#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।১০।
পদ্ম সিঁড়ির কাছে গিয়ে হালকা উঁকি দিল। সোফার রুমে সুঠাম দেহী এক ভদ্রলোক-কে তখন দেখল সে। তাহলে উনি’ই ডাক্তারবাবুর বাবা। ভদ্রলোকের যে বয়স হয়েছে সেটা উনাকে দেখে বোঝার যো নেই। সেই কী কঠিন ভাবভঙ্গি উনার। স্বামী স্ত্রী দুজনেই হয়েছেন সমান তালে সুদর্শন সুদর্শনা। আর উনাদের ছেলে…তাকে নিয়ে পদ্ম আর কিছু ভাবল না। তার তো দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়। ভদ্র লোক বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ। আসার পর থেকেই রুবি হোসেন তাকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু উনি আদৌ উনার কথা শুনবেন কিনা কে জানে। এতক্ষণ তো হয়ে গেল, এখনো তো তিনি পদ্ম’র সাথে দেখা করার কথা বলছেন না। পদ্ম উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল টেনশন’ই করছে। নিচের কথোপকথন কিছুই সে শুনতে পারছে না। কিছু শুনলে তো অন্তত এইটুকু বুঝতে পারতো আবহাওয়া গরম না ঠান্ডা।
পদ্ম তার রুমে ফিরে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ছয়’টা বাজে। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। সূর্য হারিয়ে গিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। এর মাঝেই গাড়ির হর্ণ শুনতে পেল সে। দৌড়ে বারান্দায় গেল। বড়ো গেইট’টা আবার খুলতে দেখেই কেন যেন খুব খুশি লাগল তার। গেইট খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরে প্রবেশ করলো কালো রঙের একটা গাড়ি। ডাক্তারবাবু চলে এসেছেন। এবার যেন কিছুটা হলেও সাহস পাচ্ছে সে। সে তার রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে ভালোভাবে খেয়াল করে মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নেয়। পরে হঠাৎ তার মনে হলো, এসব কেন করছে সে। ডাক্তারবাবু এসেছে এটা নিয়ে এত খুশি হওয়ার কী আছে। পদ্ম নিজেকে নিজে ধমক দিয়ে উঠে, “নিজের লিমিট ক্রস করিস না পদ্ম, ভুলে যাস না তুই এই বাড়ির আশ্রিতা।”
নিজের মনকে বুঝিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। মনে মনে বলে, “ঐসব প্রেম ভালোবাসা তোর জন্য না পদ্ম। তোর তো দু বেলা পেট ভরে খেতে পারলেই চলে।”
অনেকটা সময় রুমে বসে কাটানোর পর পদ্ম’র মনে হলো এবার একটু বাইরের খবর’টা নেওয়া উচিত। কী জানি বাইরে কী হচ্ছে। পদ্ম বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতেই সিঁড়ি থেকে কিছু মানুষের গলা শুনতে পেল সে। তার মানে সবাই উপরে উঠছে। পদ্ম এক দৌড়ে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে। কথার শব্দগুলো আস্তে আস্তে আরো কাছে আসতে থাকে। এক সময় তার দরজার সামনে এসেই সবকিছু নিরব হয়ে যায়। তখন রুবি হোসেনের ঠান্ডা গলার স্বর শোনা গেল,
‘পদ্ম, আসবো?’
পদ্ম ছোট্ট ঢোক গিলে বললো,
‘জ-জ্বি বড়ো মা, এসো।’
সবাই একে একে ভেতরে ঢুকল। পদ্ম ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল যেন। সে অপরাধীর মতো এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল। অস্বস্তিতে সামনের মানুষগুলোর দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। রুবি হোসেন বললেন,
‘ওই হচ্ছে পদ্ম। ওর কথায় তোমাকে বলেছিলাম। ভারি মিষ্টি না মেয়েটা?’
আলী আকবর হোসেন পদ্ম’র আপাদমস্তক পরখ করে নিয়ে বললেন,
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। তা মা, কেমন আছো তুমি?’
পদ্ম চমকে তাকাল। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘জ্বি আংকেল, ভালো। আপনি ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ, আমিও খুব ভালো আছি। তোমার কথা রুবি আমাকে সব বলেছে। শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছে জানো তো। এইরকম একটা মেয়েকে কেউ এত কষ্ট দেয়। তবে তুমি চিন্তা করো না, এখন থেকে তোমাকে আর কোনো কষ্ট পেতে হবে না। এই বাড়িতে তুমি আমাদের মেয়ে হয়ে থাকবে।’
পদ্ম বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। উনি এত সহজে সবটা মেনে নিলেন? একটুও রিয়েক্ট করলেন না? এই মানুষগুলোকে পদ্ম যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। আজ কালকার পৃথিবীতে এত ভালো মানুষ হয়?
পদ্ম বিনয়ের সুরে বললো,
‘আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আপনারা ভীষণ ভালো মানুষ। আপনাদের মতো মানুষ আছে বলেই হয়তো আমাদের মতো অসহায়েরা এখনও পৃথিবীতে বেঁচে আছে।’
‘এইভাবে বলছো কেন মা? আমাদের মেয়ে হলে আমরা দেখতাম না তাকে? তাহলে তোমাকে দেখতে কেন অসুবিধা হবে। এই বাড়ি’টাকে নিজের মনে করে থাকো। আর কোনো কিছুতে কোনো লজ্জা পেতে হবে না, ঠিক আছে?’
পদ্ম মাথা হেলিয়ে বললো,
‘আচ্ছা।’
‘ঠিক আছে তাহলে, তুমি থাকো আমি একটু রুমে গিয়ে রেস্ট নেই।’
‘আচ্ছা আংকেল।’
রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব পদ্ম’র রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। রয়ে গেলে কেবল ডাক্তারবাবু। পদ্ম তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিল। আদিদ বললো,
‘শরীর ঠিক আছে আপনার, মাথায় আর কোনো ব্যথা নেই তো?’
‘না, এখন একদম ঠিক আছি।’
‘আচ্ছা। আর এই বাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা বা কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’
‘একদমই না।’
‘হুম, মা বলেছে, আপনি আসার পর থেকে নাকি মায়ের সময় খুব ভালো যাচ্ছে। আপনি নাকি মায়ের খুব খেয়াল রাখেন, শুনে ভালো লাগল।’
পদ্ম মাথা নিচু করে আলতো হাসল। আদিদ আবার বললো,
‘উম, তাহলে আমিও এবার যাই আমার রুমে। ফ্রেশ হতে হবে।’
পদ্ম চোখের পল্লব তুলে তাকাতেই আদিদের পিঠ দেখতে পেল। সে ইতিমধ্যেই রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। পদ্ম ভারি নিশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে। মন যে তার কেন এমন করছে কে জানে। পদ্ম মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “আমার এই মনের অসুখ কে সারাবে, ডাক্তারবাবু?”
পদ্ম রান্নাঘরে। খুব যত্ন করে দু কাপ কফি বানাল সে। তারপর কাপ দুটো স্ট্রে’তে নিয়ে উপরে গেল, আদিদের রুমে। দরজায় টোকা দিয়ে বলেলো,
‘আসবো?’
‘হুম।’
অনুমতি পেয়ে পদ্ম ভেতরে যায়। অদ্ভুত ভাবেই সামনের মানুষটিকে দেখা মাত্রই অক্ষিজোড়া তার থেমে যায়। কিছুক্ষণ সেই দৃষ্টি আটকে থাকে সেখানেই। মস্তিষ্কে নিউরনগুলো জেগে উঠতেই বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ করে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃষ্টি সংকোচন করে নেয় সে। মস্তিষ্ক নতুন কোনো কিছু হঠাৎ করে দেখতে অভ্যস্ত নয়। ডাক্তারবাবুর এই নতুন সাজ মস্তিষ্কে তাই সেট হতে কিছুক্ষণ সময় লাগবে। সবসময় ফর্মাল গেট আপে দেখা মানুষটাকে আজকে হঠাৎ একটা টাউজার আর টি শার্টে মোড়ানো দেখে অন্যরকম লাগছে। লাগাটাই অবশ্য স্বাভাবিক।
পদ্ম কফি নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে এগিয়ে যায়। গিয়ে বলে,
‘কফি, ডাক্তার বা…ড-ডাক্তার সাহেব।’
আদিদ ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেশ ফুটিয়ে বললো,
‘থ্যাংক ইউ, এটার খুব প্রয়োজন ছিল।’
পদ্ম প্রতিত্তুরে তাকে ধন্যবাদ জানাল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে আদিদ বললো,
‘বাহ! দারুণ হয়েছে তো।’
‘সত্যি!’
পদ্ম’র কন্ঠে খানিক উত্তেজনা। আদিদ আরেকবার চুমুক দিয়ে বললো,
‘হ্যাঁ। আপনি খাচ্ছেন না কেন?’
পদ্মও তখন কফির কাপে চুমুক দিল। আদিদ তার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এখানে বসে খান।’
পদ্ম বসলো। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে এবার সে আদিদের পুরো রুম’টা চোখ বুলালো। যেহেতু সে এই রুমে প্রথম এসেছে তাই এখানের সবকিছুই তার কাছে নতুন লাগছে। তবে হঠাৎ করেই একটা জিনিসের দিকে তার চোখ আটকে গেল। কফি খাওয়া রেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিছানার ডান দিকের দেয়ালে কিছু দেখেছে সে। কারো ছবি। একটা মেয়ের ছবি। পদ্ম কাছে গিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে ছবিগুলো। মস্তিষ্কে জোর দিতেই তার মনে পড়ল এটা তত সেই মেয়েটা যার ছবি সে বিকেলে ঐ বইটা থেকে পেয়েছিল। এই মেয়েটার ছবি ডাক্তারবাবুর রুমের দেয়ালে কী করছে? মেয়েটা ডাক্তারবাবুর কী হয়? খুব কাছের কেউ? পদ্ম পেছন ফিরে আদিদের দিকে তাকাল। আদিদ কফি খাচ্ছে আর ল্যাপটপে কি কী যেন করছে। পদ্ম তখন নিজের মনকে স্থির করে আদিদ-কে ডেকে উঠলো,
‘ডাক্তার সাহেব, এই মেয়েটা কে?’
আদিদ তাকাল তার দিকে। তারপর আবার তাকাল দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টিপাত করলো। পদ্ম উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আদিদের জবাবের অপেক্ষা করছে। আদিদ মৃদু সুরে বললো,
‘ও সুজানা, আমার গার্লফ্রেন্ড।’
পদ্ম অবাক হলো না। ঘুরে দেয়ালের সেই ছবিগুলোর দিকে আবার তাকাল। মেয়েটা সুন্দর। অনেক বেশিই সুন্দর। ডাক্তারবাবুর সাথে তাকে খুব মানিয়েছে। নিশ্চয়ই উনি মেয়েটাকে খুব ভালোবাসেন নয়তো এত যত্ন করে দেয়াল জুরে উনার ছবি লাগাতেন না। পদ্ম হেসে হেসে বললো,
‘আপু’টা খুব সুন্দর। একদিন উনার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েন।’
আদিদ বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
‘যদি কোনোদিন খুঁজে পাই, তবে অবশ্যই করাবো।’
আদিদের কথার মানে পদ্ম বুঝতে পারলো না। সে ব্রু কুঁচকে বললো,
‘খুঁজে পাবেন মানে?’
চলবে…