পদ্মদিঘি পাঠ-৮

#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
০৮.

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

[সেরা কমেন্টকারীদের নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করা হবে। গ্রুপের লিংক গল্পের শেষে দেয়া হলো।]

কিশোরীর মুহূর্তের জন্যে মনে হলো তার এখনই শেষ সময়। ভয়ে, আতঙ্কে কিশোরী অধরে অধর চেপে চোখ কুচকে বন্ধ করে ফেললো। পরমুহূর্তে ভেঁজা ভাব অনুভূতি হলো না। ব্যাপার কী? তার তো এতক্ষণে বিকট শব্দের সাথে দিঘিতে পরার কথা! পিটপিট করে তাকালো কিশোরীর। পদ্ম ফুল তার অতি নিকটে। কিন্তু সে পরেনি। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো সেহনাত এবং অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়। শাদবিন শাহীর তার কোমড় জড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে উগ্র ভাব স্পষ্ট। কিশোরী চটজলদি সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

–“ঠিক আছো তুমি?”

কিশোরী তখন নিজের আলখেল্লা ঝাড়তে ব্যস্ত। শাদবিন তখনো কিশোরীর দিকেই নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। কিশোরী নিজেকে সামলে মিইয়ে গলায় বললো,

–“জ্বী! ঠিক আছি আমি!”

–“ওভাবে পরতে নিয়েছিলে কেন?’

–“ঠিক জানি না। পেছন থেকে মনে হলো কেউ ধাক্কা দিয়েছে। সেই ধাক্কার ফলে কাঁদায় পা পরে গেছিলো। পা পিছলে আরেকটুর জন্যে দিঘিতে পরিনি।”

কিশোরীর দৃষ্টিতে ভীতি স্পষ্ট, যা যুবকের নজর এড়ায় না। শাদবিন দু’ধাপ এগিয়ে গেলো কিশোরীর নিকট। কিশোরী অস্বস্তিতে পরলো। শাদবিন তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

–“তুমি আমার বেগম হবে ভ্রমরাণী! এরকম অনেক ঝড় আসবে যা থেকে রক্ষা করতে আমি সর্বদা তোমার পাশে থাকবো না। তোমায় আগেও অনেকবার বলেছি এখনো বলছি, নিজেকে এমন চড়ুই পাখির মতোন গুটিয়ে রেখো না। চিলের মতো হও, চিলের সূক্ষ্ম দৃষ্টি দেও চারপাশে, দেখবে মুখোশের আড়ালের সবকিছু তোমার নিকট পরিষ্কার থাকবে!”

সেহনাত নিরুত্তর। এক মুহূর্তের জন্যে বলতে ইচ্ছা হলো “আমি তো আপনার বেগম হবো না, শাহীর বাবু! আমার নিয়তির লিখনে যে আপনি লিখা নেই। কী করে দেই আপনায় মিথ্যে ভরসা! নেই যে আমার রূপ, ধন! এই দুনিয়া যে সুন্দরের পূজারী। সেই সুন্দরের পূজারী হতে আপনি-ই বা কতক্ষণ?”

সাহসে কুলালো না কিশোরীর। তাই এই অব্যক্ত উক্তিগুলো অভ্যন্তরেই রয়ে গেলো। কিশোরী প্রসঙ্গ পাল্টে শাদবিনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

–“আপনি এখানে, শাহীর বাবু?”

বলেই কিশোরী আশেপাশে নজর বুলায়। নাহ দূর দূরান্ত থেকে কাউকেই দৃষ্টিতে পরছে না। হাসে যুবক। হাসির ভাঁজ পরলো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির মসৃণ কপোলে।

–“তুমি যেখানে আমি তো সেখানেই থাকবো তাই না? তুমি কী মনে করো, আমি জানি না যে তুমি এসেছো?”

কিশোরী অবাক হলো, চরম অবাক। কিশোরীর অবাকতা দেখে যুবকের যেন হাসি পেলো। নিজের হাসি দমিয়ে অধর বাঁকালো। অতঃপর থমথমে গলায় বললো,

–“আমি-ই তোমায় এনেছি ভ্রমরাণী! রহিম মিয়াকে আমি জোরালো ভাবেই বলেছি যেন তোমার মা আসেন। তোমার মা আসলে অবশ্যই তুমি আসতে বাধ্য। বলতে পারো আমার পরিকল্পনায় তুমি আমার হস্তে ধরা দিয়েছো। কেমন লাগলো তোমার পদ্মদিঘি?”

কিশোরীর বিস্ময়ের সীমা-রেখা রইলো না। তার মানে তাকে এখানে আনার পেছনের মানুষটা তারই শাহীর বাবু। দিনকে দিন তার গোলকধাঁধা আরও কঠিন হয়ে পরছে। কী করে পারবে সে মায়া কাটিয়ে উঠতে?

————————-

মোহিনী মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। আয়েশা তা কোণা দৃষ্টিতে খেয়াল করলো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে মেয়ের কানের কাছে মুখ এনে বললো,

–“এমন পাগলের মতো হাসতাছিস ক্যান?”

–“আম্মা, আমি এক শত্রু বিনাস করে আসছি!” হাসতে হাসতে উত্তর দেয় মোহিনী।

–“শত্রু? কী কইতে চাস তুই, সোজাসাপ্টা বল। নয়তো ধোলানি খাবি আমার হাতে!”

–“সেহনাতরে আমি পুকুরে ফেলে দিয়ে আসছি, এটারে শত্রু বিনাস কয় না?”

আয়েশা মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। ললাটে তড়তড় করে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। চোখে-মুখে তার বিস্ময় এবং ভয়ের ছাপ। মোহিনী ভেবেছিলো তার মা খুশি হয়ে তাকে এক আনা দিবে। কিন্তু মায়ের মুখে আশানুরূপ হাসিটা সে দর্শন করতে পারছে না। মোহিনী মাকে কয়েকবার ধাক্কা দেয়।

–“ও আম্মা! খুশি হও নাই তুমি?”

আয়েশা আক্রোশে মোহিনীর কান মলে দিলো। মোহিনী চেঁচাতে গিয়েও লোক-লজ্জার ভয়ে চুপ করে সহ্য করলো। মুখশ্রীতে ক্রন্দন ভাব এনে মিইয়ে গলায় বললো,

–“মারো ক্যান আম্মা, কী করসি আমি?”

–“এতো বড় অকাম করে কস কী করছোস? তোরে তো মন চাইতাসে গাঙ্গে নিয়া চুবাই। হতভাগী! তোরে কে কইসে এই তামাশা করতে? এখন তোর বলদামীর জন্যে আমার ঘর, সংসার সব যাইবো। সত্যি কইতাছি মোহিনী, এমন কিছু হইলে তুই শেষ।”

মায়ের ব্যবহারে মোহিনী নিজেও ভিষণ ভয় পেয়ে গেলো। ছেলে মানুষী করতে গিয়ে কী ভুল করে বসলো সে? মায়ের বচনে স্পষ্ট প্রমাণ পায়, তার বাবা এ সম্পর্কে জানলে তাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলবে না। মোহিনীও ভেতরে ভেতরে ভয় পুষতে লাগলো। ওদিকে শবনামও কয়েকবার মোহিনীকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে কিশোরীর ব্যাপারে। কিন্তু ভীতু মোহিনী ভয়ে মুখ খোলেনি। পরিস্থিত সামাল দিতে আয়েশা শবনামকে কথার জ্বালে ফাঁসিয়ে রেখেছে। এর মাঝেই ওদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে সেহনাত ফিরলো। কিশোরীকে দেখে দুই মা-মেয়ে যেমন অবাক হয় তেমন-ই তাদের হৃদয়ে জল আসলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো দু’জনেই।

——————————

ফেরার পথে হঠাৎ মোহিনী এবং আয়েশা দু’জনই নিখোঁজ হয়। মোহিনী এবং আয়েশা উভয়ের চোখ খুলে দিতেই নিজেদের জমিদারের সামনে আবিষ্কার করলো। জমিদারকে দেখে আত্মা শুকিয়ে এলো আয়েশার। সে আটকে গলায় দ্রুত সালাম দিলো জমিদারকে। শাদবিন সালামের উত্তর দিলো না। শুধু সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো দুই মা- কন্যার নিকট। কিছুক্ষণ নিরবতার পর শাদবিন বলে ওঠে,

–“মেয়েকে এই বয়সে এই শিক্ষা দেন যে কীভাবে সমবয়সী আরেক মেয়েকে হত্যা করবে?”

আয়েশার গলা শুকিয়ে এলো। মোহিনী তো ভয়ে মুখে কুলূপ এঁটেছে। আয়েশা আমতা আমতা করে বললো,

–“নাউজুবিল্লাহ, হুজুর! এসব কী কন। আমি ক্যাম মাইয়ারে এসব শিখামু? সোনায় সোহাগা আমার একমাত্র ঝিঁ!”

শাদবিন হাসলো। সেই হাসিতে তাচ্ছিল্য স্পষ্ট। অতঃপর পায়ের উপর পা তুলে বললো,

–“ও আচ্ছা। তাহলে আপনার দৃষ্টি-ভঙ্গিতে বেশ ভুল আছে। কয়লাকে বলছেন সোনা। হাস্যকর। আমি আপনাকে বেশি কিছু বলবো না, শুধু বলবো শুধরে যান। আপনার মেয়েকেও সঠিক শিক্ষা দিন। আজ সেহনাতের কিছু হয়নি দেখেই আপনাদের রক্ষা। নয়তো আপনাদের দুই মা- কন্যার বিচার স্বয়ং আমি করতাম। কী ভেবেছেন আপনারা? আপনাদের করা অত্যাচারের কোনো খবর আমি রাখি না? আমাকে বেখেয়াল ভাবাটা আপনাদের জন্যে পাপ! এই কথাটা মাথায় ভালো করে এঁটে নিবেন। জাহিদ, এদের যেখান থেকে উঠিয়ে এনেছো সেখানেই ফেলে আসো। আর এই যে নাটের গুরু, আমি যে আপনায় এখানে এনেছি সে খবর কাঁক পক্ষীও যেন না জানে। নয়তো…”

শেষোক্ত শব্দ বলেই শাদবিন নিজের গলায় হস্ত দিয়ে গর্দানের ইশারা করলো। মা, কন্যা উভয়েই জমিদারকে ওয়াদা করলো তারা এ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলবে না।

——————————————

বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। আয়েশা সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকেই সেহনাতকে বিয়ে দেয়ার জন্যে উঠে পরে লেগেছে। সারাদিন এক কথা বলেই ঘ্যান ঘ্যান করে,

–“এতো বড় হইয়া গেছে মাইয়া, বিয়া ক্যান দেয় না এহনো? আমার মাইয়ারেও তো দেওয়া লাগবো নাকি? বিয়া না কইরা সারাজীবন ঘাড়ে বইসা খাইবো নাকি? পই পই করে বলে দিলাম, এই মেয়েরে বিয়ে না দিলে হয় এই মাইয়া আমার সংসারে থাকবো নয়তো আমি!”

এরকম কথাবার্তাতে প্রায় ঝগড়া লেগেই থাকে বাড়িতে। ভাবীর চেঁচামেচিতে শবনাম আজকাল মসলিন বুননেও মনোযোগ দিতে পারে না। ওদিকে ক্রেতারা নিয়মিত এসে কবে শেষ হবে জানতে চাচ্ছে। শবনাম কী করবে বুঝলো না, তবে চুপ করেও তো বসে থাকা যায় না। শবনাম নিজের ধৈর্যকে বিসর্জন দিয়ে মসলিন বুননের কাজ বন্ধ করলো। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে আঙিনা হতে অভ্যন্তরীণে চলে গেলো। আয়েশা তখনো ঘ্যানঘ্যান করছে পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে। পাড়া-প্রতিবেশীরাও ঠোঁট মিলিয়ে অনেক কিছু বলছে,

–“খোঁজ নিয়া দেখেন এই কন্যা কোন পুরুষের লগে সম্পর্ক জড়াইছে। সারাদিন ঘুরে বেড়ানো কন্যা আর কতটুকুন ভালো হইবার পারে? কই আমার মাইয়ারে তো সারাদিন ঘরেই রাখসি, আবার বিয়ার বয়স হইলে বিয়া দিয়া দিছি।”

–“আরে বুঝো না, মায়ের মতোই হইবো মাইয়ায়। একসময় গেছিলো না পরের হাত ধইরা মা-ভাইয়ের মুখে চুনকালি মাখাইয়া। আবার তো ঠিকই বছর খানেক পর কুলে মাইয়া নিয়া আইয়া পরলো। এ তো পুরাই অভিশাপ।”

–“আল্লাহ গোহ মাফ করো, এদের ছায়াও যেন আমাগো মাইয়াগো উপ্রে না পরে!”

সবই শুনলো শবনাম। পূর্বের শবনাম হলে হয়তো এসব শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পরতো, নেতিয়ে পরতো। কিন্তু এখন যে সে কঠিন নারীতে পরিণত হয়েছে। এসব সে সহজে গায়ে মাখে না। কম তো শুনেনি এতগুলো বছর। সে অভ্যন্তরীণে সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

–“আমার মসলিন বুনন প্রায় শেষ। আমার মসলিনের কাজ শেষ হলেই আমি আমার একমাত্র কন্যার জন্য ভালো পাত্র আনবো। পাত্র ঠিক হলেই আমার কন্যাকে অতি যত্নে তার হাতে তুলে দিবো বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে। এখন আপনারা আসতে পারেন। আর ভাবী তোমার উদ্দেশ্যে বলছি, আর একবার যদি তুমি এসব বলে ঘ্যানঘ্যান করে আমার মনোযোগ নষ্ট করো, তাহলে এই মসলিনের একটা কানাকরিও তুমি পাবে না!”

বলেই শবনাম উল্টোপথে হাঁটা দেয় মসলিন আঙিনার উদ্দেশ্যে। আয়েশা যে তখন মুখে কুলূপ এঁটেছে আর মুখ ফুটে কিছু বলেনি। এদিকে সেহনাতকে একরকম ঘর-বন্দি রাখা হয়েছে। সে চাইলেও বাহিরে মুক্ত বাতাসের সঙ্গে নিজেকে উম্মুক্ত রাখতে পারছে না। পারছে না তার শাহীর বাবুর সাক্ষাৎ পেতে। কে জানে তার শাহীর বাবু কতবার এসে খুঁজেছে তার ভ্রমরাণীকে।

——————

যত দিন গড়াচ্ছে ইফফাত যেন ততো নিবিড়ভাবে যুবকের প্রতি দুর্বল হয়ে পরছে। এই এক যুবককে দেখার জন্যে প্রতিনিয়ত ছটফট করে। কিন্তু যুবককে সে দর্শন করতে পারে না। মাঝেমধ্যে তার খুব ইচ্ছে করে ছুটে যেতে জমিদারের কক্ষে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে ইচ্ছে হয়, “গ্রহণ করুন আমায় শাদবিন। আপনাকে আমি নিজের পুরোটা বিলিয়ে দিতেও রাজি!” কিন্তু কোথায় যেন এক অস্বস্তি, জড়তা থেকেই থাকে। তার মধ্যে ভদ্রতারও তো একটা বিষয় আছে।

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

___লাবিবা ওয়াহিদ___

গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here