#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
১৮.
[কপি নিষেধ]
যখন রন্ধন শালায় কেউ ছিলো না তখন মহাপরামর্শকারী প্রবেশ করলো। চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখে এক পাত্রে খাবার বেড়ে রাখা। কুলসুমের বুঝতে বাকি নেই, এই পাত্রটি কার! সে দ্রুত তার আঁচলের আড়াল হতে একটা কিছু বের করে অনেক লাল মরিচের গুঁড়ো মাংসে মিশিয়ে দেয়। মাংস আগের চেয়েও লাল বর্ণ দেখাচ্ছে। কারো পায়ের শব্দ পেতেই কুলসুম দ্রুত বড় ডেকটার পেছনে লুকিয়ে পরে। মাথা কিছুটা বের করে দেখলো দু’জন দাসী এসেছে। তারা আলাপ আলোচনা করতে করতে খাবারের পাত্রগুলো নিয়ে চলে গেলো৷ ওদের যেতে দেখে পান চিবুতে চিবুতে উঠে দাঁড়ায় কুলসুম৷ অধরে তার লেগে আছে পৈশাচিক হাসি!
প্রায় কিছুদিন কেটে গেছে, বেগম মালিহা সেহনাতকে জমিদার মহল এর সকল নিয়ম নীতি শিখিয়ে দিয়েছে। সেহনাতকে ঘর বন্দি-ই থাকা লেগেছে। এখন অবশ্য মুক্ত তবে খুব একটা বের হয় না সে। শাদবিন এসেছে তিন- চারবার। দাসী খাবার নিয়ে আসতেই মুচকি হাসে। উত্তরে দাসীরাও মুচকি হাসে। সেহনাতকে বেগম হিসেবে সকলের বেশ পছন্দ হয়েছে। কিশোরী হলেও বিচক্ষণতা মাহশাল্লাহ! পূর্বের ন্যায় সমালোচনাও কমেছে। আর রূপা তো এখন কিশোরীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ। এই রূপা না থাকলে সেহনাত একাকিত্ব অনুভব করে। মাঝেমধ্যেই পদ্মদিঘিতে স্নান করে সেহনাত৷ সেহনাত স্নান করে শুনলে শাদবিন সর্বপ্রথম সেখানে কোনো প্রহরী রাখে না। সে নিজে তার ভ্রমরাণীকে পাহারা দেয়। দূর থেকে শাদবিনের এই যত্নগুলো ভালোই লক্ষ্য করে কিশোরী। তখন সেহনাতের অধরে লেগে থাকে মিষ্টি একটা হাসি।
অনেক অনেক অনুরোধ, আকুতি করেছিলো যুবকের নিকট। কিন্তু যুবককে সে কাছে টানতে অক্ষম৷ সেহনাত বুঝেছে কেন তার স্বামী তার উপর রাগাম্বিত। কিন্তু সেহনাতের কী করার ছিলো? সে কম চেষ্টা করেনি অভিমান ভাঙ্গাতে। সেহনাত টলমলে চোখে সেদিন বলেছিলো,
–“আচ্ছা শাহীর বাবু, এখন কী আমার রক্ত দ্বারা আপনার অভিমান ভাঙ্গাতে হবে? আর কতো মৃত করবেন আমায়? একটু তো এই নিথর প্রাণে ছুঁয়ে দিন, এই নিথর প্রাণকে সতেজ করুন! আপনার ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে যে আমি তৃষ্ণার্ত! আমার দেহ, মন সবটাই তৃষ্ণার্ত রেখে দিলেন আপনি!”
সেদিন কিছুটা হলেও গলেছিলো শাদবিন। তবে পুরোপুরি কাছে আসেনি। আজ তাদের বিয়ের সতেরো দিন চলছে। দাসী খাবার গুছিয়ে দিয়ে প্রস্থান করলো। সেহনাত রূপার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মুখে খাবার তুললো। অতঃপর….
———————-
–“দেখুন দাদীজান, আপনি যাচ্ছে তাই করতে পারেন না। এভাবে বিপদে ফেলে আপনার লাভ কী?”
–“তো তোমার ওই বি’য়া’দ’ব কন্যাকে বসিয়ে রাখবো? তুমি জমিদার। তোমার যেমন নানান দায়িত্ব ভার আছে তেমনই তারও আছে। তা সে করে কী? বিয়ে করে রাজার হালে খাচ্ছে-দাচ্ছে আর ঘুমোচ্ছে।”
–“আমি আপনার জন্যেই ওকে বের হতে নিষেধ করেছি দাদীজান। দয়া করে আর একটাও বাজে কথা বলবেন না, আমার রাণী সম্পর্কে! নিজের সীমানার মধ্যে থাকুন। আর কী বললেন দায়িত্ব? তা তাকে কোন দায়িত্বটা দিয়েছেন আপনি? আজেবাজে পরিকল্পনায় তার ক্ষতি না করে দায়িত্ব দিন। সে নাহয় দায়িত্ব দিয়ে-ই আপনার চোখে আঙুল তুলুক, যে সে কেমন যোগ্য!”
–“তা তো আমি দিবোই! তা তোমার স্ত্রী দায়িত্ব পালন করতে পারবে তো? তার তো অহংকারে মাটিতে পা’ও পরে না!”
এবার ভিষণ রেগে যায় শাদবিন। ক্রোধে তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। একটার পর একটা বাজে কথা বলেই চলেছে দাদীজান! শাদবিন কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই এক দাসী দৌড়ে কক্ষে প্রবেশ করলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–“অনুমতি না নেয়ার জন্য দুঃখিত জনাব। তবে বেগম কেমন যেন করছেন?”
–“মানেহ?”
–“জ্বী, খাবারে মনে হচ্ছে ঝাল ছিলো!” আমতা আমতা করে বলে দাসী। শাদবিন এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। এক ছুটে বেরিয়ে পরে। চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট। শাদবিনের জানামতে সেহনাত ঝাল খেতে পারে না, তার সমস্যাও হয়। ভৃত্য জাহিদকে দ্রুত নির্দেশ দেয় দ্রুত বৈদ্যকে আনার।
কুলসুমকে ধরার পূর্বেই কুলকুম প্রতিবেশি জমিদার বাড়ির দিকে রওনা হয়। সেখান যে তার আরও কার্যসিদ্ধির বাকি!
——————
শাদবিন ঘুমন্ত কিশোরীকে পলকহীন ভাবে দেখছে। ঘুমেও মধ্যেও তার অধর জোড়া মৃদু কম্পনরত। ঝালে মেয়েটার মুখশ্রীর কী বেহাল দশা! শাদবিনের হৃদয় কেঁদে উঠলো। এই কিশোরী কন্যা-ই তাকে কাছে পাওয়ার জন্য আকুতি, মিনুতি করেছিলো আর সে? বারংবার ফিরিয়ে দিয়েছে এই ছোট্ট কোমল হৃদয়কে। কোনো ভাবে যদি তার ভ্রমরাণীকে হারিয়ে ফেলতো?
হঠাৎ কিশোরী জেগে উঠলো। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সে কাঁতরাচ্ছে। বারংবার “শাহীর বাবু” করছে। শাদবিন দ্রুত সেহনাতের এক হাত নিজ মুঠোতে নিয়ে নিলো।
–“শহুরে বাবু? কোথায় আপনি? কেন এতো কষ্ট দিচ্ছেন? আপনার দেয়া ঘা নিতে নিতে আমি ক্লান্ত! বিশ্বাস করুন, আপনি ব্যতীত আমি নিঃস্ব! আপনি ব্যতীত আমি কাউকে ভাবতে পারি না। আমি ভুল করেছি, আপনাকে অবিশ্বাস করে। আমি জানি, কিন্তু চারপাশে সবাই বলে বেড়াচ্ছিলো যে আ..আপনি ও..ওই রা..রা..রাত্রির সাথে,, আমি পারিনি বিশ্বাস করুন। আমি নিরূপায় ছিলাম শহুরে বাবু। বুঝিনি মানুষদের কথার মানে। ক্ষমা করে দিন আমায় শহুরে বাবু। আপনার ওই বক্ষে ঠাই দিন আমায়, আমি যে সেখানেই নিজ প্রশান্তি খুঁজে পাই।”
অনেকদিন পর সেহনাতের মুখে “শহুরে বাবু” ডাকটা শুনতে পায় শাদবিন। কিশোরী হয়তো ঘুমের ঘোরে বলে ফেলেছে। এই ডাকে শাদবিন নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে না। সেহনাতকে উঠিয়ে বক্ষে জড়িয়ে নেয় নিবিড়ভাবে! সেহনাত কাঁদছে। এ যে দুঃখের কান্না নয়, সুখের। কতো সাধনা এবং আল্লাহ্কে ডাকার পর এই বক্ষে ঠাই পেলো। সেই চেনা আতরের ঘ্রাণ! সুবাসে চোখ বুজে এলো কিশোরীর।
–“আমায় ক্ষমা করো ভ্রমরাণী! আমিও কোন শ’য়’তা’নে’র পাল্লায় ছিলাম যে তোমার পরিস্থিতি আমি বুঝতে পারিনি। আমি একজন ব্যর্থ প্রেমিক এবং স্বামী। ক্ষমা করো আমার অমূল্য রত্ন, আমার প্রাণ! কতগা দিচ্ছি, আর কখনোই তোমার থেকে দূরে থাকবো না।”
–“তাহলে নিন আমায় আপন করে। তোমার ছোঁয়া পেতে আমি যে প্রচন্ড পিপাসু হয়ে আছি শাহীর বাবু!”
শাদবিন তার ওষ্ঠজোড়া গভীরভাবে ছুঁয়ে দেয় কিশোরীর ললাটে। সেহনাত কেঁপে উঠলো। তার ওষ্ঠজোড়া মৃদু কম্পনরত। শাদবিন শীতল স্বরে বললো,
–“আজ আমাদের সুখের রজনী ভ্রমরাণী। এ রজনীর সাক্ষী হয়ে থাকবে গগণের অপরূপ চন্দ্রটি। এক নতুন সুখময় পৃথিবী পার করবো একসঙ্গে। আসবে কী আমার হাতে হাত রেখে?”
সেহনাত শাদবিনের বক্ষে মুখ লুকায়। লাজুক হেসে মাথা নাড়ায়। শাদবিন এর চোয়ালেও হাসি ফুটে ওঠলো।
তারা যখন ভালোবাসতে ব্যস্ত তখন আড়ালে তাদের দেখতে থাকে আগন্তুক। সেই আগন্তুকের চোয়াল শক্ত। তড়তড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“যতো হাসার হেসে নাও। সেই তুমি আঁধারের অতিথি হয়েই আসবে বেগম। তোমার এই সুখ, সুখের সংসার কতদিন টিকিয়ে রাখো আমিও দেখবো। ধ্বংস হবে তুমি, তোমার সমগ্র জমিদার পরিবার। তৈরি হও আগাম ঝড়ের।”
বলেই পৈশাচিক হাসি দিলো আগন্তুক। অতঃপর প্রহরীগণ তাকে দেখার পূর্বেই আঁধারে মিলিয়ে যায়। কেউ এই কালো আঁধারের টের পেলো না। কী হবে পরবর্তীতে? সেহনাত কী তার জায়গা উশুল করতে পারবে? পারবে কী, এই আঁধারিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে? নাকি হারিয়ে যাবে এই কঠিন রহস্যের গভীরে? কে ছিলো সেই আগন্তুক?
সাসপেন্স-০১
–“আমার শাহাজাদী, আপনি তাহলে ফিরছেন জমিদার বাড়ি?”
–“তা তো অবশ্যই কুলসুম। আমার শাদবিনকে যে আমার চাই। তার জন্যে আমি যে কোনো অবস্থায় যেতে রাজি।”
পৈশাচিক হাসি হাসলো কুলসুম।
সাসপেন্স-০২
–“কী সেহনাত আহিম? নিজেকে বেগম হিসেবে প্রমাণ করতে তো? পারবে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে? যোগ্যতা প্রমাণ করতে না পারলে তুমি কিন্তু সব হারাবে!”
বেগম আকলিমার কথায় সেহনাত রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলে,
–“আল্লাহ ভরসা দাদীজান। দোয়া করবেন, যেন আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হই!”
সাসপেন্স-০৩
অনেকদিন পর তার নিষিদ্ধ অনুভূতির বাক্সটা বের করলো শবনাম। কতো সুখ-দুঃখের স্মৃতি এই বাক্সে ধারণ করা আছে। শবনাম ধুলোমাখা বাক্সটি খুলে সর্বপ্রথম একটি ফতুয়া এবং সাদা পাজামা বের করলো। সেই ফতুয়া থেকে এক পরিচিত ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। শুভ্র ফতুয়ায় লেগে থাকা রক্তে হাত ছুঁয়ে শবনাম ডুকরে কেঁদে উঠলো। কেঁদে কেঁদে বলে উঠলো,
–“তোকে আমি বাঁচাতে পারলাম না রে বাবা!”
সাসপেন্স-০৪
সেহনাতকে গভীর রাতে একাকী বেরিয়ে যেতে দেখতে পায় প্রহরীসহ দাস-দাসীগণ! কোথায় যায় সে এই রাত-বিরেতে? মনে প্রশ্ন জাগলেও প্রকাশ করে না। এ-ও সম্পূর্ণ গোপন রইলো। বেগম সেহনাত আহিমের আদেশ বলে কথা!
সাসপেন্স-০৫
শাদবিনের পান করার পাত্রে রক্ত? তাঁজা রক্তের ঘ্রাণে শাদবিন দূরে ছুঁড়ে মারে। উত্তেজনায় মাথা তার ভনভন করছে!
সাসপেন্স-০৬
–“কী পরিকল্পনা তোমার ***!”
–“অপেক্ষা করুন, অপেক্ষার ফল মিঠা হয়। তবে একজন আমার পথে এসেছিলো। তাকে আরামসে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছি!”
–“কাজের কাজ করেছো। তা শুনলাম শাদবিন শাহীরের পেয়ালায় রক্ত পাওয়া গিয়েছে?”
পৈশাচিক হাসি দেয় আগন্তুক। তার হাসিতে খেলে গেলো ভয়ংকর কিছু!
১ম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি।
বিঃদ্রঃ পুরো পরিচ্ছেদটি কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। এখানে কয়েকটা সাসপেন্স দেখালেও আরো কিছু সাসপেন্স চেপে গেছি। সেগুলো দিলে মজা থাকবে না। যাইহোক গল্পটি ফ্যান্টাসি-থ্রিলার জনরার। সাসপেন্স-ও থাকবে। এখানে ১ম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি ঘটেছে। আরও সাসপেন্স নিয়ে ফিরবো কোনো একদিন ইনশাল্লাহ। উপন্যাসটি বড় হওয়ায় দীর্ঘ সময় পর আবার শুরু করবো। কিছু বিষয় নিয়ে স্টাডি করতে হবে সঙ্গে আরও উপন্যাসটা নিয়ে পাকাপোক্ত হয়ে ফিরবো ইনশাল্লাহ। পুরো পরিচ্ছেদের ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
আর হ্যাঁ, প্রথম পরিচ্ছেদে এমন অনেক রহস্য-ই রয়ে গেছে যেগুলো দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে প্রকাশ পাবে। ইনশাল্লাহ তখন রহস্য উম্মোচন হবে। আপাতত ২য় পরিচ্ছেদ নিয়ে অপেক্ষা না করার অনুরোধ! হ্যাপি রিডিং!♥️♥️
গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts