#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
১৬+১৭.
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
মসলিনে আবৃত কিশোরী অবাক নয়নে বিপরীতের দর্পণে নিজেকে দেখছে। অনন্য সুন্দর লাগছে নিজেকে। হাতে বড় দু’টো বালা, এটা তার শ্বাশুড়ির তরফ থেকে পেয়েছে। নাকে কারুকার্য করা নথ! গলায় দারুণ কারুকার্যের শিতা হার! সজ্জায় তাকে পুরোই জমিদার বউ লাগছে। পাশ থেকে রূপা সেহনাতের মাথায় ঘোমটা তুলতে তুলতে অমায়িক হেসে বলে,
–“মাহশাল্লাহ, বেগম আমার! আপনাকে খুব দারুণ লাগছে!”
অধর প্রশস্ত করলো কিশোরী। কপোলে লাজুজ আভা ছেয়ে আছে। লাজুক হেসে বলে,
–“এই শ্যামবতীকে এরকম অপরূপ লাগবে আমারও জানা ছিলো না রূপা! সত্যি-ই আল্লাহ্’র সৃষ্টি সেরা!”
–“যাক! অবশেষে করলেন স্বীকার! তার বেগম, এই অলংকার এবং শাড়ি পরিধান করে কী আপনি হাঁটতে পারবেন?”
আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সেহনাত। মসলিন বা অলংকার, কোনটাই ভারি নয়। তবুও এসবের সাথে নতুন পরিচয় তার। মানিয়ে নিলে সমস্যা হবে না। সেহনাত মুচকি হেসে রূপার উদ্দেশ্যে বলে,
–“আমার কোনোরূপ সমস্যা হচ্ছে না রূপা! চলো, অন্দরমহল ঘুরে দেখি!”
–“জ্বী আমার বেগম!”
তাদের কক্ষ হতে বের হওয়ার মুহূর্তে-ই রত্না তাদের দ্বারে এসে হাজির হয়। পিটপিট নয়নে আপাদমস্তক নতুন বেগমকে দেখে নেয়। অতঃপর এক গাল হেসে বলে,
–“আসসালামু আলাইকুম, বুবু! আমি রত্না! শাহাজাদী ইসরাতের একমাত্র কন্যা!”
হাসে সেহনাত। যদিও শাহাজাদী ইসরাতকে চিনতে পারেনি। তাও নিজেকে ধাতস্থ করে সালামের উত্তর নিলো,
–“ওয়া আলাইকুম আসসালাম, রত্না! খুব ভালো লাগলো তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে!”
বারো বছরের কিশোরীর তখন খুশির অন্ত নেই। নতুন বউ এতো অমায়িক, সাধারণ ব্যবহার করবে তার সঙ্গে, কল্পনার বাহিরে ছিলো! রত্না খিলখিলিয়ে হেসে বলে,
–“তুমি জানো, তুমি তোমার জবানের মতোই মিষ্টি!”
প্রসন্ন হাসলো সেহনাত। অল্প সময়ের পরিচয়ে রত্নাকে ভিষণ আপন লাগলো তার। কথাবার্তায়ও বেশ ভুলা-ভালা মনে হচ্ছে। এরকম এক সঙ্গীর বড্ড প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলো সে। সেহনাত রত্নার উদ্দেশ্যে বললো,
–“আচ্ছা, রত্না! আমায় কী অন্দরমহল ঘুরে দেখাতে পারবে?”
–“নিশ্চয়ই বুবু! আমি অত্যন্ত খুশি হবো তোমায় এই অন্দরমহল চেনাতে পারলে!”
–“তাহলে চলো!”
একে একে সবটা ঘুরে দেখলো সেহনাত। মহলের প্রতিটি কোণায় কোণায় যেন সৌখিনতার ছোঁয়া! সব থেকে আকৃষ্ট করেছে পদ্মদিঘির অংশটা! প্রকৃতির সব সৌন্দর্য যেন এখানেই আপাদমস্তক ঢেলে দেয়া হয়েছে। পুরো দিঘি পদ্মতে ঠাসা! সেই সাথে পদ্মের নিজস্ব ঘ্রাণে চারপাশ মৌ মৌ করছে। লম্বা নিঃশ্বাস গ্রহণ করলো সেহনাত। নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিষণ্ণতা নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে গেলো। অদূর হতে কোকিলের মিষ্টি সুরের গান শ্রবণ হয় কিশোরীর। এছাড়া নিস্তব্ধতা, শব্দহীনতায় পদ্মদিঘি। কোনো বায়ু দূষণ নেই, কোলাহল নেই! নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই সেহনাতের চোখ আটকালো ডানদিকের ফুলে মোড়ানো বৈঠকঘরটি! মুহূর্তেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় কিশোরীর। মসলিন হালকা উঁচু করে সেখানেই ছুটে গেলো সে। পেছন হতে শ্রবণ হয় রূপার সাবধান বাণী।
–“আস্তে বেগম! শাড়ি জড়িয়ে পরে যাবেন!”
কর্ণকুহরে বাণীটি প্রবেশ করলেও মনোযোগ দেয় না কিশোরী। উচ্ছ্বাসে তার অধরে হাসি লেগেই আছে।এই অপরূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচিত হতে সক্ষম সে। প্রতিটা আসবাব পত্র, ফুলে আবৃত দোলনাটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে সেহনাত। কী দারুণ অনুভূতি। তার এই উচ্ছ্বাস সমাপ্ত হতেই দাসী এসে আহারের কথা জানালো। ধ্যান ভাঙ্গে কিশোরীর। কিশোরী মুখে কিছুটা কাঠিন্য এনে মাথা নাড়ায়। অতঃপর রূপার উদ্দেশ্যে বললো,
–“অবশেষে বেগম আকলিমা আমায় সকলের সঙ্গে আহারের অনুমতি প্রদান করলো!”
–“সে আর বলতে! তার নিকট কোনোরূপ উপায়ন্তর নেই যে!”
অধর প্রসারিত করলো সেহনাত। রূপার কথা বলার ভঙ্গি তাকে চরমরকম শান্তি দেয়। তার শাহীর বাবু বাঁদী হিসেবে রূপাকে চিনতে ভুল করেনি। অন্তস্থলে সহস্রবার ধন্যবাদ দিলো শাদবিনকে, এমন সঙ্গী দেয়ার জন্যে। রূপা নিতান্ত-ই বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ নারী। রত্না দাসীর সঙ্গেই প্রস্থান করেছিলো। শাদবিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ ভোরেই হয়েছিলো তার। এরপর আর প্রেমিক পুরুষটিকে দর্শন করেনি। কিশোরী জানে না কবে ভাঙবে শাদবিনের অভিমানের পাহাড়! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো কিশোরী। অতঃপর রূপার উদ্দেশ্যে বলে ওঠলো,
–“চলো রূপা, বিলম্ব হচ্ছে!”
পদ্মদিঘি ছেড়ে মহলের অভ্যন্তরে কিছুদূর আসতেই ভুলবশত কারো সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খায় কিশোরী। কিশোরী অসাবধান বশত পরে যাওয়ার পূর্বেই রূপা তাকে ধরে ফেললো। কিন্তু সামনের ব্যক্তিটির জন্যে কোনো সাধারণ ধাক্কা ছিলো না। সে একপ্রকার মেঝেতে পরে যায়। পা’তে ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো বৃদ্ধা। কোথা থেকে দাসী নীতু দৌড়ে আসলো “বেগম” বলে চিৎকার দিয়ে! কিশোরী বেসামাল দৃষ্টিতে সম্মুখে মেঝেতে পরে থাকা বেগম আকলিমার দিকে তাকালো। রূপা দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে। সেহনাতের চিনতে অসুবিধে হয় না বেগম আকলিমাকে। বেগম আকলিমা তৎক্ষনাৎ চিৎকার করে উঠলো,
–“কোন মূর্খ্য আমায় ধাক্কা দিশ?”
চোয়াল শক্ত আকলিমার। সম্মুখে দাঁড়ানো সেহনাতকে দেখে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়লো। আঁখিযুগল অত্যন্ত লাল! নীতুর সাহায্যে উঠে দাঁড়ায় বেগম আকলিমা। বেগমের এরূপ রূপ দেখে থমকে আছে সেহনাত। নিজে গিয়ে তাকে উঠে দাঁড়া করানো সাহায্য করতেও যেন ভুলে বসেছে। ধ্যান ফিরতেই সেহনাত দৃষ্টি নত করে সালাম দেয়। বেগম আকলিমা সালামের উত্তর না দিয়ে অত্যন্ত ত্রুদ্ধ গলায় বললো,
–“এতো স্পর্ধা তোমার কন্যা? তুমি আমায় ফেলেছো, এই বেগম আকলিমাকে? অন্দরমহলে বেখেয়ালি হয়ে ঘুরে বেড়াও, খেয়াল করো না তোমার সম্মুখে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তিকে নাকি জমিদারের স্ত্রী বলে নিজ মন যা বলবে তাই করে বেড়াবে? মনে রেখো, পুরো কাশিমপুরে আমার পৈত্রের রাজত্ব চললেও এই অন্দরমহলে আমার রাজত্ব!”
অপমানে রূপারও মাথা নিচু হয়ে গেলো। কী পরিমাণ কথা শোনাচ্ছে সেহনাত। সেহনাত তার মন্তব্য প্রকাশ করার সামান্য সুযোগটা অবধি পাচ্ছে না। একসময় আকলিমা থামলে সেহনাত অতি নম্র গলায় বলে,
–“ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম! আপনি যেমনটি ভাবছেন সেরকম কিছু নয়! এই মুহূর্তের জন্যে আমি নিজেও যে প্রস্তুত ছিলাম এমনটি নয়। দুজন, দুজনের পথে হুট করে চলে এসেছিলাম, আপনার পায়ে কী খুব বেশি লেগেছে বেগম? আমি পা মালিশ করে দিবো?”
বেশ অবাক হয় বেগম আকলিমা। তার ধারণা মোতাবেক সেহনাত সাধারণ কন্যা। তার বুলি এতোটা স্নিগ্ধ, শুদ্ধ তা অপ্রত্যাশিত ছিলো। নিজ চিত্তে ভেবে রেখেছিলো অশুদ্ধ ভাষা নিয়ে সেহনাতকে আরও দুটো কথা শুনাবে, কথার ঘাঁয়ে দুর্বল করবেন। কিন্তু তার পরিকল্পনা বৃথা। নিজের হেরে যাওয়া নিয়ে মেজাজ তার তুঙ্গে। ফোঁসফোঁস করে বলে,
–“দুর্ঘটনা ইচ্ছাকৃত নয়, তার প্রমাণ কী? তুমি কন্যা বড় শাস্তির প্রাপ্য! নীতু, আমায় হাঁটতে সাহায্য করো!”
নীতু ভাবলেশহীন হয়ে বেগমকে সাহায্য করতে লাগলো। সেহনাত ওখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে। রূপা সেহনাতের কর্ণধারে মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে বলে,
–“ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম তবে আমি তার একটুখানি ধাক্কায় পরে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারলাম না। আপনি পরেছেন বুঝলাম কিন্তু আপনার মতোন নরম শরীরের সাথে এক ভারি শরীর ধাক্কা খেয়ে কীভাবে পরতে পারে?”
–“চুপ করো রূপা! আমি দেখতে চাই তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। তবে তুমি এটা ধরে রাখো, আমায় বিপদে ফেলার ধাপসমূহর সূচনা ঘটবে। এখন আমার আল্লাহ্ আর আমার সবচেয়ে আপন মানুষটি সহায় হলেই শোকর!”
–“তার প্রসংশা করতেই হয় বেগম! সে না থাকলে আপনার হঠাৎ পরিবর্তন হওয়াটা সত্যি-ই দুষ্কর হতো!”
হাসলো না সেহনাত। থমথমে মুখে এগিয়ে গেলো আহারের কক্ষে। সেখানে যেতেই দেখলো বেগম শর্মিলা দাসীদের আদেশ করছে। আদেশ অনুসারে দাসীরা আহারের পাত্র একে একে সাজাতে ব্যস্ত। বেগম শর্মিলার নজর সেহনাতের উপর পরতেই বিনয়ী হাসলেন। অতঃপর সেহনাতকে কাছে ডেকে বলে,
–“আরে আমার কন্যা যে! মাহশাল্লাহ, কী সুন্দর লাগছে।”
উত্তরে লাজুক হাসে কিশোরী। অতঃপর চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে মিনমিন করে বলে,
–“শাহীর বাবু কী আহার করবেন না?”
শুনতে পেলেন যেন বেগম শর্মিলা। মুখ টিপে হেসে বলে,
–“শাদবিন এখন নিজ কক্ষে হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত। প্রভাতের আহার সে খুব ভোরে করত্র সাচ্ছন্দ্যবোধ করে!”
খানিক লজ্জা পেলো সেহনাত। ধীর কন্ঠে উত্তর দিলো, “ওহ!”
সেহনাত আজ নিজেও জানে না, তার ললাটের লিখন সম্পর্কে। ইতিমধ্যে সে বেগম আকলিমার সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, এখন আবার সকলের বসার পূর্বে সেহনাত চেয়ার টেনে বসেছে। এতে যেন বাকিদের বিস্ময়ের সীমা নেই। দাসী’রা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিতে তাকিয়ে! ঠিক তখনই আহার কক্ষে প্রবেশ করে বেগম আকলিমা। তার পূর্বে সেই কন্যাকে বসতে দেখে তার ক্রোধের সীমা অতিক্রম করে গেলো। বাজখাই গলায় হুংকার ছাড়লো বেগম আকলিমা। বেগম আকলিমার হুংকারে পুরো অন্দরমহল যেন কেঁপে উঠলো। কেঁপে উঠলো উপস্থিত প্রতিটি মানুষের হৃদয়ও। বেগম আকলিমা এবার সেহনাতকে সোজা কিছু বললো না। “শাদবিন” বলে কয়েকবার উচ্চস্বরে হাঁক ছাড়লো। সেহনাত আতঙ্কে কখনই উঠে দাঁড়িয়েছে।
দাদীজানের হঠাৎ এমন ডাক শুনে শাদবিন দ্রুত কক্ষ হতে বেরিয়ে আসে। একপ্রকার ছুটে বাম কাঁধের নীল শালটিতে এক হাত চেপে ধরে সিঁড়িঘরের দিকে ছুটলো। বৈঠকঘর পেরিয়ে যেতেই আহারের নির্দিষ্ট স্থানে জটলা দেখতে পেলো। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো শাদবিন। বেগম আকলিমার এরূপ ক্রোধ দেখে কিছু-ই ঠাওর করতে পারলো না। কিন্তু জনসম্মুখে সেহনাতকে দেখে কিছুটা চমকালো যুবক। এবার তার খটকা লাগলো। সে একপলক সহধর্মিনীর দিকে দিয়ে বেগম আকলিমার নিকট আসলো। অতঃপর শীতল গলায় বলে,
–“কী হয়েছে দাদীজান? এভাবে ডাকার কারণ?”
–“কারণটি তোমার নয়া সহধর্মিণী, আমার শের! এখন এটা জিজ্ঞেস করো না কী করেছে। জিজ্ঞেস করো কী করা বাদ রাখেনি এই বি’য়া’দ’ব কন্যা!”
–“বুঝতে পারিনি দাদীজান! বুঝিয়ে বলুন!”
পূর্বের ঘটনাসহ এখনকার দুঃসাহসিকতা সবটা খুলে বললো বেগম আকলিমা। সব জানানোর পর তড়তড় করে ঘাম ছুটলো তার মুখমন্ডলে। অত্যন্ত রাগাম্বিত সে। আবারো ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
–“কতটা বে’য়া’দ’প এবং অবাধ্য এই কন্যা! তুমি নিশ্চয়ই জানো শাদবিন আমি এই মুহূর্তে যে কোনো কঠিন শাস্তি তোমার সহধর্মিণীকে দিতে পারি?”
শাদবিন শান্ত, বিমূঢ়। চোখ-মুখে উত্তেজনা অথবা আতঙ্কের ছাপ নেই। শীতল চাহনিতে সেহনাতের করুণ মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে। দৃষ্টি আদান-প্রদান হয় মুহূর্তেই। কিশোরী নেতিবাচক মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ এরকম কিছুই না! এবার শাদবিন বেগম আকলিমার দিকে দৃষ্টি ঘুরালো। শাদবিন বেশ শীতল গলায় বলে ওঠে,
–“এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না, আসুন দাদীজান।”
বলেই বৈঠকঘরের দিকে হাত বাড়ালো। বেগম আকলিমা মুখে গাম্ভীর্য এনে বৈঠকঘরের দিকে অগ্রসর হয়। তার ঠিক পাশেই শাদবিন! শাদবিন সামনে নজর রেখে বলে,
–“আপনার কথা অনুযায়ী আপনি পরে গিয়ে আপনি আহত হয়েছেন। কিন্তু আপনি তো বেশ স্বাভাবিক হেঁটে চলেছেন, দাদীজান?”
থমকে দাঁড়ালো বেগম আকলিমা। রাগের বশবর্তী হয়ে চরণের কথা প্রায় ভুলে বসেছিলো। শাদবিনও বেগম শর্মিলা সম্মুখে দাঁড়ায়। বেগম আকলিমা দমলেন না, সে কথা ঘুরিয়ে তেঁজী কন্ঠে বললো,
–“ব্যথা গুরুতর ছিলো না। ভাগ্যিস নীতু তেল মালিশ করে দিয়েছিলো, তাই এখন কিছুটা ভালো লাগছে।”
শাদবিন সকল দাস-দাসীদের এখান হতে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললো। ভৃত্য জাহিদ তা বুঝতে পেরে সকলকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। এবার শাদবিন তার বক্ষে দু’হাত গুঁজে বলে ওঠলো,
–“আচ্ছা, তাও মেনে নিলাম। এখন আপনি বলুন তো, কী করে এক কিশোরী কন্যার সঙ্গে আপনি ধাক্কা খেয়ে পরে গেলেন? তার ওজন তো আপনার ওজনের চার ভাগের এক ভাগ! ভারী কে? আপনি নাকি সেহনাত? উত্তর দিবেন কী আমার দাদীজান?”
থতমত খেয়ে যায় বেগম আকলিমা। তার পরিকল্পনা ভালো ভাবেই ধরতে পেরেছে শাদবিন। কোথায় ভেবেছিলো আহত পা নিয়ে শাদবিনের মুখ বন্ধ করে দিবে তা না, হলো তার বিপরীত তাও নিজ কর্ম দোষে! বেগম আকলিমা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলেন শাদবিনকে। দূর হতে এতক্ষণ শাহাজাদী ইসরাত গুণগুনিয়ে বকেই যাচ্ছিলো কিশোরীকে। কিশোরীকে যখন বেগম আকলিমা কথা শোনাচ্ছিলো, তখন বারংবার সে বলছিলো,
–“ঠিক হয়েছে, একদিনেই দেমাগ বেড়েছে না তোর? এবার বুঝ, কতো ধানে কতো চাল! আমার আম্মি তোকে একদম গেলে দিবে। চার আনার মেয়ে! সখ খুব তার জমিদারনি হওয়ার। হাহ্!”
কিন্তু পরমুহূর্তে শাদবিনের প্রশ্নে তার মনে খটকা দিলো। শুধু ইসরাত নয় উপস্থিত সকলের মধ্যেই এই খটকা জম্ম নিয়েছে। বেগম আকলিমা গলা খাঁকারি দিলো। অতঃপর চাপা স্বরে বললো,
–“ঠিক আছে, সেটা নাহয় মানলাম। কিন্তু তোমার স্ত্রী আমার পূর্বে আসন পেতে বসেছে তার শাস্তি কী? সে আমায়, এই বেগম আকলিমাকে অসম্মান করেছে। তার শাস্তি কী? শেখাওনি এই কন্যাকে কোনোরকম আদব-কায়দা? নাকি আদব-কায়দা শিখতে এই কন্যার রুচিতে বাঁধে?”
এবার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো শাদবিনের। শাদবিন কোনো কথা না বলে দ্রুত সেহনাতের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর সেহনাতের ডান হস্তের কব্জি ধরে একপ্রকার টেনে সিঁড়িঘরের দিকে নিয়ে যায়। নির্বোধ, হতভম্ব কিশোরী টু-শব্দ করার সুযোগ অবধি পায় না! যাওয়ার পূর্বে জাহিদকে হুকুম করে দিয়ে যায়!
–“আজ বিকালের মধ্যে যেন মহা-পরিচালিকা আমার বেগমের কক্ষে উপস্থিত থাকে! আর ওর খাবার উপরে পৌঁছে দাও!”
—————————
–“আমার নবাব! বিশ্বাস করুন আমি দাদীমাকে মন হতে শ্রদ্ধা করি। তাকে আমি অবজ্ঞা করবো, এটা কী করে সম্ভব?”
যুবক নির্বিকার চাহনি নিক্ষেপ করে রয় ব্যাকুল, নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে। এই অবুঝ মেয়েটি যে এখনো অবগত নয়, তাই পরিবারের ভয়াবহতা। এই লড়াইয়ের শেষে হারলে যে তাদের জীবনে আসবে বিচ্ছেদ! চরম বিচ্ছেদ। যুবক চেয়েও চোখ সরাতে পারছে না তার ভ্রমরাণীর দিক হতে। কতটা আকর্ষণীয় লাগছে তার ভ্রমরাণীকে। কিন্তু বাস্তবতা দেখো, তাদের দুজনের মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল দিয়ে রেখেছে। চাইলেও সে পারছে না দেয়াল ভেঙ্গে তার প্রেয়সীকে আপন করে নিতে। যুবক প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে,
–“সবাইকে এতটাও কোমল ভেবো না, তোমার মতোন। মহা-পরিচালিকা আসবেন বিকালে। তার নিকট হতে নিয়ম-কানুন শিখে নিবে!”
–“মহা-পরিচালিকার কী প্রয়োজন পুত্র? তোমার এই মাকে চোখে পরে না?”
অপ্রস্তুত হয়ে পিছে ফিরে তাকায় যুবক। বেগম মালিহা খাবার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। পেছনে দাসীরাও রয়েছে। সেহনাত এবং শাদবিনকে একসাথে দেখে দু’এক জন মুখ টিপে হাসছে। তা দৃষ্টি এড়ায় না যুবকের। গলা পরীষ্কার করে সেহনাতকে কোনরকমে “আসছি” বলে তাদের পাশ কাটিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। বেগম মালিহা হাসলো পুত্রের এরূপ কাজে। কিশোরী প্রথমে বুঝলো না তাদের এতো হাসাহাসির কারণ। বোকার মতোন দৃষ্টি দিয়ে রয় সকলের দিকে। রূপা এর মাঝেই এসে দাঁড়ায় তার মালকিনের নিকট। এতক্ষণ সেহনাত এবং শাদবিন ব্যক্তিগত সময় পার করছিলো বিধায় বাহিরে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো তাকে। যুবক বেরিয়ে যেতেই আবারও রূপা এসে হাজির। বেগম মালিহা এবারও খাবার দাসীদের রাখতে বলে। তারা হেসে হেসে খাবার সাজিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। ওদের এমন হাসাহাসির মানে এখনো বুঝে ওঠে না কিশোরী। রূপাকে কাছে ডেকে রূপার কর্ণধারে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–“কী হয়েছে বলো তো, ওরা এভাবে হাসছিলো কেন?”
মুখ টিপে হাসলো রূপা। অতঃপর মিনমিন করে কিশোরী সেহনাতের উদ্দেশ্যে বললো,
–“বোকা বেগম আমার! আপনি এবং জমিদার হুজুর একই কামড়ায় ছিলেন। তাই ওরা আজেবাজে ভেবে হাসছিলো। তবে সবটা আজেবাজেও বলা যায় না!”
নিমিষেই গৌবর্ণের গাল দু’টি রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। কান দিয়ে যেন ধোয়া বের হচ্ছে তার। রূপা কোনদিকে ইঙ্গিত করেছে সেটা তার বুঝতে বাকি রইলো না। লজ্জায় লাল হয়ে তার মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইলো। কিন্তু তাদের ভাবনাগুলো কতোটুকু সঠিক? বাহিক্য রূপ দেখে কী অভ্যন্তরের বিরহ উপলব্ধি করা যায়? তা যে সকলের ধারণার বাইরে!
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন। বেশ তাড়াহুড়োয় লিখেছি। বানান ভুল হলে বলবেন অবশ্যই। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।