১.
আশিক তারিনের দিকে ছুরি হাতে নিয়ে একটু একটু করে এগুতে লাগলো। তারিন বিশ্বাস করতে পারছে না আশিক এইরকম কিছু করতে পারে। তারিনের মনে পড়ে যাচ্ছে আশিকের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো। তখন কতই না ভালো ছিল ওদের পথচলা। সেই ঢাকা থেকে ছুটে যেতো শুধু তারিনকে একবার দেখার জন্য। সারাদিন একসাথে ঘুরাঘুরি করতো। সন্ধ্যাবেলায় দু’জনে নদীর পাড়ে বসে জোৎস্না স্নান করতো । চাঁদের আবছায়া আলো আর ঠান্ডা হাওয়া শরীর শিহরণ দিয়ে উঠতো। খোলা আকাশে বুক ভরে নিশ্বাস নিতো।
সেই সময়ের কথাগুলো মনে পড়লে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তারিনের।
তখনকার আশিক আর আজকের তারিনের মধ্যে কোন মিল নেই। আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
তারিন কান্না করতে করতে আশিক কে বলছে..
-প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও??
আশিক হিংস্র পশুর মত আচরণ করতে লাগলো তারিনের সাথে। শয়তানি একটা হাসি দিয়ে তারিনকে বলল– “আমি যা চাই তা আমাকে দিয়ে দে। তাহলে আমি তোকে ছেড়ে দিবো”
তারিনের কান্নার আওয়াজ আরও বেড়ে গেলো। সেই সাথে আশিকের উপর প্রচুর রাগ হতে লাগলো। ইচ্ছে করছে এখনই আশিক কে শেষ করে দিতে। কিন্তু কীভাবে সে আশিক কে মারবে সে নিজেই তো আশিকের হাতে বন্দী হয়ে আছে?
আস্তে আস্তে আশিক তারিনের অনেকটা কাছে চলে এসেছে। তারিনের কাছে এসে শরীরের ঘ্রাণ নিতে লাগলো আশিক। তারিনের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে যাচ্ছে। তারিন ভাবছে আজ আর আশিকের হাত থেকে তার নিস্তার নেই। আশিক আজ আমার শরীর ভোগ করবেই।
হঠাৎ করে তারিনের চোখের সামনে বাবা- মা’র মুখ ভেসে উঠলো।
কাল যখন আমার বাবা- মা জানতে পারবে, তাদের মেয়ে ধর্ষিতা। তাহলে তারা সমাজের কাছে কীভাবে মুখ দেখাবে? কীভাবে তারা আমাকে নিজের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দেবে?
আশিক এখন তারিনের পুরো শরীরের ঘ্রাণ নেওয়ায় ব্যস্ত। তারিন হাতে পেয়ে গেলো আশিকের ঘরের টেবিলের উপর থাকা কাঁচের জগ টা । তারিন আস্তে করে জগ টা হাতে নিলো। তারপর নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আশিকের মাথায় আঘাত করলো। আশিক মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। তারিন রাগি চেহারা নিয়ে আশিকের দিকে তাকিয়ে আছে। তারিন নিজেকে এই হিংস্র পশুর হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। আশিকের মাথা দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হতে লাগলো। কিছুক্ষন পর আশিক অজ্ঞান হয়ে গেলো। তারিন একটু কষ্ট অনুভব করলো আশিকের জন্য। আশিক তারিনকে দেহের জন্য ভালবাসলেও তারিন তো আশিক কে মন থেকে ভালবেসেছিল। কিন্তু এখন এসব ভেবে নষ্ট করার মতো সময় তারিনের হাতে নেই।
তাকে যেভাবেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে। তারিন জগটা রেখে বাহিরের দিকে দৌড়াতে লাগলো।
তার এখন একটাই চিন্তা যেভাবেই হোক এই হিংস্র পশুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।
সামনেই বাস স্ট্যান্ড । তারিন স্ট্যান্ড এর দিকে দৌড়াতে লাগলো।
২.
রিফাত অনেকক্ষন ধরে বাস স্ট্যান্ড এ দাঁড়িয়ে আছে। রংপুর যাবে একটা গানের গোগ্রামের জন্য।
ওর ফ্রেন্ডরা সবাই সকালেই চলে গেছে।
কিন্তু রিফাতের একটা কাজ ছিল তাই সকালে সবার সাথে যেতে পারেনি। কাজ শেষ হতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। রিফাত জানতো রংপুর যাওয়ার শেষ ট্রেন টা অনেকক্ষন আগেই ছেড়ে দিছে। তাই রেলওয়ে স্টেশনে না গিয়ে সোজা বাস স্ট্যান্ডে এসেছে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয় আরকি। প্রায় ১ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন বাস তো দূরের কথা একটা রিক্সা ও রাস্তায় নেই।
এখন নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিফাত । কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না? সকালের আগে পৌঁছাতে না পারলে তো কালকের পোগ্রামে জয়েন করতে পারবে না। মোবাইলে চার্জ ও নেই যে ফ্রেন্ডদের ফোন করে এই বিপদের কথা জানাবে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই।
রিফাতের খুব রাগ হতে লাগলো।
নিজেকে নিজেই বকতে শুরু করে দিছে। সকালে যদি ওদের সাথে চলে যেতাম তাহলে আর এখন এই বিপদে পড়তে হতো না।
৩. এদিকে তারিন দৌড়াতে দৌড়াতে বাস স্ট্যান্ডে এর কাছে চলে এসেছে। রিফাত মাথা নিচু করে ল্যাপ পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারিন রিফাত কে দেখতে পেয়ে থেমে গেলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ও আর এই ছেলেটা ছাড়া কেউ নেই। এর শীতের রাতে কেউ না থাকাটাই স্বাভাবিক।
তারিনের মনে খটকা লাগলো।
তারিন মনে মনে বলল..”এই শীতের মধ্যে একটা ছেলে একা একা এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?? ছেলেটা চোর নয়ত??”
নানান রকম প্রশ্ন তারিনের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ ছেলেটার হাতে থাকা গিটারের দিকে চোখ গেলো। তারিনের ভাবনা এবার চেঞ্জ হয়ে গেলো। তারিন ভাবছে…
-“ছেলেটা মনে হয় গান গায়। দেখেও তো মনে হচ্ছে ভদ্র ছেলে। আর এখন আশিকের মতো হিংস্র পশুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এর সাহায্য ছাড়া কোন উপায় নেই।”
তারিন আর কিছু না ভেবে রিফাতের
সামনে এসে দাঁড়ালো। এতক্ষন রিফাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে সামনের দিকে তাকালো। আর সামনে তাকিয়ে তারিন কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।
রিফাত একবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো এই অপরিচিত মেয়ে ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। খুব অবাক হলো রিফাত। মনে মনে ভাবতে শুরু করলো– “এত রাতে একা একটা মেয়ে এভাবে এই বাস স্ট্যান্ডে কী করে??
আর আমার সামনেই বা কেন এসে দাঁড়ালো?? রিফাত কোন কথা না বলে অবাক হয়ে তারিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তারিন ভাবছে – “লোকটা পাগল নাকি। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন??”
রিফাত কিছু বলছে না দেখে তারিন রিফাত কে বলল…
— হ্যালো, মিঃ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন??
রিফাত তারিনের কথা শুনে চমকে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল–
– না মানে.. আপনি কে?? আর এত রাতে এখানে কী করছেন??
তারিন রিফাতের কথাতে খুব রেগে গেলো। রিফাতের প্রশ্ন এখন তারিনের কাছে খুব বিরক্ত লাগছে। কিন্তু তেমন কিছু না বলে তারিন রিফাত কে জিজ্ঞেস করলো
– “আমি কে সেটা বলার মতো সময় এখন নেই। আগে আমাকে বলেন রংপুর যাওয়ার বাস কখন আসবে??”
তারিনের কথা শুনে রিফাতের খুব হাসি পেলো। তাই রিফাত হো হো হো করে হেসে দিলো। রিফাতের এরূপ ব্যবহার দেখে তারিনের পুরো শরীর রাগে জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই ঘুসি মেরে দাঁত সব ভেঙে ফেলতে। কিন্তু এত রাতে রিফাতের সাথে ঝগড়া করার কোন ইচ্ছে নেই তারিনের। তাই খুব করুণাময় কণ্ঠে রিফাত কে বলল
— প্লিজ বলুন না রংপুর যাওয়ার বাস কখন আসবে।আমি খুব বিপদে পড়েছি।
বিপদের কথা শুনে রিফাত একটু সিরিয়াস হলো। কিন্তু কী বিপদ সেটা জানার খুব আগ্রহ হলো রিফাতের?
তাই তারিন কে জিজ্ঞাসা করে ফেললো…
— কী বিপদ??
–প্লিজ আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেননা। আমি এইসব আর মনে করতে চাই’না।
রিফাত আর জোর করলো না।
তারিনকে বলল..
— আমি প্রায় ১ ঘন্টা ধরে এখানে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কোন বাস পাচ্ছি না ??
রিফাতের মুখে এই কথা শোনার পর তারিনের মুখ টা মলিন হয়ে গেলো। সে এখন কী করবে?? কীভাবে বাড়ি যাবে? বাড়িতে নিশ্চয়ই বাবা-মা অনেক চিন্তা করছে। মা হয়তো কান্নাকাটি শুরু করে দিছে। কিন্তু আমি বাড়িতে যেতে না পারলে কীভাবে হবে? যে কোন সময় আশিক চলে আসতে পারে। তারিন কান্না শুরু করে দিলো। রিফাত তারিনকে এভাবে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো…
— আপনি কাঁদছেন কেন??
তারিন কোন কথা বলছে না। অনবরত কাঁদেই চলেছে। তার মনে একটাই চিন্তা কীভাবে বাড়িতে যাবে? আশিক যদি একবার চলে আসে তাহলে আর বাঁচার কোন রাস্তা নেই।
রিফাত তারিন কে কয়েকবার বলেছে- “কান্না কেন করছেন ?”
কিন্তু তারিন রিফাতের কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না। অনবরত কেঁদেই চলেছে। রিফাত তারিনকে একটা ধমক দিলো। আর সাথে সাথে তারিন চুপ হয়ে গেলো। তারপর রিফাত প্রশ্ন করলো…
— কে আপনি সত্যি করে বলেন তো?? আর এত রাতে এখানে কী করছেন?
— “প্লিজ এখন এগুলো বলার সময় নেই। আপনি যেভাবেই হোক আমাকে রংপুর পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। ও যদি একবার এসে যায় তাহলে আমাকে মেরে ফেলবে।”
এই কথা গুলো তারিন কান্না করতে করতে বলল। রিফাত তারিনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এই বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না।
তারপর রিফাত বলল.
– ‘আমিও রংপুর যাবো। সেখানে একটা পোগ্রাম আছে। সবাই সকালেই চলে গেছে। আমার একটা কাজ ছিল তাই সবার সাথে যেতে পারিনি। আর কাজ শেষ করতে করতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। রংপুর যাওয়ার শেষ ট্রেন অনেক আগেই ছেড়ে দিছে তাই ভেবেছি বাসে করে যাবো। প্রায় ১ ঘন্টা আগে আমার এক বন্ধু তার বাইক দিয়ে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু এই ১ ঘন্টায় কোন বাস দেখতে পেলাম না।
রিফাতের কথা শুনে তারিনের কান্নার আওয়াজ আরও বেড়ে গেল।
রিফাত কী করবে বুঝতে পারছে না?
আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। যে কাউকে জিজ্ঞেস করবে বাস না থাকার কারণ??
এদিকে আবার রিফাতের খুব খিদে পেয়েছে। সেই সকালে খেয়েছে, আরা খাওয়ার সময় পায়নি।
রিফাত গিটার হাতে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
তারিন রিফাতকে হাঁটতে দেখে জিজ্ঞেস করলো – “কোথায় যাচ্ছেন।?”
– “আমার খুব খিদে পেয়েছে। আর এখানে কোন দোকানপাটও নেই।তাই একটু সামনে এগিয়ে দেখি কোন দোকান পা’ই কি না।”
– “এভাবে একা একটা মেয়েকে ফেলে চলে যাচ্ছেন??”
– আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলেছে, চলুন আমার সাথে।
তারিন আর কোন কথা না বাড়িয়ে রিফাতের সাথে যেতে শুরু করেছে।
দু’জনে পাশাপাশি হাঁটছে। কারোর মুখে কোন শব্দ নেই। চারদিকে দিয়ে জোনাকি পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে। জোনাকি পোকার সবুজ বাতি গুলো একবার জ্বলছে আবার নিভে যাচ্ছে। রিফাত আড়চোখে তারিনের দিকে তাকালো। চাঁদের আবছায়া আলো মেয়েটার মুখে এসে পড়েছে। আর মেয়েটা এদিক ওদিক তাকিয়ে জোনাকি পোকার খেলা দেখছে। হঠাৎ রিফাতের মনে পড়লো মেয়েটার নাম টাই তো এখনও জানা হলো না। তাই রিফাত নাম জিজ্ঞাসা করল..
– আপনার নাম টা তো জানা হলো না??
– তারিন। আপনার?
– রিফাত।আচ্ছা এবার বলুন তো আপনাকে কে মারতে চায়??
তারিন কিছু না বলে চুপ করে রইলো ।
রিফাত তারিনের চুপ করে থাকা দেখে আবার জিজ্ঞাসা করলো..
— কী হলো কিছু বলছেন না যে??
তারিন একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল.
– আমার এখন কিছু বলতে ইচ্ছে না।
তারিন যখন কিছু বলতে চাইছে না তাই রিফাত আর কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। আবার দু’জনে হাঁটতে শুরু করল।
দু’জনেই নীরব হয়ে রইলো। কেউ কোন কথা বলছে না চুপ করে দু’জনেই হাঁটতে লাগলো।
রাত প্রায় ১১ টা বেজে গেছে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেলো রাস্তার পাশে একটা টং দোকান। রিফাতের খুশি দেখে কে?
রিফাত আর তারিন দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। কিন্তু দোকানের সামনে গিয়ে তারিনের হাসি মুখটা মুহূর্তের মধ্যেই মলিন হয়ে গেল।
#পার্থক্য
#রিফাত_হোসেন।
চলবে…………?