পদ্মদিঘি পাঠ-৩

#পদ্মদিঘি_[১ম পরিচ্ছেদ]
~~পর্ব ০৩~~

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

–“হস্ত বড্ড জ্বালা করছে আম্মিজান। খাইয়ে দিন, খাবার যে মুখে তুলতে পারছি না!”

সেহনাতের এমন কাতর ভরা কন্ঠস্বর শবনামের কর্ণগোচর হতেই নেত্রের কোণে জমে থাকা অশ্রু কপোল বেয়ে গড়িয়ে পরলো! শবনাম নিজের চোখের জল গোপন করে কন্যার ভাতের থালা নিজ হাতে তুলে নিলেন। অতঃপর ভাত মেখে মুখে তুলে দিলেন। সেহনাত একমনে কূপের দিকে তাকিয়ে আছে। শবনাম মেয়েকে আশ্বাসের বুলি দিয়ে বললেন,

–“ওষুধ লাগয়েছি না? একদম ভালো হয়ে যাবে মা। আল্লাহ সব ক্ষত সারিয়ে দিবেন, ভরসা রাখো আমার রাজকন্যা!”

সেহনাত খানিকটা হাসলো। কেন যেন মায়ের মুখে “রাজকন্যা” শুনতে তার বেশ লাগে। কিন্তু সে যে রাজকন্যা নয়। কী এমন পাপ হতো রাজকন্যা হলে?

–“আচ্ছা, আম্মি। মামীজান এতকিছু বলে, তুমি কেন তাকে কিছু বলো না?”

শবনাম তপ্তশ্বাস ফেলে। অতঃপর গম্ভীর হয়ে ভাত মাখতে লাগলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,

–“আমার ভিটে বলতে এই ভাইয়ের ভিটেটাই আছে রে মা। বাহিরের জগত কালো আঁধারে ঘেরা। তারা খুবলে খেতেও সময় নেয় না। এখানে যা হচ্ছে তাও আঁধারিয়ার অংশ। কিন্তু উপায় নেই যে। তবে অবশ্যই তাদের নিকট হতে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। এই দুনিয়া নরমের জম আর কঠিনের রাজত্ব।”

রমনী উত্তরে নিশ্চুপ। মায়ের কথিত উক্তিগুলো বুঝতে তার খনিক সময় লাগলো।

–“আমার আব্বা হুজুর কোথায় আম্মি? তিনি উপস্থিত থাকলে তো এতকিছু হতো না। তিনি কোথায়? তাকে নিয়ে যে আমার অনেক অভিযোগ!”

শবনাম কিয়ৎক্ষণের জন্যে থমকে গেলেন এবং আনমনে হয়ে গেলেন। দ্রুত করে সেহনাতকে পুরোটা খাইয়ে দিলেন৷ অতঃপর তাড়া দিয়ে বলেন,

–“জলটুকু খেয়ে দ্রুত শয্যায় যাও আমার মা। আমি এগুলো রেখে আসছি! বেশি রাত করো না কিন্তু!”
রমনী ফিচেল হেসে জল খেয়ে চকির দিকে এগিয়ে গেলো।

————————-

নবাববাড়ি পৌঁছাতেই অন্দরমহলে দাদীমা অর্থাৎ বেগম আকলিমার দর্শন পেলো শাদবিন শাহীর। রাতের খাবার খেয়ে তার কিছুক্ষণ হাঁটার অভ্যাস আছে। পৈত্রের দেখা মিলতেই বেগম আকলিমা হাঁটা বন্ধ করলেন। মুখশ্রী গম্ভীর। শাদবিন শাহীর তাকে সালাম দিলেন। অধর প্রসারিত করলেন বেগম আকলিমা।

–“ওয়া আলাইকুম আসসালাম আমার শের। রাত্রিতে ফিরলে যে? আর খবর নিয়েছো আমার উপহার মসলিনের?”

–“গন্ধপুর পরিদর্শনে গিয়েছিলাম দাদীমা। সেখান থেকে নওপাড়াতে যাই। এজন্যই কিছুটা বিলম্ব হয়। আর আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, আপনার এই নাতি নিজে মসলিন দর্শন করতে গিয়েছে৷ আশা রাখছি দিন কয়েকের মধ্যে আপনার চরণে পৌঁছে যাবে!”

পৈত্রের বচনে নিশব্দে হাসলেন বেগম আকলিমা। অতঃপর থমথমে গলায় বলে,

–“ইনশাল্লাহ, অপেক্ষায় রইলাম। এখন নিজ কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি!”

শাদবিন সম্মতি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজ কক্ষে চলে গেলো। বেগম আকলিমা ততক্ষণে দাসীদের খাবারের আয়োজন করতে বলে দিলেন। এর মাঝে বেগম মালিহা আসলেন। বেগম মালিহা শাদবিন শাহীরের মাতা। বেগম মালিহা বেগম আকলিমার মুখোমুখি হতেই তাকে সালাম দিলেন। বেগম আকলিমা সালামের উত্তর নিলেন না। খাঁস দাসী নিতুকে নিয়ে নিজ কক্ষের দিকে হাঁটা দিলেন। বেগম মালিহা সেখানে দাঁড়িয়ে আকলিমার যাওয়া দেখলেন। কোনো এক কারণে তিনি মালিহাকে অপছন্দ করেন যা মালিহা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে। পেছন হতে শাদবিন শাহীরের চাচীজান শর্মিলা বানু মালিহার কাঁধে হাত দিলেন। অতঃপর আশ্বাসের স্বরে বলে,

–“নিশ্চিন্ত থাকুন বুবু, ইনশাল্লাহ একদিন আম্মা আপনায় বুঝবেন। আপনি মন খারাপ করবেন না!”

মালিহা কিঞ্চিৎ হাসলো। অতঃপর শর্মিলার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

–“আমিন, শর্মিলা! আমার পুত্রের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে?”

–“জ্বী, দাসী সেই ব্যবস্থাই করছেন।”

————————

শাদবিন শাহীর নিজ কক্ষে প্রবেশ করতেই শয্যায় এক নারীমূর্তি আবিষ্কার করলো। শাদবিন শাহীর কিড়মিড় দৃষ্টিতে তাকালো।

–“এই নারী! কে তুমি? আমার শয্যায় অবস্থান করার দুঃসাহস কোথায় পেলে?”

নারী যেন শাদবিনের উপস্থিতি বুঝতে পারে। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে। অতঃপর মুখশ্রীর উপর থেকে কাপড় সরিয়ে বলে,

–“এটা আমি, রত্না!”

শাদবিনের হস্ত মুঠিবদ্ধ হয়ে গেলো ক্রোধে! ক্রোধ দমিয়ে শীতল কন্ঠে বলে উঠে,

–“তুমি আমার কক্ষে কেন?”

–“আম্মি বললো আমি যদি এভাবে আপনার শয্যায় বসে থাকি তাহলে আপনি আমায় খুব আদর করবেন!”

বারো বছরের কিশোরীর মুখে এমন বচন শুনে শাদবিনের ক্রোধ সীমা অতিক্রম করে ফেললো। সে বাজখাঁই গলায় দাসীদের ডাকলো। শাদবিনের এরূপ হুংকারে কিশোরী কেঁপে ওঠলো আতঙ্কে। কিশোরী বেশ ভয় পায় ভ্রাতাকে। মাতার আদেশের ফল তার জন্যে যে বিপদজনক এতক্ষণে বুঝতে পারলো। রত্না ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। দাসীরা দ্রুত কক্ষে আসলো। শাদবিন হুংকার ছেড়ে বলে,

–“আমার ক্রোধ সীমা অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই এই কিশোরীকে আমার কক্ষ হতে বের করো! আগামী সাত দিন যেন এর ছায়া না দেখি!”

দাসীরা আদেশ মতো রত্নাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তারা চলে যেতেই শাদবিন নিজেকে সামলালো। অতঃপর আপনমনে বিড়বিড় করে বললো,

–“দিনদিন ফুপ্পিজানের সাহস বেড়েই চলেছে।”

তখনই একজন দাসী আসলো। শাদবিনকে সালাম যিজানিয়ে বলে,

–“আপনার হাম্মামখানা প্রস্তুত হুজুর।”

—-

শয্যায় গা এলিয়ে দিতেই সেই রক্তিম মুখশ্রী চোখে ভেসে ওঠে শাদবিনের। শাদবিন জানালা ভেদ করে বিশাল অম্বরে চেয়ে রইলো। মন তার ভবঘুরে, বারংবার সেই সেহনাতকেই স্মরণে আসছে। শাদবিন এই প্রসঙ্গ ভাবনা হতে বিরত থাকতে চাইলো কিন্তু তার অবুঝ হৃদয় তাকে ভাবনায় ব্যস্ত রাখতে চাইছে। হৃদয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যায় যুবক। নির্ঘুম রজনী পার করলো কিশোরীর ভাবনায়। কিশোরীর বোকাসুলভ বচনগুলো স্মরণে আসতেই আপনমনে হেসে উঠছে। অতঃপর হাতের কালচে দাগের প্রসঙ্গ স্মরণে এলো। ললাটে চিন্তার ভাঁজ পরলো। তাড়াহুড়োয় এই প্রসঙ্গ সে ভুলেই গেছিলো। কী হয়েছিলো কিছু সময়ের ব্যবধানে? হাতে কেন পোড়া দাগ? এই প্রশ্ন জমিদারের মস্তিষ্ক তাকে ঘুমাতে দিলো না।

——

আকলিমা অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে তার একমাত্র মেয়ে ইসরাতের দিকে। ইসরাতের দৃষ্টিতে অনুশোচনা বোধ পেলো না বেগম আকলিমা। বেগম কিছুটা হুংকার ছেড়ে বললেন,

–“ইসরাত! তোমার স্পর্ধা কী করে হয় আমার পৈত্রের কক্ষে রত্নাকে পাঠানোর? বয়সের সাথে কী বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে তোমার? তোমার কন্যা কতোটা ছোট, শাদবিন কখনোই ওকে মেনে নিবে না! এটুকু বুদ্ধি নেই মাথায়?”

–“ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন আম্মা। আমি এখানে ভুল কিছু তো দেখছি না। আমার কন্যা সুন্দরী, বুদ্ধিমতি। আর কী প্রয়োজন আম্মা? হোক না বয়স কম, তাও দেখেন কতো মার্জনীয় তার ব্যবহার!”

কন্যার এমন বচনে আকলিমা যেন তেঁতে উঠলেন। ইসরাতের স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই কনিষ্ঠ কন্যা রত্নাকে নিয়ে অন্দরমহলে থাকেন। কিন্তু তার মেয়েটা দিনদিন লোভী হয়ে যাচ্ছেন। সঠিক-বেঠিকের পার্থক্য যেন সব ভুলে বসেছে। আকলিমা শেষ একটি উক্তি-ই দিলো,

–“তোমায় আমার সাবধান করার প্রয়োজন ছিলো, আমি করেছি। আবার বলছি, এরকম দুঃসাহস দেখাতে যেও না। শাদবিন শাহীর তার ক্রোধ বহিঃপ্রকাশ করলে এর ফল ভালো হবে না। এখন তুমি আমার দৃষ্টির সামনে থেকে চলে যাও! মূর্খ্য!”

ইসরাত দেরী করলো না, নিজ মনে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেলো বেগম আকলিমার কক্ষ হতে। বেগম আকলিমাকে উত্তেজিত হতে দেখে খাঁস দাসী নিতু শান্ত করতে বলে,

–“বেগম! শান্ত হোন! এতো উত্তেজনা স্বাস্থ্যের জন্যে কল্যাণকর নয়! জল দিবো, বেগম?”

বেগম আকলিমা হাত দিয়ে নিতুকে থামিয়ে দেন। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–“তার প্রয়োজন নেই। তুমি জগন্নাথকে ডাকার ব্যবস্থা করো। প্রহরী পাঠাও। বলবে বেগম তাকে স্মরণ করেছে!”

–“জ্বী আমার বেগম!”

বলেই নীতু বেরিয়ে গেলো।
তিন দিন অতিবাহিত হলো। যুবক শাদবিনের উত্তেজনা যেন কিছুতেই কমছে না। তার হৃদয় যেন বারংবার সেই কিশোরীর নিকট ছুটে যেতে চাচ্ছে। এ যেন কঠিন সম্মোহন। কিশোরীর দর্শনের জন্যে সে নিবিড়ভাবে তৃষ্ণার্ত। নাহ আর পারবে না সে। শাদবিন শাহীর তার ভৃত্য জাহিদকে আদেশ করলো ঘোড়া নামাতে। ভৃত্য জাহিদ আদেশ পেয়ে ছুটে গেলো। শাদবিন তার এলোমেলো কেশে আঙুল চালিয়ে অধর বাঁকালো। আনমনেই বলে ওঠলো,

–“আসছি আমি, চঞ্চলীনি! হবে আবারও আমাদের সাক্ষাৎ!”

~চলবে।

__লাবিবা ওয়াহিদ__

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ছোট দেয়ার জন্যে দুঃখিত। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here