#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৮|
বিকেলের দিকে হঠাৎ করেই রাণীর খুব পেটে ব্যাথা উঠল। এমন ভয়ানক পেটে ব্যাথা আজ অবধি তার হয়নি। মেয়ে তো সেই ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলছে। পদ্ম কোনোভাবেই তাকে শান্ত করতে পারছে না। পেটে ব্যাথা হলে বেশি করে পানি খেতে হয়, সেই বিদ্যাও পদ্ম রাণীর উপর খাটিয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি, ওর ব্যাথা কমবার নামই নিচ্ছে না। রাণী আর সহ্য করতে না পেরে জোরে জোরে কাঁদছে। পদ্ম কী করবে বুঝতে পারছে না। আশেপাশে কোনো ফার্মেসীও নেই যে কোনোরকমে একটা ঔষধ এনে খাওয়াতে পারবে। পদ্ম উপায়ান্তর না দেখে একটা প্যারাসিটামল রাণীকে দিল। কিন্তু রাণী নাকি সেটা খাবে না। রাণী কাঁদতে কাঁদতে বললো, এই সামান্য ঔষধে তার পেটে ব্যাথা কমবে না, তাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে। হসপিটাল তাদের এই কলোনি থেকে অনেকটাই দূরে। পদ্ম কোনোভাবেই রাণীকে ঔষধ খাওয়াতে পারলো না। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তাকে রাজি হতে হলো। রাণী তখন আবার বললো, সে নাকি অন্য কোনো হসপিটালে যাবে না, সে আদিদের হসপিটালে যাবে। পদ্ম এবার কোমরে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
‘তুই ইচ্ছে করে এসব করছিস তাই না?’
রাণী আরো জোরে কেঁদে উঠল। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,
‘তোমার কাছে আমার এই কান্না নকল মনে হচ্ছে? অবশ্য তুমি কী বুঝবে আমার কষ্ট, ব্যাথা তো আমার হচ্ছে তাই আমি জানি কতটা বেদনাদায়ক এই ব্যাথা। থাক লাগবে না, আমি এমনিই সুস্থ হয়ে যাবো। আমাকে নিয়ে কষ্ট করে আর হসপিটালে যেতে হবে না।’
রাণীর এসব সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা শুনে পদ্ম বিরক্ত হলেও সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। তার মনে হচ্ছে রাণী সত্যিই নাটক করছে। কিন্তু তার অভিনয় এত নিখুঁত যে ধরার উপায় নেই।
রাণীর কান্নার বেগ বাড়লে পদ্ম কে এবার রাজি হতে হয়। সে রাণী কে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়। পথিমধ্যে পদ্ম তাকে কাছের একটা হসপিটালে নিতে চেয়েছিল কিন্তু রাণী বাচ্চাদের মতো ঝিম ধরে রিক্সার মধ্যেই বসে থাকে। সে কোনোভাবেই নামবে না। পদ্ম কে তখন রেগে মেগে আবার রিক্সায় উঠতে হয়। ত্রিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে তারা আদিদের হসপিটালে গিয়ে পৌঁছায়। পদ্ম রাণীকে ধরে নামিয়ে রিক্সার ভাড়া দেয়। রাণী এই প্রথম তার ডাক্তার সাহেবের হসপিটালে এসেছে। খুশিতে তার চোখ মুখ গদগদ। তবে পদ্ম’র সামনে সেটা সে প্রকাশ করছে না। সে পদ্ম কে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘আপু, আমাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে চলো; আমি আর এই ব্যাথা সহ্য করতে পারছি না।’
পদ্ম রাণী কে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে গিয়েই রাণী এদিক ওদিক তাকিয়ে মনে মনে আদিদ কে খুঁজতে লাগল। পদ্ম রাণীকে নিয়ে রিসিপশনে গেল। সেখানে গিয়ে সে একজন ভালো লিভার বিশেষজ্ঞের খোঁজ নিল। সেখান থেকে ডক্টরের খোঁজ নিয়ে তারা লিফট দিয়ে তিন তলায় উঠল। ডক্টরের চেম্বারের কাছে গিয়ে দেখল বেশ বড়ো সিরিয়াল। রাণী কে নিয়ে পদ্ম একটা সাইডে বসলো। রাণীর মন তো ঐদিকে হাঁসফাঁস করছে আদিদের সাথে দেখা করার জন্য। সে তখন ইনিয়ে বিনিয়ে পদ্ম কে বললো,
‘আচ্ছা আপু, ডাক্তার সাহেবের কেবিন টা কোন দিকে?’
পদ্ম ব্রু কুঁচকে ফেলল। বললো,
‘কেন?’
রাণী জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বললো,
‘আমাকে তো ডাক্তার সাহেব দেখলেই পারতেন। অযথা এই ডাক্তারের কাছে কেন নিয়ে এসেছো?’
পদ্ম তখন চোখ মুখ কুঁচকে অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বললো,
‘উনি একজন সার্জন, রাণী। উনি আপনার পেটের চিকিৎসা করতে পারবেন না। আর সব রোগের জন্যই আলাদা আলাদা বিশেষজ্ঞ আছেন। আপনাকে শুধু আপনার ডাক্তার সাহেবের কাছেই কেন যেতে হবে, শুনি?’
রাণী জবাব না দিয়ে মুখ কালো করে বসলো। পদ্মও আর কিছু বললো না।
পদ্মদের সিরিয়াল এলো। তাদেরকে ডাকা হলে সে রাণীকে নিয়ে ভেতরে গেল। চেয়ারে বসার পর ডক্টর পেশেন্টের সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। পদ্ম ডক্টর কে বললো, তার বোনের দুপুরের পর থেকেই অনেক পেটে ব্যাথা। কোনোভাবেই কমছে না, তাই বাধ্য হয়ে তাদের হসপিটালে আসতে হয়েছে। ডক্টর রাণীর দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলেন, এই যেমন কখন থেকে ব্যথা শুরু হয়েছে, পেটের ঠিক কোনদিকে ব্যাথা করছে, ব্যাথা ঠিক কতটা তীব্র..ব্লা ব্লা..
রাণী কী উত্তর দিবে। সে ভোমরা মুখে ডাক্তারের প্রশ্নে উল্টা পাল্টা উত্তর দিল। ডাক্তার বুঝলেন কিনা কে জানে। তিনি কতকগুলো টেস্ট লিখে দিলেন। যার মধ্যে ছিল আলট্রাসনোগ্রাফি, ব্লাড টেস্ট আর ই সি জি। রাণী বুঝলো না পেটের সাথে বুকের কী সম্পর্ক, আলাট্রাসনোগ্রাফি টা মানানসই কিন্তু ই সি জি কেন। পদ্ম রাণীকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে বললো,
‘চল, এবার টেস্টগুলো করিয়ে আনি।’
রাণী জোরে হাঁটা ধরে বললো,
‘জীবনেও না। আজাইরা যতসব ডাক্তার। একটু কোনো অসুখ হলেই একগাদা টেস্ট ধরিয়ে দেয়। আমার কোনো পেটে ব্যাথা নেই। তাই এসব টেস্ট করানোর কোনো প্রশ্নই আসে না।’
পদ্ম ঠোঁট চেপে হাসল। বললো,
‘ওমা, তোর পেটে ব্যাথা এত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেল। আমি তো ভেবেছিলাম এই পেটে ব্যাথা এই জীবনেও যাবে না। তা এত তাড়াতাড়ি কীভাবে ভালো হয়ে গেল, বলতো?’
রাণী বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
‘কেন, আমি সুস্থ হয়ে গেছি, তাতে তুমি খুশি নও?’
‘কী বলিস, খুশি না হয়ে যাবো কোথায়। তোর এত সুন্দর এক্টিং দেখে আমি জাস্ট মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি। এত ভালো এক্টিং কী করে করিস তুই?’
কথাটা বলেই পদ্ম হাসতে আরম্ভ করে। পদ্ম’র হাসি দেখে রাণী নাক মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘তোমার থেকেই শিখেছি। তুমিও তো সেদিন ডাক্তার সাহেব আর তার মা’র সামনে কী সুন্দর এক্টিং করলে। কেউ তোমার এক্টিং ধরতে পারেনি। আমি তো সেদিনই শিখেছিলাম, কীভাবে এক্টিং করে মানুষকে বোকা বানাতে হয়।’
পদ্ম রাগী গলায় রাণীকে বললো,
‘মার খাবি কিন্তু, রাণী।’
‘পরে খাবো। এখন আমাকে আগে ডাক্তার সাহেবের কেবিনে নিয়ে যাও।’
পদ্ম ভাব নিয়ে বললো,
‘আমি কেন নিয়ে যাবো? এত যখন তোর উনার সাথে দেখা করার ইচ্ছা, তো তুই নিজেই খোঁজে নে না তোর ডাক্তার সাহেবের কেবিন, আমাকে বলছিস কেন?’
রাণী ভেংচি কেটে বললো,
‘ঠিক আছে, দাঁড়িয়ে থাকো তুমি এখানে। আমি একাই যাবো।’
রাণী তাড়াতাড়ি রিসিপশনে গেল। সেখান থেকে ডক্টর আদিদের কেবিনের খোঁজ বের করে ফেলল সে। খুশিতে সে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটল সেদিকে। আদিদের কেবিনের সামনে গিয়ে দেখল সেখানেও অনেক মানুষ। সে সেখানের স্টাফের সাথে কথা বললে স্টাফ তাকে জানাল, সন্ধ্যা সাত’টার আগে আদিদের সাথে কোনোভাবেই দেখা করা যাবে না। এখন বাজে মাত্র পাঁচ টা। ছয় টা, সাত টা আরো দুই ঘন্টা। এতক্ষণ পর্যন্ত তো জীবনেও পদ্ম তার জন্য অপেক্ষা করবে না। রাণী স্টাফ কে অনেকভাবে রিকোয়েস্ট করলো, একবার তাকে ভেতরে যেতে দেওয়ার জন্য। কিন্তু স্টাফ তার কথায় পাত্তা না দিয়ে সে তার কাজে মনোনিবেশ করলো। রাণী কাঁদো কাঁদো মুখে তখন তাকিয়ে রইল আদিদের কেবিনের দরজার দিকে। পদ্ম এসে তার পেছনে দাঁড়াল। বললো,
‘কী হলো, ভেতরে যেতে দিচ্ছে না বুঝি?’
রাণী না সূচক মাথা নাড়াল। পদ্ম ঠোঁট উল্টে ভেঙানোর ভঙ্গিতে বললো,
‘আহারে!’
রাণী হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পদ্ম স্টাফের কাছে যায়। স্টাফ তাকে দেখেই হেসে বলে,
‘ভালো আছেন, আপা?’
পদ্মও হেসে বললো,
‘জ্বি ভালো। আপনি ভালো আছেন?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। অনেকদিন পর আপনারে দেখলাম। দেইখা অনেক ভালো লাগল। আপনি কি আদিদ স্যারের সাথে দেখা করতে আইছেন, স্যার কে বলমু?’
পদ্ম তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
‘না না, থাক। উনি এখন উনার পেশেন্টদের নিয়ে ব্যাস্ত। উনি ফ্রি হলেই আমরা উনার সাথে দেখা করবো।’
‘আচ্ছা, তাইলে আপনি ঐদিকে বসেন। স্যার ফ্রি হলে, আমি বলমু।’
‘ঠিক আছে। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, এখানে যে একজন নার্স ছিলেন, নাম শিমু; উনি কি এখানে নেই? উনাকে দেখছি না যে?’
‘না, শিমু আপা তো এখন আর এখানে কাজ করেন না। উনি উনার ফ্যামিলি নিয়ে অন্য জায়গায় চইলা গেছেন।’
পদ্ম’র কিছুটা মন খারাপ হলো। সে আবার রাণীর কাছে ফিরে গেল। রাণী তখন রাগান্বিত কন্ঠে তাকে বললো,
‘তোমাকে স্টাফ দেখা করার কথা বলছিল আর তুমি না করে দিলে? কেন? এখন বসে থাকো দুই ঘন্টা। ধুর, ভাল্লাগেনা।’
পদ্ম গিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। তারপর ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,
‘ভালো না লাগলে চলে যা, কে তোকে এখানে থাকতে বলেছে?’
রাণী পদ্ম’র কথায় পাত্তা না দিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলো। তারপর তার কাঁধে মাথা রেখে বললো,
‘আমি ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা না করে যাবো না।’
‘কী করবি দেখা করে?’
পদ্ম তাকে প্রশ্ন করলো। রাণী জবাবে বললো,
‘তোমাকে বলা যাবে না।’
চলবে…