#পদ্মপাতার_জল
#মুন্নি_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১০ (শেষ পর্ব)
অপারেশন থিয়েটারের সামনে সবাই বসে আছে।অনিরুদ্ধ ফোন করে সবাইকে সবটা বলে দিয়েছে।সন্ধ্যার পর থেকে মৃন্ময়ীকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছিল।তখন সবাই দেখা করেছে তার সাথে।
অনিরুদ্ধ হাঁটুর উপর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সবার থেকে বেশ দূরে বসে আছে। তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ।চোখ দুটো বার বার ঝাপসা হয়ে আসছে।কোনো বারণ শুনছে না!
মৃন্ময়ীকে অপারেশনের কথা বলায় সে কাটকাট না করিয়ে দেয়।কিছুতেই সে অপারেশন করাবে না,টাকা নষ্ট করতে রাজি নয় সে।পরে সবাই মিলে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে তাকে রাজি করিয়েছে।
তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার আগ মুহূর্তে অনিরুদ্ধর হাত ধরে তার কানের কাছে বলেছে,
“ভালোবাসি তোমায়!”
মৃন্ময়ীর বলা কথাটি তার বুকে হানা দিচ্ছে এখনো।সেই সাথে তীব্র ভাবে যোগ হয়েছে তাকে হারানোর ভয়।অনিরুদ্ধ আর পারলো না।দুহাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিল!
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো অনিরুদ্ধ।দেখলো তার শুভ্রা ভাবী দাঁড়িয়ে আছে।সেও কান্না কাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।
অনিরুদ্ধ শুভ্রার হাতটা ধরে আবারো কেঁদে দিল।শুভ্রা পরম মমতায় তার মাথায় হাত রেখে আশ্যস্ত করলো।
একটুপর অনিরুদ্ধ শুভ্রার থেকে হাত ছাড়িয়ে এক দৌঁড়ে হসপিটালের বাইরে চলে গেল।
সবাই তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।অনির্বান পেছন থেকে বার কয়েক ডাকলো তাকে।কিন্তু অনিরুদ্ধ কানে তুলল না।
মাজেদা বেগম বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।তিনি নামাজে বসবেন।এতদিন মেয়েটির জন্য আল্লাহর কাছে কিছু চায়নি।আজ চাইবেন তিনি।তার ছেলের জন্যই মেয়েটিকে চাইবেন তিনি।
সন্ধ্যায় তিনি মেয়েটিকে জীবনে প্রথমবারের মতো জড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছেন।বহুদিন আগেই মেয়েটিকে নিজের মেয়ের আসনে বসিয়েছেন।তিনি কিছুতেই সেই আসন খালি হতে দিবেন না।প্রাণভিক্ষা চাইবেন তিনি।সবকিছু যেনো সুস্থ মতো হয়,তার দুয়া করবেন।তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
_________________
আজ মৃন্ময়ীর চোখের ব্যান্ডেজ খোলার দিন।এতগুলো বছর পর সে নতুন রূপে পৃথিবীকে দেখবে।তার কাছের মানুষদের দেখতে পাবে।তার যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না!
হসপিটালের বেডে মৃন্ময়ী আধ শোয়া হয়ে আছে।তার পাশে অনিরুদ্ধ বসে আছে। অনিরুদ্ধর ডান হাতটা মৃন্ময়ী শক্ত করে দুহাতে ধরে পেটের উপর নিয়ে আছে।এ হাত সে এ জীবনে ছাড়বে না!
অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো।আজ সব অপেক্ষার অবসান হবে।মৃন্ময়ী আবার আগের মতো দেখতে পাবে।মুক্ত প্রকৃতির স্বাদ নিবে।
মৃন্ময়ীর চোখে মুখেও হাসি যেনো উপচে পড়ছে।তার অবচেতন মন প্রতিটা সময় অনিরুদ্ধকে এক নজর দেখার জন্য আকুপাকু করতো।সে কল্পনায় কত ছবি এঁকেছে তার!কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেনি সে দেখতে পাবে তাকে,আবার নয়ন ভরে অবলোকন করবে এই পৃথিবীকে।
অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীর বাম হাত নিজের গালে স্পর্শ করলো।তারপর বলল,
__’চোখ খুলে সর্বপ্রথম কাকে দেখতে চাও মৃন?’
মৃন্ময়ী হাসলো।বলল,
__’তোমার কাকে মনে হয়? ‘
__’আমার কাকে মনে হয়?তোমার ছোটবেলার সেই দপ্তরি আঙ্কেলের কথা মনে আছে? আমার তো মনে হয় তুমি সর্বপ্রথম আমাদের সেই স্কুলের দপ্তরি আঙ্কেলকে দেখতে চাইবে।কারণ আঙ্কেল তোমায় অনেক স্নেহ করতো!’
__’একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবে না কিন্তু!এতদিন আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে অনেক ফাজলামো করেছো।এবার আমার পালা!তোমায় এমন শিক্ষা দিবো না,সাত জনম মনে থাকবে!’
অনিরুদ্ধ ভয় পাওয়া গলায় বললো,
__’মা গো মা!আমায় বাঁচাও।আমি প্রচুর ভয় পেয়েছি।’
মৃন্ময়ী ধমকে উঠলো।বলল,
__’চুপ,একদম চুপ।হসপিটাল এটা।’
দুজনে একসাথে হেসে উঠলো।দরজার কড়া নাড়তে অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো।তার পরিবার এসে গেছে। সাথে ডাক্তারও।সবাই এসে মৃন্ময়ীকে ঘিরে দাঁড়ালো।অনিরুদ্ধ আস্তে করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
অনিরুদ্ধ ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে।রাস্তার দিকে তাকালো।গাড়ি অনেক কম।মাঝে মাঝে দু একটা বাস সাই করে তাকে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে।রোদের তীব্রতা মোটামুটি অসহ্য পর্যায়ে চলে গেছে।সে একটা রিকশা দাঁড় করালো।এতটা পথ একা হাঁটা সম্ভব নয়।
রিকশা আপনগতিতে চলছে।অনিরুদ্ধন মনের নদীতে উথাল পাথাল ঢেউ খেলানো শুরু হয়ে গেছে।কেমন যেনো লাগছে তার!
তার মন চায় মৃন্ময়ী চোখ খুলে সর্বপ্রথম তাকে দেখুক।তাকে দিয়েই শুরু হোক এ পৃথিবীতে আরেকবার বাঁচার নতুনত্ব।কিন্তু তার মস্তিষ্ক এর বিরুদ্ধে।মৃন্ময়ী তাকে দেখবে কিন্তু সবার পরে।এটা তার নিজের ক্ষুদ্র শাস্তি।
___________________
সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগে।মৃন্ময়ী মুখ ফুলিয়ে বিছানায় বসে আছে।সেই সকাল দশটার দিকে তার চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে।তখন থেকেই অনিরুদ্ধ উধাও।এখন পর্যন্ত তার দেখা মেলেনি।
মৃন্ময়ী সারা বিকেল তন্নতন্ন করে অনিরুদ্ধর রুমে ছবি খুঁজেছে তাকে এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু রুমে কোনো ছবির টিকিটিও পায়নি।তার মনে হচ্ছে অনিরুদ্ধ ইচ্ছে করে সব করছে।কিন্তু কেন?
চোখ খুলে সে সর্বপ্রথম অন্তিককে দেখেছে।অন্তিক খালামনি বলতে পাগলো।বদ্ধ রুমে তখন প্রায় সময়টা অন্তিকের সাথেই কাটতো মৃন্ময়ীর।
হঠাৎ করে রুমের সব লাইট অফ হয়ে গেল।মৃন্ময়ী অন্ধকার দেখতে দেখতে অন্ধকার নিয়ে কুৎসিত ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তার মনে।সে ভয় পেয়ে গেল।
বিছানা থেকে নামতেই কেউ তাকে পরম যত্নে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে।
মৃন্ময়ী কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
__’অনিরুদ্ধ! ‘
__’হু,ভয় পেয়ো না।তোমায় এখন এক জায়গা নিয়ে যাবো।আর চেঁচামেচি করবে না একদম।সবাই টের পেয়ে যাবে।কেমন?’
__’কিন্তু কোথায় যাবো?’
__’গেলেই বুঝতে পারবে।আর কোনো কথা না।’
মৃন্ময়ী থেমে গেল।অনিরুদ্ধ তার চোখে পাতলা কালো কাপড় বেঁধে কোলে তুলে বাইরে বের হলো।
ঘন্টা দুয়েক পর গাড়ি থামালো অনিরুদ্ধ।নিজে নেমে মৃন্ময়ীকে কোলে তুলে সামনে হাঁটা ধরলো।
মৃন্ময়ীকে দাঁড় করিয়ে চোখ খুলে দিল অনিরুদ্ধ।
চোখ খুলতেই মৃন্ময়ী অবাকের সপ্তম আসমানে পৌঁছালো।হা করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।
সে এখন একটা পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সারা পুকরে পদ্মফুল ভাসছে।পুকুরের চারপাশ লাইটিং করা।নীল আর সাদা শেডের আলো জ্বলছে, নিভছে।সে দক্ষিণের দিকে একটা ডিঙি নৌকাও দেখতে পেল।
মুখে হাত দিয়ে সে হা করে তাকিয়ে আছে পুকুরের দিকে।নীল আলো পড়ায় পদ্মপাতা ফুলসহ কি সুন্দর লাগছে দেখতে!
__’বারে,পদ্মফুল দেখতে দেখতে মানুষ আমার কথা ভুলেই গেছে দেখছি!কি আর করা অনিরুদ্ধ! ‘
অনিরুদ্ধর কন্ঠ কানে আসতে হুশ ফিরে মৃন্ময়ীর।হঠাৎ করে বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড লাফাতে থাকে।ভয়ে নাকি সুখে জানা নেই!
সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।অনিরুদ্ধর চোখে চোখ রাখার সাহস হচ্ছে না।
অনিরুদ্ধ তাকে একটানে নিজের কাছে নেয়।আস্তে করে বলে,
__’বউ চোখ খুলো।ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আমি ভাল্লুকের মতো দেখতে না,হু।অনেক হ্যান্ডসাম।তুমি জানো,কত মেয়ে আমার জন্য পাগল!’
অনিরুদ্ধর মিষ্টি হাসি কানে বাজতেই আস্তে করে চোখ খুলে মৃন্ময়ী।পরমুহূর্তে হা করে তাকিয়ে থাকে অনিরুদ্ধর মুখপানে।যেনো জনম জনমের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।
অনিরুদ্ধ হেসে বলে,
__’এভাবে দেখার কি আছে?আমার বুঝি লজ্জা করে না!’
অনিরুদ্ধর কোনো কথা মৃন্ময়ীর কানে যাচ্ছে না।সে অনিরুদ্ধকে দেখতে ব্যস্ত।সে তো এ জীবনে মানুষটাকে দেখার আশাই ছেড়ে দিয়েছিল।
তার দুচোখ জলে ভরে উঠলো। কাঁপা কাঁপা হাতে অনিরুদ্ধর সাড়া মুখে হাত বুলিয়ে দিল।তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
কিছুক্ষণ পর অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীকে ছাড়িয়ে বলল,
__’দেখো তো,বাড়িটা পছন্দ হয়েছে না?এটা একটু গ্রামের দিকে।বাড়িটা তোমার জন্য কিনেছি।পুকুরে পদ্মফুলও চাষ করেছি।উইক এন্ডের দিনগুলো আমরা এখানে কাটাবো।তারপর মাঝে মাঝে ফ্যামিলি পিকনিক হবে।দারুণ না?’
মৃন্ময়ী সারা বাড়ি এক নজর চোখ বুলালো।অনেক বড় বাড়ি।গাছপালাতে ঘেরা।পুবদিকে এক তলা বিল্ডিং।নীল কালারের রঙটা চকচক করছে।মৃন্ময়ী হেসে ফেলল।
বলল,
__’অনেক সুন্দর! আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।’
__’চলো,এবার নৌকায় উঠি।’
অনিরুদ্ধ হেসে হাত বাড়িয়ে দিল।মৃন্ময়ী নিজের হাতটা দিয়ে তার হাত শক্ত করে ধরে নৌকায় উঠলো।
মাঝপুকুরে নৌকা নিয়ে অনিরুদ্ধ তিনটা পদ্ম ফুল তুলে মৃন্ময়ীর হাতে দিল।মৃন্ময়ী এতক্ষণ পানি ছিঁটে খেলছিল।সে এগিয়ে এসে অনিরুদ্ধর হাত থেকে ফুলগুলো নিলো।
তারপর অনিরুদ্ধর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীর খোপা করা চুল ছেড়ে দিল।কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে কানে একটা পদ্মফুল গুঁজে দিলো।তারপর নৌকা ভাসালো ভালোবাসার নদীতে।যে নদীর ভালোবাসার জল কোনোদিন শুকাবে না।অম্লান,অনবদ্য হয়ে দুটি হৃদয়ে থেকে যাবে জনমের পর জনম!
★সমাপ্ত★
গল্পটা খুবই সুন্দর ছিলো কিন্তু একটা জিনিস ভালো লাগে নাই,সেটা হলো গল্পের নায়ক নায়িকার নামটা পুরোদমে হিন্দুয়ানী ছিলো!