#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।১২।
বাইরে থেকে কারো মোটা গলার শব্দ পাওয়া গেল,
‘খুলো মা, আমি।’
আকবর সাহেবের গলা’টা শুনেই পদ্ম’র ভয়টা যেন তরাৎ করে বেড়ে গেল। উনি এত রাতে কেন এসেছেন? পদ্ম থম মেরে বসে থাকে। বাইরে থেকে তখন আবার শোনা যায়,
‘কী হলো মা, দরজা খুলছো না কেন?’
পদ্ম জবাব দেয় না। তার চোখমুখ ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গিয়েছে। সে চাদর খামছে ধরে বসে আছে। দরজায় আরেকবার ঠকঠক শব্দ হলো। পদ্ম চোখ বুজে মরার মতো শুয়ে পড়ল। কিছুটা সময় গেল। এরমধ্যে বাইরে থেকে আর কোনো শব্দ এলো না। সে মিটমিট করে ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত এক’টাই ঐ ভদ্র লোক কেন তার রুমে আসতে চাইছিল। কী চাই লোকটা? উনি কি তবে সত্যি সত্যিই খুব খারাপ একটা লোক? পদ্ম’র ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়লো দরজায় যখন আবার ঠকঠক করে শব্দ হলো। পদ্ম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকাল। না, দরজা খুলবে না সে। দুনিয়া উল্টে গেলেও খুলবে না। কিন্তু সে এবার চমকে গেল দরজার বাইরে রুবি হোসেনের গলা শুনে। তিনি পদ্ম-কে বললেন,
‘দরজা খুলো মা। কী হলো?’
পদ্ম এবার আর কিছু না ভেবে দরজা খুলে দিল। রুবি হোসেনকে বাইরে দেখে প্রসন্ন হাসলো সে। বললো,
‘বড়োমা, তুমি এত রাতে..?’
‘তোমার কী হয়েছে, বলতো? জেগে থেকেও দরজা খুলছিলে না কেন, তোমার আংকেলও তো কতক্ষণ ডাকল। আমরা তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’
পদ্ম শুকনো মুখে হাসল। বললো,
‘না মানে আসলে, ভেবেছিলাম কে না কে এসেছে..তাই..’
‘কে না কে এসেছে মানে কী? এই বাড়িতে আছিই তো আমরা কয়জন মানুষ। আমাদেরকেও কি তুমি বিশ্বাস করতে পারছো না?’
আদিদের বাবা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে উঠলেন। পদ্ম’র এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে লোকটার মুখের উপর বলে দিতে যে, “না পারছি না। সবাই-কে বিশ্বাস করতে পারলেও অন্তত আপনাকে সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না।”
সেটা বলা তার পক্ষে সম্ভব নয় বলে সে আপাতত চুপ হয়ে রইল।
রুবি হোসেন তখন এগিয়ে এলেন। পদ্ম’র মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘আচ্ছা থাক মা, আর মন খারাপ করতে হবে না। বুঝতে পেরেছি তুমি হয়তো এখনও নিজেকে আমাদের সাথে এডজাস্ট করে উঠতে পারছো না। সমস্যা নেই, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’
পদ্ম ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,
‘কিন্তু, আপনারা এত রাতে এখানে এসেছেন, কোনো সমস্যা?’
‘আরে আর বলো না। তোমার আংকেল, সে তোমার জন্য চিন্তা করতে করতে শেষ। তুমি ওভাবে না খেয়ে চলে এলে না, সেই নিয়ে ওর দুশ্চিন্তা। হঠাৎ কী হলো তোমার, শরীর খারাপ হলো কিনা এসব টেনশনে সে ঘুমাতেই পারছিল না। আর আমাকেও ঘুমাতে দিচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এত রাতে তোমার রুমে আসতে হলো।’
পদ্ম আকবর সাহেবের দিকে তাকাল। উনি দরদমাখা গলায় বললেন,
‘বাবা’র তার মেয়ের জন্য টেনশন হবে সেটা কি স্বাভাবিক নয়, বলো?’
পদ্ম’র বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধক করে উঠল। মেয়ে? উনি কি পদ্ম-কে নিজের মেয়ের চোখে দেখেন? সত্যিই তাই? তাহলে কি পদ্ম’ই উনাকে নিয়ে ভুল ভাবছে? তার এই স্পর্শ, এই চাহনী সবটাই কি স্নেহ আর মায়ার খাতিরে? কোনো খারাপ চিন্তা নেই এর মাঝে? পদ্ম’র মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে কাকে নিয়ে কী ভাবছে সে নিজেও জানে না। কাকে বিশ্বাস করবে আর কাকে বিশ্বাস করবে না সেটাই সে বুঝতে পারছে না। মানুষ ভীষণ ধূর্ত প্রাণী। তাদের মুখোশের আড়ালের চেহারা’টা সহজে ধরা যায় না। তাই তো তখন এই বিশ্বাস নামক জিনিসটার প্রতিফলন ঘটাতে খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। পদ্ম নিশ্বাস নিল জোরে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
‘আমি একদম ঠিক আছি। প্লীজ আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে আপনারা আমার দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারছেন না। প্লীজ এমন করবেন না। আমি ঠিক আছি, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন।’
রুবি হোসেন বললেন,
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আর দুশ্চিন্তা করবো না। তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়ো আমরাও শুয়ে পড়বো।’
‘আচ্ছা বড়ো মা।’
রুবি হোসেন বেরিয়ে গেলেন। আকবর সাহেবও তার পেছন পেছন দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছনে ফিরে মুচকি হেসে বললেন,
‘গুড নাইট, বেবিগার্ল।’
পদ্ম জবাব দিল না। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দরজা আটকে এসে আবার শুয়ে পড়ল। মাথাটা খুব ধরেছে তার। আর এত প্রেসার মাথায় নিতে পারবে না সে। সম্ভব না, মাথা ফেটে যাচ্ছে যে। সে ড্রয়ার থেকে একটা পেইনকিলার বের করে খেয়ে চুপচাপ গিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। এখন একটু ঘুম আসলে বাঁচে সে…
.
.
‘তুই আমার শেষ ভরসা ছিলি, দোস্ত। আর শেষ পর্যন্ত এখন তুইও হার মেনে নিলি?’
আদিদের গলার স্বর আটকে আসছে। তার সবটুকু আশাও এবার যেন শেষ হয়ে গেল। ফোনের ওপাশ থেকে কেউ বললো,
‘আমার সবটুকু দিয়ে আমি ট্রাই করেছি, কিন্তু আমি পারিনি। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমি ওকে খুঁজিনি। তুই বিশ্বাস কর দোস্ত, সারা দেশে আমার পরিচিত যত ডিটেক্টিভ ছিল, সবার কাছে আমি সাহায্য নিয়েছি কিন্তু তাও লাভের লাভ কিছুই হয়নি। তুই হয়তো জানিস না আমি এই কেইসটা নিয়ে ফরেইনার কিছু ডিটেক্টিভদের সাথেও কথা বলেছি। তারাও অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আ’ম সরি টু সে দ্যাট, উই অল আর ফেইলড। আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব না, দোস্ত। ক্ষমা করিস আমায়।’
আদিদ স্তব্ধ হয়ে গেল। তবে কি আর কোনোভাবেই সে সুজানা-কে খুঁজে পাবে না। এত ভাবে খুঁজেছে সে সুজানা-কে, এই এক বছর পাগলের মত হন্য হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে এদিক ওদিক তাও সে পায়নি তাকে। শেষ ভরসা তার এই বন্ধু। কিন্তু সেও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। সুজানা-কে খুঁজে পাওয়ার শেষ আলোটাও যে নিভে গেল এবার। আদিদ চোখ বুজল। ভাঙ্গা গলায় বললো,
‘ফোন’টা রাখ।’
রাখ বলে সে আর অপর পাশের ব্যক্তির ফোন কাটার অপেক্ষা করলো না নিজেই কল’টা কেটে দিল। তারপর সেই ফোন’টা ছুঁড়ে মারল বিছানার উপর। ফ্লোরে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তার ছোটোবেলা থেকেই এই অভ্যাস। যখনই তার খুব মন খারাপ হয়, খুব কষ্ট হয় তখনই সে রুমে এসে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে। কেন যেন সেই মুহুর্তে ফ্লোরে শুয়ে থাকতে তার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয় মনটা হালকা হয়েছে।
মাথার নিচে দু’হাত রেখে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দেয়ালে টানানো সুজানার ছবিগুলোর দিকে। আজ যদি মেয়েটা থাকতো তবে সে তার কলিগ হতো। আর তো কেবল এক বছরই ছিল তার ইন্টার্নি শেষ করার। তারপর সে একজন ডক্টর হিসেবে তার হপিটালে জয়েন করতে পারতো। আর তারপর..তারপর দুজনের কত শত প্ল্যানিং ছিল। সুজানার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হিসেবে জয়েন করার পর পরই তারা বিয়ে করবে। তারপর দুই ডাক্তার দম্পতি মিলে চুটিয়ে সংসার করবে। কিন্তু তার মাঝেই হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল। তবে আদিদের এখনও মনে আছে, সুজানা হারিয়ে যাওয়ার আগে সবসময়ই তাকে কী যেন বলতে চাইতো। কিন্তু কোনোভাবেই সেটা সে বলে উঠতে পারতো না। আর আদিদও কখনো তাকে সেটা বলার জন্য জোর করেনি। আদিদের এখন মনে হচ্ছে, যদি একবার সে সেই কথাটা শুনতে পারতো, তাহলে হয়তো সুজানা-কে তার আজকে হারাতে হতো না। নিশ্চয়ই সুজানা এমন কিছু তাকে বলতে চাইছিল যেটা তার হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী..
চলবে..