পার্থক্য পর্ব-২১

0
812

পার্থক্য

২১ পর্ব।

#রিফাত_হোসেন।

৩৫.
ছাদে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে রিফাত। টপটপ করে চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। উত্তর দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। শরীরে শীতের কোন কাপড় নেই। এত শীত উপেক্ষা করে রিফাত চোখের জল বন্ধুদের কাছে লুকানোর জন্য ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।
আস্তে আস্তে রাত গভীর হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ করে রিফাত কাধে কেউ হাত দেয়। চমকে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে।
আরিয়ান রিফাত কে কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করে বলল – ‘রুমে আয়।’
– ‘তুই যা, আমি কিছুক্ষন পরে আসছি।’
– ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি আছিস।’

আরিয়ান চলে গেল। রিফাত ছাদে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। তারিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।

আমেনা ও আফজাল সাহেব কেউ তারিনের কান্না করার কারণ জানতে পারেনি। তাদের কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না তারিন। আফজাল সাহেব বার বার জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে। কিন্তু তারিনের একটা কথাই “কিছু হয়নি”।
কোন উপায় না পেয়ে তারা ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ঘরে চলে যান । তারিন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো।

৩৬.
রিফাত সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে বিছানায় শুয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুপুর ১২ টা বেজে গেছে। মাথাটা কেমন ভাড়ি হয়ে আছে। রিফাত কাল রাতের কথা মনে করতে লাগলো। কাল অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে বলে এতটা বেলা হয়ে গেছে। আর মাথাটা ও কেমন ভাড়ি ভাড়ি লাগছে। কিন্তু রিফাত তো ছাদে ছিলো, তাহলে এখানে কীভাবে আসলো। চোখ ডলতে ডলতে বাথরুমে গেল। তারপর চোখে মুখে পানি দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে বিছানায় বসলো। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা বের করে আরিয়ান কে একটা ফোন দিলো।
আরিয়ান ফোন রিসিভ করার পর রিফাত বলল – ‘কি রে কোথায় তোরা?’
– ‘সবাই নিচে আছি।’
– ‘উপরে আয়।’

আরিয়ান আসছি বলে ফোন কেঁটে দিল।
রিফাত জানালা দিয়ে দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর আরিয়ান এসে জিজ্ঞেস করলো – ‘কী হয়েছে ডাকছিস কেন?’
– ‘আমি তো ছাদে ছিলাম। তাহলে এখানে কীভাবে আসলাম?’
– ‘আমি আর রাফি নিয়ে এসেছি।’
– ‘ওহ্, আচ্ছা বিয়ে তো শেষ এবার তাহলে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেওয়া দরকার।’

আরিয়ান একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল – ‘কেবল তো প্রথম পর্ব শেষ হলো।’

রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘মানে।’
– ‘এখন এত কিছু বলা যাবে না। তুই বস আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।’

কিছুক্ষন পর আরিয়ান রিফাতের জন্য খাবার নিয়ে আসলো। খাবার রিফাতের হাতে দিয়ে বলল – ‘তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে নিচে আয়। তোর জন্য খুব বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করে আছে।’

রিফাত বেশ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘আমার জন্য আবার কী সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে?’
– ‘সেটা নিচে গেলেই দেখতে পাবি।’
– ‘ঠিক আছে তুই যা আমি আসছি।’

আরিয়ান নিচে চলে গেল। রিফাত খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘর থেকে বের হলো। সিড়ি দিয়ে নামার সময় খেয়াল করলো ড্রয়িংরুমের সোফায় কারা যেন বসে আছে। হয়তো তাদের কোন রিলেটিভ। এটা ভেবে রিফাত সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে নিচে নামতে লাগলো। নিচে নেমে সোফায় বসে থাকা মানুষদের দেখে যতটা খুশি হয়েছে, তার থেকে বেশি ঘাবড়ে গেছে। কারণ ড্রয়িংরুমে সোফায় রিফাতের মা বসে ছিলো। আর তার পাশেই বসে ছিলো তারিন। তার পাশের সোফাতে আরিয়ান, আরিফ আর তারিনের বাবা বসে ছিলো। আর সামনের বসে ছিলো চেয়ারম্যান সাহেব।
সবাইক এমন ভাবে বসে ছিলো যেন এটা একটা বিচার সভা । সবাই চারদিকে গোল হয়ে বসে আছে। সবাইকে এভাবে দেখে রিফাত আসামীর মতো মাথা নিচু করে ফেললো। আড়চোখে একবার মায়ের দিকে তাকালো। আয়শা বেগম রিফাতের দিকে রাগি চোখে তাকাতেই রিফাত চোখ নামিয়ে ফেললো। মায়ের চোখ কে ফাঁকি দিয়ে তারিনের দিকে তাকালো।
তারিন রিফাতের অবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসতে লাগলো। রাগে রিফাতের পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু সবার সামনে তারিন কে কিছু বলতে পারছে। হঠাৎ আয়শা বেগম বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর রিফাতের সামনে গেল। ভয়ে রিফাতের হাত-পা সব কাঁপতে শুরু করলো।
রিফাত মনে মনে ভাবছে ‘মা এখানে কীভাবে আসলো। কই আমাকে তো কিছু বলেনি। তাহলে কী চেয়ারম্যান সাহেব আরিয়ান কে দিয়ে মা কে এখানে ডেকে এনেছে । না জানি চেয়ারম্যান সাহেব মা কে কতটুকু বলে দিছে। আর মা এখন কীরকম রিয়াক্ট করবে সেটাই দেখা বাকি আছে। হয়তো দু’টো গালে চারটা থাপ্পড় মারবে। কিন্তু তার থেকেও কষ্টকর বিষয় হলো এতগুলো মানুষের সামনে মা’র সম্মান টা নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গেছে। অবশ্য ছেলের খারাপ সার্টিফিকেট যে কোন মায়ের কাছে অসহ্যকর এবং অত্যন্ত অপমানিত একটা বিষয়। কিন্তু অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরেও মায়ের কোন রিয়াকশন দেখতে পেলো না রিফাত। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই রিফাতের দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে রেখে হাসছে। আজ সবার হাসি কেমন রহস্যজনক। কী হয়েছে সবার? নীরবতা ভেঙে রিফাত প্রথমে বলল – ‘সবাই এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আর হাসছেনই না কেন?’

কেউ কোন কথা বলছে না। আয়শা বেগম কে জিজ্ঞেস করলো – ‘আর মা তুমি কখন এলে?’
– ‘অনেকক্ষন আগে।’
– ‘কিন্তু আমরা তো একটু পরেই চলে যেতাম।’
– ‘কোথায় যেতি?’
– ‘কেন? বাড়িতে যেতাম।’

আয়শা বেগম হাসতে হাসতে বললেন – ‘আগে বিয়ে হোক, তারপর বৌ নিয়ে বাড়িতে যাবি।’

আয়শা বেগম এর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না রিফাত। কার বৌ? আর কোথায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে? নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রিফাতের মাথায়। পাশ থেকে আরিয়ান রিফাতের কাধে হাত রেখে বলল – ‘খুব অবাক হচ্ছিস তাই না।’
– ‘এক্কেবারে আকাশ থেকে পড়ার মতো।’
– ‘হা হা হা। আগে বিয়েটা হোক তারপর সব বুঝতে পারবি।’

রিফাত আরিয়ান কে একটু রাগ দেখিয়ে বলল – ‘সবাই এভাবে রহস্য নিয়ে কথা বললে কিছু বুঝার আগেই আমি পাগল হয়ে যাবো। সবার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। কার বিয়ে? কার বৌ? আর হঠাৎ করে মা এখানে কীভাবে আসলো। প্লিজ আমাকে একটু ক্লিয়ার করে বল।’

চেয়ারম্যান সাহেব বলল – ‘বাকিটা আমার কাছেই শোন।’

চেয়ারম্যান সাহেব বলতে শুরু করলেন ‘আসলে কাল তোমাদের ওভাবে দেখে খুব রাগ হয়েছিলো আমার। ভেবেছিলাম তোমাদের কঠিন একটা শাস্তি দিবো। কিন্তু তোমাদের সাথে কথা বলার পর বুঝলাম তোমরা সত্যিই একে অপরকে ভালোবাসো। তারপর ভেবেছিলাম তোমাদের বাবা-মা কে বলে একটা ব্যবস্থা করবো। কিন্তু তোমাদের বাবা-মা’র সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে বলে দু’জনেই ঠিক করলে তোমরা আলাদা হয়ে যাবে। তাই তোমরা যাওয়ার পর অনেক ভেবে ঠিক করলাম আমি নিজে সামনে থেকে তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো। তারপর আমি তারিনের বাবা কে ফোন দিয়ে সব জানালাম। তিনি কোন আপত্তি করেননি। আর আরিয়ানের কাছে থেকে তোমার মায়ের নম্বর নিয়ে তাকে সব কিছু বললাম। তিনি বলল তোমার উপর তাদের সম্পুর্ন বিশ্বাস আছে। তারা মনে করে তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে অবশ্যই ভেবে চিন্তে নিবে। তাই তোমার কথা ভেবে তিনি ও রাজি হয়ে গেলেন।’

এতক্ষন রিফাত চুপ করে কথাগুলো শুনছিলেন। নিজের কানকে ও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না রিফাত। কাল রাতে ও মনে হয়েছিলো সব কিছু শেষে। এই সম্পর্ক কেউ মেনে নিবে না। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে যে এতবড় একটা সারপ্রাইজ পাবে তা রিফাতের কল্পনার বাহিরে ছিলো।

পাশ থেকে আরিয়ান বলল – ‘আরো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তোর জন্য ।’

রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘কী সারপ্রাইজ?’
– ‘একটু অপেক্ষা কর, সময় মতো সারপ্রাইজ পেয়ে যাবি।’

রিফাত তারিনের দিকে তাকিয়ে দেখে তারিন মাথা নিচু করে বসে আছে। হয়তো সবার সামনে লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু রিফাত লজ্জা না পেয়ে তারিনের বাবা কে বলল – ‘আঙ্কেল আমি একটু তারিনকে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাই।’

রিফাতের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। তারিন চোখ বড় বড় করে রিফাতের দিকে তাকিয়ে রইলো।
হাসি থামিয়ে আয়শা বেগম বলল – ‘এই দুপুরে রোদের মধ্যে কোথাও যেতে হবে না। বিকেলে ঘুরতে যেও।’

মায়ের কথার উপর রিফাত কথা বলে না। তাই হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষন পর তারিন আর আফজাল সাহেব চলে গেল। দুপুরের খাবার খেয়ে কিছুক্ষন রেস্ট নিলো রিফাত।

বিকেলের দিকে তারিন কে ফোন দিল রিফাত। তারিন ফোন ধরতে দেরি করেনি কারণ আজ আর কোন বাধা নেই।
রিফাত তারিন কে বলল তাড়াতাড়ি করে নদীর পাড়ে আসতে। ফোন কেটে দিয়ে রিফাত নদীর পাড়ে গিয়ে তারিনের আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষন পর সামনে তাকিয়ে দেখলো তারিন আসছে। তারিন কে দেখে রিফাত একটু মৃদু হাসি দিল। তারিন রিফাতের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর রিফাতের হাত ধরে নদীর পাড়ে ঘাসের উপর বসিয়ে দিলে বলল – ‘আপনি তখন সবার সামনে বললেন কেন? আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন।’
– ‘হি হি হি। এই কয়দিন তোমার সাথে ভালো করে কথা বলতে পারিনি তাই তখন বলে ফেলেছি।’
– ‘তাই বলে সবার সামনে।’
– ‘আচ্ছা বাদ দেও তো ওই কথা।’
– ‘যেই দেখেছেন সবাই মেনে নিয়েছে। ওমনি আপনার লুচ্চামি শুরু হয়ে গেল তাই না।(রাগ দেখিয়ে বলল)

রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘আমি আবার কখন লুচ্চামি করলাম?’
– ‘এই যে আপনি থেকে তুমি তে চলে গেছেন।’
– ‘হুহ্, কিছুদিন পর তো আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। তখন তো আর আপনি বলা যাবে না।’

তারিন আস্তে আস্তে বলল – ‘কিছুদিন পর না আজকেই হবে।’
– ‘কী বললে ঠিক বুঝতে পারলাম না।’
– ‘কই কিছু বলিনি তো।’
– ‘ওহ্,

দু’জনে আরো কিছুক্ষন একসাথে থেকে বাড়িতে চলে গেল। রিফাত অবশ্য আরো কিছুক্ষন থাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু তারিন বাড়িতে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলো। তাই রিফাত বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে এলো।

ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই রিফাত থেমে গেল। চোখ বড় বড় করে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন রিফাতের বিশ্বাস হচ্ছে না সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে। হা করে তাকিয়ে আছে।

চলবে……….?

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

শব্দ সংখ্যা – ১৩০০+

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here