#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।১১।
আদিদ পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো,
‘ও হারিয়ে গিয়েছে।’
পদ্ম’র কুঁচকানো ব্রু যুগল এখন আরো কিছুটা কুঁচকে গেল। সে অবাক কন্ঠে বললো,
‘মানে?’
‘মানে সুজানা-কে আমি হারিয়ে ফেলেছি। ও গত এক বছর যাবত নিখোঁজ। অনেক খুঁজেছি, ইনফ্যাক্ট এখনও খুঁজে যাচ্ছি। কিন্তু…কিন্তু ওকে আমি পাচ্ছি না। পুলিশ কেইসও হয়েছিল। অনেক তদন্ত আর খোঁজা খুঁজির পর তারাও হার মেনে নিয়েছে। আর ওর মা বাবা, উনারা তো এখন পুরো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। একটা মাত্র মেয়ে উনাদের। মেয়েকে হারিয়ে যেন পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছে উনাদের। আর আমি..সুজানার সবথেকে পছন্দের মানুষ। যেই মানুষটাকে সে একা ফেলে রেখে হারিয়ে গিয়েছে। জানেন তো, খুব করে চাই ও আবার ফিরে আসুক। কিন্তু আমার এই আশাটা আদৌ পূর্ণ হবে কিনা জানি না।’
আদিদ থামল। গলা ধরে এসেছে তার। সে এক টানে পুরো কফি শেষ করলো। তারপর আবার পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো,
‘কিছু মনে না করলে, আপনি এখন আসতে পারেন। আমি একটু একা থাকতে চাই।’
পদ্ম কিছু না বলে ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। বিছানায় বসে ভাবতে লাগল, সত্যিই মেয়েটা হারিয়ে গিয়েছে? এত বড়ো মেয়ে এইভাবে উধাও হয়ে গেল কিভাবে? মেয়েটার কি কোনো শত্রু আছে? কোথায় গেল মেয়েটা? ইশ, মেয়েটার জন্য পদ্ম’র কেন যেন খুব মায়া হচ্ছে। এই ভাগ্য নামক জিনিস’টা এত বিচিত্র কেন? একেক জনের সাথে একেক খেলা খেলে। কাউকে একভাবে কষ্ট দেয় তো কাউকে অন্যভাবে। না জানি, মেয়েটা এখন কোথায় আছে, কিভাবে আছে। তবে সেও মনে মনে খুব করে দোয়া করলো, মেয়েটা ফিরে আসুক। ও ফিরে আসলে ডাক্তারবাবু খুশিতে হয়তো আত্মহারা হয়ে যাবে। প্রথম দেখেই হয়তো জাপটে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদবে। আচ্ছা, ডাক্তার’রা ও কি কাঁদে? ওদের তো মন খুব শক্ত হয়। ওরাও কি আমাদের মতো কাঁদতে পারে? কি জানি..
পদ্ম কফি’টা শেষ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। তখনই তার রুমের দরজায় শব্দ হলো। পদ্ম ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখল আকবর সাহেব। পদ্ম চমকে উঠে বসলো। নিজের জামা ওড়না টেনে উঠে দাঁড়িয়ে ইতস্তত কন্ঠে বললো,
‘আংকেল আপনি?’
‘হ্যাঁ মা, আমি। তোমার সাথে তো আমার তেমন করে কথাই হলো না তাই ভাবলাম এসে একটু গল্প করি। তা তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?’
পদ্ম না চাইতেও হেসে বললো,
‘না না, অসুবিধা কিসের? আপনি আসুন না, ভেতরে আসুন।’
আকবর সাহেব ভেতরে গিয়ে বসলেন। পদ্ম দাঁড়িয়ে রইল। তিনি তাকে বললেন,
‘বসো।’
পদ্ম গুটিসুটি মেরে বসলো। আকবর সাহেব হেসে বললেন,
‘তোমার পুরো নাম কী, মা?’
‘আফসানা পদ্ম।’
‘বাহ! বেশ সুন্দর নাম। আচ্ছা, একটা কথা বলতো, তুমি পড়াশোনা কতটুকু করেছো?’
‘টেন পাশ’টা কোনোরকমে করেছিলাম। তারপর আর মামা মামি পড়তে দেয়নি।’
‘ওহ, তা এখন তোমার বয়স কত?’
‘একুশ বাইশ হবে হয়তো।’
‘আচ্ছা আচ্ছা।’
লোকটা ঠোঁটের উপর দুই আঙ্গুল রেখে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন,
‘তোমার নাকি কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল? সেই ছেলেটা কি ভালো ছিল না?’
পদ্ম মাথা নুইয়ে বললো,
‘না, ঐ লোকটা খুব খারাপ।’
আকবর সাহেব বললেন,
‘কেন? বয়স বেশি বলে?’
‘বয়স না, আসলে লোকটার ব্যবহার খারাপ। আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল।’
আকবর সাহেব তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘আহারে, এইটুকু একটা মেয়ের সাথে কতকিছু হয়ে গেল। থাক মা, তুমি আর কষ্ট পেয়ো না। আগের কথা সব ভুলে যাও। ভেবে নাও এটা তোমার নতুন জীবন। তাই এখন থেকে সবসময় হাসিখুশি থাকবে, নিজেকে আনন্দে রাখবে কেমন?’
আকবর সাহেব কথা’টা বলার সময় পদ্ম’র মাথায় হাত রাখলেন। পদ্ম হেসে বললো,
‘আচ্ছা।’
তিনি তার হাত’টা নামিয়ে পদ্ম’র বাহুতে রাখলেন। সেখানে হাত ঘষতে ঘষতে বললেন,
‘আচ্ছা মা, কোনো টেনশন নিও না। কোনো অসুবিধা হলে সবার আগে আমাকে বলবে। আমি সবটুকু দিয়ে তোমাকে সাহায্য করবো।’
লোকটার অমন করে গায়ে হাত ঘষা’টা পদ্ম’র ঠিক পছন্দ হলো না। সে হেসে হেসে উনার হাত’টা সরিয়ে বললো,
‘আচ্ছা আংকেল বলবো।’
তিনিও হেসে এদিক ওদিক তাকিয়ে আরো কিছু প্রশ্ন করলেন। এই যেমন এই রুম’টা পছন্দ হয়েছে কিনা, রুমের কিছু বদলানো লাগবে কিনা কিংবা কিছু আনতে হবে কিনা এই ধরনের অবান্তর কিছু প্রশ্ন। পদ্ম’র ভীষণ বিরক্ত লাগলেও সে হেসে হেসে উত্তর দিল। লোকটি এক পর্যায়ে কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। পদ্মও সম্মানের খাতিরে তার সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। লোকটি বললো,
‘আচ্ছা তাহলে অনেক গল্প হয়েছে, এখন তাহলে আমি আমার রুমে যাই?’
এই কথাটা বলার সময়ও তিনি পদ্ম’র গালে আবার হাত রাখলেন। পদ্ম এবার ব্রু কুঁচকে ফেলল। বারবার গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা লাগে নাকি, আশ্চর্য! পদ্ম হাত সরিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললো,
‘ঠিক আছে আংকেল, আপনি আসুন।’
আকবর সাহেব বেরিয়ে গেলেন। উনি বেরিয়ে যেতেই পদ্ম গিয়ে দরজা’টা লাগিয়ে দিল। তারপর ধপ করে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। কেন যেন লোকটার এই ছোঁয়াগুলো সে ভালো ভাবে নিতে পারছে না। এই ছোঁয়াতে কোনো স্নেহ ছিল না, ছিল অন্যকিছু। তার অস্বস্তি হতে লাগল ভীষণ। গাল’টা ঘষে বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে পড়ল সে। আর কিছু খারাপ চায় না সে। আর নিতে পারবে না। তার মধ্যে আর সেই ধৈর্য নেই। এবার কিছু খারাপ হলে সে মরে’ই যাবে। এইভাবে আর বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না।
.
ডাইনিং এ বসে সবাই রাতের খাবার খাচ্ছে। পদ্ম’র আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। তাও রুবি হোসেনের জোরাজুরিতে তাকেও বসতে হলো। তার উল্টো পাশে চেয়ারে আদিদ বসা। লোকটা কী সব সেদ্ধ শাক সবজি খাচ্ছে। ঐগুলো তো জীবনেও পদ্ম খেতে পারবে না। আদিদের পাশে তার বাবা বসেছে। উনার জন্য আজ অনেক কিছু রান্না হয়েছে। উনি একের পর এক খাবার নিচ্ছেন আর খাচ্ছেন। মনে হয় খুব ভোজনরসিক মানুষ। পদ্ম এক লোমকা নিচ্ছে তো কিছুক্ষণ জিরুচ্ছে। রুবি হোসেন পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কি ব্যাপার পদ্ম, তুমি তো দেখি কিছুই খাচ্ছো না।’
পদ্ম হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘না না, খাচ্ছি তো।’
আদিদ তখন তাকিয়ে বললো,
‘শরীর খারাপ লাগছে আপনার? খেতে মন না চাইলে জোর করে খেতে হবে না। নয়তো তাতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
পদ্ম এবার আমতা আমতা করে বললো,
‘আ-আমার আসলে সত্যিই খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘ওমা! কেন মা, কী হয়েছে তোমার? শরীর কি খুব খারাপ তোমার? দেখি তো..’
উনি হাত বাড়িয়ে পদ্ম’র কপাল আর গলা ছুঁয়ে বললো,
‘না, জ্বর টর তো আসেনি। তাহলে কী হয়েছে?’
পদ্ম’র এবার আরো বেশি খারাপ লাগতে লাগল। লোকটা ইচ্ছে করে তার গায়ে হাত দিচ্ছে। একজন পুরুষ মানুষের কোন ছোঁয়া’টা কেমন সেটা একটা মেয়ে খুব সহজেই বুঝতে পারে। এই লোকটার ছোঁয়ার উদ্দেশ্য ভালো নয়। পদ্ম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ফিচেল গলায় বললো,
‘আপনারা খান, আমি রুমে যাচ্ছি।’
পদ্ম উপরে চলে গেল। রুবি হোসেন তখন তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘মেয়েটার আবার কী হলো?’
‘কিছু হয়নি মা। হয়তো শরীর একটু খারাপ লাগছে। রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি টেনশন নিও না।’
সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার রুমে চলে গেল। আদিদ নিজের রুমে যাওয়ার আগে একবার পদ্ম’র রুমের কাছে গেল। দরজায় নক করতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল সে। মনে মনে ভাবল, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়লে, অযথা তার ঘুম’টা নষ্ট হবে। এই ভেবে সে আর দরজায় নক করলো না, চলে গেল নিজের রুমে।
.
সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু পদ্ম তার দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না। তার খুব ভয় করছে। ভয়ে সে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। আদিদের বাবাকে তার পছন্দ হচ্ছে না। উনার ব্যবহার স্বাভাবিক না। উনার এই স্পর্শ স্বাভাবিক না। পদ্ম’র ভালো লাগছে না। সে জোর করে ঘুম আনার চেষ্টা করছে। ঘুমালে হয়তো মাথাটা একটু ঠান্ডা হবে তার। তাই সে যখন চোখ বুজে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে ঘুমের জন্য ঠিক তখনই তার রুমের দরজায় কে যেন নক করে। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে দরজার এই ঠকঠক শব্দ কিছু সময়ের জন্য পদ্ম-কে ভীষণ ভীত করে তুলে। সে ভয়ে ভয়ে উঠে বসে। ঢোক গিলে জিগ্যেস করে,
‘কে?’
চলবে..