#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৯|
কনে পক্ষের সবাই চলে এসেছে। অভি তার পুরো পরিবার সহিত আশ্রমে আরো আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। কনে কে নিয়ে মেয়েরা ভেতরের রুমে গেল। কাজী ও চলে এসেছে এবার বিয়ে পড়ানোর পালা।
কাজী সাহেব সহ আরো বেশ কয়েকজন বয়োজৈষ্ঠ লোক ভেতরের রুমে গেলেন। পদ্ম সহ বাকি সব মেয়েরা কনে কে চাদর দিয়ে আড়াল করলো। কাজী সাহেব কাবিননামা পড়ে শুনালেন তারপর মেয়েকে কবুল বলতে বললেন। পদ্ম’র সেই মুহুর্তে তার নিজের বিয়ের ঘটনাগুলো মনে পড়ছিল। সেই মুহূর্তে বুকের ভেতর টা তার কী পরিমাণ ছটফট করছিল সেটা কেবল সেই জানে। কী ভয়ানক সুন্দর ছিল সেই অনুভূতি। তবে তার পরিণতি ছিল ভীষণ কুৎসিত। পদ্ম আর সেসব নিয়ে ভাবল না। কনে কাঁদছে। পদ্ম তার হাতের উপর হাত রেখে বললো,
‘আপু, কবুল বলুন।’
মেয়েটা নাক টেনে বললো,
‘কবুল।’
পরপর তিনবার কবুল বলার পর সকলে একসঙ্গে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠল। তারপর সবাই ব্যস্ত হয়ে ছুটল বরের কাছে। সবাই চলে যাওয়ার পর পদ্ম একটা টিস্যু নিয়ে কনের চোখ মুখ মুছে দিল। তারপর সে তার পাশে বসলো। মুচকি হেসে বললো,
‘অবশেষে আমাদের অভি ভাইয়ের বউ হয়েই গেলেন। মাশাল্লাহ, দুজন কে একসাথে পুরো রাজযোটক লাগবে।’
মেয়েটি মিষ্টি করে হাসল। পদ্ম আবার বললো,
‘আপনার বুঝি কবুল বলার সময় খুব কষ্ট হচ্ছিল?’
মেয়েটি বললো,
‘হ্যাঁ, বিয়ে করলেই তো মা বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে সেইজন্যই খুব কষ্ট হচ্ছিল।’
পদ্ম আস্তে করে বললো,
‘ওহ।’
মেয়েটি কিছুক্ষণ পদ্ম’র দিকে চেয়ে থেকে বললো,
‘অভির কাছে আমি তোমার কথা অনেক শুনেছি। তুমি খুব সাহসী একটা মেয়ে। সারাজীবন এইভাবে এক বুক সাহস নিয়ে বেঁচে থাকো, দোয়া করি।’
পদ্ম তার কথার জবাবে প্রসন্ন হাসল।
.
খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সবাই মনোযোগ দিল ফটো সেশনে। সবাই বর কনে কে নিয়ে অনেক অনেক ছবি তুলছে। পদ্ম দূরে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখছিল। সেই সময় কেউ তার পেছনে এসে বললো,
‘আপনি ছবি তুলছেন না যে?’
পদ্ম চমকে পেছনে তাকাল। আলতো হাসল সে। বললো,
‘আপনি ছবি তুলবেন না?’
আদিদ বললো,
‘না, ইচ্ছে করছে না।’
‘সেকি, আপনার একমাত্র বন্ধুর বিয়ে বলে কথা আর আপনার তার সাথে ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে না!’
‘না, করছে না। এতে এতো অবাক হওয়ার কী আছে?’
পদ্ম সেই কথার জবাব না দিয়ে আদিদের দিকে তাকাল। আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,
‘কী হলো?’
পদ্ম হেসে বললো,
‘আপনি সব সময় সাদা পাঞ্জাবী কেন পরেন? আপনার কি অন্য রঙের পাঞ্জাবী নেই?’
ব্যাপার টা আদিদের কাছে ভীষণ বিরক্তিকর মনে হলো। সে কী কালার পাঞ্জাবী পরবে সেটা তার ব্যাপার। এতো কিছু নিয়ে এই মেয়েকে কেন কথা বলতে হবে। আদিদ তার চোখে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,
‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই পরেছি।’
পদ্ম আর কিছু বলে না। আদিদ কিছুক্ষণ থেমে বলে,
‘আগামী মাসে আমার ফ্লাইট।’
পদ্ম নিরব থাকল। আদিদ তখন বললো,
‘অভি বলেছে এখানে থাকলে আপনি খুব ভালো থাকতে পারবেন। আর এখানের নারী সংস্থার সাহায্যে আপনি একদিন স্বাবলম্বী হতে পারবেন তখন আর আপনাকে বেঁচে থাকার জন্য অন্য কারোর উপর নির্ভর করতে হবে না। অভির সাথে আমার কথা হয়েছে, ও বলছে ও আপনার খেয়াল রাখবে। আর আমিও আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো। নিজেকে কখনোই একা ভাববেন না। আমরা সবাই আপনার পাশে সবাই আছি।’
পদ্ম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পদ্ম’র মৌনতা দেখে আদিদও আর কিছু বললো না। দূর থেকে অভি তাদের ডাকল। আদিদ তখন পদ্ম কে বললো,
‘চলুন, অভি ডাকছে।’
বলে সে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। পদ্ম আর সেদিকে গেল না। সে তার রুমে গিয়ে গা থেকে শাড়ি’টা খুলে ফেলল। তারপর একটা সুতি থ্রি পিস পরে আবার বাইরে বের হলো।
.
আদিদের জুরুরি একটা কল আসায় সে বাগানের এক কোণে গিয়ে কথা বলছিল। কথা শেষে চলে আসার সময় হঠাৎ সে কিছু একটা দেখে দাঁড়াল। বাগানের অপর পাশে রাণীকে দেখতে পেল সে, আর তার সাথে ছিল অভির শালা মানে নতুন কনে নিঝুমের ভাই। রাণী খুব হেসে হেসে ছেলেটার সাথে কথা বলছিল। ছেলেটার বয়সও বেশি না। হবে হয়তো উনিশ বিশের মতো। আদিদ বেশ আগ্রহ নিয়ে ব্যাপারটা দেখল। তখন তার মনে হলো এই জন্যই রাণী আজ আর তাকে বিরক্ত করেনি কারণ সে বিরক্ত করার নতুন মানুষ পেয়ে গিয়েছে। আদিদ হেসে হাঁটতে হাঁটতে বাগান থেকে বেরিয়ে আসে। সে বেরিয়ে আসতেই পদ্ম কে দেখে, হাতে বিশাল এক ঝুড়ি নিয়ে বাগানে ঢুকছে। তাকে বাগানে ঢুকতে দেখে আদিদ জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘বাগানে, ফুল তুলবো।’
‘ভেতরে তো এত ফুল আছে। আর ফুল দিয়ে কী হবে?’
‘অভি ভাই বলেছে উনার বাসর ও নাকি এখানেই হবে। নিঝুম আপুও সেটাই চান। তাই উনাদের বাসর ঘর সাজানোর জন্য অনেক ফুল প্রয়োজন।’
আদিদ তখন উৎসুক কন্ঠে বললো,
‘চলুন তাহলে, আমিও আপনাকে সাহায্য করি।’
পদ্ম আদিদ কে বারণ করলেও আদিদ তার মতো কাজ করে যায়। অনেক ফুল নিয়ে তারা দু’তালার গেস্ট রুমে যায় সেটা সাজানোর জন্য। পদ্ম বললো, নিঝুম আপুর গোলাপ ফুল পছন্দ তাই অভি ভাইয়া বলেছেন গোলাপ ফুল দিয়েই পুরো রুম সাজানোর জন্য। কিন্তু আদিদ বললো, শুধু গোলাপ দিয়ে সাজালে ভালো দেখাবে না। তার সাথে কিছু অর্কিড নিলে হয়তো বেশি মানাবে। দুজনের কথা না মেলায় কিছুক্ষণ সেখানে বেশ তর্ক হলো। এক পর্যায়ে আদিদ বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ঠিক আছে, আপনি সাজান আপনার মন মতো, আমি গেলাম।’
পদ্ম তাকে পাত্তা দিল না। আদিদ সত্যি সত্যিই চলে গেল।
সন্ধ্যার দিকে কনে পক্ষের সবাই আশ্রম থেকে চলে গেলেন। কেবল থেকে গেল কনের ভাই। পরিবারের মানুষগুলো চলে যাওয়ার সময় নিঝুম খুব কাঁদছিল। আর ওর কান্না দেখে আশ্রমের বাকি মেয়েরাও কাঁদছিল। আদিদ হতভম্ব হয়ে তখন মেয়েদের দেখছিল। সে বুঝতে পারে না, এক মেয়ের বিদায়ের বেলায় এত মেয়েকে কেন কাঁদতে হবে। যার বিদায় সে কাঁদবে, না এখানে সবাই দল বেঁধে কাঁদতে নেমেছে।
অভির মা বাবা বাদে তার বাকি আত্মীয়-স্বজন’রাও চলে যায়। তারা কালকে নতুন বউ নিয়ে একেবারে ফিরবে বলে আজ রাতটা সকলে এখানেই কাটায়।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আদিদ চলে যেতে চাইলেও অভি তাকে দেয় না। অভির জোরাজুরি তে এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে এখানে থাকতে হয়। আর তার জন্য সে প্রচুর বিরক্ত ও হয়ে উঠে। এখানে থাকার যে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই সেটা পদ্ম তার মুখ দেখেই বুঝতে পারে। কেবল মাত্র বন্ধুত্বের খাতিরে সে সবকিছু খুশি মেনে নিয়েছে।
.
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। কিন্তু আদিদের চোখে ঘুম আসছে না। সে অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে হাসফাস করতে লাগল। তাও ঘুমের ছিটেফোটাও তার চোখে এসে ধরা দিল না। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সে বারান্দায় গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ খোঁজার চেষ্টা করলো। আকাশে আজ চাঁদ নেই। আদিদ তখন মনে মনে ভাবল, অভি আর নিঝুমের জন্য এই আকাশটা আজ বড্ড বেমানান। অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সে আবার রুমে চলে যায়। তারপর বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে। চেষ্টা করতে থাকে, যদি অক্ষিকোণে একটু ঘুমের দেখা পাওয়া যায়।
______________________________________
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়,
পদ্ম’র কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। শরীরের জামা’টার অনেককাংশ ঘামে ভিজে উঠেছে। মাথার উপর জলন্ত সূর্য টা যেন তাকে ভস্ম করে দিতে চাইছে। আদিদ গাড়ি টা স্টার্ট দিতেই পদ্ম আরো একবার কম্পিত স্বরে বলে উঠে,
‘না গেলে হয়না ডাক্তারবাবু?’
আদিদের কানে সেই সুর পৌঁছায় না। সে অভিকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। আশ্রমের সবাই তাদের বিদায় জানায়। তারপর তারা একে একে সবাই ভেতরে চলে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে কেবল পদ্ম। এই রোদে দাঁড়িয়ে থেকে তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে। কিন্তু সেই কষ্ট সে টের পাচ্ছে না। ডাক্তারবাবু চলে যাচ্ছে বলে এর থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। যদি তার ক্ষমতা থাকতো তবে সে তাকে আটকে রাখতো, যেতে দিত না। কিন্ত আফসোস! সেই ক্ষমতা তার নেই। পদ্ম নিষ্প্রাণ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন তার হাতটা এসে কেউ ধরে। পদ্ম আলতো চোখে তাকায় তার দিকে। রাণী তখন বিষন্ন কন্ঠে বলে,
‘তুমি কি ডাক্তার সাহেব কে ভালোবাসো?’
পদ্ম নিস্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কেবল মাথা নাড়ায়। রাণী মেয়েটি তখন তার হাত ছেড়ে ভেতরে দৌঁড়ে যায়। আর পদ্ম দাঁড়িয়ে থাকে ঐভাবেই।
চলবে…