেঃ লাবিবা ওয়াহিদ!
গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যই পারে পরবর্তী পর্ব লিখতে অনুপ্রেরণা দিতে।