#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
০৭.
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
[সেরা কমেন্টকারীদের নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করা হবে! গ্রুপের লিংক গল্পের শেষে দেয়া হলো।]
–“কী হলো শাহাজাদী, খাচ্ছো না কেন? খাবার কী সুস্বাদু হয়নি?”
–“আরে না, না। খাবার তো ভিষণ সুস্বাদু হয়েছে। ভাবছিলাম আজ কী শাদবিন সাহেব ফিরবেন না?”
বেগম আকলিমার অধরে লেপ্টে থাকা হাসিটা নিমিষেই হারিয়ে গেলো। মুখশ্রীতে ভর করলো গাম্ভীরতা! বেগম সরল অভিব্যক্তি দেখিয়ে জানায়,
–“আমার শের হচ্ছে জমিদার। কাজে, কর্মে তাকে অনেক সময়ই বাইরে কাটাতে হয়। দুশ্চিন্তার কারণ নেই, তুমি তোমার আহার সমাপ্ত করো!”
বলেই বেগম আকলিমা নিজের খাবারে মনোযোগ দিলেন। ইসরাত আড়চোখে ইফফাতকে দেখছে আর অগ্নির ন্যায় জ্বলছে।
–“এসেছে দু’ঘন্টাও পেরোয়নি, এতেই এতো দরদ উতলে পরছে যেন শাদবিন তার সো~য়া~মি! হুহ! হৃদয়ে কোন প্যাঁচ আছে আল্লাহ মালুম!”
–“আম্মিজান, কী বলো তুমি বিড়বিড় করে? শাহাজাদী ইফফাত অনেক সুন্দরী তাই না?”
রত্নার সরল বুলিতে কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইসরাত। ইচ্ছে তো করছে মেয়ের গলা টিপে দিতে। প্রবাদ আছে, “যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর!” এই বয়সেও রত্নার মস্তিষ্ক শূন্য! এ জমিদারনি হওয়া তো দূর, ফুঁ মারলেই গগনে উড়তে চলে যাবে! ইসরাত ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। পরমুহূর্তে ভাবলো, হার মানলে চলবে না। এই শাহাজাদীকে যে করেই হোক ভাগাতে হবে। বেগম আকলিমা নিশ্চয়ই বড়ো কোনো পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নেমেছেন।
আহার শেষ হতেই সকলে উঠে দাঁড়ায়। শাহাজাদী ইফফাত নিজ বাঁদীর সঙ্গে নির্ধারিত কক্ষে চলে গেলেন। কক্ষে যাওয়ার পূর্বে বেগম শর্মিলা তাকে জানান কোনো সমস্যা হলে যেন প্রহরী/দাসীকে জানায়। শাহাজাদী ইফফাত উত্তরে মুচকি হেসে বলে,
–“নিশ্চিন্তে থাকুন আপনি বেগম৷”
শর্মিলা অধর প্রসারিত করে ইফফাতের মাথায় পরম মমতার সঙ্গে হাত বুলিয়ে দেয়!
———————————
সুমিষ্ট প্রভাত। ফজরের সালাত আদায় করে শাদবিন মসজিদে বসে রইলো দীর্ঘক্ষণ! মসজিদের এক কোণায় বসে থাকায় কারো নজরে এলো না সে। তার পাশে ভৃত্য জাহিদ অথবা কোনো দেহরক্ষী নেই। সকলকেই শাদবিন আদেশ করেছে মসজিদ হতে দূরে অবস্থা করতে। এতে করে কারো সন্দেহ থাকবে না, শাদবিন এখানে অবস্থান করছে। মুয়াজ্জেম জানালার মরিচিকা ধরা গ্রিল মুছতে ব্যস্ত। ইমাম সাহেব বাচ্চাদের কুরআন শিক্ষা দিচ্ছেন। শাদবিন তসবিহ পড়তে পড়তে জানালা ভেদ করে কুয়াশায় আবৃত প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তার মস্তিষ্কে বারংবার সেহনাতের বলা বচনগুলো তরঙ্গিত হচ্ছে। শেষোক্ত বাক্যগুলো তাকে নিবিড়ভাবে নাড়িয়ে তুলেছে, সঙ্গে তুলেছে অন্তঃপুরে বিশাল ঝড়। সেই ঝড়ের প্রতিটি স্রোত যেন কাঁটাযুক্ত। যতবারই ঝড় প্রবাহিত হচ্ছে ততবারই কাঁটাগুলো তার অভ্যন্তরে বিশাল এবং গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে।
একমাত্র তার জন্যে, একমাত্র শাদবিনের জন্যেই তার ভ্রমরাণীর করুণ অবস্থা। ভ্রমরাণীর সেই করুণ অবস্থা ভাবতেই পুণরায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। শাদবিন এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। বাহিক্য কোনো আঘাত ব্যতীত সে কতটা ক্ষত-বিক্ষত তা কাউকে প্রকাশ করে বোঝাতে পারবে না। বোঝাতে পারবে না ভ্রমরাণীর জন্যে তার অন্তরের পাহাড়সম প্রণয়। প্রাণবায়ু ব্যতীত বড্ড একাকীত্ব অনুভূত করছে সে।
কিছুক্ষণ বাদেই সূর্যের নরম কিরণ তার চরণ স্পর্শ করলো। শাদবিন তাবিজ পড়া শেষ করলো। মোনাজাত শেষ করে উঠে দাঁড়ায় সে। লোকচক্ষুর আড়ালে শাদবিন বেরিয়ে গেলো। নিজেকে উষ্কখুষ্ক, উগ্র লাগলে পাশের পুকুর হতে মুখ ধুঁয়ে এলোমেলো কেশ হাত দিয়ে ঠিক করে নেয়৷ ধৌত মুখশ্রী পরিহিত পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে মুছে নেয় নিবিড় ভাবে। এবার শুভ্র মুখশ্রীতে আনলো গাম্ভীর্য, যার ফলে তাকে প্রকৃত জমিদার লাগছে। অন্তঃপুরের দুঃখ সে কাউকে টের পেতে দেয় না। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ভৃত্য এবং দেহরক্ষী নিয়ে রওনা হয় জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
—————–
সেহনাত কিছুটা সুস্থ হতেই সংবাদ পায় মামুর এক নিয়মিত ক্রেতার বাড়ি হতে তাদের দাওয়াত এসেছে। সেই দাওয়াতে পরিবার বর্গ এবং বিশেষ করে শবনামের যাওয়ার অনুরোধ রয়েছে। শবনাম তো সেহনাতকে ছাড়া যাবেই না। তাই ফিরোজ তাকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এই অসুস্থতার মাঝেও কিশোরীর অধরে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সে গ্রামের বাইরে কখনো গিয়েছে কি না স্মরণে আসে না। রমনী নিজের আহত চরণ নাড়াতে নাড়াতে ভাবতে থাকে কেমন হবে রহমতপুর! চরণের ক্ষত প্রায় শুকিয়ে এসেছে। এ কদিনে শাদবিন তার সাথে সাক্ষাৎ করেনি। সেহনাতের ভাবনার মাঝে শবনাম দুটো কালো আলখেল্লা নিয়ে আসলো। সাথে রয়েছে বিশেষ ধরণের কালো হিজাব। শবনাম মেয়েকে তাড়া দিয়ে বলে,
–“দ্রুত এখান থেকে একটি পরিধান করো আমার মা। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা দিবো!”
–“জ্বী আম্মিজান!”
তৈরি হওয়ার পরপরই স্ব-পরিবারে বেরিয়ে গেলো ঘাটের উদ্দেশ্যে। কিশোরী পর্দার আড়াল হতে উৎসুক নজর চারিপাশে আওড়াচ্ছে। শুনেছে রহমতপুরেই জমিদার বাড়ি সাথে সকলের হৃদয় কাড়া “পদ্মদিঘি”!
সেই দিঘি নাকি বিরাট অংশ জুড়ে। বিশাল দিঘির এক অংশ জমিদার বাড়ির অধীনে পরেছে। বর্ষাকালে দিঘি ভর্তি পদ্মফুল থাকে। যতোই মানুষ ওঠায়, পদ্মের তাড়না যেন শেষ নেই। এজন্যই লোকে এর নাম দিয়েছে “পদ্মদিঘি”! গ্রামের লোকেরা এও বলে, এটা উপরওয়ালার তরফ থেকে এক অপরূপ উপহার।
ঘাটে এসে নির্ধারিত নৌকায় উঠলো সবাই। কিশোরী গুটিশুটি মেরে মায়ের প্বার্শেই বসে রয়। বিস্ময়ের সঙ্গে নদীর ঢেউ, গগনে উড়ন্ত চিলের সৌন্দর্য দেখতে লাগলো।
–“শাহীর বাবু বুঝি এই সৌন্দর্য দেখেন প্রতিনিয়ত?”
আপনমনেই আওড়ায় রমনী।
————-
শাদবিন বেশ পরিপাটি হয়ে সিঁড়িঘরের দিকে যাচ্ছে। পাঞ্জাবির হাতা কনুই অবধি আনতে আনতেই হঠাৎ শাহাজাদী ইফফাতের নিকট পরে। যুবক নির্বিকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রমনীর নিকট। শাহাজাদী ইফফাত লাজুক হেসে সালাম জানায়। শাদবিনও সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে সালামের উত্তর দেয়।
–“শাহাজাদী বুঝি মহল দর্শনে বেরিয়েছেন?”
–“বিষয়টা তেমন নয়। নিজ কক্ষে যাচ্ছিলাম, পথে আপনার সঙ্গে আকস্মিক দেখা। আপনার দর্শন পাওয়া তো মুশকিল, জনাব!”
শাদবিন এবারও সৌজন্যমূলক হাসি দেয়। অতঃপর সরল অভিব্যক্তিতে বললো,
–“মহলে বসে থাকলে বাহিরটা কে সামলাবে বলুন তো?”
–“কথায় হাকিকাত রয়েছে। তা এখন কোথাও যাচ্ছেন বুঝি?”
–“হুম। আজ আসি, অন্য একদিন কথা হবে। আপনি নিজ কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম নিন!”
বলেই পাশ কাটিয়ে সিঁড়িঘরের দিকে চলে গেলো যুবক। ইফফাত সেখানেই মুগ্ধ নয়নে শাদবিনের যাওয়া দেখছে। পাশ থেকে খাঁস দাসী রিপা ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
–“কী শাহাজাদী? মনে ধরেছে জমিদার সাহেবকে?”
কন্যার ধ্যান ভাঙ্গে। সাথে মুখশ্রীতে লজ্জারা ভীড় করে। লাজুক স্বরেই বলে,
–“কীসব বলছো তুমি? এমন কিছুই নয়!”
–“আপনার লাজুক মুখশ্রী যে আমায় অন্য দিকে ইঙ্গিত করছে শাহাজাদী!”
কিঞ্চিৎ হাসলো রমনী। অতঃপর বিপরীতে তাকিয়ে আপনমনে বলে উঠলো,
–“মানুষটাই মনে ধরার মতোন, রিপা। আমার মন কেন তার বিপরীত হবে?”
–“আমার তো মনে হয়, বেগম আকলিমা শীঘ্রই আপনার সঙ্গে তাকে জুড়ে দিতে চলেছেন।”
——————
সেহনাত যেই বাড়িতে নিমন্ত্রিত, ঠিক একই বাড়িতে শাদবিনও নিমন্ত্রিত। এখানে মিলাদ হবে। বড় উঠোনে মাঝ বরাবর বিশাল পর্দা টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। পর্দার একপাশে নারীরা, অপরপাশে পুরুষগণ। পর্দার আড়ালে বসে উৎসুক নজরে চারিপাশ দেখছে কিশোরী। মুখ থেকে তার ছোট কৃষ্ণ নিকাবটি খোলা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্ণগোচর হয় সকলে “জমিদার” বলে চেঁচাচ্ছে। তার সম বয়সীরাও পর্দা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। হঠাৎ জমিদারের কন্ঠস্বরও শোনা যায়। মুহূর্তে কিশোরীর হৃদপিণ্ড ঢিপঢিপ শব্দ করে ওঠে। কেঁপে ওঠে নিজের অজান্তেই। কিশোরী অদ্ভুত নয়নে পর্দার দিকে তাকায়। পর্দা কিছুটা নরম এবং পাতলা হওয়ায় এপাশ হতে পুরুষদের পাশটুকু অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিশোরীর তৃষ্ণার্ত আঁখিযুগল তার সেই প্রেমিক পুরুষকে খুঁজতে ব্যস্ত। ওইতো দেখা যাচ্ছে সকলের মাঝে সাদা পাঞ্জাবির যুবককে। তাকে ঘিরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে। যুবকের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী তৃপ্তি নিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ কিশোরী। অধরে অধর চেপে নিজের আবেগকে দমিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো।
মিলাদ শেষ হয়। মিলাদের পরপরই আহারের ব্যবস্থা করা হয়। সকলে তৃপ্তি নিয়ে আহার করে। আহার শেষ হতেই সেহনাতের কয়েকজন সহপাঠী তাকে প্রস্তাব করে পদ্মদিঘির উদ্দেশ্যে যাবে কি না। কিশোরী এ প্রস্তাব শুনে ভিষণ খুশি হয়। সে তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে নিজের মায়ের কাছে চলে যায় অনুমতি নিতে। শবনাম প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে রাজি হয়ে যায়।
সেহনাতের স্নিগ্ধ হাসি দেখে কে? সে মুখে নিকাব জড়িয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলো। দু’মিনিট হাঁটতেই সেই স্নিগ্ধ, মোহময়ী পদ্মদিঘির দেখা মিললো। কিশোরী থমকে দাঁড়ায় এবং মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রয় পদ্মদিঘির পানে। মোহিনীও ছিলো তাদের সঙ্গে। এক সহপাঠী ওদের অন্যদিকে যেতে বলার প্রস্তাব করলে মোহিনী বলে ওঠে,
–“তুমরা যাও আমি বুবুরে নিয়া আইতাসি!”
মেয়েগুলো সম্মতি জানায়। তারা চলে যেতেই মোহিনী কিশোরীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“বুবু, আরেকটু সামনে গিয়া দেখো! দূর থেকে মজা পাবা না!”
সেহনাত যেন ঘোরের মাঝে আছে। মোহিনীর উক্তি কর্ণগোচর হতেই সেহনাত আরও এগিয়ে গেলো দিঘির নিকট। যখন প্রায় কাছাকাছি তখনই মোহিনী পেছন থেকে কিশোরীকে ধাক্কা দিয়ে পালালো। মোহিনী পূর্ব থেকেই অবগত, সেহনাত সাঁতার জানে না।
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
___লাবিবা ওয়াহিদ___
গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রাতে অথবা বিকালে আরেক পর্ব আসবে। আপনাদের গঠনমুলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।