পদ্মদিঘি পাঠ-৪

#পদ্মদিঘি_[১ম পরিচ্ছেদ]
~~পর্ব ০৪~~

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

দ্বিপ্রহরের প্রথম ভাগ। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই গ্রামে নেমেছিলো মুষলধারে বর্ষণ! সেই স্নিগ্ধ বর্ষণে প্রকৃতি প্রাণভরে ভিঁজে নেয়। চারপাশে মাটির ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। কাঁদামাটিও রয়েছে বেশ। বৃষ্টিস্নাত দিনে আম কুড়ানোর মজাই আলাদা। সেহনাত যোহরের নামাজ সমাপ্ত করেই বাচ্চাদের নিয়ে চলে যায় আম কুড়াতে। শবনাম এতো করে মেয়েকে পিছু ডাকলো, কিন্তু রমনীর চঞ্চলতায় সেদিকে খেয়াল নেই। তার অভ্যন্তরে জেগেছে আমের নেশা।

–“বুবু, তুমি একলাই খাবা নাকি? আমাদেরও কিছুটা দেও!”

বাচ্চাগুলোর সরল অভিযোগ কর্ণগোচর হতেই সেহনাত এক গাল হাসলো। অতঃপর ওদের মধ্যে ভাগ করে সেহনাত একটি পাকা আম তুলে নেয়। সকলকে দেখিয়ে বলে,

–“এর ভাগ আমি কাউকেই দিবো না!”

বলেই পেছন ফিরে যেই দৌড় লাগাবে তৎক্ষনাৎ কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো। সেহনাত নিজের নাক চেপে মাথা উঁচু করে আগন্তুকটির দিকে তাকালো এবং চমকে উঠলো। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

–“শহুরে বাবু?”

ডাকটি শাদবিন শাহীরের কর্ণগোচর হতেই তার হৃদয় শীতল হয়ে গেলো। বাচ্চারা শাদবিনকে গাছের মালিক ভেবে পালালো। শাদবিন তৃপ্তি নিয়ে কিয়ৎক্ষণ উজ্জ্বল শ্যাম মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখমন্ডল হতে যেন নূর বের হচ্ছে রমনীর। শাদবিন জানে না এই এক কিশোরীর মাঝে কী আছে, তবে সে এটুকু বুঝেছে এই কিশোরী ব্যতীত সে অসুখী!

সেহনাত তড়িঘড়ি করে মাথায় কাপড় দিলো। মুখ ঢাকতে গেলে শাদবিন বাঁধা দেয়।

–“তোমার ওই স্নিগ্ধ মুখশ্রী আমি আগেই দর্শন করেছি রমনী! তাই এই মুখশ্রী না ঢাকাই শ্রেয়!”

সেহনাত কিছুটা ইতস্তত হলো। জড়তায় মাথা নিচু করে ফেলে। শাদবিন কিশোরীর চোয়াল ধরে মাথা ওঠালো। সেহনাত কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে যায়, শাদবিনের এরূপ কর্মে।

–“মাথা নিচু করো কেন? অপরাধীরা মাথা নিচু করে, তুমি কী অপরাধী নাকি?”

সেহনাত মাথা ডানে বামে নাড়ায়। আজ কেন যেন গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না তার। কথাগুলো দারুণ ভাবে পেটে জমাট বেঁধেছে। শাদবিন হাসলো। সূক্ষ্ম হাসি।

—–

–“আচ্ছা, তুমি কী জমিদারকে চিনো না?”

–“নাহ, শহুরে বাবু। আমি তাকে কখনো দেখিনি, ওই সহপাঠীদের কাছে দু’চারটা কথা শুনতাম এই আর কী!”

–“তাই বলে নামও জানো না?”

–“শুনেছিলাম মামুজানের মুখে, তাও দীর্ঘদিন পূর্বে। তার নামটা আপনার মতোই কঠিন!”

কিশোরীর বোকাসুলভ উক্তিতে শাদবিন অধর বাঁকালো। তাহলে এই ছিলো তাকে না চেনার রহস্য। কিশোরী তখন তৃপ্তি নিয়ে আম খেতে ব্যস্ত। শাদবিন গালে হাত দিয়ে কিশোরীর মুখশ্রীর অঙ্গি-ভঙ্গি দেখতে ব্যস্ত। এভাবে কেটে গেলো এক সপ্তাহ। দুজনের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। শাদবিন আর রহমতপুর ফিরেনি। সে নওপাড়ার বাসভবনে ছিলো। ধীরে ধীরে শাদবিন প্রণয়ে মত্ত হয় রমনীর।

—————————-

–“আসসালামু আলাইকুম বেগম! আপনি আমায় তলব করেছেন?”

পর্দার আড়াল থেকে জগন্নাথ বলে ওঠলো। বেগম আকলিমা নিজের পান তৈরি করতে করতে চিন্তিত গলায় বললো,

–“জমিদার নবাবের কোনো খোঁজ পেয়েছো? সে কোথায় অবস্থান করছে? অন্দরমহলে কেন সে ফিরে না?”

–“শুনেছি বিশেষ কাজে নওপাড়া গিয়েছে বেগম। এর বাইরে কোনো খবর জানি না।”

–“দ্রুত তার নিকট আমার পয়গাম পৌঁছে দাও। আমি দ্রুত তার সাক্ষাৎ পেতে চাই!”

–“জ্বী, আচ্ছা বেগম।”

–“তুমি এখন প্রস্থান করতে পারো!”

জজগন্নাথ পর্দার আড়াল হতে চলে গেলো বেগম আকলিমাকে সালাম জানিয়ে। আকলিমার পাশে বসা ইসরাত বলে ওঠে,

–“নওপাড়ায় কিসের কাজ আম্মা? যার জন্যে এক সপ্তাহ শাদবিন সেখানে অবস্থান করছে?”

–“মূর্খ্যের মতো কথা বলো না। সে যে এক সপ্তাহ নওপাড়াতেই অবস্থান করছে তার প্রমাণ হাতে নেই। শাদবিন এই কাশিমপুরের জমিদার! নানান কাজে নানান অঞ্চলে তাকে অবস্থান করতে হয়!”

ইসরাত আর কিছু বললো না। বেগম আকলিমা মুখে এসব বললেও তার অন্তঃপুরেও একই প্রশ্ন বাসা বেঁধেছে। কোন জরুরি কাজ?

—————————-

প্রতিদিনের মতো আজও সেহনাত চুপিচুপি বেরিয়ে যায় তার শহুরে বাবুর সঙ্গে দেখা করার জন্যে। কিন্তু আজ খেয়াল হলো তার মামাতো বোনসহ সহপাঠীরা একদিকে ছুটে যাচ্ছে। তারা ব্যতীতও অনেকে সেদিকেই ছুটে চলেছে। কৌতুহলে সেহনাত থেমে গেলো। তার পেছন থেকে দুজন খালা ছুটতে ছুটতে বললো,

–“আরে শুনসো? জমিদার নাকি আমাগো গেরামে আইসে! চলো যাইয়া দেহি, কিছু দিবো নাকি!”

“জমিদার” শব্দটা শুনে সেহনাতের কৌতুহল আরও বেড়ে গেলো। তার অনেকদিনের ইচ্ছে সে জমিদারকে দেখবে। সহপাঠীদের মুখে শুনেছে জমিদার সুদর্শন একজন যুবক। জমিদারকে দেখার ইচ্ছের মাঝে শাদবিনের ভাবনা সে ভুলে বসলো অবিলম্বেই। সেও মাথায় ভালোমতোন কাপড় জড়িয়ে সকলের সঙ্গে চলে গেলো।

সকলের ভীড় জমেছে নওপাড়ার উত্তর দিকের আম বাগানে। মূলত সেখানেই আজ শাদবিনের সঙ্গে সেহনাতের সাক্ষাৎ করার কথা। ঠিক সেখানেই জগন্নাথসহ দুজন প্রহরী এবং ভৃত্য জাহিদ এসে হাজির। জমিদার বাড়ির প্রহরীদের দেখে কিছু উৎসুক জনগণ ওদের পিছু নিয়ে সে পর্যন্ত গিয়েছিলো। জমিদারকে দেখতে পেতেই এক কান, দু’কান হতে হতে কিছু সময়ের ব্যবধানে অনেকেই জেনে যায়। এরপর ছুটে আসে তার দর্শন পেতে এবং সাহায্য চাইতে।

এমন ভীড় দেখে শাদবিনের মেজাজ বিগড়ে যায়। এখানে এসেছে সাময়িক প্রশান্তির জন্যে৷ তাও গ্রামের মানুষ ঠিকই খবর বের পেয়ে গেলো! এখন সকলের কাহীনি শুনবে নাকি প্রিয়তমকে খুঁজবে? শাদবিনের অন্তঃপুরে পোষণ করা ক্রোধ বহিঃপ্রকাশ করলো না। অত্যন্ত শীতল হয়ে অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখে।

ভীড় ঠেলে সেহনাত সামনে এসে দাঁড়ায়। সেও উৎসুক জনতার মতো জমিদারের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে যায়। জমিদারের আসনে একজন যুবক পায়ের উপর পা তুলে কয়েকজনকে আদেশ দিচ্ছে। তার কন্ঠের তেজ এতোই তীক্ষ্ণ যেন আত্মা কেঁপে ওঠে। সেই যুবক আর কেউ না শাদবিন শাহীর, সেহনাতের “শহুরে বাবু”!

ভীড়ের মাঝে চোখ বুলাতেই সেই চিরচেনা নেত্রপল্লবের দর্শন মিললো। এতে শাদবিন মোটেও বিচলিত হয়নি। উল্টো সকলের আড়ালে রমনীর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দেয়। এতে কিশোরী আরও হতভম্ব হয়। শাদবিন পুণরায় নিজের বিচারকার্যে মনোযোগী দেয়। এই প্রথমবারের মতো সেহনাত সচক্ষে শাদবিনের বিচারকার্য দেখলো৷ তার তেঁজী কন্ঠের বুলি ভিন্নরকম শিহরণ ধরিয়ে দেয়ার মতো।

——————————

–“এইযে আমার চঞ্চলীনি! মুখ এমন করে রেখেছো কেন?”

কিশোরী নিরুত্তর। সেহনাত শাদবিনের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। শেষ পর্যন্ত সে এমন মানুষের প্রতি দুর্বল হয়েছে যে কি না অমূল্য রত্ন! বিরাট অম্বরের সেই চন্দ্র, যাকে দেখা যায় কিন্তু স্পর্শ করা অসম্ভব। শাদবিন শাহীর নামক মানুষটা তার নিকট এমনকিছুই মনে হচ্ছে। এই মানুষটা তার জন্যে নয়। বরং তাদের দুজনের পথ আলাদা এবং ভিন্ন!

সেহনাতকে ভাবনায় মত্ত দেখে শাদবিন প্রথমবারের মতো রমনীর গাল স্পর্শ করলো৷ শাদবিন কিশোরীর গাল টেনে বলে,

–“কী হয়েছে আমার ভ্রমরাণীর? যে কি না আমার হৃদয়ের বাগানের প্রতিটি ফুলে ফুলে ভ্রমরার ন্যায় উড়ে বেড়ায়, সে হঠাৎ এতোটা নিশ্চুপ কেন শুনি?”

সেহনাত জড়তার সঙ্গে শাদবিনের হাত সরিয়ে দেয়। অতঃপর অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,

–“নিকাহের পূর্বে কোনো পরপুরুষের সংস্পর্শে আসতে নেই, এটা কী আপনি জানেন না শহুরে.. দুঃখিত শাহীর বাবু!”

–“জানো আমার ক্ষুদ্র নামটা তোমার এই মুখে অমৃতের ন্যায় লাগছে। এতো মধুময় কেন এই দু’টি শব্দ? আর, কীভাবে মনে রাখলে আমার এই কঠিন নাম!?”

–“জীবনটাই এমন শাহীর বাবু। পরিস্থিতি অনেক অভ্যাসও যেমন বদলে দেয়, তেমনই অনেক ভাবনাও বদলে দেয়! দেখুন না, আপনায় আমি ভাবতাম শহরের বাসিন্দা। অথচ আজ সচক্ষে দেখে বুঝলাম, আমার ধারণা ভুল। আপনি এই পুরো কাশিমপুরের জমিদার! কী মূর্খ আমি!”

শেষোক্ত বাক্যে শাদবিন কিছুটা তেঁতে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে সেহনাতের বিপরীতে গিয়ে বসলো শাদবিন! সেহনাত দৃষ্টি পদতলের নিকট নিক্ষেপ করে রইলো।

–“মূর্খ নও তুমি, তুমি কোমল। কোমল একটা হৃদয় আছে তোমার, যা স্বল্প সময়েই মানুষকে আপন করে নেয়। আমি সেই মনটারই চরম ভক্ত হয়ে গেছি। তোমার নিকট হতে বুঝেছি এসব টাকা-পয়সা, ধন-রত্ন-ই দুনিয়া না। আমি যা কখনো অনুভব করিনি, সেটা তোমার নিকট থেকে শিখেছি, উপলব্ধি করেছি। এতকিছু শেখার সাথে সাথে তুমি অজানায় আমার চিত্ত দখল করে ফেলেছো। গভীর প্রণয়ে মত্ত আমি শাহাজাদী!”

–“আমি কোনো অন্দরমহলের শাহাজাদী নই শাহীর বাবু! তাও কেন আপনি আমাতেই মত্ত?”

–“কে বলেছে শাহাজাদী হতে হলে অন্দরমহলের প্রয়োজন? শাহাজাদীর জন্যে একটা পবিত্র হৃদয়ের প্রয়োজন! যেটা তোমার নিকট বিদ্যমান। তুমি কী জানো, ধরনীর বুকে তুমি একান্তই আমার ভ্রমরাণী, আমার শাহাজাদী, আমারই প্রাণোশিনী?”

–“আপনি ভুল পথে আসছেন শাহীর বাবু! আপনার প্বার্শে দাঁড়ানোর মতোন যোগ্যতা বা রূপ আমার নেই! আ..”

শাদবিন শাহীর রমনীর বচনে ফোড়ন কেটে বললো,

–“শুষ! রূপ তোমার যথেষ্ট আছে। নিজেকে এসব বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে নিজেকে ভালোবাসতে শেখো! সকল সৃষ্টি-ই সুন্দর! ফের যদি এই শব্দ উচ্চারণ করো তাহলে আমি শাদবিন শাহীর, তোমার কী হাল করবো, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তুমি আমারই বেগম হবে! তোমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এই বাক্যটি ভালোভাবে এঁটে নেও।”

~~বর্তমান~~

সেহনাতের ভাবনার মাঝেই দরজায় আবারও কড়াঘাত শোনা যায়, সঙ্গে মামুজানের গলা খাঁকারি চিৎকারও। সেহনাত হাতের উল্টোপিঠে অশ্রু মুছে এদিক সেদিক তাকালো। কী পদক্ষেপ নিবে সে?

–“কী রে অপয়া মাইয়া! মইরা গেছোস নাকি? দরজা খুল নয়তো আজই খুন হইবি তুই! তোর এতো বড় সাহস অন্যগো দিয়া আমাগোরে বেইজ্জতি করিস!”

সেহনাতের দৃষ্টি পরলো ক্ষুদ্র দর্পণে! দর্পণটিতে নজরে পরতেই সে দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর ধীর পায়ে দর্পণটির দিকে এগিয়ে গেলো। সেহনাত আর দেরী করলো না। গোপন দরজাটি দিয়ে বেরিয়ে আয়নাটা ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে৷ বিকট শব্দের সঙ্গে দর্পণটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ভাঙ্গা কাচগুলো নিয়ে সাবধানে দরজাটি লাগিয়ে দেয়। অতঃপর ঘরে এসে দর্পণটি দিয়ে..! কিছুক্ষণ বাদে দরজা ভাঙ্গা হলো। দরজা ভেঙ্গে মামা এবং মামী ভেতরে ঢুকতেই…!!!

~চলবে।

___লাবিবা ওয়াহিদ___

বিঃদ্রঃ যারা গল্পটি পড়ছেন তারা গল্পে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন, প্লিজ! ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কী হতে পারে সেহনাতের সঙ্গে? সে কী আত্মহত্যা করবে নাকি তার জীবনের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাবে? গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here