#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৭|
আজ সকাল সকালই পদ্ম তার পাঠশালার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। পথিমধ্যে রোজগার মতো এক কাপ চা পান করতে ভুললো না সে। মন মেজাজ ভালো নেই, এই সময় চায়ের প্রয়োজন টা একটু বেশিই হয়।
পাঠশালায় পৌঁছে আজ আর বাচ্চাদের কাছে গেল না পদ্ম। সোজা সে গেল অনিকের অফিস রুমে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে অনিকের অনুমতি নিল। পদ্ম কে দেখে অনিক স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
‘আসুন।’
পদ্ম ভেতরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। অনিক লেপটপ টা সাইডে সরিয়ে পদ্ম’র দিকে তাকাল। তারপর বললো,
‘আপনি আর চাকরী টা করবেন না, তাই তো?’
পদ্ম অবাক হলো। সে ব্রু কুঁচকাল, বললো,
‘আপনি কী করে জানলেন?’
অনিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিন্তু এই দীর্ঘশ্বাস কে দীর্ঘ ক্লান্তি শ্বাসও বলা যায়। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। পদ্ম’র উপর গভীর দৃষ্টি ফেলে বললো,
‘আপনি আদিদ কে ভালোবাসেন। হয়তো নিজের রাগ আর অভিমানকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে উল্টো আপনি আপনার নিজের কষ্ট বাড়াচ্ছেন। ভালোবেসেও এখন স্বীকার করতে চাইছেন না। আপনাকে তো আমি সাহসী ভাবতাম, কিন্তু আজ তো মনে হচ্ছে আপনি ভীষণ ভীতু। যে ভালোবাসার কথা স্বীকার করতে পারে না সে কখনোই সাহসী হতে পারে না। আমি এই কয়দিনে আপনার প্রতি যা অনুভব করেছি তা কিন্তু বিনা দ্বিধায় আপনাকে বলে দিয়েছি। কারণ আমার মনে হয় এই জীবন টা খুব সংক্ষিপ্ত, আপনি একটা কথা বলবেন বলবেন করে ভাবতে ভাবতেই দেখবেন আপনার জীবনের পাতা ঝরার সময় চলে এসেছে। তখন আপনার আফসোস হবে, মনে হবে কেন সময় থাকতে বলেনি। তাই আমি কোনো আফসোস রাখতে চাই না। মনে যা এসেছিল বলে দিয়েছিলাম আপনাকে। আপনি না করেছেন, চলে গিয়েছেন। সবটাই স্বাভাবিক। আপনার জন্য তো আর আমার জীবন থেমে থাকবে না, তাহলে আমি কেন থেমে থাকব। তাই আমি আমার মতোই আছি। আর আপনাকে আমি এসব কথা কেন বলছি জানেন, যেন আপনার এইরকম আফসোস কখনো না হয়। কখনো যেন মনে না হয়, “ইশ, কেন সেদিন বললাম না।” দেখুন পদ্ম, আপনি আমি কেউই জীবনে একপাক্ষিক ভাবে সুখ নিয়ে বেঁচে নেই। সুখের সাথে একটা বিরাট অংশ জুড়ে আছে দুঃখও। তাই বলে কি, আমরা থমকে যাবো? পুরোটা জীবন দুঃখের শোকেই কাটিয়ে দেব? একদমই না। পরিস্থিতি যেমনই হোক তার মধ্যে থেকেও সুখটা খুঁজে বের করে নিবেন। কোনোদিন ভাববেন না, আমার জীবনে বুঝি আর সুখ আসবে না, আজীবন আমাকে এই দুঃখ নিয়েই থাকতে হবে। একটা কথা মনে রাখবেন, সুখ নিজ থেকে আসে না, সুখকে আনতে হয়। আপনার যখন যেটাতে সুখ মনে হবে, আপনি তখন ঠিক সেটাই করবেন। ডানে বামে এতকিছু ভাবতে হবে না। কী হবে এত ভেবে? জীবন একটাই পদ্ম, এই একটা জীবনেই আমাদের প্রাণ খুলে বাঁচতে হবে। এত হতাশা নিয়ে বাঁচা যায় না। এত রাগ, এত অভিমান করে কী লাভ। এসব কি আপনাকে সুখ এনে দিচ্ছে, দিচ্ছে না তো। সবকিছু ভুলে যান। যাকে ভালোবাসেন, তাকে টুপ করে বিয়ে করে নিন। জীবনে সহজ ভাবে বাঁচতে শিখুন। এত পেঁচিয়ে কোনো লাভ আছে, হু? আমার কথাগুলো ভেবে দেখবেন, পদ্ম। আশা করছি আপনার বোধগম্য হবে।’
পদ্ম কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। অনিক এবার একটা মোটা বাঁধাই করা খাতা বের করে বললো,
‘এখানে একটা সাইন করে দিন।’
পদ্ম খাতাটার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কী এটা?’
‘এখানে সাইন করলেই আপনি আজ থেকে মুক্ত। আপনাকে তখন আর এই চাকরী টা করতে হবে না।’
কথাটা বলে অনিক খাতাটা পদ্ম’র দিকে এগিয়ে দিল।পদ্ম খাতাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
‘না, আমি সাইন করবো না।’
অনিক মুচকি হেসে বললো,
‘তারমানে আপনি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছেন। যাক, শান্তি পেলাম। এবার আপনি আপনার বাচ্চাদের কাছে যান, ওরা আপনাকে এই কয়দিন না দেখতে পেয়ে পাগল হয়ে উঠেছে।’
পদ্ম উঠে যেতে নিয়েও আবার বসলো। বললো,
‘আচ্ছা, আদিদের কথা আপনি কী করে জানলেন?’
অনিক হালকা হেসে বললো,
‘অভি আমাকে সবকিছু বলেছে।’
পদ্ম আরো বেশি অবাক হলো এবার। অভি ভাই তো এসব ব্যাপারে কিছু জানতেন না। তাহলে উনাকে এসব কে বলেছে..ডাক্তারবাবু?
বাচ্চাদের পড়িয়ে পদ্ম আবার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। আজ তার হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছিল না বলে রিক্সায় চড়েছে। কিন্তু, বিরক্তিকর ব্যাপার হলো অর্ধেক পথে গিয়ে জ্যামে আটকাতে হলো তাকে। সকাল বেলা মেজাজ খারাপ থাকলে এখন তার মন ফুরফুরে। বাচ্চাদের দেখে মন হালকা হয়েছে তার আর অনিকের কথাগুলোও খুব ভালো লেগেছিল। সত্যিই তো, এই ক্ষুদ্র জীবন নিয়ে এত কিসের ভাবনা। নিজেকে সুখী রাখতে এখন থেকে সর্বস্ব টা করবে সে। তার ভাবনার মাঝেই জ্যাম টা ছাড়ল। ব্যাটারি চালিত রিক্সা টা সা সা করে ছুটে চললো। আর সেই বাতাসের দাপটে পদ্ম’র চুলগুলো উড়ছে। সেগুলো বারবার কানের পেছনে গুঁজে দিচ্ছিল সে। ভালো লাগছিল, মনটা হালকা লাগছিল তার। সে বাসায় ফিরলো। আসার পথে রাণীর জন্য ফুচকাও নিল। কালকে চ’ড় মা’রার পর থেকে মেয়েটা তার সাথে আর কথা বলছে না। মেয়েটার রাগ ভাঙাতে হবে। আর এই ফুচকাই তার একমাত্র অস্ত্র।
ফুচকা পাওয়া মাত্র সত্যি সত্যিই রাণীর সব রাগ ফুস হয়ে গেল। সে খুশিতে লাফাতে লাফাতে রান্নাঘর থেকে একটা বাটি এনে ফুচকা খেতে বসলো। পদ্ম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রাণীর খাওয়া দেখল। রাণী পদ্ম কে সাধলও না। একাই খেল সব ফুচকা। রাণীর খাওয়া শেষ হবার পর পদ্ম বললো,
‘এখন আর আমার উপর রেগে নেই তো?’
রাণী ভাব নিয়ে বললো,
‘শুধুমাত্র ফুচকা এনেছো বলে মাফ করে দিয়েছি, নাহলে জীবনেও মাফ করতাম না।’
পদ্ম খুশি হয়ে আদর করে রাণীর গালটা টেনে ধরলো। রাণী আর কিছু বললো না। পদ্মও কিছুক্ষণ চুপ রইল। অনেক ভাবনা চিন্তার পর সে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘রাণী, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
রাণী বললো,
‘জানি, তুমি পাঠশালার চাকরী টা আর করবে না। কথা তো বলতে গিয়েছিলে। তা তোমার স্যার কী বললো?’
‘আরে না, পাঠশালার কাজ আমি করবো। আমি অন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
রাণী ব্রু কুঁচকালো। বললো,
‘আবার কী সিদ্ধান্ত নিয়েছো?’
পদ্ম মাথা নুইয়ে ইতস্তত কন্ঠে বললো,
‘আমি ডাক্তারবাবুকে বিয়ে করবো।’
রাণী চেঁচিয়ে উঠার আগেই পদ্ম তার মুখ চেপে ধরলো, বললো,
‘চেঁচাস না, আমাকে আগে শেষ করতে দে।’
তারপর সে রাণীর মুখ ছেড়ে দিয়ে একটু শান্ত ভাবে বসলো। বললো,
‘বিয়ে করবো তবে এত সহজে না। ডাক্তারবাবু আগে নিজে থেকে আমাকে বিয়ের প্রপোসাল দিবে, তারপর আমি উনাকে বিয়ে করবো। এর আগে না।’
খুশিতে রাণীর চোখমুখ চকচক করছে। সে আহ্লাদ মাখা কন্ঠে বললো,
‘দিবে দিবে, ডাক্তার সাহেব নিজেই তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিবে। আর তার ব্যবস্থা আমিই করবো।’
পদ্ম কপালে চওড়া ভাঁজ ফেলে বললো,
‘কী করবি তুই?’
রাণী ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ইট’স সিক্রেট। বলা যাবে না।’
কথাটা বলেই রাণী খিলখিলিয়ে হাসল। আর পদ্ম বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রাণীর সেই হাসির দিকে।
চলবে…
(পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত।)