#গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০২
রোদ্দুরের বাহুতে অহি একটা ধাক্কা দিতে সে চোখ বন্ধ রেখেই অহির হাত চেপে ধরলো।জড়ানো গলায় বললো,
—“ঘুমাতে দে আমায় অজান্তা।নইলে তোর খবর আছে।বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি একপ্রকার।একটু নিরিবিলি থাকার জন্য।সবাই আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে যা অসহ্যকর।আমার রুমের সব ভাঙচুর করে এসেছি।”
—“আপনি এখানে এসেছেন সবাই জানে?”
—“জানি না।”
—“রোদ্দুর ভাই, কিছু খাবেন?কখন খেয়েছেন?”
—“এক ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে ফেলবো অজান্তা।বিরক্ত করতে বারণ করেছি।”
অহি আর বিরক্ত করে না।সাবধানে রোদ্দুরের হাতের ভাঁজে চেপে রাখা নিজের বন্দী হাতটা মুক্ত করতে চায়।কিন্তু রোদ্দুর ছাড়ে না।
হাল ছেড়ে চুপচাপ বেডে বসে রোদ্দুরের মুখপানে চেয়ে থাকে।তার খুব ইচ্ছে হয় রোদ্দুরের চুলে বিলি কেটে দিতে।হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিয়ে আসে।কোথায় যেন বাধা!
মিনিট দশেক পর রোদ্দুরের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসে অহির।যাহ!রোদ্দুর ঘুমিয়ে পড়েছে।তার মানে মেডিসিন অতিদ্রুত তার কাজ শুরু করেছে।সে একপ্রকার জোর করেই রোদ্দুরের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।মাকে ফোন দিয়ে সব বৃত্তান্ত জানতে হবে তার!রোদ্দুর যে এখানে সেটাও জানাতে হবে।
পায়ের নিচ থেকে সাবধানে চাদরটা উঠিয়ে রোদ্দুরের গলা অবধি জড়িয়ে দেয়।সরে আসার আগে আরেকবার রোদ্দুরের মুখ পানে চাইতেই তার ভয়ংকর একটা ইচ্ছে জাগে।নিজের লাগামছাড়া ইচ্ছেকে দমন করতে না পেরে রোদ্দুরের কপালে গভীর এক চুমু বসিয়ে দেয়।
তারপর অতিদ্রুত টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বের হয়ে যায়।
—————-
বিকেল বেলা পা দিয়ে বেলকনির কাচ ঠেলে ভেতরে ঢুকে অহি।তার এক হাতে এক কাপ চা।আর ডান হাতে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা বই।”রোদনভরা এ বসন্ত”! অষ্টম বারের মতো বইটি পড়া শুরু করেছে সে।
বেলকনির মাঝ বরাবর রাখা ছোট্ট টেবিলের উপর বইটা রেখে সে চেয়ার প্রকৃতিপানে বসে পড়লো।চায়ের কাপে এক চুমুক দিতেই সামান্য ভালো লাগার অনুভূতি হলো।
কিছুদিন হলো তার মন খচখচ করছে।অনেক চেষ্টা করেও রোদ্দুরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।আজ এক সপ্তাহের মতো হলো অহি রোদ্দুরকে দেখে না।রোদ্দুরের কোনো খোঁজ নেই।সেই যে সেদিন রাতে তার রুমে ঘুমিয়েছিল।সকালবেলা সে পাশের রুম থেকে জেগে উঠে গিয়ে দেখে রোদ্দুর নেই।কাজের লোকের মাধ্যমে জানতে পারে ভোরবেলা সূর্য উঠার আগেই চলে গেছে।
কিন্তু কোথায় গেছে তা কাজের লোক জানে না।শুধু যেতে দেখেছে।একরাশ টেনশন নিয়ে সে রোদ্দুরের নাম্বারে ফোন দেয়।ফোন সুইচট অফ বলে।পরে সে খালাকে ফোন দিয়ে জানতে পারে রোদ্দুর বাসায় ফিরেছে এবং এখন নিজের রুমে দরজা আটকে আছে।
অহি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
এই সাতদিনে সে অনেক বার রোদ্দুরের ফোনে কল দিয়েছে।কিন্তু রোদ্দুরের ফোন সেদিনের পর থেকে বন্ধ।সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিন রাত নিজের রুমে থাকে।অহির বড়ো মায়া হয়!
রোদ্দুরের যে মেয়েটার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার নাম বৃষ্টি।অসম্ভব সুন্দর গড়নের একটা মেয়ে।অহি যে বছর রোদ্দুরের ভার্সিটিতে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয় সেই বছরই রোদ্দুরের ভার্সিটির পাঠ চুকে যায়।বাবার বিজনেসে তখন ঢুকে পড়ে।
আর বৃষ্টি রোদ্দুরের এক বছরের জুনিয়র হওয়ার কারণে অহির সাথে প্রায়ই ভার্সিটিতে কথা হতো।কোনো কোনোদিন রোদ্দুর যখন অফিস থেকে সোজা ভার্সিটি এসে বৃষ্টির সাথে দেখা করতো,দূর থেকে সেসব দেখে অহির বুক পুড়তো!এখন অহি থার্ড ইয়ারে।ততদিনে বৃষ্টির পড়াশোনা শেষ বলে দু পক্ষের সম্মতিতে বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়।কিন্তু বিয়েটা হয় না!
হুট করেই অহির অস্থির লাগতে শুরু করে।সে রোদ্দুরকে দেখবে।তাও আবার এক্ষুনি!সে এক চুমুকে বাকি চা টুকু শেষ করে দ্রুত নিচে নামে।যতদ্রুত সম্ভব রোদ্দুরের কাছে পৌঁছাতে হবে তাকে।
মানুষ তীব্র সুখ এবং তীব্র দুঃখের সময় কাউকে পাশে চায়।রোদ্দুরের দুঃখের সময় এখন তাকে প্রয়োজন।বড্ড প্রয়োজন।
রান্নাঘরে উঁকি দেয় অহি।তার মা খালার বাসা থেকে ফিরেছে চারদিন হলো।সে নিঃশব্দে মায়ের পেছনে গিয়ে বলে,
—“মা!আমি খালামনির বাসায় যাব।”
তার মা শাহানা বেগম চুলায় করলার ভাজি বসিয়েছে।তার বাবা ঢাকার নামকরা কলেজের ফিজিক্সের টিচার।তিনি আবার কাজের লোকের হাতের রান্না খায় না।সেজন্য ছোটবেলা থেকে অহি দেখে যাচ্ছে তার মা পরম যত্নে সবার জন্য রান্না করে।
শাহানা বেগম চুলার আঁচ একটু কমিয়ে মেয়ের দিকে ফিরে তাকালেন।ভেজা হাত দুটো শাড়ির আঁচলে মুছে বললেন,
—“তোর কাজকর্ম তো কিছুই আমি বুঝতে পারি না।হিমের বিয়ের সময় কত করে বললাম চল যাই,চল যাই!কিন্তু নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে গেলি না।আর এখন ও বাড়ির সবার মানসিক অবস্থা ভালো না।তুই এখন ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে যাবি।বলি,তোর আক্কেল কবে হবে রে?”
—“মা,তুমি এমন ভাবে বলছো যেন আমি সত্যি সত্যি ও বাসায় গিয়ে নাচা শুরু করবনি।”
—“তোকে দিয়ে বিশ্বাস আছে?আচ্ছা যা।ড্রাইভারকে বল।নিয়ে যাবে।আর ও বাড়ি গিয়ে বেশি পাকনামো করিস না।”
অহি মায়ের সামনে থেকে সরে আসে।ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমে যায়।চার মিনিটের মাথায় ছোট্ট একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিচে নামে।
—“বুবু, কই যাস?”
অহি সিঁড়ির ডানপাশে তাকিয়ে দেখে অপূর্ব।অপূর্ব তার ছোট ভাই।ক্লাস নাইনে পড়ে।সদ্য গোঁফ উঠছে যার জন্য সে সবসময় সবার থেকে লুকিয়ে থাকতে চায় লজ্জায়।তারা এই দু ভাই বোনই!
অহি তার কাছাকাছি গিয়ে বলে,
—“তুই কখন এলি?ক্রিকেট খেলতে না গিয়েছিলি শুনলাম?”
—“মাত্র এলাম।তুমি কি রোদ্দুর ভাইদের বাসায় যাও?”
—“হুঁহ।যাবি তুই?চল যাই।”
অপূর্ব মুখে হাত রেখে ফিসফিস করে বলে,
—“না।তুমি যাও।তোমার ওখানে রোদ্দুর ভাই আছে।আমার তো কিছুই নেই।”
অহি হাত উঠিয়ে মারার আগেই সে এক দৌঁড়ে রুমে চলে যায়।অহি মুচকি হাসে!মাকে বলে গাড়িতে উঠে।
রোদ্দুর ভাইদের বাসা হাতিরঝিল।তারা থাকে মোহাম্মদ পুর।মধ্যবর্তী দূরত্ব বেশি নয়।দ্রুত পৌঁছে যাবে।
—————-
রোদ্দুর ভাইদের বাসার সামনে গাড়ি থামতেই নেমে পড়ে অহি।সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উপরে তাকাতেই একটা প্লেটলেট চোখে পড়ে।সেখানে খোদাই করা ‘নিশ্চিন্ত ভবন’।
অহি অবাক হয় না।এ বাসার নাম দুদিন পর পর পরিবর্তন করা হয়।আর এই কাজটা তার পিএইচডি ধারী খালু সাহেব করেন।বাসার সমসাময়িক পরিস্থিতি উপর ভিত্তি করে অতি উৎসাহের সাথে কিছুদিন পর পর নতুন প্লেটলেট লাগায়।
কিন্তু সে অনুযায়ী এবার লাগানোর কথা ‘অনিশ্চিন্ত ভবন’।কারণ এখন তো রোদ্দুর ভাইয়ের এ অবস্থায় কেউ নিশ্চিন্ত থাকার কথা না।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিং বেলে চাপ দেয়।সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় দরজা।মনে হয় ওপাশে কেউ যেন দরজা খোলার জন্যই হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।
দরজা খুলেছে রোদ্দুর ভাইদের বাসার কাজের মেয়ে কুটি।কুটির ভালো নাম পারভীন।কিন্তু সে নাম এখন ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত।সবাই তাকে কুটি বলেই ডাকে।১৭-১৮ বছর বয়সের গোলগাল চেহারার প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে।
অহিকে দেখেই চমকে বলল,
—“আফা, আপনে?”
অহি ভেতরে ঢুকে বলল,
—“কুটি কেমন আছো?”
—“ভালা আফা।আপনে কেমুন আছান?”
—“আমিও ভালো কুটি।কাউকে তো দেখছি না।সবাই কোথায়?”
—“সবাই উপ্রে হিম দাদার দরজার সামনে।দাদা দরজা খুলতাছে না।বলতাছে খাইবো না।আইজ সারাডা দিন কিচ্ছু খায় নাই।”
অহির বুকের ভেতর ব্যথা হয়।এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।
(চলবে)
রাতে আরেক পর্ব দেয়ার চেষ্টা করবো।গতকালের পর্বে একটু ঘোলাটে হয়েছিল।রোদ্দুর, অহির বড়।কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলে কমেন্ট বক্সে প্রশ্ন করবেন।💕🖤