#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৫|
অভির কাছ থেকে আদিদ পদ্ম’র ঠিকানা নিল। তারপর বিকেলের দিকে মা’কে নিয়ে আদিদ সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যেতে লাগল প্রায় আধ ঘন্টা।
কলোনির দুই নম্বর গলির সামনে এসে আদিদ গাড়ি থামাল। মা’কে বসতে বলে সে গাড়ি থেকে নামল। আশেপাশের কয়েকটা বাড়ির নেইমপ্লেট দেখল সে। অভির দেওয়া নামের সাথে তো কোনো নামই মিলছে না। সে আরো কিছুটা সামনে গেল। একটা সবজিওয়ালা দেখল, যে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করছিল। কলোনিগুলোর এই এক সুবিধা, এখানে রাতদিন চব্বিশ ঘন্টায়’ই কোনো না কোনো ভ্যানওয়ালা থাকবেই। আর এইসব ভ্যান ওয়ালার কদরও এখানে অনেক। নয়তো এই বিকেলে কেউ কি সবজি কিনতে বের হয়?
আদিদ বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না বলে ভ্যানওয়ালার কাছে গেল। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি কি রহিমা মঞ্জিল টা চিনেন?’
সবজিওয়ালা চিনল না। কিন্তু তার থেকে যে সবজি কিনছিল সেই মেয়েটার মনে হলো নামটা তার খুব পরিচিত।
সবজিওয়ালা চিনতে পারেনি বলে আদিদ ফিরে যাচ্ছিল। তখনই মেয়েটির মনে পড়ে, আরে! তারা যে বাড়িতে থাকে সেটার নামই তো রহিমা মঞ্জিল। সে পেছন ফিরে আদিদ কে ডেকে উঠে,
‘শুনুন।’
আদিদ চমকে পেছন ফিরে তাকায়। আর তার দৃষ্টি মেয়েটির উপর পড়তেই সে নির্বাক হয়ে যায়। মেয়েটিও বাকরুদ্ধ। সে কী সত্যিই দেখছে সামনে মানুষটাকে, নাকি এটাও তার কল্পনা? আদিদ বিস্ময় কাটিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে,
‘পদ্ম!’
পদ্ম’র বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ শব্দ করছে। চোখের পল্লব ফেলতে ভুলে গেছে যেন। মস্তিষ্কের স্নায়ু কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে কেবল ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। এমনটা কেন হলো? কেন সে আদিদ কে দেখল? আদিদ কেন এখানে এলো? কেন তাদের আবার দেখা হলো? খুব কি দরকার ছিল এসবের?
পদ্ম’র নিস্তব্ধতা দেখে আদিদ তার দিকে দু কদম এগিয়ে গেল। সরব গলায় বললো,
‘আমাকে চিনতে পারছেন না, পদ্ম? আমি আদিদ।’
পদ্ম ঢোক গিলল। বললো,
‘আপনাকে ভুলিনি আমি।’
থামল সে। খুব বেশি জড়তা কাজ করছে তার মাঝে। সে চোখ বুজে নিশ্বাস নিয়ে বললো,
‘ভালো আছেন?’
আদিদ মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘হ্যাঁ, ভালো আছি। আপনার কী খবর? শোনলাম আপনি আর রাণী নাকি আলাদা বাসায় থাকেন?’
‘জ্বি।’
আদিদ একটু থেমে বললো,
‘আমরা আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও পদ্ম ভদ্রতার খাতিরে বললো,
‘ঐ যে আমার বাসা। অভি ভাইয়াকে নিয়ে আমার বাসায় চলুন।’
‘অভি তো আসেনি।’
পদ্ম কিছুটা ভাবুক কন্ঠে বললো,
‘তাহলে আমরা বললেন যে?’
আদিদ কিছুক্ষণ চুপ থাকল। মায়ের কথা শুনলে পদ্ম’র রিয়েক্ট কেমন হবে সেটাই ভাবছে সে। অন্যদিকে আদিদকে চুপ থাকতে দেখে এক মিনিটের জন্য পদ্ম’র মনে হলো, আদিদ বিয়ে করে ফেলেনি তো? এখন হয়তো বউকে নিয়ে সে এখানে এসেছে। কথাটা ভাবতেই কেন যেন পদ্ম’র শরীর আষাঢ় হয়ে আসছিল। সে অস্থির হয়ে বললো,
‘কে এসেছে আপনার সাথে?’
আদিদ তার দিকে তাকাল। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
‘মা।’
পদ্ম তাকিয়ে রইল। আদিদ বললো,
‘মা, আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছেন পদ্ম।’
পদ্ম কোনো জবাব দিল না। মনের অশান্তি টা আরো বেড়ে গেল তার। পদ্ম কে চুপ থাকতে দেখে আদিদ এবার বললো,
‘বাবা মা’রা গিয়েছেন, পদ্ম। আর মা তার কর্মের ফল ভোগ করছেন। মা খুব কষ্টে আছেন। উনি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে চান। আর মা’র এই অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি বলে মা’কে নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। আশা করছি, আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন।’
পদ্ম মাথা নুইয়ে আস্তে করে বলে,
‘উনাকে নিয়ে আমার বাসায় চলুন।’
আদিদ কিছুটা স্বস্তি পেল। বললো,
‘আপনি দাঁড়ান, আমি মা’কে নিয়ে আসছি।’
আদিদ তার গাড়ির দিকে গেল রুবি হোসেনকে আনার জন্য। পদ্ম দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মানুষটা আগের মতোই রয়ে গেছে। এত বছর পরে এসেও সে আদিদের কাছে এখনো আগের মতোই গুরুত্বহীন। পদ্ম’র আজ খুব আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেন সে সেদিন আদিদের কাছে নিজের আবেগ প্রকাশ করেছিল? কেন সে নিজেকে শক্ত রাখতে পারেনি? কেনই বা আজও সে একইভাবে আদিদের জন্য কষ্ট পাচ্ছে, কেন..?
আদিদ মা’কে নিয়ে পদ্ম’র মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। রুবি হোসেনকে দেখে পদ্ম যেন চিনতেই পারেনা। কী থেকে কী হয়ে গিয়েছে। কোথায় গেল সেই সৌন্দর্য? মুখের চামড়া আজ ঝুলে গিয়েছে। চুলে পাঁক ধরেছে তার। এই কয়েক বছরের ব্যবধানে কী আমূল পরিবর্তন একটা মানুষের। পদ্ম রুবি হোসেনের চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারে, উনি কতটা কষ্ট আছেন। স্বামী কে হারিয়েছেন, ছেলের কাছ থেকেও এতদিন এতটা দূরে ছিলেন, কম মানসিক যন্ত্রণা পোহাননি উনি। কিন্তু এটাই হয়তো উনার পাপের ফল ছিল।
রুবি হোসেনের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
‘আমাকে ক্ষমা করবে পদ্ম?’
পদ্ম সঙ্গে সঙ্গে বললো,
‘ডাক্তারবাবু উনাকে নিয়ে আমার সাথে চলুন।’
“ডাক্তারবাবু” অনেকদিন পর এই শব্দ টা শুনে আদিদের মনের ভেতরে কেমন যেন একটা শান্তি লাগল। কিন্তু পদ্ম তার নিজের কথা শুনে বিরক্ত হলো। ডাক্তারবাবু বলাটা কি খুব জরুরি ছিল। সে বিরক্ত কন্ঠে আবার বললো,
‘আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।’
আর দুটো বাড়ির সামনেই পদ্ম’র বাসা। পুরোনো একটা বিল্ডিং। রঙ উঠে শ্যাওলা পড়ে আছে। একতলা বিল্ডিং এর পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট। একপাশে বাড়িওয়ালা আর অন্যপাশে পদ্ম’রা থাকে। পদ্ম দরজায় কলিং বেল দিলে রাণী এসে দরজা খুলে। রাণী প্রথমে স্বাভাবিক থাকলেও হঠাৎ পদ্ম’র পেছনে থাকা মানুষটাকে দেখে সে যেন আর স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। চেঁচিয়ে উঠল,
‘ডাক্তার সাহেব আপনিইইইইই!’
রাণী রীতিমতো লাফাচ্ছে। পদ্ম রেগে বললো,
‘কী শুরু করেছিস, উনাদের ভেতরে যেতে দে।’
রাণী খুশিতে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে দৌঁড়ে ভেতরে গেল। বিছানা টেনে টুনে ঠিক করলো। সোফা নেই ওদের তাই বিছানাতেই বসতে হবে। পদ্ম তাদের নিয়ে ভেতরে ঢুকল। তার হাতের সবজির ব্যাগ টা এক পাশে রেখে তাদের বললো,
‘আপনারা বসুন, আমি আসছি।’
পদ্ম রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি বসালো।
পদ্ম চলে গিয়েছে, এই সুযোগে রাণী অস্থির কন্ঠে আদিদ কে বলতে লাগল,
‘আপনি কেমন আছেন ডাক্তার সাহেব? আমাকে নিশ্চয়ই আপনি ভুলে গিয়েছেন? আমি কিন্তু আপনাকে ভুলিনি। আপুকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি আপনার কথা কতো বলি। আপনাকে যে আমি কত মিস করেছি তা বলার বাইরে। আচ্ছা, আপনার পাশে উনি কে? আপনার আম্মু?’
রুবি হোসেন তখন হেসে বললেন,
‘কী করে বুঝলে?’
রাণী দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘আপনাদের চেহারা মিলে।’
রুবি হোসেন খুশি হয়ে বললেন,
‘তাই! আচ্ছা মা, একটু পদ্মকে ডাকবে। আমি একটু ওর সাথে কথা বলবো।’
রাণী ছুটে রান্নাঘরে গেল। রাগী গলায় বললো,
‘তুমি এখানে কী করছো, আপু? তোমার শ্বাশুড়ি মা এসেছেন, যাও উনার সাথে গিয়ে কথা বলো।’
পদ্ম চোখ গরম করে রাণীর দিকে তাকাল। রাণী তখন বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো,
‘না মানে, উনি ডাকছেন তোমাকে।’
‘তুই চা’ টা দেখ। আমি যাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে, তুমি যাও।’
পদ্ম সেই রুমে এলো। রুবি হোসেন তখন ছোট্ট একটা ঢোক গিললেন। কীভাবে কী শুরু করবেন কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না। আদিদ মায়ের দিকে তাকাল। তার মা অস্বস্তিতে কিছু বলতে পারছে না সেটা সে বুঝতে পারলো। সে মায়ের হাতে হাত রেখে বললো,
‘মা, কী হলো?’
রুবি হোসেন শুকনো মুখে হেসে বললেন,
‘কিছু না।’
তারপর তিনি পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে হতাশ কন্ঠে বললেন,
‘আমাকে ক্ষমা করবে মা? আমি আর এই পাপের ভার কাঁধে নিয়ে চলতে পারছি না। নিজের পাপের জন্য নিজের স্বামীকে হারিয়েছি, ছেলের কাছ থেকে দূরে থেকেছি। এখন আর পারছি না, মা। খুব কষ্ট হয় এখন। শরীর, মন সব এখন দুর্বল হয়ে গিয়েছে, কোনরকমে বেঁচে আছি বলতে পারো। এখন আমার শেষ ইচ্ছে এইটুকুই যে, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, প্লীজ মা।’
পদ্ম উনার কাছে এগিয়ে এলো। উনার পায়ের সামনে বসলো। তারপর ধরা গলায় বললো,
‘যখন আপনার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়, তখন আমি ভেবেছিলাম আমি আরেকটা মা পেয়েছি। কোনোদিনও ভাবেনি আপনি আমার সাথে এমন করবেন। একটা ভয়ংকর সময় আমি পার করে এসেছি। এখনো সেই মুহুর্তগুলোর কথা ভাবলে আমার বুক কাঁপে। কষ্ট হয়। কিন্তু আমি পাষাণ হতে পারিনা। কেউ আমার সামনে দু ফোটা চোখের জল ফেললে আমি গলে যাই। তাই আজও পারলাম না। আপনার প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। নিজের ভুলের শাস্তি স্বরূপ অনেক কিছু হারিয়েছেন। এখন বাকি সময়টা ছেলেকে নিয়ে খুব ভালো থাকুন, এই দোয়াই করি।’
রুবি হোসেন মাথা নিচু করে পদ্ম’র মাথার উপর চুমু খেলেন। তারপর তিনি মাথা তুলে বলেন,
‘তোমার কাছে আর একটা জিনিস চাইবো মা, দিবে আমায়?’
পদ্ম জিজ্ঞেস করলো,
‘কী?’
রুবি হোসেন দ্বিধা ভরা কন্ঠে বললেন,
‘আমার সাথে আমার বাড়িতে থাকবে?’
মায়ের এমন প্রস্তাবে আদিদও অবাক হলো। পদ্ম উঠে দাঁড়াল। দ্বিমত পোষণ করে বললো,
‘এটা আর কোনোভাবেই সম্ভব না।’
রুবি হোসেন তখন বললেন,
‘তোমাকে আমি এমনি এমনি নিব না। পরিপূর্ণ সম্মান দিয়েই ঐ বাড়িতে নিয়ে যাবো।’
পদ্ম ব্রু কুঁচকে বললো,
‘মানে?’
রুবি হোসেন একবার আদিদের দিকে তাকালেন। আদিদ ও কপালে ভাঁজ ফেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘আমার ছেলের বউ করে তোমাকে আমি ঐ বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই, পদ্ম।’
চলবে…