#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৪৯|
আদিদ গম্ভীর গলায় বললো,
‘আপনার কী সমস্যা রাণী? আপনি চুপ করে আছেন কেন?’
রাণী ঘনঘন চোখের পল্লব ফেলল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
‘জানেন কী হয়েছে?’
আদিদ টেবিলের উপর কিছুটা ঝুঁকে বললো,
‘না বললে কী করে জানবো?’
রাণী মুখ কালো করে বললো,
‘ঐ অনিক পদ্ম আপুকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে। আর আমার মনে হচ্ছে, আপু বোধ হয় এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে।’
আদিদ ভীষণ বিরক্ত হলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললো,
‘হোক রাজি। আমার কী তাতে।’
রাণী উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
‘আপনার কিচ্ছু না, ডাক্তারসাহেব? আপনি না আপুকে পছন্দ করেন?’
আদিদ কপাল কুঁচকে ফেলল। ক্ষেপে গিয়ে বললো,
‘আমি কখন বলেছি আমি আপনার আপুকে পছন্দ করি?’
‘না বললেও আমি বুঝি।’
আদিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বললো,
‘আপনি বেশি বুঝেন। এত বোঝা ভালো না। তা আপনি কি এখানে একাই এসেছেন?’
রাণী মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘না, আপুও এসেছে।’
‘তো উনি কোথায়?’
‘আপনার উনি বাইরে বসে আছেন।’
রাণীর কথা শুনে আদিদ নাকের পাল্লা ফুলিয়ে কাটকাট গলায় বললো,
‘আমার উনি কী আবার?’
রাণী জবাব না দিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসল। আদিদ নিজেকে শান্ত করে বললো,
‘উনার কি ভেতরে আসতে অসুবিধা হচ্ছে, বাইরে বসে আছেন কেন?’
রাণী খুব সিরিয়াস ভাব নিয়ে বললো,
‘আপু বলেছে, সে নাকি দিনকে দিন খুব সুন্দর হয়ে যাচ্ছে আর তার মনে হচ্ছে আপনি নাকি তাকে দেখে প্রেমে পড়ে যেতে পারেন তাই সে আপনার সামনে আসবে না। আর আপনি তার প্রেমে পড়লে তার অনিকের কী হবে? ঐ বেচারা তো খুব কষ্ট পাবে, তাই না?’
আদিদ জানে রাণী মজা করছে। পদ্ম’র কথা বার্তার ধরণ তার জানা আছে। সে জানে পদ্ম কখনোই এভাবে বলবে না। সে তখন তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘চলুন, আপনার আপুর সাথে কথা বলে আসি। দেখি, উনাকে দেখে আরো একবার প্রেমে পড়তে পারি কিনা?’
রাণী মুখ চাপড়ে হেসে বললো,
‘প্রেমে না পড়লেও আমি জোর করে ফেলে দিব।’
আদিদ সেই কথা শুনলো না। সে বাইরে গেল। গিয়ে দেখল তার কেবিনের বাইরের বেঞ্চ’টা তে পদ্ম মাথা ঝুঁকে বসে আছে। আদিদ গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। পকেটে দু হাত গুঁজে গম্ভীর গলায় ডেকে উঠল,
‘পদ্ম!’
হঠাৎ কারোর ডাকে চমকে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল। আদিদ যেহেতু তার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তাই সে উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো সে আদিদের খুব কাছে চলে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে দু কদম পিছিয়ে আবার বসে পড়ল সে। আদিদ তার কান্ড দেখে বিরক্ত হলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
‘সমস্যা কী আপনার?’
পদ্ম শক্ত কন্ঠে বললো,
‘আমার কী সমস্যা হবে?’
‘তাহলে এখানে কেন বসে আছেন?’
পদ্ম হঠাৎ কী উত্তর দিবে বুঝতে পারে না। এখানে কেন বসে থাকে মানুষ? এমনি। কিন্তু তার এখানে এমনি বসে থাকাটা মানায় না। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,
‘এখানে কি বসা মানা আছে নাকি?’
আদিদ দু হাত বুকের উপর ভাজ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পদ্ম’র দিকে তাকাল। আদিদের এমন দৃষ্টিতে পদ্ম যেন বিব্রত বোধ করতে লাগল। সে চোখ নামিয়ে ফেলল। আদিদ বললো,
‘ভেতরে গিয়েও তো বসতে পারতেন। রাণী একা গেল অথচ আপনি গেলেন না, কেন? এত কিসের রাগ আপনার আমার উপর? এমন তো নয় আমি আপনাকে ভালোবেসে ধোঁকা দিয়েছি, আপনাকে ঠকিয়েছি। তাহলে আমার সাথে এই ব্যবহারের কারণ কী? আমাকে আপনি সেদিনও কিছু বলার সুযোগ দেননি। অপমান করেছিলেন। আপনি বলুন তো, আমি কি সত্যিই আপনার সেই অপমানের যোগ্য ছিলাম? আমি কি আপনার জন্য কিচ্ছু করেনি, পদ্ম? এইটুকু উপকারও কি আপনি আমার কাছ থেকে পাননি? আমি মানছি আমার মা বাবা অনেক অন্যায় করেছেন, তার জন্য উনারা শাস্তিও পেয়েছেন। আমার বাবা মা’রা গিয়েছেন, আর আমি সেটা জানতামই না। সেদিন জেনেছি সেটা। আমার মা একা এতদিন গ্রামে পড়েছিলেন। ছেলে, স্বামী সবাইকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন উনি। ঐ মানুষটাকে নিয়ে আমি জোর করে শহরে আসি। মা তো, যতই অন্যায় করুক, ফেলে তো আর দিতে পারবো না। আর উনি এসেই জেদ ধরেন, আপনার সাথে দেখা করবেন, আপনার কাছে ক্ষমা চাইবেন। তাই উনাকে আমি আপনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম না উনি সেখানে গিয়ে এমন কোনো প্রস্তাব দিবেন। আর সেই প্রস্তাবের বিপরীতে যে আপনিও এতটা রিয়েক্ট করবেন সেটাও আমি আশা করিনি। আপনার মত না’ই থাকতে পারে, তাই বলে কি ওভাবে রিয়েক্ট করতে হবে? এমনটা তো নয় আমি জোর করে আপনাকে বিয়ে করছি, তাহলে? (একটু থেমে) পদ্ম, আপনি আমার কাছে আমার আর পাঁচটা পেশেন্টের মতো নন। আপনার সাথে না চাইতেও আমি অনেক কিছুর জন্য নানাভাবে জুড়ে গিয়েছি। সেদিনের আপনার ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট আজ আপনার আর আমার জীবনে এত বড়ো প্রভাব ফেলেছে। সেই এক্সিডেন্ট টা না হলে হয়তো কখনোই আপনার সাথে আমার পরিচয় হতো না, আর না এত সব কিছু হতো। তবে শুনেছি যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। সবকিছুরই একটা উদ্দেশ্য আছে। হয়তো আপনার সেই এক্সিডেন্ট টাও একটা উদ্দেশ্যেই হয়েছিল। সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই পদ্ম, আপনি যতটা স্ট্রং থাকতে পেরেছেন, আমি সেটা পারিনি, পদ্ম। বিদেশ যাওয়ার পর পরই অনেক বেশি ভেঙে পড়েছিলাম। মা, বাবা, সুজানা সবার কথা খুব মনে পড়তো। আর কেন জানি তখন আপনার জন্যও আমার মায়া হতো। চোখ ভুজলেই আপনার ভেজা চোখগুলো আমি দেখতে পেতাম। সেদিন এত কেন কেঁদেছিলেন, পদ্ম? আপনি জানেন, আপনার সেই ক্রন্দনরত চোখ আমার মনে কতটা অপরাধ বোধ জাগিয়েছিল? শান্তি পাইনি আমি, সব ছেড়ে দূরে গিয়েও শান্তি পাইনি। আর আজ মনে হচ্ছে, আমার সেই অশান্তির কারণ টা আপনি। যবে থেকে আপনার সাথে দেখা হয়েছে তবে থেকেই আমার জীবন অশান্ত হয়ে উঠেছে। এত জ্বালান কীভাবে, বলুন তো? আমি তো ভাবছি ঐ বেচারা অনিকের কথা। ছেলেটার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে। না জানি বিয়ের পর আপনি তার কী অবস্থা করেন!’
পদ্ম আদিদের সব কথা গিলতে পারলেও লাস্টের কথাটা গিলতে পারলো না। অনিকের বিয়ের কথা এখানে কোথ থেকে আসছে? আর অনিক কে এই ভদ্র লোক চিনলই বা কীভাবে? পদ্ম এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘অনিক স্যার কে আপনি কীভাবে চিনেন?’
আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,
‘অনিক স্যার মানে?’
‘মানে, আমি যে পাঠশালাতে পড়ায় উনি সেখানকার মালিক, সেক্ষেত্রে আমার স্যার। কিন্তু আপনি উনার কথা জানলেন কী করে, অভি ভাইয়ের কাছ থেকে?’
আদিদ তখন চোখ ঘুরিয়ে রাণীর দিকে তাকাল। রাণী তাকে ইশারা দিয়ে “না” করছে। আদিদ বুঝলো ব্যাপারটা। তাই সে বললো,
‘হ্যাঁ, অভি বলেছে।’
‘আর বিয়ের কথা কী বলেছিলেন?’
আদিদ বললো,
‘কিছু না।’
পদ্ম ঠোঁট গুঁজ করে সরু চোখে তাকাল। সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে। সে পরক্ষণেই আবার ঠিক হলো। মনে পড়ল আদিদ তাকে এত কিছু শুনালো অথচ সে কিছু বলতেই পারেনি। সে ঝাঁঝাল কন্ঠে আদিদ কে বললো,
‘সরে দাঁড়ান।’
আদিদ দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বললো,
‘কী হয়েছে?’
পদ্ম উঠে দাঁড়াল। চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
‘আপনি তখন কী বলছিলেন, আমি আপনাকে জ্বালিয়েছি? আমার জন্য আপনার জীবনে অশান্তি? যত সমস্যার মূল, আমি? আর আপনি কী, দুধে ধোয়া তুলসী পাতা? আপনার জন্য আমাকে সমস্যায় পড়তে হয়নি? আমার জীবনের উপর দিয়ে কি কম ঝড় গিয়েছে? আমি কি ভালো থাকতে পেরেছি? আপনি আমাকে আরো বেশি কষ্ট দিয়েছেন। এত পাষাণ কী করে হন বলুন তো? আমাকে এত কষ্ট দিয়ে এখন সব দোষ আমাকে দিচ্ছেন? সেদিন আপনি কেন বলেছিলেন, অপেক্ষা করার কথা? কেন বলেছিলেন, আপনার ঝিলে যখন একদিন পদ্মফুল প্রয়োজন হবে তখন আপনি এই পদ্মফুলকে নিতে আসবেন, কেন? আমি তো জানতাম আপনার ঝিলে কোনো পদ্মফুলের প্রয়োজন নেই। কারণ সেই ঝিলের পানি শুকিয়ে সেখানে এখন ক্যাকটাস গাছ উঠেছে। তাই তার কথায় এখন এত কাঁটা ফুটে।’
পদ্ম’র কথা শুনে আদিদের কেন যেন খুব হাসি পাচ্ছিল। সে কোনোরকমে সেটা কন্ট্রোল করলো। তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘পদ্মফুল চাইলে কিন্তু সেই ক্যাকটাস সরিয়ে নিজে তার জায়গা দখল করতে পারতো। কিন্তু আমার মনে হয়, সেই পদ্মফুল এখন অন্য কারোর ঝিলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
পদ্ম রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,
‘কী বলতে চান আপনি? সরাসরি বলুন।’
আদিদ তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো,
‘বলেছি তাড়াতাড়ি বিয়ে করুন, বুড়ি হয়ে যাচ্ছেন তো।’
পদ্ম’র রাগ তড়তড়িয়ে মস্তিষ্কের স্নায়ুতে পৌঁছে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘নিজের বয়সের হিসাব নেই আসছে আমাকে বুড়ি বলতে। আপনি তো চৌত্রিশ বছরের বুড়ো, আপনার বয়সী আপনার বন্ধুর একটা এক বছরের বাচ্চাও আছে আর আপনি এখনো বিয়েও করেনি। দেখা যাবে যে আপনার বিয়ে হয়ে বাচ্চা হতে হতে আপনার বন্ধু নাতি নাতনীদেরও মুখ দেখে ফেলবে, সেই লোক এসেছে আবার আমাকে বুড়ি বলতে।’
পদ্ম’র কথার পরপরই রাণী খুশ মেজাজে বলে উঠল,
‘এই আপু, এই বুড়ি বুড়োর কম্বিনেশন টা কিন্তু খুব মানাবে।’
পদ্ম রাণীর দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বললো,
‘থা’প্পড় খাবি?’
রাণী মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘না, কিছু খাবো না। আমার পেট ভরা।’
আদিদ এবার বললো,
‘রাণীর সাথে আর রাগ দেখাতে হবে না। আমার রাগ ঐ বেচারির উপর ঝেরে কী লাভ? তার চেয়ে বরং একটা সমঝোতায় যাওয়া প্রয়োজন।’
পদ্ম বিরস মুখে বলে,
‘কিসের সমঝোতা?’
আদিদ তার হাতের ঘড়ির দিকে একবার তাকাল। তারপর বললো,
‘আমার লেসার টাইম শেষ। এখন আর কোনো কথা বলতে পারছি না, সরি। কাল বিকেলে ফ্রি থাকলে বলবেন, ডিটেইলসে সবকিছু বলবো।’
এই বলে আদিদ হনহনিয়ে তার কেবিনে চলে গেল। তার যাওয়া দেখে পদ্ম ফুঁসে উঠে বললো,
‘ভাব দেখে বাঁচা যায় না।’
তারপর সে আর রাণীও বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
চলবে…
(মনে হচ্ছে রাইটার্স ব্লকে আছি। একেবারেই লিখতে পারছি না😥)