পদ্মফুল #লেখিকা_জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা #সূচনা_পর্ব

‘স্যার, ইমারজেন্সিতে একজন পেশেন্ট এসেছে। অবস্থা ভালো নয়, মনে হয় এক্সিডেন্ট কেইস।’

‘ইমাজেন্সিতে কি কোনো ডক্টর নেই?’

‘না স্যার। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন, পেশেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ।’

‘ঠিক আছে, চলুন।’

ড. আদিদ স্টেথোস্কোপ’টা গলায় পরে নার্সের পেছন পেছন ছুটল ইমারজেন্সি রুমে। গিয়ে দেখল স্ট্রেচারে একটি মেয়েকে রাখা হয়েছে। যার মাথার চারপাশ’টা র/ক্তে র/ক্তা/ক্ত হয়ে আছে। সে দ্রুত মেয়েটার কাছে গেল। হাতের পালস্ চেক করে দেখল, বেঁচে আছে। কিন্তু ব্লিডিং হয়েছে অনেক। এক্ষুণি র/ক্ত পড়া বন্ধ না করতে পারলে সিরিয়াস কিছু হয়ে যাবে। আদিদ নার্সকে তাড়া দিয়ে বললো,

‘এক্ষুণি উনাকে ও.টি তে নিয়ে যান। অবস্থা ভালো নেই। মাথায় অনেকটা চোট পেয়েছে। সেলাই করতে হবে বোধ হয়।’

আদিদের কথা মতো নার্স মেয়েটিকে নিয়ে ও.টি তে ঢুকল। আদিদ তখন আশে পাশে তাকিয়ে বললো,

‘উনার সাথে কে এসেছে?’

একজন মধ্যবয়স্ক লোক তখন জবাবে বললো,

‘জ্বি আমি। আসলে আমার গাড়ির সঙ্গেই মেয়েটির এক্সিডেন্ট হয়। তবে আমার কোন দোষ ছিল না। মেয়েটি’ই ইচ্ছে করে এসে আমার গাড়ির সামনে পড়েছে।’

‘আচ্ছা, সেসব নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। এখন আপনি আগে গিয়ে রিসিপশনে একটা ফর্ম ফিল আপ করুন। বাকিটা আমি দেখছি।’
.

কপালের পাশটা ড্রেসিং করার পর আদিদ দেখল অনেকটাই কেটে গেছে। সেলাই না করে উপায় নেই। তিন থেকে চারটা সেলাই লাগল। হাতে আর পায়েও অল্প কিছু অংশ ছিলে গিয়েছে। সেগুলোও সে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিল। কপাল থেকে অনেকটা র/ক্ত যাওয়ায় তার এক ব্যাগ র/ক্ত ও লেগেছে।

মেয়েটাকে কেবিনে দিয়ে আদিদ রিসিপশনে গেল। সেই লোকটি সেখানের একটি চেয়ারে বসে আছে। আদিদ তাকে গিয়ে জিগ্যেস করলো,

‘মেয়েটির সাথে কিছু ছিল? উনার পরিবারের সাথে তো যোগাযোগ করতে হবে।’

লোকটি তার পকেট থেকে একটি বাটন ফোন বের করে বললো,

‘এই ফোন’টা ছিল বোধ হয়। কিন্তু এটা তো এখন চালু হচ্ছে না।’

‘দিন আমার কাছে। আর আপনি এখানে বসেই অপেক্ষা করতে থাকুন মেয়েটার জ্ঞান ফেরার আগ অবধি। এক্সিডেন্ট কেইস তো, অনেক সময় অনেক ঝামেলা হয়।’

‘ঠিক আছে, আমি আছি এখানে। আর মেয়েটা এখন সুস্থ তো?’

‘জ্বি। আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।’

আদিদ কথা শেষ করে ফোনটা নিয়ে তার কেবিনে চলে গেল। ফোনটাও ভেঙে গিয়েছে। আদিদ তাই ফোনটা থেকে সিম কার্ড’টা খুলে নিজের ফোনে ঢুকাল। তারপর সে ফোনের কন্টাক্ট নাম্বারে গিয়ে দেখল কেবল একটাই নাম্বার সেইভ করা, “মামা” দিয়ে। আদিদ সেই নাম্বার’টাই কল লাগাল। সঙ্গে সঙ্গে কল’টা রিসিভও হয়ে গেল। আদিদ কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে কেউ ঝাঁঝাল গলায় বলে উঠল,

‘কোথায় তুই? কোন নাগরের হাত ধরে পালিয়েছিস? এই দিন দেখার জন্য তোকে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছি। কই তুই, কিরে মুখপুড়ী কথা বলছিস না কেন? মান সম্মান তো সব শেষ করলি, পাড়ায় মুখ দেখানোর উপায় রাখলি না আর।’

আদিদ ভীষণ রকম বিরক্ত হলো। এইভাবে কেউ কথা বলে নাকি? ভদ্রলোক তাকে একটা বার কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেন না। লোকটার ব্যবহার এত খারাপ কেন, আশ্চর্য!

আদিদ ভারি গলায় বলে উঠল,

‘দয়া করে আমাকে একটু বলার সুযোগ দিন।’

ওপাশ থেকে আবারও ঝাঁঝাল কন্ঠ শোনা গেল। লোকটি বলে উঠল,

‘এই আপনি কে? পদ্মর ফোন আপনার কাছে কেন? ওহ, আপনিই কি তবে সেই নাগর, যার হাত ধরে পদ্ম পালিয়েছে?’

‘এক্সকিউজ মি! ভদ্র ভাবে কথা বলুন। আমি একজন ডক্টর, হসপিটাল থেকে কথা বলছি। এই নাম্বারটি যার তিনি এখন হসপিটালে আছেন। আপনি যদি উনার বাড়ির লোক হয়ে থাকেন তবে দয়া করে এক্ষুণি হসপিটালে চলে আসুন।’

লোকটি তখন আঁতকে উঠে বললো,

‘মেয়েটা মরে টরে গেছে নাকি?’

আদিদ বুঝে উঠতে পারে না কী বলবে। এই লোকটা ঐ মেয়েটার কী হয়, সেটাই এখন সে ভাবছে। সে বিরক্ত কন্ঠে জবাব দিল,

‘না, উনি বেঁচে আছেন। আপনি আর কথা না বাড়িয়ে পেশেন্ট কেয়ারে চলে আসুন। রাখছি।’

আদিদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কলটা কেটে দিল। তার কাছে আগেও এমন অনেক এক্সিডেন্ট কেইস এসেছে। যখনই সে পেশেন্টের বাড়ির লোকদের খবর দিত, তারা তখন পাগলের মতো ছুটে আসতো। কিন্তু, এই লোকটা কী অদ্ভুত! এইভাবে কেউ কারোর মরার কথা জিগ্যেস করে নাকি? আদিদ তখন ভাবে, মেয়েটা মনে হয় পারিবারিক ভাবে অনেক সমস্যাতে আছে; নয়তো এই বয়সের একটা মেয়ে আত্মহত্যা কেন করতে যাবে।

প্রায় এক ঘন্টা পর একজন নার্স এসে বললো,

‘একশো তিন নাম্বার রুমের পেশেন্টের বাড়ির লোক এসেছেন, স্যার। উনারা পেশেন্টের সাথে দেখা করতে চাইছেন।’

আদিদ গম্ভীর গলায় বললো,

‘উনাদের আগে আমার কেবিনে পাঠান।’

‘ঠিক আছে, স্যার।’

কিছুক্ষণ পর আদিদের কেবিনে এক জন মধ্যবয়স্ক পুরুষ আর এক জন মহিলা ঢুকল। তারা কোনরূপ অনুমতি না নিয়েই সরাসরি আদিদের ডেস্কের সামনে এসে বললো,

‘কই, আমাদের মেয়ে কই? আপনি’ই কি আমাদের কল দিয়েছিলেন?’

আদিদ বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। শান্ত কন্ঠে বললো,

‘জ্বি। আপনারা পেশেন্টের কী হোন?’

‘মামা, মামি।’

কথা’টা শোনে আদিদ তাদের আপাদমস্তক একবার পরখ করলো। তারপর বললো,

‘চলুন আমার সাথে।’

আদিদ বেরিয়ে একশো তিন নাম্বার রুমে গেল। পেছন পেছন উনারা দুজনও গেল। কেবিনের ভেতরের নার্স বললো,

‘স্যার, পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।’

‘ঠিক আছে, আপনি যান আমি দেখছি।’

আদিদ মেয়েটির কাছে গিয়ে তার পালস্ চেক করতে হাত’টা স্পর্শ করতেই মেয়েটি মিট মিট করে তাকানোর চেষ্টা করলো। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলা লাগছে তার। মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। আদিদ জিগ্যেস করলো,

‘ঠিক আছেন আপনি?’

মেয়েটা জবাব না দিয়ে চেয়ে রইল। পেছন থেকে তার মামি চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘এই মাইয়া, ঢং করতাছোস কেন? মুখ দিয়া কি কথা বের হয় না?’

আদিদ ব্রু কুঁচকে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আস্তে কথা বলুন, এটা হসপিটাল। আর উনি অসুস্থ, তাই হয়তো কিছু বলতে পারছেন না।’

মহিলা’টা কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার স্বামী তাকে ইশারা দিয়ে থামিয়ে দিলেন। তারপর তিনি হাসি হাসি মুখে বেডে শোয়ানো মেয়েটার কাছে গেলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

‘মা, এখন সুস্থ আছিস তো? তোর জন্য আমরা কত চিন্তা করেছি তুই জানিস? এইভাবে কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়? একবার তো আমাদের কথাটা তোর ভাবা উচিত ছিল। শুধু শুধু এত বড়ো একটা বিপদ ডেকে আনলি। একটা কথাও তুই আমাদের শুনিস না।’

“পদ্ম” নামের মেয়েটা তার মামার দিকে অনেকক্ষণ পলকহীন চোখে চেয়ে রইল। তারপর সে ঠোঁটগুলো হালকা ফাঁক করে একটু বাতাস বের করে আস্তে করে বললো,

‘কে আপনি? আর আমা-আমার কী হয়েছে?’

মেয়েটার কথা শুনে উপস্থিত সবাই ভীষণ অবাক হলো। আদিদ ব্রু কুঁচকে ফেলল। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ তার। সে পদ্মকে বললো,

‘উনি আপনার মামা হোন। আপনি কি উনাকে চিনতে পারছেন না?’

পদ্ম অস্থির হয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘না।’

আশ্চর্য! মেয়েটা কপালে ব্যাথা পেয়েছে। তার এফেক্ট কোনোক্রমেই মস্তিষ্কে পড়েনি সেটা নৈরিথ জানে। তবে মেয়েটা এমন ব্যবহার করছে কেন?

পদ্ম মেয়েটা তখন কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,

‘আ-আমি কাউকে চিনতে পারছি না। আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না। কী হয়েছে আমার? আমি এখানে কেন?’

‘আপনি অস্থির হবেন না। আপনার ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল তাই আপনি এখানে। রেস্ট নিন কিছুক্ষণ, আস্তে আস্তে সব মনে পড়বে।’

পদ্ম’র মামি তখন ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘আরে, মাইয়ার সব মনে আছে। আমাদের দেইখা ঢং করতেছে। এই মাইয়া, তুই কী ভাবছিস তোর এসব নাটক আমরা বুঝি না। কানের নিচে একটা দিলে পরপরাইয়া সব মনে পইড়া যাইবো।’

‘আহ, থামুন। আমার পেশেন্টের সাথে ভদ্র ভাবে কথা বলুন। উনি এখন অসুস্থ, তাই এমন হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনারা বাইরে গিয়ে বসুন। আমি উনার সাথে কথা বলছি।’

পদ্ম’র মামা মামি তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেল। উনারা বেরিয়ে যেতেই আদিদ পদ্মকে জিগ্যেস করলো,

‘আপনার কি সত্যিই কিছু মনে পড়ছে না?’

পদ্ম’র চোখ দুটো ভিজে উঠল। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সে আদিদের দিকে তাকাল। কিছু বলতে চাইছে সে। কিন্তু পারছে না, কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে। নিশ্বাস ফেলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার। তার উপর আবার মাথাটাও যন্ত্রণা করছে ভীষণ। সে চোখ বুজে ঘনঘন কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে বললো,

‘আমি মিথ্যে বলেছি, ডাক্তারবাবু।’

চলবে..?

#পদ্মফুল
#লেখিকা_জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
#সূচনা_পর্ব

(একটু অন্যরকম ধাঁচের কিছু লিখব ভাবছি। জানি না যা ভেবে রেখেছি তা লিখে উঠতে পারবো কিনা। তবে চেষ্টা করবো। আর আপনাদের রেসপন্সের উপর ভিত্তি করেই গল্পটা আগাবে। ভালো না লাগলে বলবেন, বেশি বড়ো করবো না। কয়েকটা পর্ব দিয়ে শেষ করে দিব। আশা করছি, আপনারা পাশে থাকবেন, অন্য গল্পগুলোর মতোই ভালোবাসা দিবেন।😊 আসসালামু আলাইকুম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here