পদ্মদিঘি পাঠ-১৩

#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
১৩.

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
জমিদার পুত্রের আংটিবদল তাও সাধারণ এক কিশোরীর সঙ্গে৷ এই কঠিন সত্য কতদিনই বা গ্রামবাসীর থেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব? সময়ের ব্যবধানে এই সংবাদ প্রায় সকলের কর্ণগোচর হয়ে যায়। আরও শ’খানেক মানুষের কানে পৌঁছানোর পূর্বেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় জমিদার নবাব শাদবিন শাহীর এবং কিশোরী সেহনাত আহিম! কিশোরী নির্বোধ, হতবুদ্ধিহীন! এতো দ্রুত বিবাহের কার্য সম্পাদন হবে কে জানতো?
শবনাম অদূরে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে। শীতল চোখে কন্যা এবং কন্যার বরকে দেখছেন। বক্ষের নিদারুণ তোলপাড় তাকে ভষ্ম করে দিচ্ছে। অতীতের স্মৃতি মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতেই নেত্রের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগলো।

–“আমার কন্যাকে সুখ দিন আল্লাহ। আমার মতোন হতভাগী যেন না হয়। আমার কন্যার উপর রহম করুন মাবুদ!”

বিবাহের কার্য সম্পাদন হতেই শাদবিন শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফিরোজ সাহেবের নিকট। জমিদারের কোমল চাহনিতে কিছুটা ঘাবড়ে যান ফিরোজ। জমিদার ফিরোজ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,

–“আমি এখুনই নিজ স্ত্রীকে নিয়ে মহলের দিকে রওনা হতে চাই। জাহিদ! মিষ্টান্ন এবং উপহারগুলো দিয়েছো?”

ভৃত্য জাহিদ মাথা নিচু করে জানায়, “জ্বী হুজুর!”

———————

দীর্ঘ রজনী। কিশোরী বঁধুরূপে ফুলে সজ্জিত শয্যায় বসে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই কয়েকজন দাসী তাকে বঁধুয়া সাজে সজ্জিত করে গেছে। সাজানোর সময় তাদের কী মশকরা, এই বাসররাত নিয়ে। কিশোরী লজ্জায়, জড়তায় গুটিশুটি মেরে গিয়েছে। বক্ষ তার তোলপাড় করছে জমিদার পুত্রের জন্যে। যেন এই তিনি এলেন। এসে তার চিবুক উঁচু করে বললো,

–“মাহশাল্লাহ, আমার ভ্রমরাণী! আমার কথা রেখেছি, তোমায় করেছি আমার বেগম!”

কল্পনা করতেই কিশোরী লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আজ তাকে লজ্জারাণী আবৃত করে রেখেছে। কিছুতেই যেন এই লজ্জা’রা তাকে ছাড়ছে না। হঠাৎ এক দাসী তার জন্য পানীয় আনলো। কিশোরী সেই পানীয়টি পান করতেই নেত্রপল্লবে তন্দ্রা ভর করলো। ধীরে ধীরে অপেক্ষারত কিশোরী তন্দ্রার অতলে তলিয়ে গেলেন। দ্বারের আড়াল হতে সবটাই লক্ষ্য করলো শাদবিন শাহীর। নিজের নিষিদ্ধ চিন্তা-চেতনা তাকে কিশোরীর নিকট তাড়না করলেও যুবক নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলো। শাস্তি দিতে চায় তার ভ্রমরাণীকে। শাদবিন হঠাৎ বলে ওঠলো,

–“আমার মহলে ফিরতে হবে জাহিদ!”

জাহিদ যেন আসমান হতে পরলো। চোখ বড়ো করে অস্ফুট স্বরে বললো,

–“এ আপনি কী বলছেন জনাব? বেগমের আপনাকে প্রয়োজন। আর এই স্থানও বিপদমুখী।”

–“নিশ্চিন্তে থাকো, আমি সব ব্যবস্থা করেই যাচ্ছি। আমার যে করেই হোক মহলে ফিরতে হবে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই জমিদার মহল অবধি পৌঁছে গেছে আমাদের বিবাহের সংবাদ। দেরী করো না, ঘোড়া তৈরি আছে চলো!”

বলেই সুদূরে দাঁড়ানো প্রহরীকে চোখের ইশারা দিলো। প্রহরী সঙ্গে সঙ্গে শিষ বাজিয়ে সকলকে সাবধান করে দেয়। শাদবিন আরেক পলক ঘুমন্ত কিশোরীকে দেখে দেহরক্ষী সমেত বেরিয়ে পরলো রহমতপুরের উদ্দেশ্যে। এই দালানটি নওপাড়ার। সন্ধ্যার বেশি সময় পার হয়ে যায় বিধায় শাদবিন চায়নি নদী পার হয়ে মহল পর্যন্ত কিশোরীকে নিয়ে যেতে। তাই আজকের রাতটা কিশোরীকে এখানেই রাখলো, সম্পূর্ণ সুরক্ষায়।

————–

অন্দরমহলে পিনপতন নীরবতা। সকলে এক জোট হয়ে বৈঠকঘরে অবস্থানরত। বেগম আকলিমা কপোলে হাত দিয়ে বসে। মালিহা এবং শর্মিলা তার নিকট হতে দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। ইসরাত আরেক আসনে বসে আছে। সকলের কাছেই বিবাহের সংবাদ এসেছে। বেগম আকলিমার চোখ-মুখ অত্যন্ত লাল। নেত্রজোড়া দিয়ে যেন আগুনের গোলা বের হচ্ছে তার। বেগম মালিহা আনমনা। পুত্রের এরূপ কর্ম কেন যেন বাকিদের মতোন মেনে নিতে পারছে না। ইসরাতের মুখশ্রী তখন অন্ধকারচ্ছন্ন। মোটকথা যুবক এমন কাজ করবে তা কারোর প্রত্যাশায় ছিলো না।

সকলের নিরবতার মাঝে শাদবিন উপস্থিত হলো। শাদবিনকে দেখে চমকে উঠে দাঁড়ায় বেগম শর্মিলা। তাকে হঠাৎ দাঁড়াতে দেখে বাকিটা সদর দরজায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। শাদবিন দাঁড়িয়ে তবে একা। সকলে কিছুটা অবাকই হলো। তার চেয়েও বিষ্ময়কর, যুবকের দৃষ্টিতে উদ্বিগ্নতার রেশমাত্র নেই। বেগম আকলিমা নিজের ক্রোধ বহিঃপ্রকাশ করলো বিকট ধমকে।

–“ছিঃ শাদবিন! তুমি জমিদার হয়ে আমাদের জমিদার বাড়ির মান এভাবে ডুবালে? কোনো আলোচনা, মতামত না নিয়েই এতো বড়ো ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে? এই তুমি জমিদারের দায়িত্ব পালন করো?”

–“বিয়ে করেছি, কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত তো হইনি দাদীজান। আমার জমিদারির দিকে আমার যথেষ্ট লক্ষ্য আছে। আমি করতাম না, আপনাদের অনুমতি ব্যতীত বিয়ে। কিন্তু জানেন কী, আমি নিজ গৃহেই শত্রু পালছি!”

বলেই সকলের দিকে দৃষ্টি ঘুরালো! বেগম আকলিমা আরও জোরে ধমক দিয়ে বললেন,

–“শাদবিন!”

একরোখা, নিজ সিদ্ধান্তে অটল শাদবিন শাহীরকে নাড়াতে সক্ষম হলেন না বেগম আকলিমা। যাকে বলে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে তার প্রিয় পৈত্র। বেগম আকলিমা নিজের ক্রোধ দমানোর প্রচেষ্টা চালালো। অতঃপর শান্ত কন্ঠে বলে ওঠলো,

–“বেশ! বিয়ে করেছো যখন তখন আমাদের কিছু করার নেই। তবে হ্যাঁ! আমি তোমার সম্মুখে বলছি, ওই কন্যাকে আমি নিজে কঠিন পরীক্ষায় ফেলবো। সে যদি যোগ্য জমিদারনি হয়ে দেখাতে পারে তাহলে সে স্বেচ্ছাধীন! আর যদি সে অক্ষম হয় তাহলে আমি তৎক্ষনাৎ আমার প্রিয় পাত্রী শাহাজাদী রাত্রীর সঙ্গে তোমায় বিয়ে দিবো। সিদ্ধান্ত এখন তোমার!”

বলেই বেগম আকলিমা চোখ রাঙানি দিয়ে খাঁস দাসী নিতুকে নিয়ে প্রস্থান করলেন। শাদবিন সেখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে। তার ধারণাই একশো ভাগ সঠিক হলো। তবে সেহনাতকে নিয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পরে যুবক। কিশোরী সরলতার সাগর। তাকে কীভাবে এই কঠিন লড়াই এ সামিল করবে? নাহ, হার মানলে চলবে না। যুবক শাদবিন কখনো হারতে শিখেনি। অভ্যন্তরের দুশ্চিন্তা সে বহিঃপ্রকাশ করলো না। যুবকের ধ্যান ভাঙে বেগম শর্মিলার বচনে। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাকীমার দিকে।

–“নতুন বউ কোথায়, শাদবিন? সাথে নিয়ে আসো নি?”

–“কাল আনবো। যেখানেই আছে, সুরক্ষিত আছে।”

বেগম শর্মিলা হাসলো। শাদবিন একবার মায়ের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সিঁড়িঘরের দিকে চলে গেলো। ভোরে আবার রওনা হবে তার ভ্রমরাণীকে আনতে। বৈঠকঘরে এতো ঘটনা ঘটে গেলো শাহাজাদী কাকপক্ষীতেও টের পেলো না। সে তখন তন্দ্রায় মত্ত।

ভোর হতেই শাদবিন বেরিয়ে গেলো নওপাড়ার উদ্দেশ্যে। শাহাজাদী রাত্রীরও ভোরের দিকে তন্দ্রা কেটে যায়। আজকের পরিবেশ খুবই সুন্দর। এই পরিবেশে শাদবিনকে পাশে পেলে মন্দ হতো না। ভাবতেই অধরের কোণে কিশোরীর হাসি ফুটে ওঠলো। নাহ অনেক অপেক্ষা করেছে সে। এবার তো হোক অপেক্ষার অবসান। ভাবতেই শাহাজাদী চিন্তা করতে লাগলো আজ কীভাবে যুবক শাদবিনকে চমকে দিবে। তখনই খাঁস দাসী রিপা তন্দ্রা কাটিয়ে শাহাজাদী রাত্রীর পেছনে দাঁড়ালো। দাসীর উপস্থিতি টের পেতেই শাহাজাদী রাত্রী স্মিত হেসে আদেশ করলো,

–“চন্দন এবং পদ্ম দ্বারা হাম্মামখানা প্রস্তুত করো রিপা! আজ সবচেয়ে আকর্ষণীয় সাজ চাই।”

————-

তন্দ্রা কাটতেই নিজের সম্মুখে এক অচেনা যুবতীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসে কিশোরী সেহনাত। সেহনাতকে বিচলিত দেখে যুবতী তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

–“উত্তেজিত হওয়ার কারণ নেই বেগম! আমি এখন হতে আপনার খাঁস বাদী/দাসী হিসেবে নিযুক্ত। হুকুম করুন বেগম!”

–“আপনি আমার বয়সে বড় হবেন হয়তো, আর…”

–“নাউজুবিল্লাহ, বেগম! এসব বলবেন না অনুগ্রহপূর্বক! আপনি বেগম এবং আমি দাসী, মালকিনের আদেশ পালন করাই আমার ধর্ম!”

কিশোরীর তখনই মনে পরলো শাদবিনের বলা কথাগুলো। শাদবিন পূর্বে তাকে শিক্ষা এবং ধারণা দিয়েছিলো জমিদার বাড়ির নিয়ম-নীতির বিষয়ে। কার সাথে কীরূপ আচরণ করতে হবে সেটা প্রতিদিনই তাকে শিখাতো। এবং এটাও বলতো,

“কাউকে কখনো নিজের কোমলতা দেখাবে না! তোমার কোমলতাই তোমাকে ধ্বংস করার বিরাট অস্ত্র!”

কিশোরীর মাও বিদায়ের পূর্বে বলেছিলো, নিজের মরিচিকা ধরা জ্ঞান-বুদ্ধি সতেজ করতে এবং আল্লাহ্ কে স্মরণ করে সামনে এগোতে। জমিদার বংশে সরু পথের চেয়ে কাঁটাযুক্ত পথই বেশি। সেটাকে অতিক্রম করতে কিশোরী বাধ্য। সেখানে তো কিশোরী নিজে জমিদারের বেগম। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় পরে গেলো সেহনাত। তখনই একজন দাসী এসে জানালো,

–“আসসালামু আলাইকুম বেগম! আপনার জন্য হাম্মামখানা প্রস্তুত করা হয়েছে। জমিদার হুজুরের আদেশে আহারও করতে হবে। জমিদার হুজুর খুব শীঘ্রই আসছেন!”

শেষোক্ত বাক্যে কিছুটা অবাক হলো কিশোরী। চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে তার শাহীর বাবুকে দেখতে পায় না সে। পরমুহূর্তে খাঁস বাঁদীকে প্রশ্ন করে উঠলো,

–“জমিদার সাহেব কোথায়?”

–“জ্বী, উনি জমিদার মহলে গিয়েছেন। আর বেগম, আমি রূপা! আপনি আমায় রূপা বলেই সম্বোধন করতে পারেন!”

কিশোরী প্রতিউত্তরে মাথা নাড়ায়। পরমুহূর্তে আনমনা হয়ে ভাবতে থাকে, “তাহলে কী শাহীর বাবু রাত্রীতে আমার নিকট আসেননি?”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here