#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
০৬.
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
–“আসসালামু আলাইকুম হুজুর!” এক প্রকার হাঁপাতে হাঁপাতে বললো ভৃত্য জাহিদ।
শাদবিন তখন কিছু হিসাব মেলাতে ব্যস্ত ছিলো। জাহিদ অনুমতি ব্যতীত কক্ষে প্রবেশ করায় কিছুটা বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো মুখশ্রীতে। পরমুহূর্তে তাকে এরূপ উত্তেজিত হতে দেখে প্রশ্ন করলো,
–“কী হয়েছে ভৃত্য? এতো উত্তেজিত হচ্ছো যে?”
–“মাত্রই খবর এসেছে হুজুর। আপনার প্রিয় মানুষটি বৈদ্য শালায় ভর্তি৷ জানা যায় উনি কোনোভাবে আহত হয়েছেন। আপনার জন্য প্রয়োজনীয় সংবাদ মনে হলো তাই এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছুটে এসেছি।”
আতঙ্কে উঠে দাঁড়ায় শাদবিন। তার প্রিয় মানুষ বলতে তো একমাত্র “সেহনাত”! হুট করে কী হলো তার ভ্রমরাণীর? সে রাগ দেখিয়েছে বলে বাড়ির মানুষজন কোনো ক্ষতি করে দেয়নি তো? শাদবিন উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
–” দ্রুত ঘোড়া প্রস্তুত করো। আমি এই মুহূর্তে নওপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। ঘাটে লোক পাঠাও। যেন অতি দ্রুত আমার জন্য নৌকা নির্ধারণ করা হয়।”
–“কিন্তু হুজুর এই রাতে? এখনই তো এশার আযান দিবে!”
–“আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি, পাল্টা প্রশ্নের স্পর্ধা দেখাচ্ছো? যা বলছি তা করো!”
বাজখাঁই ধমকে ভৃত্য ভয়ে আঁতকে উঠলো। অতঃপর কাঁপা হাঁটু ধরে আমতা আমতা করে বললো,
–“জ্বী হুজুর!”
বলে এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। সোজা বেরিয়ে যায়। শাদবিন গায়ে উত্তোরিয়ো জড়িয়ে কক্ষ হতে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতেই এক দাসী তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। দাসী সালাম জানিয়ে বলে,
–“হুজুর, শাহাজাদী ইফফাত প্রায় চলে এসেছেন। বেগম আকলিমা বলেছেন যেন আপনি অতি শীঘ্রই সদর দরজায় উপস্থিত হোন।”
এবার নিজের আক্রোশ সংবরণ করতে পারলো না শাদবিন শাহীর। সে তার পাশে থাকা এক ফুলদানি জোরে আছাড় মারলো। দাসী ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলো। ভাংচুর এবং দাসীর চিৎকার শুনে কক্ষের বাহিরে থাকা দুজন প্রহরী দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলো এবং ঘটনার সূত্রপাত বোঝার প্রচেষ্টা চালালো।
–“করেছি তোমাদের শাহাজাদীর অভ্যর্থনা, হয়েছে?আমার ক্রোধ তোমাদের ওপর বহিঃপ্রকাশ হওয়ার পূর্বেই দ্রুত আমার কক্ষ থেকে দূর হও!”
বলেই ওদের ফেলে শাদবিন নিজেই কক্ষ ত্যাগ করলো। দাসী তখনো ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।
—-
–“স্বাগতম শাহাজাদী, আমি সত্যি-ই সন্তুষ্ট তুমি আমাদের আমন্ত্রণ রক্ষা করেছো!”
বেগম আকলিমার বচন কর্ণগোচর হতেই ইফফাত লাজুক হাসলো। দেহরক্ষী তার ফুলে সাজানো পালকির পর্দা সরিয়ে দেয়। ইফফাত পালকি থেকে নামার মুহূর্তেই শাদবিন এসে উপস্থিত হলো। পৈত্রকে দেখে বেগম আকলিমা বেশ খুশি হলেন। ইফফাতও দেখতে পায় যুবককে। যুবকের দর্শন পেতেই ইফফাতের লাজুক হাসি আরও প্রগাঢ় হলো। হয়তো ভেবে নিলো যুবক তার হাত ধরে পালকি থেকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে এবং তার নিজস্ব কন্ঠে মধুর হাসি দিয়ে বলে উঠবে,
–“স্বাগতম, শাহাজাদী ইফফাত!”
মুহূর্তটুকু কল্পনা করতেই অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো সর্বাঙ্গে। কিন্তু শাহাজাদীর ভাবনার এক বিন্দুও বাস্তবে রূপান্তর হয় না। শাদবিন হনহন করে ইফফাতের পাশ কাটিয়েই চলে গেলো ঘোড়াশালার নিকট। শাদবিনের এরূপ আচরণে উপস্থিত সকলের বিস্ময় আকাশচুম্বী। শাহাজাদী নির্বিকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো শাদবিনের যাওয়ার পথে। বেগম আকলিমার তখন ক্রোধে মাথা ফেটে যাবার উপক্রম। ইচ্ছে তো করলো ঝাঁঝালো গলায় এক ধমক দিতে। কিন্তু বেগম নিজেকে সংগত করলো। বেগম শর্মিলাকে ইশারা করতেই বেগম শর্মিলা বিনয়ী হেসে শাহাজাদীর নিকট চলে গেলেন। অতঃপর শাহাজাদীকে হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন। শাহাজাদী অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন। বেগম আকলিমা হাসার চেষ্টা করে বললেন,
–“শাদবিনের হয়তো কোনো জরুরি কাজ আছে তাই তোমায় অভ্যর্থনা জানাতে পারেনি!”
–“আমি বুঝেছি, বেগম।”
বেশ সন্তুষ্ট হলেন বেগম আকলিমা। অতঃপর সকলে মিলে অন্দরমহলে চলে গেলেন। মালিহা তখনো অন্দরমহলের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে। তখনই ইসরাত এসে দাঁড়ায় মালিহার প্বার্শে! ইসরাত পান চিবুতে চিবুতে বললো,
–“থাক ভাবী, মন খারাপ করিও না। এরা মানসিক রোগে আক্রান্ত বুঝলা? এই রোগ আমার আম্মাকে কেন্দ্র করেই এসেছে। দেখো না সবাই কেমন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে তোমার থেকে? আল্লাহ আছে গো ভাবী, উনি অবিচার সহ্য করবেন না!”
ম্লান হাসলো মালিহা। অতঃপর ইসরাতকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।
–“আমি জানি না বুবু, আম্মা কেন আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। জমিদার শাহরিয়ারও কখনো আমার মুখ দর্শন করেননি। আমি তো এই জমিদারী অথবা বেগম হওয়ার কোনো ইচ্ছে পোষণ করিনি! নিঃস্বার্থভাবে এই পরিবারকে ভালোবেসেছি, এটাই কী আমার অন্যায়!”
–“মন খারাপ করো না ভাবী। ভালোর দাম নেই এই দুনিয়ায়। আমি বুঝি, স্বামী ছাড়া জীবন কতটা সংগ্রামের।”
———-
–“প্রণয়ের তাড়নায় যে একসময় শাদবিন শাহীরকে অন্যের জানালায় উঁকিঝুঁকি মেরে চুরি করে কক্ষে ঢুকতে দেখা যাবে, কে জানতো?”
ভৃত্য জাহিদ আপনমনেই আওড়ালো আকাশের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সে আপাতত বৈদ্যশালার বাইরে পাহাড়া দিতে ব্যস্ত। বৈদ্য আরেক কক্ষে তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। শবনাম তখন চলে যাওয়ার পর আর ফেরেনি মেয়ের নিকট। কিশোরী শুয়ে শুয়ে মায়ের অপেক্ষা করতে করতে নিদ্রায় তলিয়ে যায়। সেই মায়াবী ঘুমন্ত মুখশ্রী একমনে দেখে চলেছে তারই প্রেমিক পুরুষ শাদবিন শাহীর।
–“পৃথিবীতে মানুষের দুটো পছন্দ থাকে। আমার দুটো পছন্দের প্রথমটাও তুমি, শেষটাও তুমি। তুমি যে এক-এ সহস্র রূপ ধারণ করো। তোমার প্রতিটি রূপেই আমি শাদবিন ঘায়েল হই প্রতিবার, নতুনভাবে।”
শাদবিনের বিড়বিড়ের মাঝেই সেহনাত নিদ্রাভ্রষ্টা হয়ে গেলো। পিটপিট করে চোখ মেলতেই চাঁদের আবছা আলোয় পরিচিত মুখশ্রী দেখতে পেলো। পরিচিত মানুষটা তার উপরই ঝুঁকে। তীক্ষ্ণ আতরের ঘ্রাণ খুব কাছ থেকে অনুভূত হচ্ছে। আবেশে চোখ বুজে আসলেও কিশোরী নিজেকে সামলে নিলো এবং ওঠার চেষ্টা করলো। শাদবিনের সাহায্যে উঠে বসলো কিশোরী। অতঃপর পাশ থেকে কাপড়টা নিয়ে দ্রুত মাথায় কাপড় দিলো। শাদবিন মনোযোগ দিয়ে সবটা দৃ্ষ্টিবন্দী করে ফেললো।
–“আ.. আপনি এখানে?”
–“তুমি অসুস্থ আর আমি নিশ্চিন্তে বসে থাকবো? কী করে ভাবলে তুমি ভ্রমরাণী?”
সেহনাত বিস্মিত হলেও প্রকাশ করে না। তার সরল হৃদয় খুব করে চাইছে এই মানুষটিকে ভরসা করতে। কিন্তু কোথায় যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে৷ চাইলেই পূর্বের ন্যায় সরল অভিব্যক্তি দেখাতে পারছে না সে। বারংবার কর্ণধারে মায়ের বলা কথাগুলোই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আদৌ কোনটা সত্যি? সে কোনটাকে মেনে নিবে? মায়ের উক্তি নাকি শাদবিন শাহীরকে। কিশোরীর ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আর জোর খাটাতে পারলো না। ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“আমার ঘুমের প্রয়োজন শাহীর বাবু। খুব ক্লান্তিবোধ হচ্ছে। আপনিও ফিরে যান আপনার নীড়ে। এখানে আপনাকে কেউ দেখে ফেললে আমার বড়ো বিপদ হবে!”
–“কিসের বিপদ? আমি আগে জানতে চাই তোমার এ অবস্থা কী করে হলো? কী এমন হয়েছিলো যার জন্যে এমন আহত হয়ে পরলে? একবার মুখ ফুটে বলো তারপর দেখো আমি ওদের…”
শাদবিনের বচনে ফোড়ন কেটে সেহনাত কন্ঠে ক্লান্তির ভাব ফুটিয়ে বলে,
–“এখানে কারো হাত নেই শাহীর বাবু। এটা দুর্ঘটনামাত্র। আমার ললাটে যা লিখা ছিলো তাই হয়েছে।”
শাদবিন এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেহনাত আর কিছু না বলে শাদবিনের সাহায্য ব্যতীত শুয়ে পরে। চোখ বুজে আবারও বলে উঠলো,
–“এই অধমের অসুস্থতায় তাকে স্মরণ করার জন্যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে আপনি আসতে পারেন!”
মুহূর্তেই বেশ উগ্র দেখালো শাদবিনকে। হস্তজোড়া মুঠিবদ্ধ করে নিজ ক্রোধকে দমানোর প্রচেষ্টা করলো। অতঃপর উঠে দাঁড়ালো। কক্ষ থেকে বের হওয়ার জন্যে চরণ দু’ধাপ এগোতেই কিশোরী নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠলো,
–“আমি প্রায়শ্চিত্ত করেছি শাহীর বাবু। নিজ রক্তের দ্বারা প্রায়শ্চিত্ত করেছি।”
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
___লাবিবা ওয়াহিদ___
গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃ্ষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। আজ দুই পর্ব দিলাম, খুশিতো পাঠকমহল?