#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৪|
বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদিদ। তার থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়ানো তার মা। আদিদ নিরব চোখে তাকিয়ে আছে সেই কবরের দিকে। সে কখনো ভাবেনি এবার ফিরে এসে আর বাবাকে দেখবে না। ভেবেছিল, সামনে না গেলেও দূর থেকে একবার মা বাবাকে দেখে যাবে। কে জানতো, সে দেখার আগেই তার বাবাকে এই মাটির নিচে রেখে দেওয়া হবে। কে জানতো, আর চাইলেও বাবাকে দেখা হয়ে উঠবে না তার। এতকিছু হয়ে গেল, বাবা অসুস্থ হয়ে মা’রা গেল অথচ সে কিছু জানল না। কেমন ছেলে সে, আর কেমন ডাক্তারই বা সে, যদি না নিজের বাবার চিকিৎসাটাই করতে পারলো। আদিদ চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। মেনে নিতে পারছে না সে, কোনোভাবেই পারছে না। এই ঘৃণা আর ক্ষোভ তার কাছ থেকে তার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। এখন কাকে ঘৃণা করবে সে? কার প্রতি এত ক্ষোভ নিয়ে বসে থাকবে?
আদিদ চোখ মেলে তাকায়। তারপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে যায়। তার মা কাঁদছেন। এত এত কষ্ট আর হয়তো তিনি সহ্য করতে পারছেন না। আদিদ তার মা’কে গিয়ে বললো,
‘মা, তৈরি হয়ে নাও। আমি তোমাকে নিয়ে এখনই শহরে ফিরে যাবো।’
রুবি হোসেন ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বললেন,
‘এই মানুষটাকে এখানে একা ফেলে আমি কী করে চলে যাবো। সারাটা জীবন আমার পাপের সঙ্গী ছিলেন। শেষ সময়ে এসে রাতদিন কেঁদে কেটে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। অনেকবার চেয়েছিলেন তোমার সাথে যোগাযোগ করতে, কিন্তু সাহস হয়ে উঠেনি। আর যেদিন মা’রা গিয়েছিলেন সেদিনও তোমার জন্য খুব কেঁদেছিলেন। আমি এই মানুষটাকে কীভাবে ভুলবো? উনি তো ভালো ছিলেন, আমি উনাকে খারাপ বানিয়েছি। আমার জন্য উনি কষ্ট করেছেন। আমাকে উনি কোনোদিনও মাফ করবেন না। কোনোদিনও না..’
এই বলে তিনি আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠলেন। আদিদ তার মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কষ্ট তো তারও হচ্ছে, ভীষণ কষ্ট। বুক ফেটে যাওয়ার মতো কষ্ট। কিন্তু এখন আর সে আগের মতো কাঁদতে পারে না। চোখ দিয়ে এখন আর পানি আসে না তার।
রুবি হোসেন অনেকক্ষণ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন । তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক মুখ মুছে বললেন,
‘চলো বাবা, তোমাকে কিছু খেতে দেই। বিকেল হয়ে গেছে, এখনও কিছু খাওনি তুমি। চলো।’
ছেলেকে নিয়ে তিনি ভেতরে গেলেন। ছোট্ট একটা টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা করলেন, ছেলের বসার জন্য। তারপর তিনি খাবার নিয়ে এলেন। এক প্লেট ভাত, এক বাটি ডাল আর অন্য একটা বাটিতে কিসের একটা তরকারি। খাবারগুলো দেখে আদিদ অবাক হলো। তার মা এখন এসব খায়! হায়! ভাগ্য মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে আসে।
আদিদ খুব মজা করে খাবারটা শেষ করে। অনেকদিন পর এতটা তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে সে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আদিদ তার মা’কে বললো,
‘তুমিও খেয়ে নাও মা। আর খেয়ে তৈরি হয়ে নাও, আমরা শহরে ফিরছি।’
রুবি হোসেন বলে উঠলেন,
‘আমি তোমার বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না, আদিদ।’
আদিদ জোর গলায় বললো,
‘যেতে হবে তোমাকে। এখন থেকে আমার সাথেই শহরের বাড়িতে থাকবে তুমি। প্রয়োজন পড়লে কিছুদিন পরপর এসে আমরা বাবাকে দেখে যাবো। তাও তোমাকে এখানে একা রেখে আমি কোথাও যাবো না।’
আদিদের কাছে হার মেনে রুবি হোসেনকে রাজি হতে হলো। তিনি ফিরে গেলেন তার শহরের বাড়িতে।
আবার সেই বাড়িতে ঢুকে কেঁদে উঠলেন। কত স্মৃতি উনার এই বাড়ি জুড়ে। উনি ভুলতে পারবেন না কখনো। আজ নিজেকে অসহায় লাগছে, মনে হচ্ছে নিজের হাতের সুন্দর সম্পর্কগুলো ধ্বংস করেছেন। আর তার শাস্তিই হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাকে এইভাবে দিচ্ছেন।
অনেকদিন বাড়ি বন্ধ থাকায় অনেক ময়লা আবর্জনার স্তুপ পড়েছে বাড়িতে। আদিদ খবর দিয়ে বাইরে থেকে লোক আনাল, এসব পরিষ্কার করতে। সাথে তার বাড়ির পুরোনো কাজের লোকদেরও খবর দিল, আবার আসার জন্য।
.
.
রাণী পুরোটা দিন খুব অস্থিরতায় কাটাল। আদিদ এসেছে সেই খবর আরো অনেক আগেই পেয়েছে সে। কিন্তু পদ্ম’কে যে সে এটা বলবে সেই সাহসটুকুও পাচ্ছে না। পদ্ম সেদিনের পর থেকে খুব রেগে আছে। রাণীর সাথেও ভালো ভাবে কথা বলে না। অযথাই তার সাথে রাগ দেখায়। রাণী বুঝতে পারে পদ্ম ঐ ছেলের রাগ তার উপর মিটাচ্ছে, তাই সেও আর কিছু বলে না। কিন্তু আদিদ আসার খবর টা সে কোনোভাবেই পেটে রাখতে পারছে না। আর অন্যদিকে ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। বারবার পদ্ম’র রুমে উঁকি মেরে চলে আসছে। পদ্ম দু’দিন ধরে পাঠশালাতেও যাচ্ছে না। বাসায় সারাদিন তার ব্লকের কাজ করছে। অনিকও তাকে আর কল দেয়নি। পদ্ম ঠিক করেছে সে আর পাঠশালায় যাবে না। কিন্তু ঐ বাচ্চাগুলোর কথা মনে পড়লে কষ্ট লাগে তার। আবার ঐ অনিকের কথা মনে পড়লে রাগে তার গা রি রি করে উঠে। সে এতিম বলে, সবাই কি ভালোবেসে তাকে দয়া দেখায়? প্রয়োজন নেই, এই ভালোবাসা নামক দয়া তার লাগবে না। কারো কাছ থেকে লাগবে না, আদিদের কাছ থেকেও না।
সারাদিন ছটফট করতে করতে সন্ধ্যার পর রাণী লুকিয়ে অভিকে কল দেয়। তারপর সে ফিসফিসিয়ে অভিকে বলে,
‘অভি ভাই, আমাকে ডাক্তার সাহেবের সাথে একবার দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও না।’
অভি তাকে ধমক দিয়ে বসে,
‘তোর বাঁদরামো কি এখনো যায়নি, রাণী। আদিদ আসার কথা শুনে আবার শুরু করেছিস।’
‘আরে ভাই, তুমি বুঝতে পারছো না। আমার ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করতেই হবে। খুব জরুরি। প্লীজ, একটা ব্যবস্থা করে দাও।’
অভি রাণীর কথা বিশ্বাস করলো না। সে ভাবল রাণী হয়তো আবার আদিদ কে বিরক্ত করতে চায়ছে। তাই সে তাকে শাসিয়ে বললো,
‘দাঁড়া, আমি এক্ষুণি কল করে পদ্ম কে বলছি। পদ্ম’র হাতের কান মলা না খেলে তুই মানুষ হবি না।’
রাণী ভয় পেয়ে যায়। বলে,
‘না না, আপুকে বলো না প্লীজ। আচ্ছা আমি দেখা করবো না কিন্তু তাও আপুকে কিছু বলোনা।’
রাণী কলটা কেটে মন খারাপ করে বসলো। সে বুঝতে পারছে না আদিদের সাথে যোগাযোগ কী করে করবে। এতদিন তো আদিদ আসার অপেক্ষাতেই সে বসে ছিল। আদিদ আসবে আর সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পদ্ম আর আদিদের মিল করবে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, আদিদের সাথে যোগাযোগই করতে পারবে না সে। রাণী মন খারাপ করে বসে থাকে, আর ভাবতে থাকে কীভাবে কী করা যায়।
পরদিন সকালে মা’কে নিয়ে আদিদ তার হসপিটালে আসে। মায়ের অনেকগুলো টেস্ট করাবে সে। এসেই অন্যসব ডক্টরদের সাথে মায়ের টেস্টের ব্যাপারে কথা বলে সে। রুবি হোসেন সেসময় আস্তে আস্তে হেঁটে একটা কেবিনের সামনে যান। এই কেবিনেই পদ্ম’কে তিনি প্রথম দেখেন। এই একটা মেয়ে তাকে পুরো বদলে দিয়েছে, এই একটা মেয়ে তার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়ে, এই একটা মেয়েই তাকে আবার মানুষ হতে শিখিয়েছে। রুবি হোসেনের মনে তখন প্রশ্ন জাগে, “আচ্ছা, মেয়েটা কোথায়?” তিনি একবার তার সাথে দেখা করতে চান। তার কাছে ক্ষমা চাইতে চান। একবার জড়িয়ে ধরতে চান মেয়েটাকে। কিন্তু কোথায় সে?
আদিদ তার মায়ের পেছনে এসে বললো,
‘মা, তুমি এখানে কী করছো?’
রুবি হোসেন ঘুরে ছেলের দিকে তাকালেন। মৃদু সুরে বললেন,
‘পদ্ম কোথায় আছে আদিদ, তুমি কী জানো?’
আদিদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
‘উনাকে তোমার কী প্রয়োজন?’
রুবি হোসেন জবাবে বললেন,
‘আমি ওর কাছ থেকে ক্ষমা চাইবো।’
আদিদ দম ফেলে বললো,
‘ঠিক আছে, অভির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে আমরা উনার সাথে দেখা করবো।’
‘আজই আমি ওর সাথে দেখা করবো।’
আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,
‘আজ?’
‘হ্যাঁ, আজকেই।’
‘ঠিক আছে, তোমার টেস্টগুলো আগে শেষ হোক। তারপর নাহয় পদ্ম’র সাথে দেখা করা যাবে। এখন চলো আমার সাথে।’
চলবে…