পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা |৩৪|

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৪|

পদ্ম’র প্রতিক্রিয়া দেখে আদিদ অভির দিকে তাকাল। অভি যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। পদ্ম আবারো উঁচু সুরে বললো,

‘কী হলো, আপনারা চুপ করে আছেন কেন? এখানে আমার বিয়ের কথা কোথ থেকে উঠছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ডাক্তারবাবু, আপনি কিছু বলছেন না কেন?’

আদিদ পদ্ম’র দিকে ফিরে তাকাল। গম্ভীর গলায় বললো,

‘আপনি শান্ত হোন। আমি ব্যাপার’টা বুঝিয়ে বলছি আপনাকে। আসলে, অভি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে। আপনি তো নিজেই বলেছেন, আপনি মেয়ে, আপনার বেঁচে থাকার জন্য এক জনের সাহায্য প্রয়োজন। আর অভি সেই সাহায্যটা আপনাকে করতে চাইছে। ওকে চাইলে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। তবে এখনই বলছি না, আগে কিছুদিন ওর আশ্রমে থাকুন। নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলুন। ওর সাথে সময় কাটান। তারপরই আস্তে আস্তে সিদ্ধান্ত’টা নিন। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।’

পদ্ম কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সে অভির দিকে তাকাল। পদ্ম’র তাকানো তে অভির অস্বস্তি’টা আরো বেড়ে গেল। পদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘আমি সুস্থ নই। না মানসিক ভাবে, আর না শারীরিক ভাবে। আমি জানি আমি একা বাঁচতে পারবো না। আমার সাহায্যের প্রয়োজন। আর সেই জন্যই আমি আপনার সঙ্গে আপনার আশ্রমে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার মতো আরো অনেক মেয়ে আছে। তারা কেউ বসে নেই। ওরা নিজেদের মতো স্বাবলম্বী হচ্ছে। ওরা তো কেউ এখনও বিয়ে করেনি। আপনি তো তাদের মধ্যে থেকে কাউকে বিয়ে করতে চাননি, তবে আমাকে কেন? বলুন?’

অভি থমকে গেল। এই প্রশ্নের কী জবাব হতে পারে সেটা তার জানা নেই। সে জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। পদ্ম নত মস্তিষ্কে বললো,

‘আমি অসহায়। বড্ড অসহায়। নিজেকে অসহায় বলে দাবি করতে কারোরই ভালো লাগে না। কেউই পৃথিবীতে দয়া নিয়ে বাঁচতে চায় না, আর সেটা আমিও চাই না। কিন্তু আফসোস, আমাকে সেইভাবেই বাঁচতে হবে। এই বিয়ে’টা করে আপনি আমার উপর দয়া করতে চান, তাই না? আমি জানি, আপনি না বললেও আমি বুঝি। আমার মতো মেয়েকে কেউ এমনি এমনি বিয়ে করতে চাইবে না। যদি না তার আরাফাতের মতো অসৎ উদ্দেশ্য থাকে কিংবা সে আপনার মতো দয়ালু না হয়। এমনিতেও আপনি আর ডাক্তারবাবু আমার জন্য অনেক করেছেন। এখন শুধু আমাকে আপনার ঐ আশ্রমে থাকতে দিন, আমার তাতেই চলবে। আমি আর নতুন করে এই বিয়ে নামক বস্তুতে নিজেকে আর জড়াতে পারবো না। ক্ষমা করবেন আমায়।’

কথাগুলো বলে পদ্ম কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। অভি আর আদিদ তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পথে। সে চলে যেতেই অভি বিরক্ত গলায় বললো,

‘তোকে এখনই এসব কথা বলতে হলো?’

আদিদ কাঁচুমাচু করে বললো,

‘আরে আমি তো ভেবেছিলাম, তুই হয়তো উনাকে সব বলে দিয়েছিস।’

অভি মুখ কালো করে আদিদের পাশে বসলো। বিরস গলায় বললো,

‘সত্যিই, মেয়ে মানুষগুলো না একটু বেশিই বুঝে। আমি কি একবারও বলেছি ওকে দয়া করে বিয়ে করবো? মানে নিজে নিজেই সব ভেবে নিয়েছে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দিল না। ধ্যাত!’

আদিদ আলতো হাসল। বললো,

‘এত প্যারা নিস না। তুই তো একসময় মেয়ে পটানোর ওস্তাদ ছিলি। আবার না হয় সেই বিদ্যা’টা এখন কাজে লাগাবি।’

‘পাগল হয়েছিস! এই বয়সে এসে আমি এখন মেয়ে পটানোর জন্য মেয়ের পেছন পেছন ঘুরবো? ইমপসিবল। মেয়ে পটানো ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ আছে। ও বিয়ে করতে না চাইলে আমিও ওকে জোর করবো না। মা’র কাছে আরো অনেক মেয়ে আছে, মায়ের পছন্দেই না হয় একজনকে বিয়ে করে নিব।’

আদিদ তখন গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,

‘মেয়েটার প্রেমে পড়িস নি?’

‘কেন, প্রেমে পড়া কি বাধ্যতামূলক?’

‘না, তুই তো প্রেমে পড়তে জানিস। হুটহাট যে কারোর প্রেমে পড় যাস। আমার কত নার্সকে দেখেও তো..’

‘আরে কী শুরু করেছিস? এসব আগের কথা এখন তুলছিস কেন? তখনের আমি আর এখনের আমি’র মাঝে বিশাল পার্থক্য। এখন আর আমি প্রেমে পড়ি না, বরং মেয়েরা আমাকে দেখে প্রেমে পড়ে।’

আদিদ হাসে। বলে,

‘তা তো পড়বেই। দিন দিন যা হ্যান্ডসাম হচ্ছিস, কবে যেন মেয়েরা তোকে তুলে নিয়ে যায়। পরে দেখা যাবে ডাক্তারি ছেড়ে আমাকে উল্টো গোয়েন্দা হয়ে তোকে খুঁজে বের করতে হবে।’

আদিদের কথা শুনে অভি হেসে উঠে। তার সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠে আদিদ নিজেও। হাসতে হাসতেই হঠাৎ আটকে যায় সে। মনে হয়, অনেকদিন পর সে আবার এইভাবে প্রাণ খুলে হেসেছে। নয়তো সে তো এই হাসি ভুলতেই বসেছিল। আদিদ তখন হুট করেই অভির হাতটা জড়িয়ে ধরে। অভি খানিকটা অবাক হয়ে তাকায়। আদিদ জড়ানো গলায় বলে,

‘তুই আমাকে কখনো ছেড়ে যাস না, দোস্ত। আমাকে তুই সারাজীবন আগলে রাখিস, প্লীজ।’

অভি শক্ত করে আদিদের হাতটা ধরে। বলে,

‘যতদিন বেঁচে থাকবো, আমি এইভাবেই তোর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবো।’

আদিদের তখন মনে হয় পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর সম্পর্কই টা মনে হয় এই ‘বন্ধুত্ব’ই’। পৃথিবীর সব মানুষ স্বার্থপর হলেও একজন বন্ধু কখনও স্বার্থপর হয় না। যেখানে মা সন্তানকে, সন্তান মা’কে বিশ্বাস করতে পারে না সেখানে দুইজন দুই ভিন্ন স্বত্বার মানুষ কী সুন্দর একে অপরকে বিশ্বাস করে নেয়। এটাই হয়তো বন্ধুত্বের শক্তি। এই শক্তি আর অন্য কোনো সম্পর্কে নেই আর হয়তো কখনো জন্মাবেও না।
.
.
পদ্মকে অনেক খোঁজার পরও কোথাও পাওয়া গেল না। অভি বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। মেয়েটা গেল কোথায়? তখন যে কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তারপর থেকে আর তার মুখদর্শন পাইনি কেউ। এখন তো অনেকটাই রাত হয়ে গিয়েছে, এত রাতে কোথায় গেল মেয়েটা?

অভি রিসিপশনে গিয়ে খোঁজ নিল, কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। সে আবার আদিদের কেবিনে গেল। আদিদ বসে বসে নিজের হাতের ব্যান্ডেজ’টা দেখছিল। অভি এসে চিন্তিত গলায় বললো,

‘দোস্ত, পদ্মকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।’

আদিদ ব্রু কুঁচকে ফেলল।

‘খুঁজে পাচ্ছিস না মানে? হয়তো নিচ তলায় রেস্ট রুমে আছে।’

‘নেই, আমি খুঁছে এসেছি। কোথাও নেই।’

‘কী বলিস? রাগ টাগ করে আবার কোথাও চলে টলে গেল নাকি?’

‘আমারও তো তাই মনে হচ্ছে। এখন কী করি বলতো?’

‘ওর নাম্বারে একটা কল দে।’

‘নাম্বার পাবো কই থেকে। ওর ফোন তো মিসিং।’

‘ওহ তাই তো। তাহলে এক কাজ কর। নার্স শিমুকে ডাক। উনার সাথে আবার পদ্ম’র খুব ভালো সম্পর্ক। ডেকে দেখ, উনি কিছু জানেন কিনা?’

আদিদের কথা মতো অভি গিয়ে নার্সের সাথে কথা বললো। নার্স তখন বললো পদ্ম নাকি হসপিটালের ছাদে গিয়ে বসে আছে। তার নাকি খুব মন খারাপ তাই সে আজ ছাদ থেকে নামবেই না। নার্সের কথা শুনে অভি বিরক্ত হলো।
সে ছয়তালা পার হয়ে লিফট দিয়ে ছাদে উঠল। ছাদে পা রাখতেই সে অনেক খানি চমকে গেল। কী চমৎকার সুর। সে কিছুটা এগিয়ে যেতেই সুর’টা আরো গাঢ় হলো। সে ধীর পায়ে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থামল। পেছন থেকে দেখে অভি বুঝতে পারলো এটা পদ্ম। এই শুনশান পরিবেশে তার তীক্ষ্ণ সুর বুকের ভেতরকার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে তুলছে। সে মিহি কন্ঠে গেয়ে যাচ্ছিল,

…দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ও পারে-
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে ।।
বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী-
এসো এসো পারে হয়ে মোর হৃদয়মাঝারে ।।
তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে,
বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে ।
কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি
আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে….

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here